আলতাফ মাহমুদ সুর দিয়েছিলেন: “আমি কি ভূলিতে পারি”
কুড়ি বছর ধরে এই গান মন্ত্রের মতো উচ্চারিত হয়েছে। ‘পূর্ব-পাকিস্তান’ থেকে ‘বাঙলাদেশ’-এর দীর্ঘ জটিল দুস্তর পথযাত্রায় কুড়ি বছর ধরে এই গান প্রতিটি যাত্রীকে বারবার গাইতে হয়েছে।
প্রতিক্রিয়া জানত একুশে ফেব্রুয়ারী হল হল বোধন, “সোনার বাঙলা” প্রতিষ্ঠিা। তাই ওরা রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করেছিল। তাই ওরা বেছে বেছে হত্যা করেছে কবি সুরকার আলতাফ মাহমুদকে।
ফুটফুটে ছোটখাটো বউটিকে দেখলাম-সারা আরা মাহমুদ। বৃষ্টি শেষের পুষ্পিত টগর গাছের মতো শুভ্র শোকের প্রতিমূর্তি। চার বছরের বাচ্চা আছে একটা, আর বৃদ্ধা শ্বাশুড়ী। কিছু বই, কিছু রেকর্ড। আর স্মৃতি…
ফিশফিশ করে বললেন : পঁচিশে মার্চ রাতে? রাজারবাগের বাসায় ছিলাম। আমার ভাই-বোনরাও আমাদের সঙ্গে থাকত। উনিও সেদিন বাসায়ই ছিলেন।
যেন পাখি তার ডানা গোটাল। ভুরু কুঁচকে সেই ভয়াল রাতের কথা ভাবতে ভাবতে সারা মাহমুদ কথা বলছেন। ক্রমেই তাঁর স্বর স্পষ্ট হচ্ছে। ক্রমেই যেন একটা গলা তিনি শুনতে পাচ্ছেন, একটি সুর।
আমরা স্তব্ধ হয়ে তাঁকে দেখছিলাম ! বিষাদ আর প্রেরণার এমন সংমিশ্রণ শতাব্দীতে বারবার চোখে পড়ে না।
সারা বলতে লাগলেন: আমাদের বাসার সামনেই পুলিশ লাইন। পঁচিশে মার্চ রাতে এখানেই প্রথম আক্রমণ শুরু হয়, বাঙালি পুলিশরা এখানেই প্রথম অস্ত্র হাতে পাকিস্তানী সৈন্যদের সঙ্গে রীতিমতো যুদ্ধ করে।
বিকেল থেকেই শহর থমথম করছিল। নানা রকম গুজব। সবাই বুঝেছে কিছু একটা হবে। কিন্তু ঠিক কী…তা কেউই জানে না। উনি বাসায় ফিরেছেন অসম্ভব অস্থিরতা নিয়ে। এমন সময় পুলিশ ব্যারাকে হৈ চৈ শোনা গেল। ভাই গিয়ে জেনে এলো মিলিটারি আক্রমণ হতে পারে। ওখানে তাই প্রতিরোধের আয়োজন চলছে। ফকরুল আলম বিল্লাহ সারার ভাই। পরবর্তীকালে সীমান্ত অতিক্রম করে ‘মেলাঘর’ ক্যাম্পে কাজ করেছেন। বললেনঃ আউটার সার্কুলার রোডের একদিকে পর পর সিভিলিয়ানদের বাড়ি, অন্যদিকে সাত-আটশো ফুট লম্বা টিনের ছাউনি দেওয়া শেডস। তার মধ্যেই কিচেন আর কিছু পুলিশের কোয়ার্টার। তারপর সারিসারি বিল্ডিং, পুলিশ ব্যারাক। শ দেড়েক পুলিশ ঐ বিল্ডিংগুলোর ওপর পজিশন নেয়। বাকিরা রাস্তায়, নালার ধারে বা কোনো আড়াল বেছে পজিশন নেয়। ঐ টিনের শেডেও কিছু লোক পজিশন নিয়েছিল। তাছাড়া সিভিলিয়ানদের অনেকের বাড়ির ছাদেও সশস্ত্র পুলিশবাহিনী উঠেছিল।
সারা বলতে লাগলেন: রাত এগারটায় এয়ার পোর্টের দিক থেকে ফায়ারিং শুরু হয়। উনি বললেন আলো নিভিয়ে সব একতলায় চলে যাও। ঘন্টাখানেক পরে রীতিমতো যুদ্ধ শুরু হল। দরজা-জানালা বন্ধ করে আমরা মুহূর্ত গুনছি। আমাদের গেটের সামনে মর্টার বসিয়ে পুলিশক্যাম্পে শেল দাগা হচ্ছে। ওদিক থেকেও উত্তর আসছে। আমাদের বাড়িটা কেঁপে উঠছে মাঝে মাঝে। আর বন্ধ জানালার ফাঁক দিয়ে দেখতে পাচ্ছি চারিদিকে দিনের আলো। মিলিটারি সার্চলাইট জ্বেলেছে।
ফকরুল হেসে বললেন: ট্রেসার লাইট।
সারা বলতে লাগলেন: সেই আলোয় মিলিটারি বিল্ডিংগুলোর ওপর পুলিশদের অবস্থান দেখে ফেলে। সম্ভবত বিল্ডিংয়ের ভিউ আরো স্পষ্ট পাওয়ার জন্য পাঞ্জাবীরা সেই প্রকান্ড টিনের শেডে রাত তিনটে নাগাদ আগুন ধরিয়ে দেয়। সে কি আগুন, উ: অনেকে তার ভেতরই আটক পড়ে। পুলিশরা ব্যারাক ছেড়ে রাস্তার পাশে নালার ধারে বা সিভিলিয়ান লাইনের কোনো দেয়াল কোনো গেটের আড়াল নিয়ে যুদ্ধ করতে থাকে।
