শহীদ আলতাফ মাহমুদের জীবনকাহিনী অবলম্বনে
অমিত গোস্বামীর উপন্যাস
আলতাফ
উৎসর্গ
বাংলাদেশের আগামী প্রজন্মকে যারা এখনো মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস সম্পর্কে অবহিত নন।
লেখক সম্পর্কে
জন্ম ২৬ মার্চ, ১৯৬২, কলকাতায়। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নৃতত্ত্বে এম এস সি। বিপণন বিশেশজ্ঞ। কর্পোরেটে চাকরী জীবন বর্তমানে শেষ পর্যায়ে।
প্রকাশিত কবিতা সংকলন – রূপসারি ( সপ্তর্ষি প্রকাশন, কলকাতা ), রিমি তোকে (প্রিয়মুখ, ঢাকা) বাংলাদেশে হৃদয় মেশে (প্রিয়মুখ, ঢাকা), চরিত্রহীনের পদাবলী ( ই সংস্করন, পূর্বপশ্চিম প্রকাশনা, কলকাতা)
প্রকাশিত উপন্যাস – যখন বৃষ্টি নামল ( নন্দিতা প্রকাশ, ঢাকা) এবং (সপ্তর্ষি প্রকাশন, কলকাতা)
সম্মাননা – বাংলাদেশ জাতীয় কবিতা উৎসবে আমন্ত্রিত ভারতীয় কবি হিসেবে অংশগ্রহন।
পশ্চিমবঙ্গ শিল্প- সাহিত্য- সংস্কৃতি সম্মান – সেরা কবি, ২০১৫
সংপৃক্ততা – পূর্বপশ্চিম পত্রিকার সম্পাদক। ‘আমাদের সময়’ ও ‘ভোরের কাগজ’ এ নিয়মিত উপসম্পাদকীয় রচনা।
ভারত ও বাংলাদেশের প্রথম সারির সাহিত্য পত্রিকায় নিয়মিত রচনা প্রকাশ।
কলকাতায় স্ত্রী কাবেরী, মা গৌরীকে নিয়ে নিপাট সংসার। কন্যা অয়ন্তী বৈবাহিক সুত্রে দিল্লি প্রবাসী ও অনুবাদ সাহিত্যে ক্রমেই জামাতা অর্ঘ্যের উৎসাহদানে নাম করছে।
প্রিয়তম মানুষ নাতনী অরিমা। সাহিত্যসঞ্জাত সকল প্রাপ্তি রাখা আছে শুধু তারই জন্যে।
নিজস্ব ওয়েবসাইট – www.amitgoswami.in
ফোন – +৯১ ৯৯০৩০৫৫৪৪১
ই মেইল – agoswami441@gmail.com
লেখকের বক্তব্য
শহীদ আলতাফ মাহমুদ আমার স্বপ্নের নায়ক। বাংলাদেশে আমার পা দেওয়ার আগেই তিনি একজন বিপ্লবী হিসেবে আমার মনের মণিকোঠায় স্থান করে নিয়েছিলেন। বিধির বিধান একেই বলে… কারণ বাংলাদেশে পা রাখার প্রথম দিনেই আমার পরিচয় ঘটে শহীদ আলতাফ মাহমুদের পরিবারের সাথে। আজ আমি তাদের পরিবারের একজন। তাই মুগ্ধতা ছিল। কিন্তু আলতাফ মাহমুদ নিয়ে লেখার স্পর্ধা ছিল না। কিন্তু আমাকে প্রথম সাহস দেন আলতাফ মাহমুদের স্ত্রী সারা আরা মাহমুদ। বললেন – তুই লেখ, নিজের মত করে। এগিয়ে এলেন শাওন – আলতাফ কন্যা। নাসিরুদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু – বাংলাদেশের আরেক সূর্যসন্তান। আমার দিদি শিমুল ইউসুফ।
কোন মহান চরিত্র নিয়ে উপন্যাস লেখা খুবই কঠিন। কারণ ঔপন্যাসিক স্বাধীনতা থাকে না। কাহিনীকে মুচমুচে করতে কল্পনার আশ্রয় খুব কম জায়গায় নেওয়া যায়। শুধু সত্যি ঘটনার বিবরন দিতে হয়। সেখানে ভুল ভ্রান্তি থাকলে সেটার জন্যে তীব্রভাবে সমালোচিত হতে হয়। তাই বাংলাদেশে অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তান আলতাফ মাহমুদের জীবন অবলম্বনে এই উপন্যাস লিখতে গিয়ে বিস্তর সমস্যায় পড়তে হয়েছে। বারেবারে আন্তর্জাতিক কল করতে হয়েছে শাওন ও শাওনের স্বামী সায়িদ হাসান টিপুকে। সবার সাহায্য নিয়ে চেষ্টা করেছি এই উপন্যাসকে একটি অবয়ব দেওয়ার।
কিছু জায়গায় তথ্য নিশ্চিত নয়। কিছুটা অস্পষ্ট। সেখানে অবশ্যই শোনা কথা ও কল্পনার আশ্রয় নিতে হয়েছে। কারণ আমি ইতিহাসবিদ নই। জীবনী লিখি নি। উপন্যাস লিখেছি। ঔপন্যাসিক কিছু স্বাধীনতা নেবেই। তবে তা আলতাফ মাহমুদের পরিবারের অনুমতি সাপেক্ষে।
এই ধরনের কাহিনীতে চিত্রকল্প সৃষ্টির সুযোগ খুব কম। কাহিনীর পরম্পরা বিবৃত করা ছাড়া অন্য কিছু করার নেই। আমি শুধু সেটাই করতে চেয়েছি। একটু নিখুঁতভাবে। পাঠকের যদি মনে হয় সেটুকু করতে পেরেছি তাহলেই আমি ধন্য। সাহিত্য মুন্সীয়ানা দেখানোর সুযোগ তো পরে মৌলিক রচনায় থাকবেই।
সাহায্য নিয়েছি কিছু বইয়ের। যেমন জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’, দীনু বিল্লাহের ‘সুরের বরপুত্র আলতাফ মাহমুদ’, শিমুল ইউসুফের বিভিন্ন স্মৃতিকথা, শাহরিয়র কবীরের সম্পাদনায় ‘একাত্তরের দুঃসহ স্মৃতি’, রফিকুল ইসলামের ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম’। এছাড়া সারা আরা মাহমুদের ব্যক্তিগত স্মৃতিচারন এই বইয়ের মূল ভিত্তি।
আলতাফ
( ১)
ঢাকায় সবে সন্ধ্যে নেমেছে । মালিবাগ মোড় থেকে একটু এগিয়ে গেলেই আউটার সার্কুলার রোড। এই আউটার সার্কুলার রোডের ৩৭০ নং বাসাটি আজ বেশ চুপচাপ। অন্যান্য দিন সন্ধ্যেটা গমগম করে বন্ধুদের ভিড়ে। কে আসেন না সে আড্ডায়। শফিউল্লা চৌধুরী, বদিউজ্জামান নাসিম, আবুল ফখরুদ্দিন, শাহরিয়র কবির, মির্জা আব্বাস… শিল্পী, কবি, সাংবাদিক, রাজনীতিক… হরেক কিসিমের মানুষের ভিড়ে আড্ডা গড়ায় রাত অবধি। আজ কেউ নেই। তাই বাসাটা আজ বেশিরকমের শান্ত।
দেওয়ালে ঝোলানো ক্যালেন্ডারটা পাতাটা লাট খাচ্ছে। ক্যালেন্ডার আজকের তারিখটা জানাচ্ছে তীব্রভাবে আজ ২৫ মার্চ, ১৯৭১। হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। দরজা খুললেন গৃহকত্রী আমেনা বিল্লাহ।
– কি অবস্থা বাবা, কাকে চাই?
– আমরা উল্টোদিকের রাজারবাগ পুলিশ লাইনের লোক। আলতাফ ভাইকে একটু ডেকে দিন। কথা ছিল।
আমেনা হাঁক পারলেন- আলতু, আলতু, তোমাকে এঁরা ডাকছেন। কন্যা শাওনকে বুকে নিয়ে হেঁটে এল আলতাফ। পরনে পা’জামা আর একটা হাফ হাতা গেঞ্জি।
– কি হয়েছে ভাই?
– আলতাফ ভাই, আমরা রাজারবাগ পুলিশ লাইনের পুলিশ। একটু কথা ছিল।
– বলেন।
– আপনি তাড়াতাড়ি পরিবারসহ নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান।
– কেন? কি হয়েছে?
– জানেন তো আজ মুজিব ইয়াহিয়ার আলোচনা ব্যর্থ হয়েছে। এরপরে ভুট্টোর সাথে সলাপরামর্শ করে ইয়াহিয়া প্রেসিডেন্ট ভবনের পিছনের দরোজা দিয়ে সাদা পোষাকে বিমান বন্দরে চলে গেছেন।
– সে কী! প্রেসিডেন্ট পালিয়ে গেছেন?
– হ্যাঁ। আর তার পরেই ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের পাক সেনারা বেঙ্গল রেজিমেন্টের সব বাঙালি অফিসারদের গ্রেফতার করে নিরস্ত্র করে বন্দী করেছে। কিছু অফিসারকে মেরে ফেলা হয়েছে। কিছু অফিসার পালাতে পেরেছে। ই পি আর, আনসার বাহিনীর সদস্যরা অস্ত্র নিয়ে পালিয়েছে। কাজেই পরিস্থিতি ভাল না। আজ রাতেই সেনা আক্রমন হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি।
– তা এ পরিস্থিতিতে আপনারা কি করছেন?
– আমরা পুলিশ লাইনের অস্ত্রের গুদাম ভেঙে রাইফেল ও গুলি নিয়ে নিয়েছি। একটু পরেই আমরা সব দালান বাড়ির ছাদে, নর্দমা খালে, মতিঝিল, শান্তিরনগর বাজার, চামেলিবাগ,শাজাহানপুর, মালিবাগ, সিদ্ধেশ্বরি সব জায়গায় পজিশন নেব।
– কিন্তু পাকি সৈন্যদের আধুনিক স্বয়ংক্রিয় আছে। সব ধরনের যুদ্ধ সরঞ্জাম মজুদ। কি করে লড়বেন ওদের মুখোমুখি?
