একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এক গণযুদ্ধের বহিঃপ্রকাশ। সাধারণ পুরুষ-নারী, কিশোর-তরুণ, বৃদ্ধরা একযোগে সেই যুদ্ধ ময়দানে লড়াই করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে নারী মুক্তিযোদ্ধাদের কথা খুব কম বলা হয়। আর শহীদ নারীদের নামের তালিকা হয়তো আর করা হবে না। নারী শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বুদ্ধিজীবী সম্পর্কে খোঁজ নিতে গেলে তেমন কোনো তথ্যই পাওয়া যায় না। বেশিরভাগ নারীর শহীদ মুক্তিযোদ্ধা বা বুদ্ধিজীবীর মা, বোন, মেয়ে বা স্ত্রী হিসেবে নাম আসে। এমনকি বেঁচে থাকা স্বজনরাও বাবার সঙ্গে নিহত হওয়া মা, ভাবি বা বোনের ক্ষেত্রে বাবাকে নিয়েই সব সময় কথা বলতে দেখা যায়। আত্মত্যাগী অনেক নারীরা আড়ালেই থেকে যায়।
একাত্তরের কালরাত ২৫ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় শহীদ হন মধুসূদন দে ও তার পরিবারের সদস্যরা। মধুসূদন দের সঙ্গে নিহত যোগমায়া দে ও রিনা রানী দের কথা কেউ বলেন না। বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘স্মৃতি ১৯৭১’-এর বিভিন্ন খ-ে মাত্র চার নারী শহীদ বুদ্ধিজীবীর তথ্য পাওয়া যায়। তারা হলেন শহীদ সাংবাদিক সেলিনা হোসেন, শহীদ কবি মেহেরুন্নেসা, মাগুরার শহীদ লুৎফুন নাহার হেলেন ও শহীদ ড. আয়েশা বদোরা চৌধুরী। অথচ বাংলাদেশজুড়ে এমন অনেক নারী লেখক, কবি, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব একাত্তরে নিজের জীবন দিয়েছেন। তাদের নাম কোথাও লেখা হয়নি। ছাপার অক্ষরে রাখা হয়নি। প্রজন্ম কখনো জানবে না তাদের কথা।
পিরোজপুরের সাহসী নারী ভাগীরথী ভিক্ষুক সেজে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিভিন্ন খোঁজখবর নিতেন। এর পর তা জানাতেন মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে। পরে তার কথা জানতে পেরে রাজাকারদের সহায়তায় পাকিস্তানি সৈন্যরা ভাগীরথীকে ধরে নিয়ে যায়। তাকে জিপের পেছনে দড়ি দিয়ে বেঁধে টানতে টানতে হত্যা করা হয়েছিল। ভাগীরথীর স্থান মেলেনি শহীদের তালিকায়। দিনাজপুরের পার্বতীপুরে আঞ্জুমান আরা ও তার স্বামী তাদের বাড়িতে বাঙালিদের আশ্রয় দিতেন। আশপাশের বিহারিরা তা জানতে পারলে তাদের দুজনকে ধরে মালবাহী ট্রেনের গরম কয়লার চুল্লিতে নিক্ষেপ করে হত্যা করে। মুক্তিবাহিনীর গুপ্তচর অভিযোগে সিলেটের বিয়ানীবাজারের খাসিয়া মেয়ে কাঁকেটকে অত্যন্ত নির্মমভাবে প্রাণ দিতে হয়েছিল পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে। ১৯৭১ সালের মার্চে অসহযোগের প্রথম শহীদ যশোরের চারুবালার নাম কোথাও নেই। অথচ চারুবালার মৃত্যু ওই সময় যশোরের নারীদের মিছিলে নিয়ে আসে এবং অসহযোগ আন্দোলনকে নতুন রূপ দেয়। যশোরের নারীরা ঝাড়ু হাতে রাস্তায় নেমে এসেছিলের তখন।
