একাত্তরের কথা যখন লিখতে বসি, তখন অবাক হয়ে ভাবি যে সাধারণ মানুষগুলো শুধু দেশকে স্বাধীন করতে হবে জেনেই যুদ্ধ করার জন্য এগিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁরা শত্রুর মোকাবিলায় নিজেদের বুদ্ধিতে প্ল্যান ‘এ’ ছাড়া আর কোনো প্ল্যান ‘বি’ বা ‘সি’ নিয়ে ভাবেননি। ধরা পড়ে গেলে তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সহযোদ্ধা বা পরিবারকে বাঁচিয়ে রেখে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার জন্য। এটাকে কখনো প্ল্যান ‘বি’ বা ‘সি’ বলা যায় না।
কী ভীষণ দেশপ্রেম তাঁদের, কত গভীর সেই ভালোবাসা!
একাত্তরের ২৯, ৩০ আগস্ট ঢাকা থেকে ধরা পড়েন ক্র্যাক প্লাটুনের বেশ কিছু গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সবচেয়ে বড় অপারেশনটা হওয়ার পর প্রচুর অস্ত্র এবং গোলাবারুদ বাড়তি হয়ে গিয়েছিল। বাবা অনেক আগে থেকেই এই গেরিলা যোদ্ধাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গিয়েছিলেন। ৩৭০ আউটার সার্কুলার রোডের বাসাটা হয়ে গিয়েছিল দুর্গবাড়ি। মুক্তিযোদ্ধাদের আনাগোনা, তাঁদের অপারেশন আর গোপন চিরকুট আদান-প্রদান হতো সেখান থেকে। বাবা সংগীত পরিচালক আইডি কার্ডে, নিজ গাড়িতেই বিভিন্ন যোগাযোগ রক্ষা করতেন। সেই বাড়তি অস্ত্রগুলো ভর্তি দুটো ট্রাংক তাঁর দুর্গবাড়িতে এনে উঠোনের পেছনে কাঁঠালগাছের নিচে মাটিতে গর্ত করে পুঁতে রেখেছিলেন নিজেই।
আগস্টের শেষ সপ্তাহে যখন গেরিলা ধরপাকড় শুরু হয়, তখন সেই দলেরই এক যোদ্ধা ধরা পড়ে গিয়েছিলেন এবং পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে, ক্র্যাক প্লাটুন সদস্যদের নাম বলে দিয়েছিলেন। শুধু তা-ই নয়, তাঁকে জিম্মি করে আজাদ, জুয়েল, রুমীর বাসা চিনিয়ে দিতে বাধ্য করা হয়। ৩০ তারিখ ভোরে আউটার সার্কুলারের দুর্গবাড়িতে হানা দেয় পাকিস্তানি সেনারা। বাবাকে দিয়েই মাটি খুঁড়িয়ে, ট্রাংক দুটো তাঁকে দিয়ে বের করে আনে ওরা। বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায় বাবাকে। সঙ্গে আমার চার মামা আর মেলাঘরে যাওয়ার জন্য অপেক্ষমাণ মুক্তিযোদ্ধা আলভীকেও।
নাখালপাড়া এমপি হোস্টেল ছিল ইন্টারোগেশন অ্যান্ড টর্চার সেল। রাতে রমনা থানায় রাখা হতো গেরিলা যোদ্ধাদের। এমপি হোস্টেলের বিশাল উঠোনের চারদিক আলাদা আলাদা ঘরে ভর্তি। একজন-দুজন করে সেসব ঘরে বন্দীদের রাখা হতো। শহীদ রুমীর ছোট ভাই জামীর মুখে শুনেছি, ৩০ আগস্ট সারা দিন জিজ্ঞাসাবাদের পর পাকিস্তানি আর্মিরা ঠিক করেছিল, কারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় আছে। অত্যাচারের ধরনগুলোও সেই হিসেবে নির্ধারণ হতো। নির্মম উপায়ে জিজ্ঞাসাবাদ চলত তাদের ওপর।
বড় ঘরগুলো থেকে বাছাই করে ছোট একটা বাথরুমে জড়ো করা হচ্ছিল সেই গুরুত্বপূর্ণদের।
গভীর রাতে রমনা থানায় নেওয়ার সময় জামীর সঙ্গে রুমীর দেখা হয়েছিল। একদম কাছে এসে বলেছিলেন, বাবা, আর তুমি কিছু জানো না, তোমরা কাউকে চেনো না বলবে। একবার নয়, বারবার বলেছিলেন এ বাক্যটি। ৩১ তারিখ সকালে জামী এবং তাঁদের বাবাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। রুমী রয়ে যান, অনন্তকালে হারিয়ে যাওয়ার অপেক্ষায়।