আর বাতাসে ঠিক বন্যার ঢেউয়ের মতো আগুন এদিক-ওদিক ধাওয়া করছিল। আগুনের গোলা, বাঁশের গিঁঠ ছিটকে ঘরে আসছে। দরজা-জানালা বন্ধ রেখে আমরা কি ভেতরেই পুড়ে মরব? আমাদের গেটের ধারে বাউন্ডারির ভেতর ওঁর বড় আদরের কাঁঠালগাছটা পুড়ে গেল। আর মাত্র কয়েক হাত। তারপরেই আমাদের দালান। বাথরুমে চল্লিশ গ্যালন পেট্রল মজুত আছে। পয়লা মার্চ থেকে অসহযোগ আন্দোলন চলছিল। তাই উনি পেট্রলটুকু আগেই কিনে রেখেছিলেন।
ফকরুল বললেন: বোনকে আলতাফ ভাই এইরকমই বুঝিয়েছিলেন। কিন্তু আসলে তাঁর অন্য মতলব ছিল। এ-পেট্রল তিনি মলোটভ ককটেল বানাবার জন্য মজুত রেখেছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন আজ হোক কাল হোক মিলিটারির সঙ্গে সংঘর্ষ অনিবার্য। তাই ঐ পেট্রলের এক কণাও গাড়ির জন্য খরচ করেন নি।
সারা ভাইয়ের দিক এক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলেন। তারপর বলতে লাগলেন: আমাদের গোটা বাড়িটা তেতে উঠল। পোড়া গন্ধ। আগুনের আঁচ সইতে না পেরে টিনশেডের ঠিক উল্টো দিকের বাড়িগুলো থেকে বৌ-বাচ্চা নিয়ে মানুষ জন গুলীর মধ্যেই দৌড়ে বেরিয়ে পড়ে। উনি বললেন: ভয় পেয়ো না, আমি আছি…দাঁত দিয়ে তলাকার ঠোঁট কামড়ে মুহূর্তেক নীরব থেকে সারা মাহমুদ শেষ করলেন: শীতের ভারী ভারী জামা-কাপড় যা ছিল ভালো ভাবে ভিজিয়ে পেট্রলের টিনের ওপর চাপা দিয়ে নিজে তিনি সারারাত বাথরুমে থেকেছেন, আমাদের কাউকে কাছে যেতে দেন নি। বাইরের ঘরে সবাই আমরা প্রস্তুত হয়েই ছিলাম। বাথরুমে একটু-আধটু আগুন যা আসছিল উনি নিভিয়ে ফেলছিলেন। কয়েক ঘন্টা সেই ভয়ঙ্কর বিপদের সঙ্গে উনি একলা যুদ্ধ করেছিলেন। আমরা স্তব্ধ হয়ে শুনছিলাম। সেই মুহূর্তগুলো খানিক খানিক দেখতে পাচ্ছি। ঠিক গেটের সামনে পিশাচ মিলিটারিরা পজিশন নিয়ে আছে। চতুর্দিকে অবিরাম গুলীগোলা। মানুষজনের আর্তনাদ। পাকিস্তানী সৈন্যদের উল্লাসধ্বনি। দিন না রাত বোঝা যায় না। ট্রেসার লাইটের প্রয়োজন ফুরিয়েছে। লকলকে আগুন বাতাসে চড়ে বর্গীর মতো একবার এদিক একবার ওদিক ধাওয়া করছে। অসহায় মানুষ হাহাকার করে একবার এদিক একবার ওদিক দৌড়ে বেড়াচ্ছে, আর মুখ থুবড়ে মরছে। বাইরের ঘরে বৌ- কতইবা বয়েস, কীইবা বোঝে, চার বছরের শিশুপুত্রকে বুকে চেপে ভয়ার্ত পায়রার মতো কাঁপছে। আর বৃদ্ধা মা। আর স্ত্রীর ভাইবোন।
বাথরুমে কয়েকঘন্টা ধরে একা, একেবারে একা, পাহারা দিতে দিতে কবি গাইয়ে সুরকার আলতাফ মাহমুদ দেখছেন পাক মিলিটারিরা বাঙলাদেশে আগুন জ্বেলেছে। আগুনে সংসার পুড়ছে, মানুষ পুড়ছে, গাছ পুড়ছে। পোড়া গন্ধে নিশ্বাস নেওয়া দায়। আগুনের আঁচে বাথরুমেও টেকা যায় না। কিন্তু চল্লিশ গ্যালন পেট্রল না বাঁচলে উঠোনের ঘাসটুকুও কালো হয়ে যাবে, আশেপাশের অনেকগুলো বাড়ির মাথায় নেমে আসবে সর্বনাশের অমোঘ বজ্র। আর, অপচয় হবে এক অমূল্য সম্পদের-প্রতিরোধ সংগ্রামে যার প্রয়োজনের কোনো তুলনা হয় না।
শান্ত স্থৈর্যে একা কয়েক ঘন্টা প্রায় জতুগৃহের মধ্যে আগুনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালাতে চালাতে কি ভেবেছিলেন আলতাফ মাহমুদ? কবিতার কোনো পংক্তি কি তাঁর মাথায় আসে নি? গানের কোনো সুর কি তাঁর গলায় বাজে নি? কয়েক হাত দূরের কাঁঠাল গাছটায় যখন আগুন লাগল-তখনও কি তাঁর বড় ভালোবাসার বউটির কাছে একবার ছুটে যেতে ইচ্ছে করে নি? গেটের বাইরে পজিশন নিয়ে মিলিটারিরা যখন সবকিছু ছারখার করে দিচ্ছে-তখন, ঠিক তখন, কোন ভরসায় তিনি ভবিষ্যতের প্রতিরোধের কথা ভেবেছিলেন?