শহীদ কবি মেহেরুন্নেসা। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতির জন্য তিনি ভাষা আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। তার কবিতার মধ্য দিয়ে এর সপক্ষে মতামত ব্যক্ত করতেন। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সঙ্গে তিনি জড়িত হয়ে পড়েন এবং মিরপুরের অ্যাকশন কমিটির সদস্য হন। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ কবির হৃদয়ে তোলপাড় তুলেছিল। তাই জয় বাংলা স্লোগান দিতে দিতে ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ নিজ বাড়িতে তিনি ও তার দুই ভাইয়ের সহযোগিতায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। ২৭ মার্চ ঢাকার মিরপুরে তার বাড়িতে বিহারিদের সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর স্থানীয় সহযোগীরা আক্রমণ করে। কবি মেহেরুন্নেসা, তার দুই ভাই ও মাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। কবি মেহেরুন্নেসার খ-িত মাথাটি দিয়ে ওরা ফুটবল খেলেছিল। খেলা শেষে দীর্ঘ কালো কেশগুলো দিয়ে কাপড় শুকানো তারে তার মাথাটি ঝুলিয়ে রেখে গিয়েছিল তারা। অথচ সাপ্তাহিক বেগম পত্রিকায় মৃত্যুর ঠিক ৪ দিন আগে ২৩ মার্চ প্রকাশিত হয়েছিল তার লেখা কবিতা ‘জনতা জেগেছে’।
এপ্রিলে দিনাজপুরে নিজের বাড়িতেই শহীদ হয়েছিলেন সুরবালা দেবী। একই মাসে সৈয়দপুরে শহীদ হন সাংস্কৃতিক কর্মী ভ্রমর, সুফিয়া খাতুন, হোসনে আখতার ও সরোজিনী মল্লিক। সিলেটের পাত্রখোলা চা বাগানে শহীদ হয়েছিলেন বাবনী রাজগৌড়, লসিমুন কুর্মী, রাঙামা কুর্মী, সালগী খাড়িয়াসহ অনেকে। পটুয়াখালীতে হানাদারদের তা-বে শহীদ হন কনকপ্রভা গাঙ্গুলী, সোনাই রানী সমাদ্দার, বিদ্যাসুন্দরী দাস, সাবিত্রী রানী দত্ত, শান্তি দেবীসহ অনেক নারী। ফরিদপুরের ভাঙ্গায় মধ্য জুলাইয়ে শহীদ হন কিরণ রানী সাহা।
জোবাইদা নাসরীন লিখিত ‘নারী ও মুক্তিযুদ্ধ’ বইটিতে এমন শহীদ নারীদের মাত্র ৩০ জনকে খুঁজে পাওয়া যায়। অথচ সেই ৯ মাসে দুই লাখ থেকে তিন লাখ নারীর সম্ভ্রমহানি হয়েছিল। তাদের বেশিরভাগকে হত্যা করা হয়েছিল সময়ের সঙ্গে সঙ্গে।
শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন সাপ্তাহিক বেগম, সাপ্তাহিক ললনা ও শিলালিপি পত্রিকায় সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৫ সাল থেকেই তিনি লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৫৮ সালে তিনি ঢাকা আসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের হল পরিচালক হিসেবে চাকরি নেন। পরে ললনায় কাজ করার সময় ১৯৬৯ সালে বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ীদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে বের করেন ‘শিলালিপি’ নামে একটি পত্রিকা। তিনিই এটি সম্পাদনা ও প্রকাশনার দায়িত্ব পালন করতেন। শিলালিপি ছিল সেলিনার নিজের সন্তানের মতো। দেশের প্রায় সব বুদ্ধিজীবীর লেখা নিয়ে প্রকাশিত শিলালিপি সবারই নজর কেড়েছিল। স্বাধীনতার পক্ষের পত্রিকা শিলালিপি। এই সুবাদে ঢাকার বুদ্ধিজীবী মহলে অনেকের সঙ্গেই ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন তিনি। ১৯৬৯ সালের রাজনৈতিক আন্দোলনে উত্তাল বাংলাদেশ। নিজেও শরিক হন গণঅভ্যুত্থানের আন্দোলনে। ছেলেকে সঙ্গে নিয়েই বেরিয়ে পড়তেন ১৯৬৯ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পল্টনের জনসভায় বা শহীদ মিনার থেকে বের হওয়া নারীদের মিছিলে যোগ দিতে। শরিক হতেন বুদ্ধিজীবীদের প্রতিবাদ সভাতেও। অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, শহীদুল্লা কায়সার প্রমুখের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে সমাজতন্ত্রের প্রতিও আগ্রহী হয়ে ওঠেন তিনি। এরই মধ্যে শুরু হয় ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ।