– পালটা লড়াই তো দিতে হবে আলতাফ ভাই। না হলে তো ওরা নির্বিচারে সাধারন মানুষদের হত্যা করবে। এরমধ্যে দেখেন নি জয়দেবপুরে মিলিটারি পাবলিকের ওপর গুলি চালিয়েছে। টঙ্গী, নারায়নগঞ্জে।
– তা বটে। কিন্তু আমায় কি করতে বলেন।
– সামনের বাসার লুতফর রহমান সাহেবরে আপনার বাসায় আসতে বলেছি। আপনি তাদের ও আপনার পরিবার নিয়ে পিছনে মান্নান সাহেবের বাসায় আশ্রয় নেন। আপনার ছাদটা আমাদের ফ্রী করে দেন। আমরা ছাদে পসিশন নেব।
– তা নয় দিলাম। কিন্তু আমার স্টকের পেট্রল ! যুদ্ধ লাগলে ওগুলো দিয়েই তো পেট্রল বোমা বানাতে হবে যে।
– সে কী। বাসায় পেট্রলের স্টক? কই আপনার স্টক?
আলতাফ তাদের নিয়ে এল পিছনের একটা বাতরুমে। বাতরুমটা ব্যবহার হয় না। এখানে ধীরে ধীরে প্রচুর পেট্রল জমিয়ে রেখেছেন আলতাফ। তার মনে হয়েছে যদি যুদ্ধ লাগে তাহলে পেট্রলের স্টক প্রয়োজন হবে। বোমা বানাতে পেট্রলের জুড়ি নেই। যা পেট্রল ইতিমধ্যে মজুত হয়েছে তাতে এই বাসা কেন পাড়া শুদ্ধ উড়ে যেতে পারে। সেই স্টক দেখে চমকে উঠল আগন্তুকরা।
– বাপ রে! এত্তো! এক কাজ করেন। বাড়ির যত লেপ তোষক, কান্থা, ছালা, পুরান কাপড় নিয়া আসেন। জল দিয়া ভিজায় দেই। দিয়া মুড়ায় দিলে সমস্যা হইব না।
– আমি কিন্তু বাসায় থাকব। বাকিদের মান্নান সাহেবের বাসায় পাঠায় দেই।
– না থাকলেও চলত। আমরা তো থাকবই। আরেকটা কথা, আপনার ছাদে যে কাল পতাকা আর বাংলাদেশের নতুন সবুজ লাল পতাকা টাঙানো আছে ওটা নামায় নেন। নাইলে পাক্কিগুলান আপনার বাসা তাক কইরা বেমক্কা গুলি চালাইতে পারে।
পেট্রলের জারগুলিকে লেপ তোষকে মুড়ে পানি দিয়ে ভিজিয়ে আলতাফ যখন বাতরুম থেকে বেরোল ততক্ষনে সাড়ে ন’টা বেজে গেছে। ছেলে, মেয়ে ও নাতনীকে রাতের খাবার খাইয়ে মা আমেনা আলতাফের খাবার বেড়ে দিলেন। স্ত্রী ঝিনু এসে পাশে বসল।
– তুমি একা থাকবে?
– কেন তুমি থাকতে চাও আমার সাথে?
– তা কি করে হবে? শাওন আছে না! তুমি বরং আমাদের সাথে চলো।
– তা হয় না ঝিনু। এই পেট্রলের জারগুলো বাঁচাতে হবে। সমানে জল ঢালতে হবে ওপরের কাপড়গুলোতে।
ঝিনু আর কথা বাড়াল না। শাওন ‘বাব্বা, বাব্বা’ বলে বারকয়েক কাঁদল। কিন্তু সেও যেন বুঝে গেছে কিছু একটা ঘটতে চলেছে। মা আমেনা এঁটো বাসন তুলে সবাইকে নিয়ে চললেন সাবেক খাদ্যমন্ত্রী আব্দুল মান্নানের বাসায়।
রাত দশটা নাগাদ রাতের অন্ধকারে ছাদে পজিশন নিল রাজারবাগ পুলিশ লাইনের দুই জওয়ান। একজনের নাম সালেক অন্যজন নাসির। হাতে থ্রী নট থ্রী রাইফেল ও বেশ কিছু কার্তুজ। আলতাফ ছাদে এসে ওদের পাশে বসল।
– এভাবে বইসেন না ভাই, আপনে যা লম্বা, আপনারে দেখতে পাইবো তো পাইক্কারা। আপনে বরং শুইয়া পড়েন।
– পাকিরা আসবে কি না তার ঠিক নেই। আর আপনারা আগে থেকে যেভাবে বলছেন…
– দ্যাখেন ভাইয়া, যা ঘটতাসে রোজ রোজ তারে আপনে কি কইবেন? সাদা গাড়িত কালা পতাকা উড়াইয়া শ্যাখ মুজিব রোজই যাইতাসেন প্রেসিডেন্টের লগে আলোচনা করতে। আলোচনা তো আউগায় না। এদিকে প্লেনে কইরা রোজ সাদা পোশাকে হাজারে হাজারে সেনা নামতাসে। চট্টগ্রামে অস্ত্র ভর্তি জাহাজ ভিড়সে। দ্যাশের প্রেসিডেন্ট ঢাকায় হাজির অথচ দ্যাশ চলতাসে শ্যাখের কথায়। অফিস আদালত ব্যাঙ্ক সব খুলতাসে শ্যাখের কওয়া সময়ে। এ তো পুরাই রাস্ট্রদ্রোহিতা।
– তা বটে।
– সরকারের হ্যানস্থা কি কম হইতাসে? টিক্কা খানরে কুনো বিচারপতি শপথ পড়াইল না বইলা হে গভর্নর হইতে পারল না। অহন হে মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর। ওরা হুদ্দাই সময় নিসে ? আমাগো ছাড়বো ভাবসেন? শ্যাখ সাহেব বড্ড দেরী কইরা ফালাইলেন। স্বাধীনতাডা ঘোষনা কইরা দিলেই হইত ৭ তারিখেই।
– না, না, শেখ সাহেব ঠিক পথেই আন্দোলন চালাচ্ছেন। অসহযোগ আন্দোলন চালিয়ে জনগন তাদের দাবী ঠিকই আদায় করবে।
– সেই গুড়ে হিমালয়। ইন্ডিয়াতে গান্ধী করসিলো না? সাহেবরা মানসিলো? সুভাষ বোস তার বাহিনী লইয়া ব্রিটিশ গো পুটকিত হান্দাইসিল বইলা না হেরা ভাগল। তাও দ্যাশরে কাইটা ছাঁইটা।
– না, না, তবু এ আন্দোলন এখন অবধি ঠিক পথেই এগোচ্ছে। আবেগে ভর করে তো স্বাধীনতা ঘোষনা করা যায় না।
ঝপ করে হঠাৎ আলো নিভে গেল। রাত এগারোটা। ঢাকা শহর ঢাকা মুড়ে গেল কালো শামিয়ানায়। স্পষ্ট কিছুই দেখা যাচ্ছে না। রাজারবাগ পুলিশ লাইন তবু অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কিন্তু শান্তিনগর বাজার, চামেলিবাগ, শাজাহানপুর, মালিবাগ… সব ডুবে গেছে কালো অন্ধকারে। আলতাফ জিজ্ঞাসা করল-
– ওরা কি এখনই আসবে?
– না, না, হেরা আইতে আইতে অখনও একঘন্টা। পুর্ণিমা গেসে পাঁচদিন আগে। আধাঘন্টার মধ্যে চাঁদ উঠব। তার আগে আইয়া মারব ক্যামনে? আলো কই? দ্যাখবে ক্যামনে?
– বাবা, এত বিচার করে মানুষ মারতে আসে নাকি কেউ?
– আর্মিতে হেইডাই ট্রেইনিং। পুর্ণিমা, অমাবস্যা, জোয়ার, ভাটা, বাতাসের গতি সব হিসাবে রাখতে হয়।
– আমরা তো এগুলোর কিছুই জানি না।
– জানবেন ক্যামনে? আপনারা কি ট্রেইনিং পাইসেন? যেমন ধরেন আজ আপনার অ্যাত্তো ত্যালের ড্রামে কিছুতেই আগুন ধরব না। ক্যান কন তো?
– কেন?
– আজ বাতাসের উলটা গতি। সামনে যদি আগুনও লাগাইয়া দেয় তাও হেই আগুন আপনার বাতরুম অবধি যাইব না। আমরা যদি বুঝতামই আগুন লাগনের চান্স আছে তাইলে আমরা এই ছাদে বইতাম? কারণ আগুন লাগলে বার্স্ট করবই। যা পেট্রল মজুদ করসেন! বাপ রে!
