অনুভবে অনুরণন – শাওন মাহমুদ

কেউ কেউ বলে, পাগলের নাকি তিন হাসি, প্রথমে কিছু না বুঝে হাসে, পরে বুঝে হাসে, তারপর বেশি বুঝে হাসে। বাবা, তোমাকে কিছু লিখতে গিয়েও আমার সে রকম হাসিই পাচ্ছে। প্রথমে হাসি পাচ্ছে কিছু লিখবো বলে, তারপর তোমাকে লিখবো ভেবে, আর সবশেষে আমাদের অবস্থার কথা তোমাকে জানাবো বলে।

আমরা আসলে বেশ আছি, তোমার স্বপ্নে ধোয়া স্বাধীন বাংলাদেশে আমারা খুব ভালো আছি। গোলাপগাছের ডালে কাঁটা থাকে কিন্তু ডালের মাথায় যে সুন্দর গোলাপ ফোটে তার ভেতরের যন্ত্রনা তো কেউ অনুভব করতে পারে না। আমরাও তেমনি পায়ের নিচে কাঁটা রেখে দিব্যি স্বস্তিতে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছি। পায়ে রক্ত ঝড়ে ঝড়ুক, তবু ফুটন্ত গোলাপের মতো আমরা সুন্দর আছি। সুখে আছি, আনন্দিত প্রহরে উদ্বেল আছি।

বাবা, তুমি নেই, কিন্তু তোমার গান বেঁচে আছে, চিরদিন বেঁচে থাকবে, তোমার গান ভাষাশহীদদের কথা শোনাবে, তোমার গান দেশকে ভালোবাসার কথা বলবে, তোমার গান কিংবদন্তির সাক্ষী হয়ে থাকবে। অথচ দেখো, কত সহজে আমরা তোমাকে বিস্মৃত হয়ে যাই, আমাদের ঐতিহ্যের সীমানা থেকে তোমাকে আড়াল করে দিতে চাই। এ যেন জ্যোৎস্না পেয়ে চাঁদকে ভুলে যাওয়ার সামিল ।

বাবা, কী হবে তোমার গান গেয়ে? তোমার গান তুমি ফিরিয়ে নাও। মুক্তিযোদ্ধা ভাইদের বলো ওঁদের রক্ত আর শ্রম ফিরিয়ে নিতে। স্বাধীনতার শহীদের পরিবার আজ সহায়হীন লাঞ্চিত। তোমার গান মানুষের হাহাকারের সাথে মিশে একাকার হয়ে গেছে।

বাবা, তোমার মতো অন্যান্য শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের জানিয়ে দাও, আমরা আজও স্বাধীনতার পুরোপুরি মূল্য দিতে শিখিনি। সবার নিরাপদে শান্তিতে থাকার জন্য তোমারা একটা দেশ এনে দিলে, অথচ সে দেশেই তোমাদের পরিবারের মাথা গোজাঁর একটা ঠাঁই হয় না। তোমার যে গান সবার মনে চেতনার লাল আলো ছড়িয়ে দেয়, অথচ দেখো তোমার মেয়েকেই সুযোগের অভাবে সে গান লেখার অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে হয়। আমরা হারিয়ে যাচ্ছি, আর সবাই ক্রমশঃ নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলছে।

এতো কষ্টে, এতো রক্তে পাওয়া মাতৃভাষা বিলীন হয়ে যাচ্ছে অন্য ভাষার চাপে। এই অপবিত্র পরিবেশে তোমার নির্মল সুর একেবারে বেমানান।

বাবা, তোমার ঐ হৃদয়ের বাঁধন ছেঁড়া গান বাংলার মাটিতে থাকলেও আজও নিজের অধিকারের দাবীতে আমার ভাইদের শহীদ হতে হয়। তারপরও কি বলো এই গানকে আমাদের মাঝে ধরে রাখতে?