মুক্তিযুদ্ধের সময় সেলিনা পারভীন ঢাকায় ছিলেন। তার বাসায় মাঝে মধ্যে রাত হলে কয়েক তরুণ আসতেন। এই তরুণদের সবাই ছিলেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা। খাওয়া-দাওয়া করে চলে যাওয়ার আগে তারা সেলিনা পারভীনের কাছ থেকে সংগৃহীত ওষুধ, কাপড় আর অর্থ নিয়ে যেতেন। শিলালিপির বিক্রয়লব্ধ অর্থ দিয়েই তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করতেন। চারদিকে তখন চলছে আক্রমণ, পাল্টা আক্রমণ, প্রতিরোধ। চারপাশে শুধু বুলেটের শব্দ আর বারুদের গন্ধ, চিৎকার, গোঙানি, রক্তস্রোত আর মৃত্যু। এর মধ্যেই ললনা প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। শিলালিপির ওপরও নেমে আসে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর খড়্গ। হাশেম খানের প্রচ্ছদ করা একটি শিলালিপির প্রকাশিতব্য সংখ্যা নিষিদ্ধ করে দেয় পাকিস্তান সরকার। পরে প্রকাশের অনুমতি মিললেও নতুনভাবে সাজানোর শর্ত দেওয়া হয়। সেলিনা পারভীন বরাবরের মতো প্রচ্ছদ না নিয়ে তার ভাইয়ের ছেলের ছবি দিয়ে প্রচ্ছদ করে আগস্ট-সেপ্টেম্বরের দিকে শিলালিপির সর্বশেষ সংখ্যা বের করেন। কিন্তু এর আগের সংখ্যার জন্যই তিনি পাকিস্তানি ও তাদের দালালদের নজরে পড়ে যান- যেটিতে ছিল দেশবরেণ্য বুদ্ধীজীবীদের লেখা এবং স্বাধীনতার পক্ষের লেখা। এটিই কাল হলো। শিলালিপির আরেকটি সংখ্যা বের করার আগে নিজেই হারিয়ে গেলেন। ১৩ ডিসেম্বর ১১৫ নম্বর নিউ সার্কুলার রোডে তার বাড়িতে থাকত তিনজন- তার মা, পুত্র সুমন আর ভাই উজির। শহরে তখন কারফিউ। রাস্তায় মিলিটারি। পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসমর্পণের জন্য বিমান থেকে চিঠি ফেলা হচ্ছে। হঠাৎ একটা গাড়ি এসে থামল বাসার সামনে। সেলিনার বাড়ি এসে কড়া নাড়ে তারা। তিনি দরজা খুলে দেন। লোকরা তার পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয় এবং তারা সেলিনা পারভীনকে তাদের সঙ্গে ধরে নিয়ে যায়। ১৮ ডিসেম্বর সেলিনা পারভীনের গুলি ও বেয়োনেটে ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ পাওয়া যায় রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে। খুব শীতকাতুরে সেলিনার পায়ে তখনো পরা ছিল সাদা মোজা। এটি দেখেই তাকে শনাক্ত করা হয়।
স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আনন্দ উদযাপনে যে ব্যয় করা হয়, এর ১ শতাংশ ব্যয়ে এসব সাহসী নারীকে নিয়ে গবেষণা করার দল তৈরি করা যেত। মুক্তিযোদ্ধারাও মানুষ। রণাঙ্গন থেকে বেঁচে আসা যোদ্ধা বা বেঁচে থাকা শহীদ স্বজনরা গত ৫০ বছরে বেশিরভাগই পৃথিবী ছেড়েছেন। শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য-উপাত্ত, নাম-ঠিকানা আর্কাইভ করার সময় পার হয়ে যাচ্ছে প্রতিমুহূর্তে। আগামীর জন্য আমরা আমাদের স্বাধীন দেশের জন্য আত্মত্যাগ, আত্মোৎসর্গের বীরত্ব গেঁথে যেতে পারলাম না।
শাওন মাহমুদ : নগরচাষী ও কলাম লেখক