– বাহ। তাহলে তো ভয়ের কিছু নাই।
– পেট্রল নিয়া ভয়ের কিছু নাই। কিন্তু পাইক্কারা যদি সরাসরি গুলি চালায় তাইলে তো আপনে সোজা বেহেস্তো। লগে আমরাও। ভাইয়া, ওই দ্যাহেন, দ্যাহেন আর্মি আইতাসে। নিচু হইয়া চুপচাপ দেইখ্যা যান।
আলতাফ মুখ ঘোরাল মালিবাগের দিকে। চোখে পড়ল কিছু গাড়ির ক্ষীন আলো। ধীরে, অতি ধীরে এগিয়ে আসছে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের দিকে। একটি দু’টি নয়, প্রায় পঞ্চাশ ষাট’টা। গাড়ি এসে থামল রাজারবাগ এক নম্বর গেটে। কোন আগাম নোটিশ ছাড়াই অতর্কিতে গর্জে উঠল সামনের কামানটি। রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে খানখান হয়ে গেল। আর্মিবাহিনীর ভারী মেশিনগানের অজস্র গুলি ছুটে যাচ্ছে রাজারবাগের ভিতরে। এরই ফাঁকে একটি রাইফেলের গুলির শব্দ শুনল আলতাফ। পাশেই সালেক ও নাসিরের রাইফেল গর্জে উঠল। আলতাফ বুঝল আগের রাইফেলের গুলিটি ছিল প্রতিরোধী পুলিশদের দুলিচালনা শুরু করার সংকেত। আলতাফ মাথা আরো নীচু করল, কিন্তু দৃষ্টি সরালো না। খানসেনাদের গাড়ীর ক্ষীন আলোতে দেখল অনেক পাক সৈন্য গড়িয়ে পড়ছে রাস্তায়। আনন্দে আলতাফের চিৎকার করতে ইচ্ছে হল। কিন্তু যখনই দেখল রাজারবাগে নর্দমা খালে পুলিশের উর্দিপরা মৃতের স্তুপ তার গা কেমন যেন গুলিয়ে উঠল। সমানে ট্যাঙ্ক অগ্নিগোলা নিক্ষেপ করছে এদিকে সেদিকে। যে খুশি মরুক। দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে রাজারবাগ পুলিশ ব্যারাকে। কিছু পুলিশ আগুনের আলোয় পালাতে গেল কমলাপুরের দিকে। মেশিনগানের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেল তারা। সময় এগিয়ে চলেছে। রাস্তায় কিছু সেনাদের ট্রাক অচল হয়ে পড়ে আছে। ট্যাঙ্ক সেগুলেকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল রাস্তার পাশে। কিছু ট্রাকে খানসেনাদের লাশ তোলা হল। এক খানসেনা রাস্তার ধারে পড়ে চিৎকার করছিল – মুঝে বাঁচাও, মুঝে বাঁচাও বলে। আহত সেনাদের দিকে কারোর ভ্রুক্ষেপ নেই। তারা একে একে ভেঙে ফেলল রাজারবাগ পুলিশ মেস, ইনডোর ক্লাব, মসজিদ। সেই মসজিদের মুয়াজ্জিম যার সুরেলা কন্ঠের আজানের জন্যে সে আলতাফের প্রিয় পাত্র ছিল, সে – হাম মুয়াজ্জিম, হাম মুয়াজ্জিম বলে বাইরে বেরোতেই তাকে ফুঁড়ে দিল পাক সেনাদের গুলি। মুয়াজ্জিম তো কী, ব্যাটা বাঙালি তো। প্রথম প্রতিরোধে কিছুটা পিছু হটলেও আক্রমনের তীব্রতা এখন দ্বিগুন করেছে পাক বাহিনী। চারিদিকে বোমার বুমবুম শব্দ। মেশিনগানের ঠাঠা আওয়াজ। গোলাগুলি, ট্রেসার হাউই রঙধনু সৃষ্টি করছে আকাশে। দূর থেকে চিৎকার ভেসে আসছে। উত্তরে দক্ষিনে পূর্ব পশ্চিমে সবদিকেই দূরে আগুনের স্তম্ভ ক্রমেই স্পষ্ট ও আকাশমুখী হয়ে উঠছে। এরমধ্যে কৌশলগত ভাবে পুলিশ বাহিনী আক্রমনের তীব্রতা কমিয়ে দিল। কারণ অত্যাধুনিক অস্ত্রের সাথে এই রাইফেল দিয়ে আর টানা যাবে না। এবারে তাদের মিশে যেতে হবে জনতার ভিড়ে। নাহলে সমূহ সর্বনাশ। আলতাফ সালেকের গলা শুনল।
– ভাইয়া, লুঙ্গি টুঙ্গি কিছু আছে তো দ্যান।
– হ্যাঁ,হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। নীচে চলুন।
অস্ত্র ছাদেই ফেলে রেখে নীচে নামল সালেক ও নাসির। আলতাফকে বলল যে ব্যারেল ঠান্ডা হলে মাটির নীচে কিছু দিয়ে মুড়িয়ে পুঁতে ফেলতে। আলতাফ নিচে এসে তাদের দুটি নতুন লুঙ্গি আর জামা দিল।
– ভাইয়া, নতুন লাগব না, পরা লুঙ্গি নাই? আর পুরান জামা? নতুন দ্যাখলেও তো ধইরা ফালাইব।
আলতাফ খুঁজে পেতে পুরোনো সাজ পোশাকই দিল। দুইজন সেসব পরে পুলিশের উর্দি ছেড়ে আলতাফকে বলল –
– চলি ভাইয়া, উর্দিগুলান পুড়াইয়া দিয়েন আর রাইফেল দুইটা যা কইলাম। পুইত্যা দিয়েন।
পাকিস্তানে দু’বার সেনা অভ্যুত্থান দেখা আলতাফ কখনও ভাবেই নি নিরস্ত্র বাঙালিকে এভাবে হত্যা করে যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে দেওয়া যায়। জানলার ফাঁক দিয়ে সে চোখ রাখল। দেখল বড় রাস্তায় বাঙালি পুলিশের লাশ টেনে স্তুপ করা হচ্ছে। কিছুক্ষন বাদে সেগুলির ওপরে পেট্রোল ঢেলে দিল খানসেনারা। তারপরে দপ। আগুন জ্বালিয়ে দিল স্তুপাকৃতি লাশে। উত্তাপে জানলার পাশ থেকে সরে এল আলতাফ। কী বীভৎস! এক দেশ, এক জাতি, এক প্রাণ – যা যা জেনেছিল আলতাফ সব আজ তীব্র তাপে পুড়ে যাচ্ছে। আলতাফ অস্ফুটে বলল – আদিম হিংস্র মানবিকতার যদি আমি কেউ হই/ স্বজন হারানো শ্মশানে তোদের চিতা আমি তুলবই।
(২)
– ঝিলু, তুমি তো হুনছই যে মুই এইবার নির্বাচনে মালাদী থিক্কা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে মনোনয়ন দিসি।
– হ, শুনসি।
– আমি চাই তুমি ‘মর হইয়া এট্টু পরচার কর।
– হেইডা তো হয় না আব্বা, আমি আইসি মঠবাড়ীয়ায় মহিউদ্দিন আহমেদের হইয়া প্রচার করতে। আমারে হের লাইগাই পাঠাইসে।
– তা করো, কিন্তু লগে মুলাদীতে ‘মর হইয়াও পরচার করবা।
– আপনে যদি যুক্তফ্রন্টের হইয়া খাড়াইতেন আমি প্রচার করতাম। কিন্তু আমার তো এড্ডা নীতি আসে।
– যুক্তফ্রন্টের হইয়া খাড়নের চ্যাষ্টা কি আমি কম করসি। হেইডা হইল গিয়া জগাখিচুড়ি ফ্রন্ট। আওয়ামী মুসলিম লীগ, কৃষক শ্রমিক পার্টি আর নেজাম ই ইসলামী। উল্টামুড়ায় একলা মুসলীম লিগ। এই ফ্রন্ট কইরাই তো ভ্যাজাল বাদাইল।
– কিন্তু আব্বা, এছাড়া কি আর উপায় আছিল? মুসলীম লীগের লগে লড়তে হইলে কি ভোট ভাগ হইতে দেওয়া যায়? আপনে বরং নাম উঠাই লন।
– আব্বাডা ক্যাডা? তুমি না আমি? তুমি আমারে জ্ঞান দাও নাম উঠাইতে! তুমি ভোটার গো একবার কইলেই তুমি যার হইয়া ক’বা হেই জিতব। খন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস সাপ্তাহিক চিত্রালীতে কি ল্যাখসে পড়সো?
– না পড়ি নাই আব্বা, কি ল্যাখসে?
– ল্যাখসে ভাসানী-মুজিব-আলতাফ। পুব বাংলার তিনডা নাম, তিনডা পেত্যয়, তিনডা শক্তি। তাইলে বুঝলা ক্যান তোমারে কইতাসি তুমি বাপের জইন্য পরচারে আহ।
– না আব্বা। ‘মরে মাফ করেন। আমি যুক্তফ্রন্টের ক্যান্ডিডেটের হইয়াই পরচার করব।
– ‘মর হইয়া করবা না?
– না আব্বা, কইলাম তো, পারমু না।
– তবে তুমারে আমি ত্যাইজ্য পুত্র করমু।
– করেন।
নাজেম আলী রাগে গর্জাতে গর্জাতে স্থান ত্যাগ করলেন। নাজেম আলী হাওলাদার। বরিশাল জেলার মুলাদী থানার পাতারচর গ্রামে বাস। গোঁড়া মুসলিম। আদালতের পেশকার। ভরপুর পয়সা। জেলা বোর্ডের সেক্রেটারীও হয়েছেন। এবারে তাঁর নতুন খোয়ায়েস জনপ্রতিনিধি হবেন পাকিস্তানের। নাজেম আলীর চার স্ত্রী। এই ঝিলু নাজেম আলীর তৃতীয়া স্ত্রীর সন্তান। কিন্তু মা অপ্রকৃতিস্থা বলে মানুষ হয়েছেন নাজেম আলীর চতুর্থা স্ত্রীর কাছে। কিন্তু ঝিলু বড্ড বেয়ারা প্রকৃতির। গ্রামের বাড়িতে রাখা যায় নি। দুরন্ত ঝিলু যেন অন্যান্য শিশুদের কাছে রূপকথার নায়ক। সারাদিন টো টো আর গানের সুরে আশপাশ মাতিয়ে তোলা। সারাক্ষন ঝিলুর মুখে খালি গানের কলি। রেডিওর জনপ্রিয় গানগুলি মুহুর্তে তুলে ফেলে সবাইকে শুনিয়ে তাক লাগিয়ে দিত। মাঝে মাঝেই সঙ্গী সাথী নিয়ে ঝিলু গায়েব। কীর্তনখোলা নদীর পারে বড় ঘাস ঝোপে একটু উঁচু বেদীতে বসে ঝিলু একটার পর একটা গান গাইছে বাকিরা সব মুগ্ধ হয়ে শুনছে। মেরে মীত রে, মেরে মিতোওয়া…। এমন ছেলের সাথে মিশলে তো গ্রামের ছেলেরা সব গোল্লায় যাবে। অভিভাবকরা ভয় পেয়ে নাজেম আলীর কাছে অভিযোগ জানাতে এলেন। নাজেম আলী নেমে এলেন উঠোনে। বসলেন চেয়ারে। দাঁতের ফাঁক দিয়ে পিচ করে মাটিতে থুতু ফেললেন। এবার তাকালেন উঠোনে বিশাল কাঁঠাল গাছের দিকে। সেখানে ছুরি দিয়ে লেখা – ঝিলু দি গ্রেট। পাশের নারকেল গাছের গোড়ায় একই কথা লেখা। উচ্ছসিত প্রত্যয়ের সোচ্চার আত্মপ্রকাশ।
– কন আপনারা, কি অভিযোগ লইয়া আইসেন।
– মিয়াসাব, ঝিলুরে এট্টু সামলান। হে তো গানবাদ্যির মেহফিল বানায় ফালাইতাসে গ্রামডারে। পোলাপানরে তো আর সামলান যায় না।
– জানি, জানি, ভাইবেন না। আমি হেরে নিয়া যাইতাসি বরিশাল শহরে। ক্কারী সাহেবরেও ঠিক করসি। তাইনে ঝিলুরে আরবি আর কোরআনের ছুরা তেলাওয়াত শিখাইবেন।
– বাহ। বাহ। সঠিক সিদ্ধান্ত।
বরিশাল শহরে এসে কিছুদিন ঝিলু বেশ চুপচাপ ছিল। প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে প্রাতরাশ সেরে কোরআন তেলাওয়াত করত। ক্কারী সাহেব আসতেন। তিনি খুব খুশি এই নতুন ছাত্রকে নিয়ে। তিনি নিজেও সুকন্ঠের অধিকারী। কিন্তু ঝিলুর কন্ঠে নানা ধরনের এলহান স্বচ্ছন্দে খেলা করত। তিনি নিয়ম করে কোরআন শরিফ থেকে সুরাগুলি মুখস্থ করাতেন। শুক্রবার থাকত বিশেষ দিন। ক্কারী সাহেব তাকে মসজিদে নিয়ে তেলাওয়াত করাতেন। ঝিলুকে নিয়মে বেঁধে তাকে মস্ত ক্কারী বানানোর স্বপ্নে তিনি মশগুল। এমনই একদিন ক্কারী সাহেব এসেছেন। ঝিলু তেলাওয়াত করবে। ক্কারী সাহেব শুনবেন। নাজেম আলীও এসে বসলেন। সম্প্রতি এক মামলা থেকে রক্ষা পেয়ে নাজেম আলী ধর্মের দিকে বেশ ঝুঁকেছেন। ঝিলু তেলাওয়াত শুরু করল। তার সুরেলা কন্ঠের মুর্ছনায় বরিশালের সকালে যেন ফেরেস্তারা নেমে এল সেই ঘরে। শেষ হতেই ‘সোবাহান আল্লাহ, সোবাহান আল্লাহ’ বলে ঝিলুকে জড়িয়ে ধরলেন ক্কারী সাহেব। নাজেম আলীর মুখ স্বভাবতই উজ্জল।
– আজ তোমার তেলাওয়াত খুব সুন্দর হইসে বেটা। সুরটিও বড় মিঠা।
– আপনার ভাল লাগসে?
