আমাকে দাদা বলে ডাকত – শেখ লুতফর রহমান

আলতাফ মাহমুদ বাংলাদেশে এক অনন্য নাম। তার সঙ্গে অনেক সময় ঘনিষ্ঠভাবে মেশার সুযোগ আমার হয়েছে, যদিও তা যথেষ্ট নয়, তবু তার সঙ্গে পরিচয় ছিল ভাবতেই অত্যন্ত ভালো লাগে আমার।

সময়টা ঠিক মনে রাখতে পারিনি। সাল-তারিখ অনুসারে ঘটনাগুলো সাজিয়েও বলতে পারব না। ১৯৪৮ এর শেষ কিংবা ১৯৪৯ এর শুরুর দিকে এস এম হলে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হচ্ছিল। ওই সময় বেশির ভাগ অনুষ্ঠান হতো পুরনো শহরের জগন্নাথ কলেজে। সেই অনুষ্ঠানেই প্রথম ওর সঙ্গে আমার পরিচয়। অনুষ্টানে গায়ক হিসেবে যারা ছিলেন, তারা হলেন আব্বাসউদ্দীন, লায়লা আরজুমান্দ বানু, আবদুল হামিদ চৌধুরী আমি এবং স্থানীয় শিল্পীরা।

আমি গাইব, তার আগে একটা ছেলে গান গাইবে। আমি স্টেজের পেছনে বসে চা খাচ্ছিলাম। চা খাওয়া পুরো হয়নি। ছেলেটা গান ধরল। কানে পৌঁছাতেই আমি বেশ ভালো করে শোনার জন্য স্টেজের পেছন থেকে একটু কাছে এলাম এবং গানটি শুনলাম। সেই গানটি যথাসম্ভব সলিল চৌধুরীর কোনো গান ছিল। কিন্তু ও এত সুন্দর করে গাইল, আমি অভিভূত হয়ে গেলাম। এ দেশের ছেলেরা যে এত সুন্দর করে গাইতে পারে তা আমার জানা ছিল না। গান শেষ হওয়ার পর স্টেজ হতে নেমে গেল সে। তারপরই আমার নামটা ঘোষণা করা হলো। কিন্তু ও যে যাচ্ছে তা আমার চোখকে টেনে ধরে রাখল, আমি চোখ ফেরাতে পারছিলাম না। খুব প্রাণবন্ত হয়েছিল ওর গাওয়া, যা আমার প্রাণের ভেতরে গিয়ে মর্মমূলে নাড়া দিয়েছিল। তাই নিজের নাম ঘোষণা হওয়ার পরেও আমি মঞ্চে যাওয়ার কথা ভুলতে বসেছিলাম। অবশ্য দ্বিতীয়বার নাম ঘোষণায় আমি মঞ্চে গেলাম এবং গাইলামও, খুব সম্ভব জাগরণমূলক কোনো গান গেয়েছিলাম সেদিন। তখনো আমি চলাফেরার জন্য ক্র্যাচের ওপর নির্ভর করতাম। চলাফেরার জন্য অন্য কারও সাহায্য নিতে সংকোচ হত, কারোর হাত ধরে ওঠানামা করতে লজ্জা পেতাম। ওই দিন গান গেয়ে আমি যখন মঞ্চ থেকে নেমে আসছি, সে এগিয়ে এসে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। আমিও নিঃসংকোচে ওর হাতটা ধরে নিচে নেমে এলাম। তারপর সে আমার বুকে বুক মেলাল। আমি বললাম, আমি মনে হয় এত দিন এ ধরনের জাগরণমূলক গান গাইতাম। কিন্তু আপনার গান শুনে….সে চট করে আমার মুখে হাত দিয়ে বলল, আপনি না, তুমি। আমি আলতাফ। তারপর সে পরিচয় দিল ওর বাড়ি বরিশাল। ওরা একটা শিল্পী সংস্থা করবে। তার জন্য চিন্তাভাবনা করছে। আমি যে গানগুলো এর আগে বিভিন্ন জায়গায় গেয়েছি, সে তার কথা বলল, আপনি এ গান গেয়েছেন, ও গান গেয়েছেন। তারপর বলল, আমরা যে শিল্পী সংগঠন করতে যাচ্ছি, তাতে আপনার থাকতে হবে। আমি বললাম, আমার কোনো আপত্তি নেই। আমি যখন জিজ্ঞেস করলাম কোথায় সেই সংস্থাটা, সে যদ্দুর সম্ভব বলেছিল জোড়পুল লেনের কথা। আমি পরে গিয়েছিলাম সেখানে। নিজামুল হক, মমিনুল হক, আলতাফ ও আরো অনেকে ছিল, যাদের নাম এখন মনে করতে পারছি না। তবে যদ্দুর মনে পড়ে, সেই সংস্থার প্রধান সংগঠক ছিল নিজামুল হক।