সারা বললেন: বাতাসের গতির জন্য আমরা বেঁচে গেলাম। নইলে আমাদের বাসা, আমরা সবাই সে রাতেই পুড়ে ছাই হয়ে যেতাম। বাড়িপোড়া আগুনের মধ্য দিয়ে কখন ভোরের আলো ফুটে উঠল টের পাই নি। বাইরের দিকে তাকানো যায় না, রাস্তার দিকে তাকানো যায় না। আমরা কোনোরকমে পাশের বাড়ি চলে যাই। ঐ ২৬ তারিখ ভোরবেলা পুলিশরাও সিভিলিয়ানদের বাড়ি বাড়ি অস্ত্র এবং পোশাক ফেলে দেয়াল টপকে পালিয়ে গেল। অবশ্য ২৮, ২৯, ৩০ তারিখে রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে অনেকে অস্ত্র ফেরৎ নিয়ে যায়। কিন্তু অনেকে আর আসে নি-তাদের কেউ কেউ আর কোনোদিনই আসবে না।
মিলিটারি জীপ রাস্তা দিয়ে মাইকে বলতে বলতে যেত: পুলিসলোক, আর্মস থাকলে ফিরিয়ে দাও।
সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় যুবকরা পুলিশদের ফেলে যাওয়া অস্ত্র লুকিয়ে ফেলে, কিছু বা পানিতে ফেলে দেয়। তাদের পরিত্যক্ত পোশাকও মাটির নিচে পুঁতে রাখা হয়। ২৭ তারিখে চার ঘন্টার জন্য কার্ফ্যু উঠল। আমরা সবাই কমলাপুর বৌদ্ধ মন্দিরে গিয়ে উঠলাম। তারপর শুনলাম মন্দিরও আক্রমণ করছে। খিলগাঁও-এ এক আত্মীয়ের বাসায় গিয়ে আশ্রয় নিলাম। দিন পনের ছিলাম। আলতাফ সাহেব লুটের ভয়ে রাতে রাজারবাগের বাসায় গিয়ে থাকতেন। আমার অনুমান এই সরল আর নিরীহ ভদ্রমহিলা জানতেন না, সম্ভবত পুলিশদের ফেলে যাওয়া অস্ত্র এ-বাড়িতেও কিছু ছিল। আলতাফ মাহমুদ বোধহয় সেগুলো পাহারা দেওয়ার জন্যই বাড়ি ছাড়তে পারেন নি। এই অনুমানের কারণ অবশ্য এখন ব্যাখ্যা করা যাবে না। এইভাবে কয়েক রাত কাটল। তারপর, দিন পনের বাদে, খিলগাঁও থেকে তিনি সকলকে বাড়ি নিয়ে এলেন।
ফকরুল আলম বিল্লাহ বললেন: ঐ পনের দিনের কথা আমার কাছে শুনুন। আমরা অনেক রাত অবধি তাস খেলতাম। মহম্মদ ইকবাল আর নাসের আহমদ থাকত। সীমান্ত পেরিয়ে ইকবালও পরে ‘মেলাঘর’ ক্যাম্পে যোগ দিয়েছিল। তাস খেলতাম- কারণ কারোর চোখে ঘুম নেই। রাস্তায় মাঝে মাঝে জীপের শব্দ, তীব্র হর্ন। হঠাৎ আকাশের কোনো একটা দিক তামা হয়ে উঠত- অর্থাৎ শহরের কোথাও আগুন লেগেছে। আর থেকে থেকে নানা ধরনের গুলীর শব্দ। প্রথম কয়েকটা রাত খুবই খারাপ গেছে। আমি তো মাঝে মাঝে নিজের নিশ্বাসের শব্দেই চমকে উঠতাম। তারপর আস্তে আস্তে সয়ে এল। শহরের অবস্থা স্বাধীনতার আগে পর্যন্ত কোনোদিনই স্বাভাবিক হয় নি। তবে, প্রথম কয়েকদিনের দুঃস্বপ্নের ঘোর ক্রমে এই শহরটাও কাটিয়ে উঠল। আলতাফ ভাইকে দেখেছি, তাঁর নার্ভের জোর ছিল অসম্ভব, মুখ দেখে ভেতরের খবর কিছুই বোঝাবার উপায় নেই। তাস খেলতে খেলতে একটা-দুটো কথা বলতেন। না, এই পনের দিন তিনি এক কলি গানও গান নি! অন্যমনস্কের মতো মাঝে মাঝে বলতেন: কে বেঁচে আছে, কে কোথায় আছে-কিছুই বুঝছি না। কারোর সঙ্গে কারোর যোগাযোগ নেই। কীভাবে লিঙ্ক করা যায়? কী করা যায়?
একদিন হঠাৎ বললেন: আর্মি আসলে কিভাবে রেসিসটেন্স দেবে ভেবেছ? ধাপে ধাপে একটু একটু করে তিনি আমার কাছে কথাটা পাড়লেন। আমি তাঁর স্ত্রীর ভাই, একসঙ্গে থাকি, বন্ধুর মতো। কিন্তু এ-ব্যাপারে কোনোদিনই তিনি কাউকে সব কথা বলেন নি, আমাকেও না! তবে মনে পড়ে গোড়ার দিকে আমরা প্ল্যান করেছিলাম- বোতল কেনা হবে, মিলিটারি এলে বোতলে পেট্রল ভরে ছুঁড়ে মারা হবে। বুঝলেন? হাইলি সফিসটিকেটেড আর্মসের বিরুদ্ধে সেই ছিল আমাদের প্রথম প্রতিরোধের অস্ত্র। তারপর এপ্রিলের শেষের দিকেই আলতাফ ভাই নিজের জন্য কীভাবে পাইপ গান তৈরি করিয়ে নেন।
ফকরুল আলম থামলেন। বোনের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে অন্যমনস্কের মতো হাসলেন। তারপর বললেন: জুলাই মাসের প্রথম দিকে ছেলেরা বাইরে থেকে অস্ত্র নিয়ে ফিরতে থাকে। আলতাফ ভাইয়ের সঙ্গে তাদের কারো কারো যোগাযোগ হয়।
প্রশ্ন করলাম : কি ভাবে? প্রথম যোগাযোগ কার সঙ্গে হয়েছিল?
ফকরুল আলম অস্বস্তির সঙ্গে উত্তর দিলেন: জানি না। আগেই বলেছি সব কথা বলার অভ্যেস ওঁর ছিল না। আলতাফ ভাই একদিন আমাকে বললেন: ছেলেরা সব এসে গেছে, এইবার এ্যাকশন শুরু হবে। ঢাকা শহরে এই সময়ে কিছু কিছু বোমা গ্রেনেড ফেটেছে। আমরা ভাবতাম সেগুলো এখানেই তৈরি। দুর্ধর্ষ ছেলেপিলে সব দেশেই থাকে, তারা ফাটাচ্ছে। কিন্তু আমাদের ছেলেরা সংগঠিতভাবে বাইরে থেকে অস্ত্র নিয়ে ফিরছে-এটা স্বপ্নের মতো মনে হত। আমরা এইখানে বসে ভাবতাম উই আর ডুমড। স্বাধীন বাঙলা বেতার শুনতাম, মুক্তাঞ্চলের কথা শুনতাম-কিন্তু নিজের চোখে কিছুই দেখতাম না।
আলতাফ ভাই বললেন: দে উইল ফাইট। আপনারাও চলে যান।
-আপনি যাবেন না?