– খুব ভাল লাগসে। এমন সুন্দর সুরে এর আগে কখনও শুনি নাই। কিন্তু আমি যে সুরে তোমায় এলহান দিসি তার লগে তো কোন মিল নাই। এমন এলহান তুমি কইত্থিকা পাইলা?
– না না ক্কারী সাহেব, হেইডা কমু না। আপনেরা মোটেই খুশি হবেন না।
– না না ঝিলু তুমি কও। কিছু হইব না।
– আব্বায় রাগ করব।
– না ঝিলু রাগ করব না। তুমি কও।
– বোম্বের ছবি ‘মির্জা গালিব’য়ে ইন্ডিয়ার কুন্দনলাল সাইগল গাইসেন গুলাম মহম্মদের সুরে। গানটা হইল ‘ নুকতা চীন হ্যায় গমে দিল, উসকো শুনায়ে না বনে’। এই গজলের সুরে তেলাওয়াত করসি।
মুহুর্তের মধ্যে লাফিয়ে উঠলেন নাজেম আলী। রাগে অগ্নিশর্মা। চোখ মুখ লাল। ছুটে গিয়ে দূরে রাখা বেত তুলে নিয়েই সপাং সপাং। কিল চড় লাথি।
– ওই কাফেরি সুরে কোরাআন তেলাওয়াত? গানের ভুত অখনও নামে নাই মাথাত ত্থেকে? বেয়াদব। বেতমীজ।
রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে নাজেম আলী বেত্রাঘাত করেই চলেছেন। থামানো যাচ্ছে না। ক্কারী সাহেব কিছুতে পারছেন না তাকে থামাতে। অন্দর মহল থেকে বেরিয়ে এলেন ঝিলুর ছোটমা । নাজেম আলীর কনিষ্ঠা স্ত্রী। সচরাচর বাইরের কারোর সামনে বেরোন না।
– মাইরা ফালাইবেন নি এই ছুটো পুলারে? কি করসে হে? তেলাওয়াত তো করতেসিল। হইল কি?
– জিগাও তুমার পুলারে। ফিলিমের গানের সুরে তেলাওয়াত? বান্দরামির জায়গা পায় না। দশ জুতা মারলেও আমার মাথা শান্ত হইব না।
ক্কারী সাহেব মুখ খুললেন।
– শান্ত হন মিয়াসাহেব। মাফ কইরা দ্যান। হে যদি সইত্য কথাডা না কইত, আফনে ট্যার পাইতেন ক্যামনে? আগে এমন কেউ করসে কিনা জানি না। কিন্তু হ্যার নির্ভুল উচ্চারন আর মোহিত করা সুর আমায় পাগল করসে। সব ছুরাতেই সুর আসে। একটু পালটাইয়া যদি শুনতে ভালা হয় আপইত্ত্য কিয়ের? হোক না। ইসলামেও তো বাধা নাই।
– দ্যাহেন ক্কারীসাহেব, গান বাজনা এড্ডু আড্ডু করলে আমার আপইত্য নাই। কিন্তু হেরে ল্যাখাপড়ায় ভালা হইতে হইব। মুই কইসি কি না তারে জিগগান। তরে ইঞ্জিনিয়ার হইতে হইব। তার জইন্য যা ট্যাহা লাগে আমি দিমু। কিন্তু ব্যাডার কান্ড দ্যাহেন। অবাইগ্যা সারা গাছে লেইখ্যা রাখসে – ঝিলু দি গ্রেট। গান গাইয়া আঁকা উঁকি কইরা কি গ্রেট অইতে পারবি? শ্যাসম্যাস তো নাম লিখাইবি যাত্রা দলে।
ঝিলু ঠোঁট উলটিয়ে বলে উঠল –
– দেইখেন, একদিন আমি গ্রেট অইবই অইব। ঝিলু দি গ্রেট।
কিন্তু কিসের কী! কিসের পড়াশোনা! সারা দেশ জুড়ে তখন উত্তেজনা। ব্রিটিশরাজ শেষ হতে চলেছে। মুসলমানদের জন্যে নতুন দেশ চাই। হিন্দুদের সাথে থাকব না। ওরা সারাজীবন আমাদের ঘেন্না করে এসেছে। ফকিরবাড়ি রোডে ঝিলুর উদ্যোগে খোলা হল একটি সাংস্কৃতিক সংস্থা ‘তরুন মহফিল’। সেখানে লাইব্রেরী হল, আঁকা শেখান শুরু হল, গানের চর্চা চলল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার স্বপক্ষে শহরের বিভিন্ন স্থানে জমায়েত হতে লাগল। সেখানে গানের দল সভা মাতাতে প্রস্তুত। সেই দলের নেতা ১৩ বছরের ছেলে ঝিলু। আলতাফ মাহমুদ। স্কুলের বার্ষিক মিলাদ মহফিলে কোরআন তেলাওয়াত করে সবাইকে মুগ্ধ করে রাখত। এদিকে সভা সমিতিতে ইসমাইল হোসেন সিরাজী, কাজী নজরুল ইসলাম আর লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান। এই কিশোর ছাড়া বরিশাল শহরে কোন অনুষ্ঠান ভাবাই যেত না। পাকিস্তান তাদের চাই-ই।
১৯৪৭ সালের ১৪ই অগাস্ট রাত বারটা এক মিনিটে তরুন মহফিলের পক্ষ থেকে বরন করা হল পাকিস্তানের স্বাধীনতা। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এরপরেই। পূর্ব বাংলার সংস্কৃতি এর আগে অবধি চর্চিত ছিল হিন্দু পরিবারগুলির মধ্যে। তারা ত্রাসে ভয়ে ভারতে চলে যাওয়ার পরে সৃষ্টি হয় সাংস্কৃতিক শুন্যতা। সারা দেশের মত বরিশালেও তাই হয়েছে। সেই স্বাধীনতার অনুষ্ঠানে প্রথম ও প্রধান শিল্পী ছিল ঝিলু দি গ্রেট – আলতাফ মাহমুদ। প্রায় ভোর অবধি তাকেই গাইতে হল। তখন তার বয়স মাত্র চোদ্দ।
স্বাধীন পাকিস্তান তো এল । এবারে তো পড়াশুনো ধরতে হবে। কিন্তু পড়াশুনো ধরতেই আলতাফ দেখল যে তার পড়াশুনো প্রায় কিছুই হয় নি। পরীক্ষার বাকি কয়েক মাস। সে বুঝে নিল যে দারুন কিছু ফল করা যাবে না। স্বাধীনতার পরের বছর অর্থাৎ ১৯৪৮ সালে বরিশাল জেলা স্কুল থেকে পরীক্ষা দিল ঝিলু।
পরীক্ষার ফল বেরোবে আজ। নাজেম আলী ঘর বার করছে। সময় কাটছে হু হু করে। ঝিলু আর ফল নিয়ে আসে না। নাজেম আলী নিজেই বেরোলেন ফল জানতে। ইস্কুলের সামনেই হেড মাস্টারের সাথে দেখা। নাজেম আলী জিজ্ঞাসা করলেন –
– মাস্টারমশাই, ঝিলুর রেজাল্ট তো জানতে পারি নাই। হে কই?
– হে কই তা ক’বার পারুম না, তবে হে তো শিল্পী, এই তুচ্ছ ফল দিয়া কি হেরে মাপা যায়?