বিরাট কোনো চাওয়া-পাওয়ার হিসেব নিয়ে তো আমি আসিনি। আকাশচুম্বী কোনো স্বপ্নসৌধ তো আমি বুকে গড়ে তুলিনি। অন্য দশজনের মতো মানুষ হয়ে বেঁচে থাকার সামান্য নিশ্চয়তাটুকু চেয়েছি। এ চাওয়াতে নিশ্চয়ই কোনো অন্যায় নেই, পাপ নেই, তবু কোন পাপে তোমার পরিবারকে দেয়া বাসা থেকে বিতাড়িত হতে হয়? একটা চাকরির জন্য মাকে ক্লান্ত মুখে যুদ্ধ করতে হয়? আমার মা’র আঁচলে মোছা ঘামের মূলে তো ঐ স্বাধীনতা, তোমাকে ‘বাবা’ বলে ডাকার অধিকার হারানোর মূলেও তো ঐ স্বাধীনতা, তবে ঐ স্বাধীনতা আমাদের আর কতো বঞ্চনা দেবে? আর কত গ্লানির নির্যাস উগলে দেবে? আমরা কি চিরদিনই স্বাধীনতা আর অপরের সুখের উপাদান হবো। সবাই স্বাধীনতার ফল নিংড়ে খাবে, আর আমরা শুধু শুধু বুকে ব্যথার পসরা সাজিয়ে বসে থাকবো?

প্রতিবার একুশ আসে, ডিসেম্বর আসে, আর আমাদের নিয়ে লেখার ফুলঝুড়ি ফোটে। আর আমার তখন পাগলের তিন হাসির কথা মনে পড়ে যায় বাবা। প্রথমে মনে মনে একচোট হেসে নেই, মন তখন ছোট্ট ডোবা হয়। তারপর কী বলবো তাই ভেবে হাসি, মন তখন একটা দীঘল নদী হয়। আর সব কথা মনে হলে প্রাণ খুলে হাসি। মন তখন একটা বিরাট সমুদ্দুর হয়ে সে হাসিতে মিলে একাকার হয়ে যায়।

প্রতিবার একই কথা, একই প্রসঙ্গ। এ যেন একটি নাটকের বার বার মঞ্চায়ন। জানি না এ লেখালেখির কী অর্থ, কতটুকু সার্থকতা। আমাদের দুঃখের কথা জেনে কেউ হয়তো অস্ফুটে বলে, আহ! উফ! এটুকুই তো, তারচেয়ে আর বেশি কি?

সেদিন পত্রিকা থেকে এলেন আমার মা’র ছবি নিতে, মামনিতো ছবি তুলতেই চান না। তবু ভাইয়ার পিড়াপিড়িতে তুলতে হলো, এখন বসে বসে ভাবছি এভাবে আর কদ্দিন আমরা মিথ্যে নাটকের মহড়া দিয়ে যাব? তুমি সবার ভালোবাসা হয়ে বেঁচে থাকো, তুমি সবার মনে সংগ্রামী চেতনার উৎস হয়ে জেগে থাকো এইতো চাই। তবেই তোমার মাঝে আমাদের অস্তিত্বের দিক নিশানা খুঁজে পাওয়া যাবে। আমারতো কোনো ছোটভাই নেই, তবে তোমাকে বলছি, তাকে আমার সমস্ত ক্ষোভের আগুনে পুড়ে মানুষ করতাম। আমার তো কোনো বড় ভাই নেই, তবে তাঁর ভেতরে আমার সমস্ত জিজ্ঞাসা সঞ্চারিত করে দিতাম।

বাবা, তোমার স্বপ্নের দেশে মানুষ এখনো না খেয়ে মৃত্যুর ডাক আনে। তোমার রক্ত ভেজা দেশে বাতাস এখনও বারুদ আর লাশের গন্ধ বয়ে বেড়ায়। তোমার কল্পনার দেশে আমাদের স্বপ্ন এখনো কচুরিপানার মতো ভেসে যায়। জানি না হয়তো এটাই স্বাভাবিক, এটাই বাস্তব।

বাবা, দিন দিন তোমাকেও আমারা ভুলে যেতে বসেছি, কিংবা ইচ্ছে করেই ভুলে যেতে চাচ্ছি। কারণ, তুমি থাকলেই আমাদের নতুন করে বাঁচার কথা বলো, তুমি থাকলেই আমাদের নতুন করে সংগ্রামে মুখর হওয়ার কথা বলো। তাই যতদিন তোমার স্বপ্ন প্রদর্শিত পথ একটা চূড়ান্ত লক্ষ্যের কেন্দ্রবিন্দুতে এসে মিলতে না পারবে, ততদিন তোমার গান গাওয়ার যোগ্য আমরা নই। তোমার গান আমরা সেই দিন গাইব, যেদিন এদেশে কোনো অন্যায় শাসন থাকবে না, যেদিন আমরা আমাদের মানসিকতায় কোনো বিজাতীয় চিন্তা-ভাবনাকে লালন করবো না, যেদিন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে সমস্ত অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমরা রুখে দাঁড়াতে পারবো।

রক্ত কমল

একুশের সংকলন ১৯৮৬