তারা তখন বসত এম ইউ আহমেদ নামে একজন ইঞ্জিনিয়ারের বাসায়। ১৯৫২ র পরের কথা। আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি। ডাক্তার আমাকে হাওয়া পরিবর্তনের উপদেশ দেন। তখন কার সময়ে হাওয়া পরির্বতনের জন্য কাপ্তাই, চট্রগ্রাম, চন্দ্রঘোনা প্রভৃতি জায়গায় সবাই যেত। কিন্তু টাকা আমি কোথায় পাব? আলতাফ, নিজাম, ওরা তখন আমার চিকিৎসার জন্য অর্থ সংগ্রহ করার জন্য স্ট্রিট কালেকশন করে আমার হাতে তৎকালিন সময়ে পুরো দুশ টাকা তুলে দেয়।

মাঝে অনেকদিন আলতাফের সঙ্গে দেখা হয়নি। ১৯৫৬ সালের শেষে কিংবা ১৯৫৭ সালের প্রথম দিকের কথা। শেখ মুজিব তখন বানিজ্যমন্ত্রী ছিলেন। পশ্চিম পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী ড. এ আর খান এখানে বেড়াতে আসেন। তার সম্মানে কার্জন হলে একটি সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা করা হয়। ওই অনুষ্ঠানে শিল্পী ছিলেন ফতেহ লোহানী,বি এ খানের মেয়ে মিলি খান। আমিও ছিলাম। অনুষ্ঠানের পরে শেখ মুজিব আমাদের সবাইকে পরিচয় করিয়ে দেন ড. খানের সঙ্গে। ড. খান আমাদের পরিচয় জেনে বিশ্বাস করতে চাননি যে আমরা সবাই ভদ্রঘরের ছেলেমেয়ে। কেননা তার ধারনা ছিল, ভদ্র ছেলেমেয়েরা গান-বাজনা করে না, গান-বাজনার জন্য আলাদা কিছু  লোকই আছে। পড়ে ড. খানের আমন্ত্রনে এবং শেখ মুজিবের সহযোগীতায় ৪৩ জনের একটি গানের দল করাচিতে যায়। সেই দলে আমিও ছিলাম। সেখানে গিয়েই আবার আলতাফের সঙ্গে আমার দেখা হয় আর দুজন দুজনকে পেয়ে ভীষণ আনন্দিত হই। করাচিতে যাওয়ার পর আরো বিকশিত হয় আলতাফ। সেখানে বাণিজ্যভিত্তিক শিল্পকর্মের দিকে ঝুঁকে পড়ে এবং তাতে বেশ সাফল্য লাভও করে। ও আমাকে প্রায় সময়ই ওদের স্টুডিওতে নিয়ে যেত এবং ওর সুরগুলো শোনাত।

ওই সময়টাতে করাচিতে শেষ দিকে ওর খুব দুর্দিন যায়। কেননা তিমির বাবু পলিটিকসের চাপে পড়ে ওর কাজ-টাজ বন্ধ করে দেয় এবং তখন তিমির বাবু এক কথায় নেশায় বুঁদ হয়েই পড়ে থাকতেন। তিমির বাবুর সঙ্গে যারা কাজ করত তারাই ওকে পলিটিকস করে বসিয়ে দেয়। আর সে কারণে আলতাফের দিনও খারাপ চলতে থাকে। অবশ্য পরে আলতাফ অন্যান্য সহযোগীদের সঙ্গে কাজ করতে শুরু করে। তখন আলতাফ ভাত জোগাড় করত তাস খেলে জুয়ার বোর্ড থেকে টাকা তুলে এনে।

‘জাগে হুয়া সাভেরা’ ছবির কন্ঠদানের মধ্য দিয়ে সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে আলতাফের আর্বিভাব ঘটে। ওই ছবিতে সমুদ্র-দৃশ্যের সঙ্গীত তৈরি করার সময় সে আমাকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল এবং টাইটেল মিউজিকের হামিংও আমাকে দিয়ে করিয়েছিল।