– আরে দুরো মাস্টারমশাই, হের রেজাল্টটা কেমন হইসে হেইডা কন।
– হাই সেকেন্ড ডিভিসন। ফার্স্ট ডিভিসন হয় নাই।
নাজেম আলীর মাথায় কেউ যেন এক মালসা আগুন ঢেলে দিল। ‘খোঁজ ঝিলুকে। কই পলাইল?’ লোক পাঠালেন তিনি দিকে দিকে। তারা এক চাচাত ভাই অবশেষে তাকে খুঁজে পেল কীর্তনখোলা নদীর পারে। কৃষ্ণ কানহাইয়ার মত দলবল জুটিয়ে একটার পর একটা গান গেয়ে চলেছে। সবাই তন্ময় হয়ে শুনছে। নাজেম আলীর ইচ্ছের নটে গাছটি মুড়োল। ঝিলুর ইঞ্জিনিয়ার হওয়া আর হল না। সে এগোল গায়ক হওয়ার পথে। এবার ঝিলু ভর্তি হল বরিশাল ব্রজমোহন কলেজে। আই এস সি তে।
ধর্মভিত্তিক বিভাজনের ফল পাকিস্তান সৃষ্টির কিছুদিনের মধ্যেই মোহভঙ্গ হতে লাগল সমাজের সকল স্তরে। পাকিস্তান সৃষ্টির পক্ষে প্রথম সারির সেনানী আলতাফ মাহমুদের হতাশা আরো তীব্র হল। এ কোন দেশ হাসিল করেছে তারা। একই দেশ, একই ধর্ম – অথচ কথায় কথায় পশ্চিমাদের শাওক্সুলভ ব্যবহার। পূর্বপাকিস্তানের মানুষদের মনিষ্যি বলেই গন্য করে না পশ্চিমারা। তাদের খাঁটি মুসলমানও ভাবে না। ভাবে ইন্ডিয়ার এজেন্ট। কথায় কথায় হেলা ছেদ্দা। পড়াশুনোর ক্ষেত্রে কথায় কথায় কলেজ বন্ধ। পরীক্ষা হওয়ার ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা। এ সময় আলতাফের সাথে কলেজে আলাপ হল বামপন্থী প্রগতিবাদী ছাত্রদের সাথে। সে আকৃষ্ট হল সমাজতান্ত্রিক ভাবধারায়। যোগদান করলেন কমিউনিস্ট পার্টিতে। শুরু করলেন গনজাগরনের গান। মুসলিম লীগ সরকারের কর্মকান্ডকে বিঁধে গান। বাঙালি জাতিকে জাগাতে হবে। তাদের সত্ত্বায় আত্মমর্যাদাবোধ আনতে হবে। তাই তিনি নিজেই গান লিখছেন। নিজেই সুর দিচ্ছেন। নিজেই পথে ময়দানে কাঁধে হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে নেচে নেচে গাইছেন।
ওগো হুনছনি ভাই হুনছনি/ স্বাধীনতার নামে আজব কান্ডখানা হুনছনি/ ও ভাই স্কুল কলেজ বে আইনি/ লেখাপড়া বে আইনি/ স্বাধীনতার নামে আজব কান্ডখানা হুনছনি/ ওগো লীগের পোলা বিলাত যায়/ আর মোগো পোলা মোষ খেদায়/ স্বাধীনতার নামে আজব কান্ডখানা দেখছ নি……
শ্লোগান উঠত – ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায়/ লীগ পাক্কা চোর হ্যায়। উর্দু তখন সবে এসেছে। অনেকেই শিখছে। ক্ষমতার ভাষা। ১৯৪৯ সালে বরিশালে টাউন হলে এক কৃষক সমাবেশে আলতাফ গাইলেন – ম্যায় ভুখা হুঁ। এই গান রাতারাতি তাকে নিয়ে গেন জনপ্রিয়তার শীর্ষস্থানে।
কিন্তু অস্থির চিত্তের স্বভাব বাউল আলতাফের এই জনপ্রিয়তার আগুনে নিজেকে মুচমুচে রাখার মন ছিল না। বরিশালের চার দেওয়ালে থেকে নিজের জন্যে অনেক কিছু হয়ত করা যাবে। কিন্তু দেশের জন্যে কিছু করা যাবে না। এই পশ্চিমা দানবের বিরুদ্ধে কিছু করতে হলে বড় সংগঠন ও বড় ক্ষেত্র প্রয়োজন। অতএব চলো ঢাকা। সালটা ১৯৫০। তিনি রওয়ানা হলেন ঢাকায়।
– আমিই আলতাফ মাহমুদ। জুলফিকার ভাই বললেন আপনার সাথে দেখা করতে।
– হ্যাঁ,হ্যাঁ, আমি নিজামুল হক। আপনি শুনেছি দারুন বেহালা বাজান।
– দারুন কি না জানি না, বেহালা বাজাই। তবে গানও করি।
– বাহ। তাহলে তো ভালোই হল। সঙ্গে তো বেহালা আছে দেখছি। একবার বাজাবেন।
পুরোন ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কের এক কোনায় বসে আলতাফ হাতে বেহালা তুলে নিলেন। ধরলেন ইমন রাগ। ছড়ির মুর্ছনায় ‘ধুমকেতু শিল্পী সংঘ’এর মূল হোতা নিজামুল হক, জুলফিকার ও কামরুল কিছুক্ষনের জন্যে নির্বাক হয়ে পড়েন। নিজামুল হঠাৎই আলতাফকে বুকে জড়িয়ে বলেন –
– ব্রাভো। তুমি তো খাঁটি হীরে। কথা দাও আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবে না।
– না। তা যাব না।
– তা থাকা হয় কোথায়?
– দেশে দেশে মোর ঘর আছে আমি সেই ঘর মরি খুঁজিয়া……
– বুঝেছি বুঝেছি। চালচুলা নাই তো। আমার মতই পাগল। তা আমার একটা ছোট আস্তানা আছে। চলো ওখানেই থাকবে।
আলতাফের যোগদানে ধূমকেতু শিল্পী সংঘ দ্রুত প্রাণ পেল। সব চেয়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠল সংগঠনটি। ওদিকে পাকিস্তান পন্থী ও লীগের টাকায় চলা সংগঠন তমুদ্দীন মজলিশ আলতাফদের জনপ্রিয়তায় ইর্ষান্বিত হয়ে তাদের বেশ বাধা দিতে শুরু করল। বিশেষত ঢাকার বাইরে। লোকজনদের ক্ষেপিয়ে দিত। বলত ইসলামে গান বাজনা হারাম। এরা সেই ধর্মবিরোধী কাজ করে। আর মৌলভি আর মুসুল্লিদের সাহায্যে সভা পন্ড করার মতলব করত। কিন্তু আলতাফের ছিল ক্ষুরধার বুদ্ধি। মাইক টেনে গাইতেন – নামাজ পড়, রোজা রাখ, কলমা পড় ভাই/ তোর আখেরে কাজ করে নে, সময় তো আর নাই। তারপরেই বলতেন যে আপনারা বলুন এই গান কি হারাম? জনতার আপত্তির জায়গা থাকত না। এভাবে এগিয়ে শেষে গাইতেন গনসঙ্গীত।
ভাষা আন্দোলন বেশ তীব্রতা পেয়েছে। আলতাফ মাহমুদ ছাড়া সভা সমিতি অচল। এল ২১ শে ফেব্রুয়ারী, ১৯৫২। ভাষার জন্যে ঝরল তরুন প্রাণ। আলতাফ ঝড় তুললেন। একের পর এক গান। মৃত্যুকে যারা তুচ্ছ করিল ভাষা বাঁচাবার তরে/ আজিকে স্মরিও তারে… কিংবা… ভুলব না, ভুলব না এ একুশে ফেব্রুয়ারী ভুলব না/ লাঠি গুলি আর টিয়ার গ্যাস মিলিটারি, ভুলব না… অথবা… মায়ের ভাষার মান বাঁচাতে প্রাণ দিল আজ যারা/ ওদের ভাষা প্রাণ পেল আজ ওরা যে বাকহারা। এগুলি লেখা মোশারফউদ্দিন আহমেদ, গাজিউল হক ও বদরুল হাসানের। সুর দিয়েছে আলতাফ মাহমুদ কোনটা আবেগী সুরে, কোনটা মার্চের তালে, কোনটা আবার হৃদয় নিঙড়ানো ব্যথা ঢেলে। ঢাকা শহরে সবাই জেনে গেছে কথা মোটামুটি হলেও আলতাফ মাহমুদ তাকে সুর দিয়ে তীব্র অস্ত্রে পরিণত করবেন।
আবদুল লতিফ বরিশালের ছেলে। সেও সুরকার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবদুল গাফফার চৌধুরী ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে এক গুরুতর আহত ছাত্রকে দেখতে গিয়ে তার শয্যাপার্শ্বে বসে বড্ড আবেগী হয়ে পড়েন। তারপরে তিনি একটি কবিতা লিখেছিলেন। কবিতাটা দেখে আবদুল লতিফ তাতে সুর বসান। আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী, আমি কি ভুলিতে পারি। গানটির সুর ও বানী প্রথমে বেশ প্রেরনা যোগায় ছাত্রছাত্রী মহলে। সুরটি বেশ ছিল। কিন্তু আলতাফ মাহমুদ তাতে নতুন করে সুর বসালেন আবদুল লতিফের অনুমতি নিয়েই। ব্যস। সঙ্গীত জগতে বিস্ফোরন ঘটে গেল। নতুন সুর জনতার কন্ঠে মধু ঢেলে দিল। কী ভীষন মাদকতা, কী ভয়ংকর আকর্ষন সে গানের। এ সুরে জয়গান আছে, চোখের জল নামানো আবেগ আছে, উদ্দীপনা আছে, জীবনের জয়গান আছে। আবদুল লতিফ উদার মানুষ। তিনি তাঁর সুর তুলে নিলেন এবং আলতাফের সুরের অনুমোদন দিলেন। আবদুল গাফফার চৌধুরী বললেন – কালের নিরিখে এ গান টিঁকে থাকবে শুধু আলতাফ মাহমুদের সুরের কারণে।
বাহান্ন’র ভাষা আন্দোলনের পরে পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক চিন্তা চেতনার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটল। ১৯৫৪ র নির্বাচন আসতেই বিরোধীরা তৈরী করল যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতায় তখন মুসলিম লীগ। তারা পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের তাবেদার। আলতাফকে যুক্তফ্রন্টের হয়ে নির্বাচনী প্রচারের জন্যে পাঠানো হল বরিশালের মাঠবাড়ীয়ায়। পাশের নির্বাচনী কেন্দ্র মালাদী থেকে আলতাফের পিতা নাজেম আলী দাঁড়ালেন স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে। পিতার হয়ে প্রচারের অনুরোধ ফিরিয়ে দিলেন আলতাফ। নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট আসন পেল ২২৮ টি। শাসক মুসলিম লীগ মাত্র ৯ টি। শোচনীয় ভাবে পরাস্ত হল মুসলিম লীগ। পরাস্ত হলেন আলতাফের পিতা নাজেম আলী। পূর্ব পাকিস্তানে ব্যালট ফিরে এল শাসকের দিকে বুলেট হয়ে ।
(৩)
– আলতাফ ভাই, আলতাফ ভাই।
– কে? ওহ, কামাল লোহানী ভাই? আসেন, আসেন। কি খবর কন?
– আমি তো আসলাম আপনাদের খবর নিতে। কেমন আছেন দ্যাখতে আসলাম। আপনার বাসার সামনেই না কত কান্ড। আমি তো সেই রাতের দিন তিনেক বাদে আসছিলাম। দেখি আপনারা নাই।
– ওই রাতের পর দুই দিন ছিলাম। ওইরাতে তো মান্নান সাহেবের বাসায় পুরা ফ্যামিলিকে পাঠায় আমি ছাদে শুইয়া দ্যাখলাম জানোয়ারগুলার কান্ড কারখানা। তারপর তো দুইদিন কার্ফু। কই যাই! শুধু দেখসি রাজারবাগ পুলিশ লাইন থেকে লাশ ভর্তি ট্রাক নিয়া পাইক্কারা বাইরাইয়া যাইতাসে। আর রাস্তায় রাস্তায় সেনা পাহারা। ট্যাংক নিয়া দৌড়াদৌড়ি।
– তারপর এই বাসাত ছিলেন?