আমি সবকিছু ঠিক করে যাব।
(ক্রমে আলতাফ সাহেবের বাড়িটা একটা কেন্দ্র মতো হয়ে ওঠে। সেখানে ঢাকা শহরের একাধিক ছোটো ছোটো গেরিলা গ্রুপের কেউ কেউ এসে জড়ো হতেন। গ্রুপগুলি অবশ্য আলাদা আলাদাই এ্যাকশন করত, কিন্তু পরস্পরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়ে যাওয়ায় নিজেদের মধ্যে তাঁরা ঐখানে বসে আগে-পরে অনেক কিছুই আলাপ করে নিতেন। কেউ কেউ এঁরা পরস্পরের পূর্বপরিচিত ছিলেন। এখন কাজের সূত্রে আবার একে অপরকে নতুন করে জেনেছেন। এ্যাকশনের সাফল্যে মাঝে মাঝে ছোটোখাটো সেলিব্রেসনও হত। ঐ আড্ডায় কয়েকটি বেপরোয়া ছেলে আসত। তাদের রাজনৈতিক শিক্ষা বা অভিজ্ঞতা ছিল না। ছিল একধরনের দেশপ্রেম, “পাঞ্জাবী”দের বিরুদ্ধে অদম্য রাগ, উত্তেজনা আর সাহস। আড্ডায় বসে আলতাফ সাহেব তাদের গল্প শুনতেন আর মাঝে মাঝে সাবধান করতেন: গেরিলাদের এত কথা বলতে নেই। কখনো বা কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে বলতেন: ওনারা নতুন তো, সব ঠিক বোঝেন না। কখনো বা ঠাট্টা করতেন: কী, এই বুদ্ধি নিয়ে কত বছর পলিটিকস করা হচ্ছে? হোটেল ইণ্টার কণ্টিনেণ্টালে যারা এ্যাকশন করেছিল তাদের একজনকে তো তিনি এক দিন কিছুতেই গল্প থামায় না দেখে সস্নেহে ধাক্কা দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেন, বলেন : যান যান, রাত হয়ে গেছে!) ধীর স্থির আলতাফ মাহমুদ ছিলেন ঐ কেন্দ্রের প্রাণ। “সমূদ্রের মৌন” নিয়ে তিনি কাজ করে যাচ্ছিলেন।
জুলাই মাসে মা ও স্ত্রীকে বলেছিলেন সবাইকে বরিশালে রেখে তিনি কাজে যাবেন। অর্থাৎ সীমান্ত পেরোবেন। কিন্তু যান নি। এদিকেও তাঁর কাজ ছিল। পাকিস্তানী সৈন্যরা যে বাঙলাদেশটা নিয়ে নিতে পারে নি, অস্ত্র হাতে খোদ ঢাকা শহরে মানুষ গেরিলাযুদ্ধ করছে- বাঙলাদেশকে, ভারতবর্ষকে, পৃথিবীকে এটা দেখাবার প্রয়োজন ছিল। রেডিও টেলিভিসন সামরিক প্রশাসনের হাতে। কিন্তু বাঙলাদেশে বসেই যে মুক্তিযুদ্ধের গান লেখা হচ্ছে গাওয়া হচ্ছে- এটা সকলকে জানানো প্রয়োজন ছিল। তাই তিনি থেকে যান। সেই প্রকান্ড বধ্যভূমিতে সমগ্র অস্তিত্ব দিয়ে তিনি মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করেন- তাঁর গলায় গান, হাতে অস্ত্র। আলতাফ মাহমুদ অনেককে নিরাপদে ভারতবর্ষে পাঠাবার ব্যবস্থা করেছেন। ‘মেলাঘর’ ক্যাম্প ও খালেদ মোশাররফ-এর সঙ্গে তাঁর একটা যোগাযোগ হয়। যেসব গাইয়ে ঢাকায় থেকে গেছেন তাঁদের কাউকে কাউকে গোপনে ভারতবর্ষে পাঠাবার ব্যবস্থা করার অনুরোধ আসে। আলতাফ মাহমুদ ফেরদৌসী বেগমকে পাঠাবার চেষ্টা করেন। সেই সময়, আগস্টের প্রথম দিকে, আলতাফের মা ছেলেকে চলে যাবার জন্য পীড়াপীড়ি করেন। ছেলে বলেন: যাব কিছুদিনি পরে, কাজ বাকি আছে। পঁচিশে আগস্ট ফকরুল আলমকে বলেন: আপনারা চলে যান, আমি দিন সাতেকের মধ্যেই আসছি। আলতাফ মাহমুদ থেকে যান। বাঙলাদেশ জোড়া বদ্ধভূমির আসল হাড়িকাঠ ঢাকা শহরে বসে তিনি মৃত্যুকে শান্ত দৃঢ়তায় চ্যালেঞ্জ করেন-তাঁর হাতে অস্ত্র। গলায় গান।
সারা মাহমুদ বললেন: হাফিজ সাহেবের কথাও আপনার জানা দরকার। তিনি রেডিও পাকিস্তানের নামকরা মিউজিসিয়ান, বাদ্যযন্ত্র বাজাতেন, আলতাফ সাহেবের বন্ধু। বাড়িতে কে কখন আসে, কেন আসে…আমি প্রায় জানতামই না। বুঝতাম কিছু একটা হচ্ছে-তবে ঠিক কি ব্যাপার তার আন্দাজ পেতাম না। পেতে চাইতামও না। কিন্তু একটা ব্যাপার লক্ষ করতাম। হাফিজ সাহেব এসে হর্ন দিলে উনি যে কোনো অবস্থায়ই থাকুন না কেন দৌড়ে বেরিয়ে আসতেন। গেটের পাশে কাঁঠাল গাছের তলায় দাঁড়িয়ে দুজনে কথা বলতেন। হাফিজ সাহেব বড় একটা ভেতরে আসতেন না।
ফকরুল বললেন: তখন স্বাধীন বাঙলা বেতার ভালোভাবে চলছে। রোজ প্রায় একই গান বাজত। আলতাফ ভাই এ-কারণেও নতুন গানের প্রয়োজন অনুভব করতেন।
সারা বলতে লাগলেন: কেউ জানে না, লতিফ সাহেব আমাদের বাড়ি বসেই গান লিখতেন। বলতেন-সুর দেওয়া হলেই ছিঁড়ে ফেলবে। আলতাফ সাহেবও কিছু গান লিখেছেন। ঐ সময়টা যেন আচ্ছন্নের মতো কাটিয়েছেন। দরজা-জানালা বন্ধ করে ঘরের মধ্যে একা বসে সুর দিতেন। ঘরে কেউ থাকতে পেত না। হয়তো খুব কষ্ট পেয়েছেন। গলা খুলে গাইতে পারছেন না তো? আর, বাড়িতে যারা থাকে, নিয়মিত যারা আসে-তাদেরও জানতে দিতে চান না। এই ভাবে কি সুর হয়, বলুন? উজ্জ্বল চোখে প্রসন্ন মুখে হেসে সারা বলতে লাগলেন: কিন্তু সুর উনি দিলেন। লতিফ সাহেবের লেখা নিজের লেখা সব কটা গানেই আলতাফ সাহেব সুর দিয়েছিলেন।
-সেই কবিতাগুলি কোথায়?