ঢাকায় টেলিভিসন কেন্দ্র চালু করার পর আলতাফের নেতৃত্বে আমি এবং আরো অনেকে এক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করি। শিল্পী বেশি হওয়ায় মাথা পিছু টাকার পরিমাণ কম পড়ে। এতে আলতাফ তার ভাগের অংশটা না নিয়ে অভিমান করে চলে যায়। আমি রাতে টাকা নিয়ে আলতাফের মেসে গিয়ে ওর মান ভাঙিয়ে খামটা ওকে দিই এবং বলি, ‘তুমি যদি টাকা না নাও তবে আজ থেকে আমি আর তোমার দাদা হব না’ আলতাফ আমাকে দাদা’ বলে ডাকত। আলতাফ সাংঘাতিক আবেগময় ছিল। তবে ওর প্রধান গুণ ছিল, ও যা করত তা খুব আত্নবিশ্বাস নিয়ে করত এবং যে কারণে ওর কাজগুলো খুব পরিস্কার হতো।

যতটুকু মনে পরে ক্রান্তির ব্যবস্থাপনায় আমিনুল হকের পরিচালনায় পল্টনে নৃত্যনাট্য জ্বলছে আগুন ক্ষেতখামারে করা হয়েছিল। সেদিন আলতাফ রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করিলি রে বাঙালি’ গানটা গেয়েছিল। ওর গলায় ও বাঙালি টানটা আজও আমায় কাঁদায়। আমি নিজে সেদিন ওর দরাজ গলার টানটা শুনে ডুকরে কেঁদে ফেলেছিলাম। অপূর্ব! মনে হচ্ছিল ও যেন গানের মধ্যে দিয়ে আলিঙ্গন করছে সব বাঙালিকে। আজও ওই গানটি কোথাও পরিবশিত হলে ওর কথা মনে পড়ে। সত্যিই অপূর্ব। সেদিন যারা গানটি শুনেছিল, অর্থাৎ দর্শক-শ্রোতা ছিল, বোধ হয় আমার মতো করে কেঁদে উঠেছিল তারাও।

ও কেমন প্রাণবন্ত ছিল তার একটা ঘটনা বলছি। একবার আমরা বাগেরহাট গিয়েছিলাম অনুষ্ঠান করতে। সঙ্গে ছিলেন সুফিয়া কামাল, কামরুল হাসান, এনামুল হক, শবনম মুশতারী, পারভীন মুশতারী, সনজীদা খাতুন এবং আরো অনেক। ট্রেনে ফেরার সময় আমরা সবাই ক্লান্ত। আমরা সবাই সিটে শুয়ে বসে আধঘুমে। আলতাফ বাঙ্কে শুয়েছিল। হঠাৎ কোরআন শরীফ পড়ার আওয়াজ এল। খুব দ্রুত, খুব জোরে এবং খুব মধুর সুরে। এত জোরে আওয়াজটা আসছিল যে, গাড়ির শব্দ ঢাকা পড়ে গিয়েছিল। আমরা বুঝতে পারছিলাম না কোত্থেকে আওয়াজটা আসছে। হঠাৎ সুফিয়া কামাল পা থেকে জুতা খুলে তবে রে হারামজাদা বলে উঠে দাঁড়িয়ে আলতাফকে মারতে উদ্যত হলো। আলতাফের যেহেতু ঘুম আসছিল না। তাই সে অত জোরে এবং দ্রুত কোরআন শরীফ পড়তে আরম্ভ করেছিল, যাতে সবাই জেগে যায়। এ ঘটনাটা সবার হয়তো এখনো মনে পড়ে।

আর একবার খুলনার এক ভদ্রলোকের বাসায় আমরা নিয়ন্ত্রণ খেতে গিয়েছি। সবাইকে দুটো কৈ মাছ ভাজা দিয়েছিল। হঠাৎ আলতাফ পেছনে থেকে এসে ছোঁ মেরে আমার ভাগের একটা নিয়ে পালাল। আমি প্রশ্ন করায় বলল, কী করব, আমাকে তো একটা ভাজা কম দিয়েছে। আলতাফ খুব প্রানবন্ত এবং ফুর্তিবাজ ছিল। আমাকে দেখলেই একটু নাচের ভঙ্গি করে দাদা ডেকে পায়ে ধরে আর্শীবাদ নেওয়া ওর অভ্যাসে পরিনত হয়েছিল।