– না, না, ২৭ তারিখ তো ৭/৮ ঘন্টার জইন্য কার্ফু শিথিল করসিল। কমলাপুর বৌদ্ধ মন্দিরের পুরোহিত বিশুদ্ধানন্দ মাথের ও শুদ্ধানন্দ মাথের লোক পাঠায়সিলেন। পুরা পরিবারকে নিয়ে যাওনের জইন্য। সেখানেই ছিলাম প্রায় ১২ দিন। ওইখানে ছিলাম বইল্যা এই ধাক্কা কিছুটা সামলাইতে পারসি। আর আপনি?
– আমি? সাংবাদিক হওয়ার যে কী যন্ত্রণা সেইদিন টের পাইসি।
কথাটা বলে প্রায় ডুকরে উঠলেন সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠক কামাল লোহানী। সিরাজগঞ্জের ছেলে কামাল লোহানীর জীবনটাই সংগ্রাম। ১৯৫২ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ভর্তি হলেন পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে। ১৯৫৪ সালে আলতাফের সাথেই যুক্তফ্রন্টের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারে অংশগ্রহণ করেন। এরপরে জেলবন্দী হয়ে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে কিছুদিন কাটান। ১৯৫৫ সালে তিনি ন্যাপে যোগ দেন । ১৯৬২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দৈনিক ‘সংবাদ’-এ সিনিয়র সাব-এডিটর হিসেবে যোগ দিয়ে ১৯৬৬ সালে চলে এলেন ‘পাকিস্তান ফিচার সিন্ডিকেট’-এ এবং ১৯৬৯ সালের প্রথম দিকে কিছুদিনের জন্য ‘ দৈনিক পয়গাম’-এ কাজ করে কামাল লোহানী অবজারভার গ্রুপ অব পাবলিকেশনসের ‘দৈনিক পূর্বদেশ’ পত্রিকায় চিফ সাব-এডিটর হিসেবে যোগ দেন। এই উত্তাল সময়ে তিনি আছেন ফয়েজ আহমদ সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘স্বরাজ’ পত্রিকায় । কিছুক্ষন চুপ করে থেকে মুখ তুললেন কামাল লোহানী।
– ভাবি নি আলতাফ ভাই, কখনও ভাবি নি। ২৫ তারিখ সারারাত জেগে কাটিয়েছি। গোলাগুলির শব্দ, আগুনের স্তম্ভ, ধোঁয়ার কুন্ডলী। পরের দিন কার্ফু থাকলেও বেরিয়েছিলাম খোঁজ নিতে। প্রথমে গেলাম হাসপাতালে। ঢোকার মুখে দেখি শহিদ মিনারের স্তম্ভগুলো গোলার আঘাতে ভেঙে দুমরে রয়েছে। চোখ ভরে গেল পানিতে। হাসপাতালে শুধু আগুনে পোড়া রুগী। ওফফ। সেখানে শুনলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে প্রথমে ছাত্রাবাস উজার করে ছাত্রদের মেরেছে। তারপরে শিক্ষকদের। মনিরুজ্জামান, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, জি সি দেব, এম আর খান, এ মুকতাদির। কেউ নেই।
– সবাইকে মেরে ফেলেছে?
– না, না, সবাইকে পায় নি, এদের পেয়েছে, মেরেছে। বাংলা অ্যাকাডেমির দেওয়াল দেখি গুঁড়িয়ে দিয়েছে। জগন্নাথ হল পুরোপুরি ধ্বংস। হাজী মহসীন হলের দক্ষিনে ইকবাল হল তার ওপাশে এস এম হল। সব হলেই আক্রমন চালিয়েছে জানোয়ারেরা মহসীন হল বাদে। বিধ্বস্ত আগুনে পোড়া শান বাঁধানো চত্বরে ছাত্রদের লাশ পড়ে আছে। ছাত্রদের লাশ। স্তুপাকৃতি। গন্ধে টেঁকা যাচ্ছে না। এই সৈন্যরা এত জানোয়ার যে একদলকে বলছে কবর খুঁড়তে, তাতে কিছু লাশ গোর দিচ্ছে, তারপরেই আরেকদলকে বলছে কবর খোঁড়, সাথে সাথে আগের দলকে গুলি করে মেরে দিচ্ছে।
– ওহ। এত নিষ্ঠুর? আচ্ছা, এই ক’দিন কোনো সংবাদ পত্রিকা কি বেরিয়েছে?
– ২৮ তারিখে বেরিয়েছিল পাকিস্তান অবসার্ভার। ইয়াহিয়ার ভাষন, মার্শাল ল অর্ডার আর একপাশে ছোট করে লেখা – মুজিব অ্যারেস্টেড, মুজিব গ্রেপ্তার।
– ওফ, শেখ মুজিব তাহলে পাকিস্তান আর্মির কবজায়? বেঁচে আছেন তো?
– ভুলে যাবেন না জ্যান্ত মুজিবের থেকে মৃত মুজিব আরো ভয়ংকর। এই ভুল পাকিস্তান করবে না। নিশ্চয়ই তাঁকে কোথাও বন্দী করে রাখা হয়েছে।
– আমাদের এখন কি করা উচিৎ কিছু ভেবেছেন?
– সে জন্যেই তো এসেছি। ঠিক করেছি যে এই যুদ্ধে যোগ দেব। আপনার কি মতামত আলতাফ ভাই?
– আমি একই কথা ভাবছি। কেন না এই পৈশাচিক যজ্ঞ মেনে নিতে পারছি না। ওরা যদি ভাবে বাঙালি জাতি হিসেবে ভীতু তাহলে তা প্রতিহত করতে হবে। কাজেই বন্দুক তুলে নিতেই হবে।
– না আলতাফ ভাই, সবাই বন্দুক তুললে কাজ হবে না। যার যে কাজ সেটা দেশের স্বার্থে করতে হবে। আপনি গান বাঁধুন, সুর দিন – এমন সুর এমন গান যাতে মুক্তি সেনারা উদ্বুদ্ধ হয়। অস্ত্রটস্ত্রের ব্যাপার পরে ভাবা যাবে। আপনি আপাতত ঢাকায় থাকুন।
কামাল লোহানী চলে যেতেই আলতাফ কিছুটা ঘোরের মধ্যে চলে গেলেন। স্ত্রী ঝিনু নরমকন্ঠী। তার ডাকও কানে এল না। ছোট্ট শিমুল এসে হাত ঝাঁকিয়ে বলল – ভাইয়া, ভাইয়া, চলো খেতে চলো। আলতাফ সম্বিত ফিরে পেলেন। ছোট্ট শিমুলের দিকে তাকিয়ে বললেন – আমি যে গান গাইতে বলব, গলা চেপে প্র্যাকটিস করতে পারবি? শিমুল মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যাঁ বলতেই তার মাথাটা ঘেঁটে দিল আলতাফ।
আলতাফ ক্রমশই নিজেকে ফিরে পাচ্ছিল দেশপ্রেমের নতুন মন্ত্রে। সমমনা বন্ধুদের আসা যাওয়া বাড়তে লাগল বাসায়। শিল্পী আবদুল লতিফ, হাফিজ আহমেদ, আমানুল হক, আতিকুল ইসলাম, জহির রায়হান, নিজামুল হক সবাই আসছেন নিয়মিত। খবর আসছে নিয়মিত। বর্ডারের খবর। যুদ্ধের খবর। ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইস্ট পাকিস্থান রাইফেলস, পুলিশ বাহিনী, আনসার বাহিনী, মুজাহিদ ছাড়াও সাধারন মানুষ যারা জীবনে পানি গড়িয়ে খান নি সবাই মিলে মুক্তিবাহিনী তৈরী করে লড়ে যাচ্ছে দাঁতে দাঁত চেপে। ট্রেনিং, খাদ্য, আশ্রয় ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করছে ভারত। কিন্তু নিজেরা যুদ্ধে নামছে না। ঝিনু লক্ষ্য করেছে যে হাফিজ আহমেদের গাড়ির হর্ণ শুনলেই চঞ্চল হয়ে ওঠে আলতাফ। আজও তাই হল। হাফিজের হর্ণ বেজে উঠতেই দৌড়ে গেটের কাছে কাঁঠালগাছের তলায় গেল আলতাফ। ঝিনু জানে এখন ওখানে দাঁড়িয়ে দুজনে কিছুক্ষন শলাপরামর্শ করবে। তারপর হাফিজ ঘরে ঢুকে বলবে – ভাবী চা দেন। ওরা যে কি কথা বলে ঝিনু জানে না। আসলে জানতেও চায় না। তবে বোঝে কিছু একটা হচ্ছে। তা দেশের জন্যেই।
– আলতাফ ভাই, খবর আছে।
– বলেন।
– কামাল লোহানী ভাই কুমিল্লার চান্দিনা হয়ে নৌকাযোগে ভারত পৌঁছিয়েছেন। বর্তমানে আগরতলায় আছেন। খালেদ মশারফের ক্যাম্পে। ওখান থেকে কলকাতা যাওয়ার কথা।
– সেকি কবে গেলেন? এপ্রিলের শেষে না এ মাসের প্রথমে।
– না, না, এপ্রিলের শেষে। আপনার জন্যে খালেদ মশারফের একটা নির্দেশ আছে।
– কি নির্দেশ?
হাফিজ একটা সিগারেটের প্যাকেট বার করে মৌজ করে একটা সিগারেট ধরিয়ে আলতাফের হাতে প্যাকেটটা দিলেন। হাফিজের চোখের ইশারায় আলতাফ বুঝল নির্দেশটা আছে সিগারেটের প্যাকেটের ভিতরে। সে দেখল একটা পাতলা চিরকুট। তাড়াহুড়ো না করে নিজেও একটা সিগারেট ধরালো। চিরকুটটা আস্তে টেনে দেখল তাতে লেখা – আলতাফ ভাই, আমাকে অবিলম্বে ১২ টা গানের স্পুল পাঠান স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র-র জন্যে, আমরা ভাল আছি, পরবর্তী নির্দেশের জন্যে অপেক্ষা করুন – মণিভাই। চিরকুটটা টুকরো টুকরো করে উড়িয়ে দিলেন হাওয়ায়। দুজনে ঘরে ঢুকেই আবদুল লতিফকে আলতাফ বলল –
– লতিফ ভাই, গান চাই। মুক্তি বাহিনীর সেনাদের জন্যে। ১০/১২ টা গান। তাড়াতাড়ি লিখতে হবে।
– হয়ে যাবে। কিন্তু হ্যান্ডস পাইবেন কই?