-সুর দেওয়া মাত্র ছিঁড়ে ফেলেছেন।
-কোনো কপি নেই?
বিষণ্ন চোখে তাকিয়ে সারা মাহমুদ আস্তে আস্তে ঘাড় নাড়লেন।
ফকরুল আলম বললেন: অবশ্য টেপ করে গিয়েছেন। সেই টেপ এখন বাঙলাদেশ বেতারকেন্দ্রে আছে।
সারা মাহমুদ সোৎসাহে বললেন হ্যাঁ, টেপ করতে পেরেছিলেন। মিউজিক্যাল হ্যান্ডস যোগাড় করতেন হাফিজ ভাই আর রাজা হুসেন খান। আলতাফ সাহেব নিজের গাড়িতে ঘুরে ঘুরে গাইয়েদের যোগাড় করতেন। শিল্পী কারা ছিলেন ঠিক জানি না। ঢাকায় দুটো স্টুডিও আছে। বেঙ্গল স্টুডিও আর ফিল্ম ডেভেলপমেণ্ট করপোরেশন স্টুডিও। এর কোনো একটায় রিহার্সেল আর রেকর্ডিং হত একদিনে একসেঙ্গ। বুঝলাম আলতাফ সাহেব কোনো ঝুকি নিতে চান নি। এক জায়গায় সকলকে জড়ে করে গান শিখিয়ে রেকর্ড করে তবে শিল্পীদের বাইরে যেতে দিয়েছেন। তিনি চলচিত্রের প্রখ্যাত সঙ্গীতপরিচালক ছিলেন। সুতরাং স্টুডিওতে কেউ সন্দেহ করে নি।
সারা মাহমুদ বললেন: রেকর্ড করে সকলকে বাড়ি পৌছে দিয়ে আলতাফ সাহেব রাত তিনটে নাগাদ বাড়ি ফিরেছেন। এপ্রিল মাস থেকে প্রায়ই তাঁর ফিরতে অনেক রাত হত। একদিন রাস্তায় ডাকাতের হাতে পড়েছিলেন। জোরে গাড়ি চালিয়ে রক্ষা পান, তবে ঢিলে উইন্ডশিল্ড ভাঙে। তাছাড়া মিলিটারি পুলিশের ভয় তো ছিলই। শুনলাম আলতাফ মাহমুদ দুবার রেকর্ড করান। প্রথম দিকে তাঁর ১২ খানা গানের একটি স্পুল নিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করার সময় একজন অবাঙালি কুরিয়ার ধরা পড়েন। তাঁর মৃত্যু হয়। সেই স্পুলটা আর পাওয়া যায় নি। জুলাইয়ের শেষের দিকে আবার অনেকগুলো গান রেকর্ড করে দুটো বড় স্পুল তিনি স্বাধীন বাঙলা বেতারকেন্দ্রের জন্য পাঠান। বহু দেরিতে, সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি, সেটা কলকাতায় পৌঁছয়।
সারা মাহমুদ বললেন: (এপ্রিলের শেষের দিকে ওঁর গানের ব্যাপার শুরু হয়। জুলাইয়ের শেষ পর্যন্ত ঐ কাজে ছিলেন)।
ফকরুল আলম বললেন: আলতাফ ভাই (আগস্টের প্রথম থেকে ঢাকার ক্র্যাক প্লাটুন-এর সঙ্গে পুরোপুরি যুক্ত হন। সেপ্টেম্বরের শুরুতে হয়তো চলে যেতেন। কিন্তু তার আগেই ধরা পড়ে যান)।
সারা মাহমুদ বললেন: (তিরিশে আগস্ট সকাল ৬টায় মিলিটারি এসে আমাদের বাড়ি ঘেরাও করে। আমরা কেউ জানতেও পারি নি। সামনের ঘরে ছিল আমার দুই ভাই আর ও-বাড়ির দুটি ছেলে, আমি ভাগনে বলে ডাকি। আলভিও ছিল, আগের রাতে সে আর ফেরে নি। পেছনের ঘরে ছোট বোনটা রেওয়াজ করছিল। শেষ করে দরজা খোলা মাত্র দুজন আর্মি তার বুকের ওপর বন্দুক চেপে ধরে। বেচারা চীৎকার করে ওঠে। ওর চীৎকার শুনেই আমি ঘুমচোখে ঘর খুলে দৌড়ে বেরিয়ে এসে চেঁচিয়ে উঠি: পাঞ্জাবী পুলিশ এসেছে। ও বিছানা থেকে উঠতে উঠতে বলে: ভয় পাও কেন এত? বেরোনা মাত্র ওরা দুজনে এসে ওর দুই হাত ধরেছে। সোজা ড্রইংরুম দিয়ে বাইরে নিয়ে গেছে। একটা কথা বলার অবসর পর্যন্ত পায়নি। আমাকে ওর সেই ছিল শেষ কথা: ভয় পাও কেন এত? আমি আর মা ড্রইংরম্নমে যেতে যেতে শুনলাম কে যেন ভারী গলায় প্রশ্ন করছে: আলতাফ মাহমুদ কৌন হ্যায়? ড্রইংরম্নমে পৌঁছে খোলা দরজা দিয়ে দেখলাম বারান্দার খাটে আলভি আর ওরা চারজন বসা। তিনজন পাঞ্জাবী রাইফেল উচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দুজন আলতাফকে নিয়ে যাচ্ছে বারান্দা দিয়ে। দেখি সোজা পেছনের মাঠে পাশের বাড়ির দেওয়ালের ধারে একটা গাছতলায় গিয়ে দাঁড়াল) নানা সূত্রে আমি জানতে পারি শনিবার ঢাকার ক্র্যাক প্লাটুনের একজন গেরিলা অস্ত্র হাতে ধরা পড়ে। সমস্ত রাত মার খেয়ে সে আরেকজনের নাম বলে ফেলে। তাকে রবিবার বিকেলে ধরা হয়। কয়েকদিন আগে এই যুবকই নিশুত রাতে একটা