গলায় সুর যাই থাকুক,কণ্ঠে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’র সুর প্রথম ধারণ করে প্রথম গাওয়ার কথা এখনো স্পষ্ট মনে আছে। আজ থেকে ৪০ বছর আগের কথা। ১৯৭৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি প্রথমবারের মতো প্রভাতফেরিতে গেয়েছিলাম। প্রথম কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে গেয়েছিলাম ‘আ. আ.. আ… আ. আ.. আ…’ এখন ভাবলেও বিস্ময় জাগে যে জীবনের প্রথম সেই প্রভাতফেরি করে খোলা পায়ে আমাদের মতো শিশুরা শহীদ মিনারে যেতে পারেনি। কেন পারেনি সেটা সালটা আরেকবার দেখলেই বোঝা যাবে। ময়মনসিংহের কলেজ রোডে আমরা ছিলাম শহীদ স্মৃতি অঙ্গনের কচিকাঁচা সদস্য। তখন বুঝিনি,পরে বুঝেছি যে ওই ক্লাবটির যারা সংগঠক ছিলেন, সেই আলম ভাইরা বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর প্রতিবাদী কণ্ঠ হয়েছিলেন। জেনারেল জিয়াউর রহমানের পুলিশ তাই খুঁজছিলো তাঁদের। শহীদ স্মৃতি অঙ্গনের প্রভাতফেরিতে আলম ভাইরাও থাকতে পারেন ভেবে পুলিশ আমাদের শোভাযাত্রাটি ভেঙে দিয়েছিলো। শহীদ স্মৃতি অঙ্গন থেকে যাত্রা করে আনন্দমোহন কলেজ পার হওয়ার পরই হামলা হয়েছিল শিশুদের ওই প্রভাতফেরিতে। টাউন হল চত্বরে শহীদ বেদি তখনো কিছুটা দূরে। আমার মতো সাত বছর বয়সি কিংবা কিছুটা বড় শিশু-কিশোররা সেদিন প্রভাতফেরি করতে না পেরে পরে কলেজ মাঠে ক্রিকেট খেলতে নেমে যাই। ওই সময়ের রাষ্ট্র হয়তো এটাই চেয়েছিল। অমর একুশের অনুষ্ঠানের চেয়ে ক্রিকেটই অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ! যেমন পরের বছরগুলোতে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান ভুলিয়ে দিতে স্বাধীনতা দিবস,বিজয় দিবস এবং নতুন করে পালনের ‘বিপ্লব ও সংহতি দিবস’-এ স্টেডিয়ামের মার্চপাস্টে কিংবা স্কুলের অ্যাসেম্বলিতে আমাদের ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ স্লোগান শেখানো হয়েছে। ‘জয় বাংলা’ আর ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’-এ অর্থগত বড় কোনো পার্থক্য না থাকুক,‘জয় বাংলা’কে ভুলিয়ে দিতে পাকিস্তানি কায়দায় যখন শিশু-কিশোরদের ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ শেখানো হয় তখন এর চেতনাগত পার্থক্যটি বোঝা যায়। জাতির জনক নিহত হওয়ার পরের বছর আমার মতো যাদের স্কুলে ভর্তি হওয়া তাদের এভাবে বিরুদ্ধ এক পরিবেশে বড় হওয়া। তাদের বড় অংশ তাই অমর একুশের গানের অমর সুরস্রষ্টা আলতাফ মাহমুদকে চেনেনি। কেউ কেউ নাম জানলেও তাঁকে আর যেকোনো সুরকারের মতোই মনে করেছে ওই প্রজন্ম। যে চেতনা থেকে ওই গানের সুর করা,যে চেতনার বাণী মর্মমূল ছুঁয়ে যাওয়ার কারণে ওই গান আমাদের হৃদয়ে এমনভাবে গাঁথা;ওই প্রজন্মকে তখন কোনোভাবেই সেই চেতনায় স্নাত হতে দেওয়া হয়নি। যে আলতাফ মাহমুদ তাঁর সুর দিয়ে শহীদদের ভুলতে দেননি সেই আলতাফ মাহমুদের আত্মত্যাগও তাই অজানা ছিল বছরের পর বছর। আলতাফ মাহমুদ,তাঁর মানবিকতা,মানবিকতা থেকে তাঁর গৌরবের বীরত্ব,বীরত্ব থেকে তাঁর মহান আত্মত্যাগ;এসবই আমাদেরকে প্রথম জানিয়েছেন বারবার যিনি আমাদের বাতিঘর হয়েছেন;এখনো বাতিঘর হয়ে আলোর পথ দেখিয়ে যাচ্ছেন সেই শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। কোনো পাঠ্যপুস্তক কিংবা অন্য কোনো বই না,তাঁর ‘একাত্তরের দিনগুলি’ থেকেই আমি,আমার মতো আমাদের প্রজন্মের আরো অনেকে প্রথমবারের মতো আলতাফ মাহমুদকে জানতে পারি,কিছুটা চিনতেও পারি হয়তো তাঁকে। শহীদ আলতাফ মাহমুদের সঙ্গে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের এখানে একটা অসাধারণ মিলও আমি খুঁজে পাই। জাহানারা ইমাম যদি শুধু ‘একাত্তরের দিনগুলি’ লিখেই বসে থাকতেন,বাংলাদেশ আর যুক্তরাষ্ট্রে আয়েশি জীবন যাপন করতেন;তবু তিনি তাঁর ‘একাত্তরের দিনগুলি’ লেখার মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের এক অসাধারণ আখ্যান তুলে ধরার কারণেই অমরত্ব পেতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। বাহাত্তরের ১৭ মার্চ বঙ্গভবনের সামনে প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি তুলে ধরার মাধ্যমে তিনি যে আন্দোলনের ভ্রুণের জন্ম দিয়েছিলেন সেই আন্দোলনকে তিনি পরে সারাদেশে ছড়িয়ে দিয়ে প্রবল আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। তার ধারাবাহিকতাতেই আজ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। একইভাবে আলতাফ মাহমুদ শুধু ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটির সুর করেই অমরত্ব পেয়েছিলেন। কিন্তু,অন্য মধ্যবিত্তের মতো শুধু সেখানেই থেমে থাকেননি তিনি। যে আদর্শ ধারণ করার কারণে,মানুষকে নিজের সবটুকু দিয়ে ভালোবাসার কারণে তিনি সাধারণত্ব থেকে বেরিয়ে অসাধারণ এক সুরের জন্ম দিতে পেরেছেন;সেই ভালোবাসা,সেই চেতনাকে ধারণ তাঁকে সেখানেই থামিয়ে রাখেনি। তিনি নিজেকে জড়িয়েছেন মানুষের মহত্ত্বম আদর্শের মুক্তির জন্য সংগ্রামে। সেই সংগ্রামের পথে একাত্তরে নৃশংসতার সব বেদনা নিজে ধারণ করেছেন, মানুষের সবচেয়ে বড় সম্পদ যে জীবন সেই জীবন উৎসর্গ করে গেছেন আলতাফ মাহমুদ। তাঁর ত্যাগ এবং বীরত্বের প্রতীকী প্রকাশ আমরা কিছুটা ‘গেরিলা’ সিনেমায় দেখেছি। আলতাফ মাহমুদের চরিত্র রূপদানকারী অভিনেতা আহমেদ রুবেল যখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সামনে বলেন,‘আমিই আলতাফ মাহমুদ’ তখন মনে হয় এর চেয়ে সাহসের সঙ্গে আর কেউ,আর কোনো অভিনেতা বলতে পারতেন না। কিন্তু,আলতাফ মাহমুদের অতীত যিনি জানেন,তাঁর সংগ্রামী ইতিহাস আর মানুষের জন্য তাঁর ভালোবাসার কথা যার জানা,তিনি বুঝতে পারবেন মৃত্যু নিশ্চিত জেনে এর চেয়েও সাহসী উচ্চারণ ছিলো তাঁর। সেই সাহসী মানুষগুলোর জন্যইতো আজ বাংলা,আজ আমাদের দেশ,আজ বাংলাদেশ। কঠিন তত্ত্বে না গিয়েও বলা যায়,কিছু মানুষ মানুষের জন্য ভালোবাসা নিয়েই জন্ম গ্রহণ করেন যে ভালোবাসা পরে কোনো আদর্শ দ্বারা অনুপ্রাণিত এবং চালিত হয়। আলতাফ মাহমুদ সেরকম মানুষদের একজন। একটি জনগোষ্ঠীতে এরকম মানুষের সংখ্যা হয়তো খুব বেশি থাকে না। কিন্তু,একাত্তরে আমরাতো এ রকম শত-শত,হাজার-হাজার,লাখো সাহসী মানুষ পেয়েছি। সেটা সম্ভব হয়েছিল স্বাধীনতার জন্য রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক সংগ্রামের ধারাবাহিকতায়। সাংস্কৃতিক সংগ্রাম হয়তো কখনো কখনো রাজনীতিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে,কিন্তু মূলটা ছিলো রাজনীতিতে। আলতাফ মাহমুদের মতো মানুষ সাংস্কৃতিক সংগ্রামে সেই রাজনীতিটাকে ধারণ করেছিলেন অথবা সাংস্কৃতিক সংগ্রামে তিনি আসলে ছিলেন রাজনৈতিক এক শক্তির একক। সেই একক দশক হয়েছে,সহস্র হয়েছে,অযুত হয়েছে। কারণ একাত্তরের আগের দুই দশকে আলতাফ মাহমুদের মতো রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক সংগ্রামীরা বাঙালির মধ্যে বৈপ্লবিক এক পরিবর্তন নিয়ে আসতে পেরেছিলেন। সেরকম রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগ্রাম না থাকার কারণে বাঙালি মানস আসলে সেটাই যে বাঙালিকে আজ আমরা দেখছি। সাতচল্লিশের আগেও বাঙালির এ মানস ছিল,একাত্তরের পর আবার সেই মানস ফিরে এসেছে। মাঝের যে পরিবর্তন সেটা আসলে সেই রাজনৈতিক সংগ্রামের ফসল যে সংগ্রামে রাজনীতিকে সবার উপরে ধারণ করে সাংস্কৃতিক সংগ্রামে ছিলেন আলতাফ মাহমুদ এবং ছিল মানুষের জন্য তাঁর এবং তাঁদের ভালোবাসা।