– সে রাজা জোগাড় করবে। রাজা হুসেন খান। হাফিজও আছে।
– রেকর্ড করবেন কই?
– কেন? বেঙ্গল স্টুডিও বা ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের স্টুডিও। হয়ে যাবে। আপনি আগে গান দেন।
– আচ্ছা, এখানে বসেই লিখতাসি। ভাবীরে কন, চা দিতে।
আবদুল লতিফ খ্যাতনামা গীতিকার ও সুরকার। দারুন গনসঙ্গীত গান। বরিশালেরই ছেলে। ১৯৫২ সালে আব্দুল গাফফার চৌধুরীর লেখা আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো গানটিতে তিনি সুরারোপ করেন। পরবর্তীকালে গানটিতে সুরারোপ করেছিলেন আলতাফ মাহমুদ। দুজনের সখ্যতা সর্বজনবিদিত।
– এই যে আলতাফ ভাই। দ্যাহেন এই গানডা চলব নাকি?
– বলেন।
– আমরা নেমেছি পথে/ জলে জঙ্গলে হাতিয়ার নিয়ে উঠতে বিজয় রথে/ শপথ নিয়েছি আজ/ ভেঙে একাকার করে দেব ওই হানাদারদের রাজ…
– মন্দ হয় নাই। দাড়ান, এইটা এখনই সুরে বসাই। আপনে বরং আরেকটা ল্যাখেন। আজ অন্ততঃ দুইটা নামাই।
আবদুল লতিফ লিখেই চলেছেন- স্বাধীনতা সংগ্রামে বাধা দিলে বুঝবি/ পালিয়ে যাবার পথ নিজেরাই খুঁজবি/ আমাদের সাথে আর কতদিন যুঝবি/আমরা বাঙালি বীর মুক্তি সেনানী। মাঝে মাঝে আটকে গেলেই বাইরে এক পাক দিয়ে এসে আবার বসছেন। আবার কলম চলল – নিরস্ত্র মানুষকে মেরে ফেলে উল্লাস/ মা বোনের অপমান ছড়ানো শিশুর লাশ/ ছুঁয়ে বলি শোধ নেব, পাল্টাবো ইতিহাস/ আমরা বাঙালি বীর মুক্তি সেনানী। এদিকে ঘরের জানলা দরজা বন্ধ করে আলতাফ সুর দিচ্ছে। গলা খুলে গাইতেও পারছে না। সুর মোটামুটি তৈরী হলেই আলতাফ শিমুলকে ডেকে নিচ্ছে। গানটা শিমুলকে ডেকে তুলিয়ে রাখছে। যাতে পরে সুর ভুল না হয়। শিমুল বিল্লাহ এখন বাংলাদেশের কোকিলকন্ঠী নামে খ্যাত। বছর পাঁচেক আগে প্রেসিডেন্ট আয়ুব খানের হাত থেকে সেরা শিশু শিল্পীর পুরস্কার নিয়েছে। দ্রুত গান তুলে তা কন্ঠস্থ রাখার ক্ষমতা একমাত্র শিমুলেরই আছে। আলতাফ তাই দ্রুত শিমুলকে গানগুলি তুলিয়ে গানের কথা লেখা পৃষ্ঠা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে। গানতো তৈরী হচ্ছে কিন্তু গাইবে কে? শিমুল বা আলতাফ গাইলে সহজেই ধরা পড়ে যাবে। রেডিওর কল্যানে দুটি কন্ঠই দেশে খুব পরিচিত। একটু অনামী কেউ অথচ ভাল কন্ঠ – এমন শিল্পীর খোঁজ করতে শুরু করল আলতাফ। সেই যে গাড়ি নিয়ে বেরোচ্ছে আর রিহার্সাল করে শিল্পীদের বাসায় পৌঁছে দিয়ে নিজের বাসায় পৌঁছতে রাত দুটো আড়াইটা বেজে যায়। এরমধ্যে দুটি স্টুডিওতে বারোটি গান রেকর্ড হল। কিন্তু সমস্যা হল গানের স্পুলটি নিয়ে মেলাঘরে যাবে কে?
আল্লাহর নামে আরো কিছু দেন মা… ভিখারিটা বড্ড নাছোড়বান্দা। বারেবারে একই কথা বলে যাচ্ছে। প্রিয়ভাষী ঝিনু উত্যক্ত হয়ে একটু চড়া গলায় বলল – চাল দিলাম, আলু দিলাম আর কি চাও? ভিখারিটা বড় ঠ্যাঁটা। বেমালুম বলে উঠল – চাড্ডি পান্তা আর ভর্তা যদি পাইতাম, প্যাট ভইরা খাইতাম। ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন ঝিনুর মা আমেনা – কি হইসে? ঝিনু সব বলতেই আমেনা ঘরে ঢুকে আলতাফকে ডাকলেন – আলতু, আলতু। আলতাফ হন্তদন্ত হয়ে বেরোতেই তাকে সব বললেন মা আমেনা। কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়েই বললেন – আলতু, পুলিশের চর নয় তো? আলতাফ এগিয়ে সামনে যেতেই ভিখারিটা গান গেয়ে উঠল – এলেম নতুন দেশে- তলায় গেল ভগ্ন তরী,কূলে এলেম ভেসে। আলতাফ এদিক ওদিক দেখে বলল – সংকেত বুঝেছি প্রফেসর। একটু বসুন এখানে। আপনার নাস্তাও আসবে আর কাঁসার বাটিতে থাকবে স্পুল। আমি আর আসব না। সাবধানে যাবেন। আল্লাহ হাফেজ।
একটু বাদে মা আমেনা একটা কলাই করা থালায় পান্তা, ভর্তা আর একটা কাঁসার বাটি ভর্তি মুড়ি দিয়ে গেলেন ভিখারিকে। এক জগ পানি। ভিখারিটা ভাল করে হাত মুখ ধুল। ঝোলায় মুড়িটা ভরল। তারপরে ধীরে সুস্থে শুরু করল পান্তা খাওয়া। যেভাবে ভিখারিরা খায়। আলতাফ জানলার পর্দার আড়াল থেকে ভিখারিটার খাওয়া দেখছে।
– ঝিনু, ঝিনু, এদিকে এস।
– কি হয়েছে।
– পর্দার আড়াল থেকে ভদ্রলোকটাকে দেখ।
– কে ও?
– অধ্যাপক আশফাক আহমেদ। ফিজিক্সে পি এইচ ডি। রাজশাহী কলেজে পড়ান। আমার গানের স্পুলটা নিতে ওকে পাঠানো হয়েছে।
– ইসস, আমি যে ভিখারি ভেবে কী রুঢ় ব্যবহার করলাম…
– ও কিছু না। কিন্তু একটা কথা ভাবো আজ দেশের জন্যে একজন অধ্যাপক ভিখারি সেজে তোমার উঠোনে বসে পান্তা খাচ্ছে। জীবনের ঝুঁকি সবসময়। এ কি কম কথা?
কিছুক্ষন পরেই আলতাফের বাসার সামনে একটা জীপ থামল। সরকারী জীপ। জীপ থেকে নেমে এক ভদ্রলোক কলিং বেল টিপলেন। দরোজা খুলে দিল আলতাফ স্বয়ং। রেডিও পাকিস্তানের প্রোগ্রাম ডিরেক্টর নূরুন্নবী খান।
– আসেন, খান ভাই। বসেন।
– আলতাফ ভাই, বিশেষ দরকারে আইসি।
– কন, কি করতে পারি?
– সামরিক আইন কর্তারা আমার পিছে বন্দুকের নল ঠ্যাকায় কাম করাইতাসে। পুরান সব বেতার শিল্পীদের খুঁইজ্যা বাইর কইরা তাগো দিয়া প্রোগ্রাম করাইতে হইব। আমার বিভাগ তো কথিকা। আমার বড় ভাই এহিয়া খানরে তো চিনেন। তার দায়িত্ব হইল সঙ্গীত। হেই পাঠাইসে আমায়।
– তা আমায় কি করতে কন।
– আলতাফ ভাই, আপনে তো গায়ক সুরকার। সুবিধা অনেক। দুই তিনটা গান বাইন্ধ্যা গাইয়া দেন। একটু পাকিস্তান পাকিস্তান গন্ধ ঢাইলেন।
– না খান ভাই। আমার আর গান আইতাসে না। যা দ্যাখলাম, মন ভালা নাই।
– কিন্তু কি করবেন? সরকারী হুকুম।
– আচ্ছা, তাইলে সময় দেন। গান বান্ধা হইলে আমি আপনারে খবর করুম।
আলতাফ মাহমুদের মনটা কয়েকদিন বেশ বিক্ষিপ্ত। মাথাটা বেশ ঘুলিয়ে আছে বেশ কিছু খারাপ খবরে। যে ছেলেটি স্পুল নিয়ে যাচ্ছিল সে পাকিস্তানীদের হাতে ধরা পড়েছে। প্রমানলোপের জন্যে স্পুলটি সে নদীর জলে ফেলে দিয়েছে। শুনেই আলতাফের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়েছিল। স্পুলটির আর কোন কপি নেই। এতদিনের খাটনি সত্যি জলে গেল।
কমান্ডার খালেদ মশারফ নিউজ উইকের ৫ ও ১২ এপ্রিল ও ৩ মে’র সংখ্যা তিনটি পাঠিয়েছেন। ৫ এপ্রিলের প্রবন্ধটির শিরোনাম – পাকিস্তান প্লাঞ্জেস ইন টু দিভিল ওয়ার। পাকিস্তান গৃহযুদ্ধে জড়িয়েছে। সাংবাদিক লোরেন জেনকিংসের রিপোর্ট। ১২ এপ্রিলের সংখ্যায় শিরোনাম – দ্য অ্যায়েকনিং অফ দ্য পিওপল – জাতির জাগরন। পরের অর্থাৎ ৩ মে’র কপির শিরোনাম – ঢাকা, সিটি অফ দ্য ডেড – ঢাকা, মৃতের নগরী। তার সাথে আর্মি ক্র্যাকডাউনের বিস্তৃত সংবাদ। ভয়াবহ সব ছবি দেওয়া আছে লেখার সঙ্গে। এতটা পৈশাচিকতা আশা করে নি আলতাফ। এরপরে কী করে বলা হবে যে পাকিস্তান ভাঙার ষড়যন্ত্রে কিছু বিচ্ছিন্নতাবাদী রাস্ট্রদ্রোহী দলকে সামরিক সরকার যোগ্য শাস্তি দিয়েছে!