ষ্টিলের ট্রাঙ্ক আলতাফ মাহমুদের বাড়ি নিয়ে আসে। অন্ধকারে গাছতলায় চারজন মাটি খুঁড়ে সেটা পোঁতে। এক-আধদিনের মধ্যে সেই চারজনের দুজন সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতবর্ষে চলে যায়। দিন সাতেক পরে আলতাফ সাহেবেরও গিয়ে তাদের সঙ্গে যোগ দেবার কথা ছিল। ইতিমধ্যে চতুর্থজন ধরা পড়ে এবং অকথ্য নির্যাতনের পর মিলিটারির কাছে স্বীকারোক্তি করতে বাধ্য হয়। তিরিশ তারিখ সোমবার সকালে এসে সে নাকি দূর থেকে আলতাফ সাহেবকে দেখিয়েও দেয় । আরও জানতে পারি আলতাফ ভাইয়ের বাড়িতে যে গেরিলারা নিয়মিত আড্ডা দিত, তাদের একজন বিদেশে চলে যায় এবং স্বাধীনতা পর্যন্ত সেখানেই ছিল। এই সময় কয়েকজন আমেরিকানের সঙ্গে নাকি তার খুবই ঘনিষ্ঠতা দেখা গেছে)।
সারা মাহমুদ বলতে লাগলেন: বন্দুক দেখিরে ওরা আলতাফকে মাটি খোঁড়াল। ওরা তাঁকে লাথি ঘুঁষি মারছিল, গায়ে মুখে কাদা ছুঁড়ছিল। আমরা বুঝতেই পারছি না জায়গাটা খোঁড়াচ্ছে কেন। শেষ পর্যন্ত ওরা কি তাঁকে নিজের কবর খুঁড়তে বাধ্য করছে? হায় আল্লা, আমাদেরই চোখের সামনে? তারপর কয়েকজন মিলে একটা ট্রাঙ্ক টেনে তুলল। মুহূর্তে সব বুঝলাম। ওরা দ্রুত ওঁকে অন্য গেট দিয়ে বার করে নিয়ে গেল। যে গাড়িটা অপেক্ষা করছিল, তাতে তুলল। তারপর অস্ত্র ভর্তি স্টিলের বড় ট্রাঙ্কটা নিয়ে গাড়ি চলে গেল। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে সারা মাহমুদ আবার বললেন: চলে গেল। মুহূর্তেক নীরব থেকে বলতে লাগলেন: ইতিমধ্যে ওপর থেকে অন্য ভাড়াটেদের তিনটি ছেলেকে ধরে এনে মিলিটারিরা আমাদের বারান্দার খাটে বসিয়ে রেখেছিল। রাস্তার চলন্ত জীপ থামিয়ে তিন বাড়ির এই এতগুলি ছেলেকে ধরে নিয়ে এবার তারাও চলে গেল। সেইদিনই বিকেল পাঁচটায় ওপরের ভাড়াটিয়া তিনজন এসে যায়। বুধবার, পয়লা সেপ্টেম্বর, দুই ভাই দুজন ভাগ্নে আর আলভি ছাড়া পেল। এই দুদিন ওরা রমনা থানায় আলতাফের সঙ্গে ছিল। তাঁকে দিনের বেলা এম.পি.এ হোস্টেলের কশাইখানায় নিয়ে টর্চার করত। রাতে রমনা থানায় রাখত। সবাইকেই ভীষণ অত্যাচার করেছে। মাথা নিচু করে পা ওপরে ঝুলিয়ে দিত। তারপর ধাক্কা। ঘড়ির পেন্ডলামের মতো দোল খেতে খেতে শরীরটা যেই কাছে আসে অমনি পিটুনি। -এক মুক্তিফৌজকো নাম বাতাও। বলতে না পারলেই মার। আলভি ছবি আঁকে, নাম করা শিল্পী, তার হাতের নখ তুলে নিয়েছে। ভাই আর ভাগ্নেদের একজন অনেকদিন কানে শুনত না, একজন আজও ভালোভাবে মাথা তুলতে পারে না, একজনের আঙ্গুল ভেঙে গেছে। খনু এম.এস.সি. এগ্রিকালচারে থীসিস করত। ওরা চোখ বেঁধে তাকে ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড় করায়। এক মিলিটারি অফিসার বলে: আমি ওয়ান…টু…বলব, তার মধ্যে কোনো ‘মুক্তি’র নাম না করলেই থ্রি এবং গুলী। খনু বলে: আমি কিছু জানি না। অফিসার তখন ওয়ান…টু…বলে, কিন্তু থ্রি আর বলে নি। সে নতুন করে ভয় দেখায়: হাত-পা বেঁধে বুড়ীগঙ্গায় ফেলে দেবো। বলে: তোমার মতো কুত্তার জন্য এতটা শীষে নষ্ট করা ঠিক নয়। ভীষণ অত্যাচার করেছে। একটা বাথরম্নমে ১৬ জনের থাকার ব্যবস্থা। সেই নরকে এমনকি ছড়িয়ে বসার মতো জায়গাও ছিল না। থাকতে না পেরে হাফিজ সাহেব এক সময় দীনুকে বলেন: একটু শুই? হাফিজ সাহেব তার কোলে মাথা রেখে শোয়ার পর দীনু দেখে হাফিজ সাহেবের একটা চোখ তুলে নিয়েছে, আঙ্গুলগুলো কেটে দিয়েছে। আলতাফ মাহমুদের প্রতিরোধের গানের সঙ্গে হাফিজ সাহেবের ঐ চোখ আর ঐ আঙ্গুলই গর্জে উঠেছিল। তাই তাঁকে মরতে হয়েছে। আলতাফ মাহমুদের ওপর অত্যাচারের মাত্রাটা ছিল আরও বেশি। জানা গেছে জেরার উত্তরে তিনি একটি কথাই বলেছেন। যে-ছেলেটি বাড়িতে এসে তাঁকে চিনিয়ে দিয়েছিল, তার নাম করে বলেছেন: স্টিলের ট্রাঙ্কটা আমি ওর কথায় রাখতে বাধ্য হই। কি আছে নিজেও জানতাম না। দোষ হলে আমারই দোষ। বাড়ি থেকে আর যাদের ধরেছ-তারা কেউ কিছু জানে না। আলতাফ সাহেব একটা নাম বললে হয়তো বেঁচে যেতেন, অন্তত অত্যাচার কিছুটা কম হত। কিন্তু আর কিছুই তাঁর মুখ দিয়ে বেরোয় নি।