নাখালপাড়া ৩০ তারিখ, এমপি হোস্টেল-টর্চার সেল থেকে ইন্টারোগেশন চেম্বার। ক্ষতবিক্ষত আলতাফ পানি চেয়েছিলেন, তাঁর মুখে প্রস্রাব করেছিল পাকিস্তানি সেনারা। অত্যাচারের পালা শেষ হলে ছোট বাথরুমটায় গাদাগাদি করে ঢুকিয়ে দিত অনেকের সঙ্গে। একটা পানির কল ছিল, শক্তি ছিল না সেটা ছেড়ে পানি খাওয়ার মতো। সঙ্গের সাথিরা একজন অন্যজনের জন্য সাধ্যমতো করতেন। আঁজলা ভরে পানি খাইয়েছিলেন তাঁদেরই কেউ একজন। রাত ১০টার পর সবাইকে ট্রাকে করে রমনা থানায় পাঠানো হয়। সেখানে সাধারণ কয়েদিরা তাঁদের ভাগের শুকনো রুটি আর ডাল খেতে দিয়েছিলেন সে রাতে। সেদিন আর আলতাফের খাওয়া হয়নি, ব্যথায় কোঁকাতে কোঁকাতে জ্বরের ঘোরে ঘুমিয়ে গিয়েছিলেন।
পরের দিন ৩১ আগস্ট, নাখালপাড়া। আবার রমনা থানা থেকে সকাল ১০টায় এমপি হোস্টেল-টর্চার সেলের ইন্টারোগেশন চেম্বার। মুখ খোলানোর জন্য আলতাফকে কয়েক ঘণ্টা পরপর টর্চার সেলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। একসময় অধৈর্য হয়ে পাকিস্তানি সেনারা তাঁর পা ফ্যানের রডে বেঁধে উল্টো করে ঝুলিয়ে বেধড়ক পেটায়। তখনই হাঁটু, কনুই আর পাঁজর ভাঙে আলতাফের। একটা নাম, শুধু একটা নাম চেয়েছিল ওরা। একেবারেই বেঁকে বসা দীর্ঘদেহী সুঠাম শরীরের আলতাফ মুখ খোলেননি, শেষ পর্যন্তও না।
এভাবেই রাত হয়েছিল, ১০টায় আবার রমনা থানায় পাঠানোর আগমুহূর্তে পাকিস্তানি সেনারা ঠিক করে ফেলেছিল তাঁদের মাঝে কাকে ছাড়বে আর কাকে নয়।
রমনায় বেশ রাতে এক আরদালি ভাত আর পেঁপে ভাজি খেতে দিয়েছিল কী মনে করে কে জানে। সবাই মিলে ভাগ করে খাওয়ার আগে রক্তাক্ত আলতাফ খোঁড়াতে খোঁড়াতে দেয়াল ধরে হেঁটে হেঁটে গরাদের কাছে গিয়ে ওই আরদালিকে বলেছিলেন, একটা কাঁচা মরিচ হবে? আরদালি এনে দিয়েছিল একটা মরিচ। দীর্ঘদেহী আলতাফ, অত্যাচারে নুয়ে পড়ে টিনের থালায় ভাত আর পেঁপে ভাজিতে কাঁচা মরিচ মাখিয়ে লোকমা তুলে তৃপ্তি করে খেয়েছিলেন। কপালের চামড়া বেয়নেটের আঘাতে ঝুলে আছে, প্রচণ্ড জ্বরের ঘোরে খোলা মুখের সামনের পাটির দাঁতগুলো ভাঙা। শেষবারের মতো সবাইকে নিয়ে ভাত খেতে খেতে মামাদের ফিসফিস করে বলেছিলেন, ‘তোমরা কিছু জানো না বলবে। তোমরা কাউকে চেনো না। আর আলভী গ্রাম থেকে বেড়াতে এসেছে বলবে। ও কিছু জানে না। তোমরাও না।’
ভোরের আগে হাতের আংটিটা খুলে খনু মামার হাতে দিয়ে বলেছিলেন, ‘ঝিনুকে দিও। ওকে বলবে যে শাওন আর ঝিনুকে দেশ দেখবে।’ পরের দিন তাদের আবারও নাখালপাড়ায় নেওয়া হয়। বেলা এগারো কি দুপুর বারোটায় চার মামা আর আলভীকে ছেড়ে দেয় ওরা। বাবাকে একঝলক শেষবারের জন্য দেখেছিলেন মামারা, লম্বা বারান্দায় মাথা নিচু করে বসে আছেন। হাঁটু ভেঙে যাওয়ায় আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলেন না। রক্তাক্ত, চোখের ওপর কপালের চামড়া নেমে ঝুলছে, প্রচণ্ড জ্বরে বোবা চাহনিতে আকাশের দিকে তাঁকিয়ে আছেন।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে রুমী বা বাবার মতো অন্যান্য যোদ্ধার কোনো প্ল্যান ‘বি’ বা ‘সি’ ছিল না। তাঁরা প্ল্যান ‘এ’ নিয়েই যুদ্ধ করেছেন। নির্মম অত্যাচারেও শত্রুর কাছে মাথা নত করেননি। পালিয়ে থাকা সহযোদ্ধার নাম বলেননি। ধরা পড়ার পর পরিবারকে বাঁচিয়ে যেতে দ্বিধা করেননি। সবার আগে দেশ–এই প্ল্যান ‘এ’ নিয়েই দেশকে ভালোবেসে, আমাদের ভালো থাকার জন্য নিজেরা হারিয়ে গিয়েছেন।
লেখক: শহীদ সুরকার আলতাফ মাহমুদের কন্যা