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো গানটা সুর করার সময় ওকে বলেছিলাম, কতগুলো তাজা তরুণ ছেলে বুকের রক্ত দিয়ে, মায়ের সম্মান, ভাষার সম্মান রাখতে চেয়েছে। কাজেই ঘটনার সঙ্গে গানের সুরটার কেমন মিল আছে দেখেছ, অনেকটা চার্চ মিউজিকের মতো। আলতাফ ওর গানের সুর সম্পর্কে আমার মন্তব্য শুনে বলেছিল, ‘দাদা’ তাহলে এই গানটা কিছু হবে একদিন। তারপর সে আমার পায়ে ধরে সালাম করল।

আমার স্ত্রী ওকে আলতাফ ভাই বলে ডাকত। এ ডাকটা আলতাফের পছন্দ ছিল না। আলতাফ চাইত ওকে যেন ‘দেবর’ বলে ডাকা হয়। ও আমার বাসায় এসে রান্নার খবর জানতে জানতে রান্নাঘরে ঢুকে নিজ হাতে খাবার তুলে নিত। ও সবাইকে আপন মনে করত। আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো গানটা সুর করার পর ও প্রথম এসেছিল আমার কাছে। আমি কথাটা আগে কাউকে বলিনি। তবে কথাটা সত্যি। ওর বিয়ের সময় আমি ছিলাম না। ওকে বিয়ের কথা জিজ্ঞেস করতে ও বলেছিল, হ্যাঁ, বিয়েটা করেই ফেললাম। এবার ভালোভাবে সংসার করে বাঁচতে হবে। জনতার সংগ্রাম চলবেই গানটা সুর করার পর আমি গানের শেষ হারমোনাইজে ওর কথাতেই পরিবর্তন করেছিলাম।

ও তখন মালিবাগের দিকে সন্ধ্যাবেলা আড্ডা মারত। ওর বিয়ের পর একদিন সন্ধ্যায় আমাকে সেখানে নিয়ে যায় এবং বলে, দাদা, আমার খুব শখ ছিল একটা গাড়ির। তাই অস্টিনটা কিনে ফেললাম।

ওর সঙ্গে যেদিন শেষ দেখা হলো সেদিন ও খদ্দরের পাঞ্জাবি-পাজামা পরে ছিল। মুখে উস্কখুস্ক দাড়ি। আমরা এখনকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, অর্থাৎ তখনকার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের (ডিসি অফিসের) একটি কামরায় আড্ডা দিতাম। সেখানে সেদিন সন্ধ্যাবেলায় ও আসে। আমি তার সাজপোশাক এবং চেহারা দেখে জিজ্ঞেস করায় ও কোনো উত্তর না দিয়ে শুধু বলেছিল, কিচ্ছু ভাল্লাগেনা। সময়টা ১৯৭১ সালের আগস্টের প্রথম দিক। সেদিনই ওর সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয়। তারপর খবর পাই, ওকে ধরে নিয়ে গেছে। তবে আমি আশাবাদী ছিলাম ও ফিরে আসবে। কারণ ও খুব ভালো উর্দূ বলতে পারত। যতটুকু শুনেছি, আলতাফকে যার সহায়তায় ধরে নিয়ে যাওয়া হয় সে এখনো বেঁচে আছে এবং ব্যাংকে চাকরি করছে। আলতাফের শালারা ওকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। কিন্তু আলতাফের শাশুড়ির এ ব্যাপারে প্রচন্ড আপত্তি থাকায় তা হয়ে ওঠেনি। ছেলেটির নাম আমার জানা নেই। তবে ঘটনাটা আমি শুনেছি।

২১ ফেব্রুয়ারী আমাদের জাতীয় শোক দিবস। ২১ ফেব্রুয়ারীই সব এনেছে। আমার মনে হয় এ গানটি আমাদের জাতীয় সঙ্গীত হতে পারত। কারণ ভাষাকেন্দ্রীক স্বাধীনতার ইতিহাস অন্য কোথাও রচিত হয়েছে বলে আমার জানা নেই। বাংলাদেশে ধর্ম যাই থাক না কেন, ভাষা তো সবার এক। আমি মনে করি আলতাফকে নিয়ে কিছু করার দরকার আছে। শুনেছিলাম ওর ওপর হাসান ইমাম ছবি করবে। তবে তার অগ্রগতির কোনো খবর এখনো পাইনি। আলতাফের মুখে কোনো দিন ওর বাবা-মা ভাই বোনদের কথা শুনিনি। প্রচণ্ড আবেগময় তরতাজা তরুণ আলতাফকেই আমি বেশি দেখেছি, যে তরুণ মনেপ্রাণে বিশ্বাস করত, স্বদেশ স্বদেশ মোদের ঘর রে।