সারা মাহমুদ বললেন : (রমনা থানায় মুক্তিফৌজের জন্য ছেলেরা এই দুদিন ওঁকে পায়। খুব যত্ন করে। এম.পি.এ. হোস্টেলে নিয়ে সারাদিন মারধর করার পর ওরা রাত কাটাতে ওঁকে ফিরিয়ে আনত। পাঞ্জাবী পুলিশের সামনে সবাই আলতাফ সাহেবকে না চেনার ভান করতে, তারপর পুলিশ চলে গেলেই লাফ দিয়ে উঠে ওঁর সেবায় লেগে যেত। বাঙালি পুলিশকে ঘুষ দিয়ে তারা একটু আধটু ওষুধও আগেই আনিয়ে রাখত। আড়াই দিনে একবার সকলকে খেতে দেয়-রুটির ধারগুলো, মাঝখানে কিছু নেই; আর পচা ডাল। ছেলেরা সেই খাবারই ভালোবেসে এগিয়ে দিত। কিন্তু খাবে কে? দিন ফুরিয়ে আসছিল! আলতাফ সাহেব এই রমনা থানায় মৃত্যুর মুঠোয় বসে সেই অসম্ভব অত্যাচারের মধ্যেও খনুকে আক্ষেপ করে বলেছিলেন: দেশের কোনো কাজই তো করতে পারলাম না।) পরে এইখানকারই একজন বন্দী তাঁর ওপর নির্যাতনের নানা ভয়ঙ্কর খবর জানিয়ে বলেছিল তেসরা সেপ্টেম্বর চোখ বেঁধে আলতাফ ভাইকে কোথাও নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর কি হয় আজ পর্যন্ত কেউ জানে না। কেউ বলে তাঁকে এম.পি.এ. হোস্টেলে দেখেছে-ক্ষতবিক্ষত চেহারা। কেউ বলে সেন্ট্রাল জেলে দেখেছে- চেনা যায় না। কেউ বলে ক্যানটনমেন্ট হাসপাতালে দেখেছে-একেবারে ফালা ফালা অবস্থা। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর সংবাদও কেউ ঠিকমতো দিতে পারে নি)।
সারা মাহমুদ বললেন: অক্টোবর মাসে বন্দীদের সঙ্গে দেখা করতে চাইলে পারমিশান দিত। আমি যেতাম সেন্ট্রাল জেলে, কয়েকবার গিয়েছি, বাইরে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড় করিয়ে রেখে শেষে জানাত-ও-নামে এখানে কেউ নেই। আমার শ্বাশুড়ী ক্যানটনমেন্ট হাসপাতালে গিয়েছেন। সেখানেও তাঁকে খাতা দেখে বলা হয়েছে–ও-নামে কেউ নেই।
ফকরুল বললেন: ১৬ই ডিসেম্বর রাত দেড়টায় তন্ন তন্ন করে খোঁজা হয়েছিল। এমনকি খাতায় পর্যন্ত কোনো রেকর্ড নেই। তারপর একটু গলা নামিয়ে বললেন: ফলে আমার বোন এখনও মাঝে মাঝে আশা করে -হয়তো আলতাফ ভাই বেঁচে আছেন। বিষাদ ও প্রেরণার সেই প্রতিমূর্তির দিকে তাকিয়ে আমি বললাম: হ্যাঁ, আলতাফ ভাই নিশ্চয়ই বেঁচে আছেন। আমার ১৯৫৪ সালের কথা মনে পড়ল। কার্জন হলের ঐতিহাসিক সাহিত্য সম্মেলনে কবি, সুরকার, সঙ্গীতশিল্পী ও রাজনৈতিক কর্মী তরুণ আলতাফ মাহমুদের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। আবদুল গাফফার চৌধুরীর লেখা সেই অমোঘ গান আমি তাঁর গলায়ই প্রথম শুনেছিলাম:
“আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রম্নয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি।”
আশ্চর্য সে-অভিজ্ঞতা কোনোদিন ভুলবার নয়। হাজার লক্ষ অশ্রুসজল চোখে বজ্রের দৃঢ়তা প্রথম ঐখানেই লক্ষ করি। ঐখানেই আমি লতিফ ভাইকে গাইতে শুনি:
“ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়
ওরা কথায় কথায় শিকল পরায় আমার হাতে পায়।।”
ওইখানেই শুনি:
“কোরাস: দুইশ বছর ঘুমাইলি আর কেনরে বাংগালি
জাগরে এবার সময় যে আর নাই আইজো কি তুই বুঝবি নারে বাংলা বিনে গতি নাই।।”
ওইখানেই শুনি:
“রাখতে বাংলা তোমার মান ফাঁসির কাষ্ঠে দিমু জান লইতে বুকে গুলি না ডরাই
বলরে মোমিন বলরে সবে রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই।”
ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতার সংগ্রাম। কুড়ি বছরের রক্তাক্ত পথযাত্রা। কুড়ি বছর বড় একটা দুটো দিন না। আলতাফ মাহমুদ পঞ্চাশের দশকের শেষ থেকেই প্রাত্যহিক রাজনীতির সঙ্গে আর ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন না। সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে চলচ্চিত্রে যোগ দিয়েছিলেন।, “পয়াসা করেছিলেন।” কিন্তু পলটন ময়দানে প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারির মূল অনুষ্ঠানটি তাঁরই পরিচালনায় অনুষ্ঠিত হত। তিনি কেন্দ্রচ্যুত হন নি। তাই দু:শাসকদের সমস্ত ভ্রম্নকুটি উপেক্ষা করে ৬১ সালে রবীন্দ্রনাথ এবং ৭০ সালে লেনিনের জন্মশতবার্ষিকী উৎসবে তাঁকে তাঁর যোগ্য ভূমিকায়ই দেখা গেছে। তিনি কেন্দ্রচ্যুত হন নি। ৭১ সালে অসহযোগ আন্দোলনের সময় বিক্ষুব্ধ শিল্পীগোষ্ঠীর অনুষ্ঠান করতে তিনি রাস্তায়ও নেমেছিলেন। শহীদ দিবসে টেলিভিসনে গান গেয়েছিলেন:
“বাঙলার ভাষা বাঙালির আশা আহ্বান আনে তারি একুশে ফেব্রম্নয়ারি একুশে ফেব্রম্নয়ারি।”
তারপরেই মার্চ, তারপরেই আগস্ট, তারপরেই…
বাঙলাদেশের মাটিতে তিরিশ লক্ষ মানুষের রক্ত। বাঙলাদেশের মাটিতে দু লক্ষ ধর্ষিতা রমণীর অশ্রু। আর, একটা জাতির কল্পনাপরাস্তকারী বীরত্ব। এবং স্বাধীনতা। নতুন পতাকা, নতুন জাতীয় সঙ্গীত। বাঙলাদেশ কেন্দ্রচ্যুত হয়নি। ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের দিকে পৃথিবীর নবীনতম জাতি শুরু করেছে তার অভ্রান্ত জয়যাত্রা। কিন্তু কৃষক জমিতে লাঙ্গল দিতে এখনও ভয় পায়, কারণ মাটি খুঁড়লেই কঙ্কাল বেরোয়। জেলে নদীতে জাল ফেলতে এখনও ভয় পায়, কারণ বাঙলা-দেশে এমন কোনো নদী নেই, হাওর নেই যেখানে শত-সহস্র মৃতদেহ ভেসে যায় নি। রাস্তার ধারে কিছু পড়ে থাকলে লোকে ভয়ে ছোঁয় না, কারণ এমন তিনটে পরিত্যক্ত বস্তায় নাকি শুধু কয়েক হাজার মানুষের চোখ পাওয়া গিয়েছিল। স্বাধীনতার দুমাস পরেও নাকি পাক সৈন্যদের ফেলে যাওয়া মাইল ফাটে, গণকবর আবিস্কৃত হয়, বাঙ্কারে মেয়েদের ছেঁড়া ব্লাউজ পাওয়া যায়। বাঙলাদেশের পরতে পরতে রক্ত। এবারের একুশে ফেব্রুয়ারী তাই আরো বেশি রক্তাক্ত। (উনত্রিশে আগস্ট, ধরা পড়ার আগের দিন, আলতাফ মাহমুদ রাত নটায় বেরিয়ে এগারোটায় ফেরেন। ভাত খান নি। চাপা অস্থিরতায় ছটফট করেছেন। আলতাফ ভাই কি বুঝতে পেরেছিলেন বিশ্বাসঘাতকদের ষড়যন্ত্র তাঁকে ঘিরে ফেলছে? স্বাধীনতার দেড়মাস পরে, আঠাশে জানুয়ারি, হারিয়ে যাওয়ার আগের দিন সন্ধ্যায়, বদর বাহিনীর হাতে নিহত শহীদুল্লাহ কায়সারের বাড়িতে ‘স্টপ জেনোসাইড’ তথ্যচিত্রের পরিচালক কথাশিল্পী জহীর রায়হান অস্থির হয়ে বলেছিলেন এদেশে সি.আই.এর চক্রান্ত অব্যাহত আছে। সেই কালো হাত আমি পরিস্কার দেখতে পাচ্ছি। জহীর ভাইয়ের মৃত্যুসংবাদও কেউ ঠিকমতো দিতে পারে নি। ওঁর স্ত্রী সুচন্দাও বিশ্বাস করেন: জহীর রায়হান বেঁচে আছেন। আমার চোখে ‘স্টপ জেনোসাইড’ এর শেষ দৃশ্যটি ভেসে ওঠে। আমি মনে মনে চীৎকার করে বলি: জহীর ভাই নিশ্চয়ই বেঁচে আছেন। এবারের একুশে ফেব্রুয়ারী তাই আরো বেশি রক্তাক্ত। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিকসন ঐদিন পিকিং শহরে মাও-সে-তুংয়ের সঙ্গে কর-মর্দন করবেন। আর চীন ও মার্কিন অস্ত্রে বিধ্বস্ত ঢাকা শহরের শহীদ মিনারে লক্ষ কণ্ঠের গান শুনতে শুনতে ঐদিন আমরা সামনে জহীর ভাইকে দেখব, আলতাফ ভাইকে দেখব। তারপর ইতিহাসের সঙ্গে গলা মিলিয়ে গাইব: আমি কি ভুলিতে পারি।
পরিচয়
একুশে ফেব্রম্নয়ারি সংখ্যা
বর্ষ ৪১ সংখ্যা ৬-৭
পৌষ-মাঘ ১৩৭৮