যে ছেলে দুটি এসেছিল তাদের নাম শাহদাৎ চৌধুরী ও আলম। শাহদাৎ একটা পাতলা কাগজে লেখা চিঠি ধরিয়ে দিল আলতাফের হাতে। তাতে লেখা – আলতাফ ভাই, শাহদাতকে ঢাকায় পাঠাচ্ছি। ঢাকার প্রয়োজনমত যোগাযোগ সেই করবে। ঢাকায় মুক্তিফৌজের উপস্থিতি জানান দিতে সেখানে দ্রুত অ্যাকশন প্রয়োজন। হোটেল ইন্টারকন, শপিং প্লাজা ও বিভিন্ন পাওয়ার সাপ্লাই সেন্টারে বোমা মেরে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে হবে। যারা এই অ্যাকশন করবে তাদের ট্রেনিং চলছে মেলাঘরে। এরা আপনার সাহায্য ও পরিকল্পনা অনুযায়ী অ্যাকশন করবে হিট অ্যান্ড রান পদ্ধতিতে। অস্ত্র পাঠিয়ে দেব। আপনি প্ল্যান করুন। পরবর্তী নির্দেশের জন্যে অপেক্ষা করুন – মণি। চিঠিতে খালেদ মশারফের সীল মারা রয়েছে। আলতাফ চিঠিটা কুচিকুচি করে ছিঁড়ে আকাশের দিকে মুখ করে বলে উঠলেন – জয় বাংলা।
(৪)
নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল যুক্তফ্রন্ট। ৩ এপ্রিল, ১৯৫৪ শপথ গ্রহন করেছিল নতুন সরকার। এই প্রথম পূর্ব বাংলার মানুষ মুক্তির স্বাদ অনুভব করেছিল। কিন্তু বিধি বাম। মাত্র এক মাস সাতাশ দিন পরে ৩০ মে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার রাস্ট্রদ্রোহিতা ও কমিউনিস্ট দমনে ব্যর্থতার অজুহাত দিয়ে বরখাস্ত করল এই সরকারকে। জারি করল ৯২ ক ধারা, অতএব গভর্ণর শাসন। যে সব শিল্পী সাহিত্যিক যুক্তফ্রন্ট সরকারের সাথে জড়িত ছিলেন তাদের ওপর নেমে এল গ্রেফতারি ও নির্যাতন। আলতাফের নামে হুলিয়া জারি হল। শুরু হল ফেরারী আসামীর মত পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগের চোখ এড়িয়ে পালিয়ে বেড়ানোর জীবন। সে এক দুঃসহ সময়। এবাড়ি থেকে ও ওবাড়ি, এক পাড়া থেকে অন্য পাড়া। পিতা নাজেম আলী বিরূপ হওয়ায় নিজের পৈত্রিক ভিটে বা আত্মীয়স্বজনের বাসায় জায়গা জুটছে না আলতাফের। অবশেষে সে আশ্রয় পেয়েছে কীর্তনখোলা নদীর তীরে এক জেলে বস্তিতে। শেখাণেঈ আত্মগোপন করে আছে সে। সেখানে তার প্রাপ্তি হচ্ছে হাওরের মানুষদের গাওয়া গান আর তার সুর। এত স্বাভাবিক খোলা সুর তাকে মুগ্ধ করছে প্রতিনিয়ত।
– মিয়াভাই, আপনের যা জ্বর, সমানে কাঁপতাসেন, একবার হেকিম ডাকা দরকার।
– না ভাই, ডাইকেন না। অ্যামনেই ঠিক হয়া যাইব।
– না, না, ক্যামনে হইব। এইডা হইল তরাস জ্বর। অ্যামনে যাইব ক্যামনে?
– আমি তাচ্চে বরং বরিশালে গিয়া ডাক্তার দেখাই। হেইডাই বরং ভালা হইব।
আলতাফ বুঝতেই পারছে যে তার ম্যালেরিয়া হয়েছে। বিকেল গড়াতেই ভয়ংকর কাঁপুনি শুরু হয়। জ্বরে পুড়ে যায় গা। মাঝে মাঝে মনে হয় পিতা নাজেম আলীর কথা – দ্যাশের জন্যে তুমার এই পীরিতের অর্থ বুঝি না, মরবা, একদিন যহন মরবা, কেউ আইব না তোমার জানাজা উঠাইতে। সত্যি কি তাই? এদেশের মানুষ এতই অবুঝ? এতই নিষ্ঠুর? এতই স্বার্থপর? না, না, তা কেন হবে? এই যে জেলে দম্পতি এরা তো জেনেই তাকে আশ্রয় দিয়েছে যে যেকোন সময়ে পুলিশের হাঙ্গামা হতে পারে। তাহলে?
হল্ট। শব্দটা শুনে আলতাফ দিল ভোঁ দৌড়। জ্বরাক্রান্ত আলতাফ আজ সন্ধ্যায় সবে এসেছে বরিশাল শহরে। কিন্তু চোখ এড়াতে পারল না আই বি’র। কোতোয়ালিতে খবর যেতেই রে রে করে এসেছে পুলিশ বাহিনী। খুব কাছে এসেই হাঁক দিল ইনস্পেকটর। কিন্তু আলতাফ বুঝেই দে দৌড়। এ রাস্তা ও রাস্তা এ গলি ও গলি পেরিয়ে সে ঝাঁপ দিল এক পুকুরে। জলে নাক ভাসিয়ে ডুবে থাকল সে। অন্ধকারে তার টিকিটি না দেখতে পেয়ে পুলিশ ফিরে গেল। পাশেই পুলিশ ক্লাব। দুরন্ত আলতাফ সেই ক্লাবের গা ঘেঁসে উঠে হাজির হল ভাটিখানা রোডে অভিনেতা কেশববাবুর বাসায়।
– কেশব’দা
– কে? আলতাফ? তুমি এখানে? পুলিশ খুঁজছে তো তোমায়।
– কেশবদা, আমার শরীরে কোন বল নেই। খাই নাই সারাদিন।
– এ কি আলতাফ, তুমি তো থরথর করে কাঁপছো। গা পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে। শিগগীর ভিজে কাপড় বদলাও।
– কিছু খেতে দিন কেশব,দা।
দ্রুত ভেজা কাপড় পালটে আলতাফকে কয়েক পিস পাউরুটি ও দুধ খাইয়ে কেশববাবু তাকে সামান্য সুস্থ করে পৌঁছে দিলেন আলতাফের ভগ্নীপতি মোহাম্মেদ আলীর বাসায়।
– ভাইয়া, বারেবারে আপনারে কইতাসি যে পলিটিক্স আপনে ছাড়ান দেন। গান গাইতাসেন, ওইডাই করেন। কি হইব অ্যাত দ্যাশের কথা ভাইবা?
– দুলাভাই, আপনে বুঝবেন না। এই দ্যাশের মানুষ বড় কষ্টে আসে। এগো পাশে তো দাড়াইতে হইবই। নাইলে…
দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হতেই আলতাফ আড়ালে চলে গেল। দরোজা খুললেন আলতাফের দুলাভাই মোহাম্মেদ আলী। দরোজায় দাঁড়িয়ে আছে নিজামুল হক। আলতাফের প্রাণের বন্ধু। বগুড়া থেকে চলে এসেছে বরিশালে। আলতাফের টানে। নিজামুলের ওপরেও ঝুলছে হুলিয়ার খড়্গ।
– দুলাভাই, আলতাফ কই?
– একা আলতাফে রক্ষা নাই আইলেন এইবার নিজামুল। কাম সারসে।
আড়াল থেকে বেরিয়ে আলতাফ আলিঙ্গনাবদ্ধ হল নিজামুলের। নিজামুল জানাল যে তাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে বরিশাল শিল্পী সংসদের অফিসে। কয়েকজন পালা করে তাদের খাবারের ব্যবস্থা করেছে। অতএব দ্রুত যেতে হবে। বাইরে পুলিশ ঘুরছে। বরিশালের রুচিরার রেস্তোঁরার মালিক সত্য সেন সব ব্যবস্থা করেছেন।
শুরু হল দিনের পর দিন সীমাবদ্ধ ঘরে এই দুজনের অজ্ঞাতবাস। আলতাফ হারমোনিয়াম বাজানোয় বেশ দুর্বল। সত্য সেন জোগাড় করে দিলেন একটা পুরোন হারমোনিয়াম। আলতাফ হারমোনিয়াম বাজানো এই সময়েই বেশ ভাল করে রপ্ত করে নিল। এর মধ্যে এক বছর এক মাস কেটে গেছে। ক্ষমতায় মুসলিম লীগ সরকার। আলতাফ বা নিজামুলের টিকির নাগাল আজও পুলিশ পায় নি। ক্ষমতায় এসে মুসলিম লীগ সরকার ৯২ক ধারা তুলে নিল। প্রকাশ্যে এল আলতাফ ও নিজামুল। ক্রমাগত ডাক আসতে লাগল গান গাওয়ার। বিভিন্ন সভায় আলতাফের গানের কদর অসম্ভব। আলতাফের মঞ্চ উপস্থিতি মানেই মানুষের ভিড়। একের পর এক গান গাইতে হয় তাকে। তবে একটা গান তাকে গাইতে হয় দুই তিনবার। ‘মেঘনার কুলে ছিল আমার ঘর/ হঠাৎ একটা তুফান আইয়া/ ভাইসা নিল তারেরে’… এই গানটির জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী। ভৈরবে আওয়ামী লীগের সভাতে জিল্লুর রহমানের অনুরোধে গানটি একবার করতেই জনতা উত্তাল হয়ে উঠল – আবার আবার গানটা করতে হবে। কেউ কোন কথা শোনে না। অবশেষে পাঁচবার হাওয়ার পরে জনতা তাকে ছাড়ল। শুরু হল আসল সভা। সভা শেষে জিল্লুর রহমান বললেন – আলতাফ তুমি ঢাকা আসো, ওখানেই তো তোমাদের খুব দরকার। এইখানে বইয়া করো কি?
ঢাকায় পৌঁছে পুরোনো ঢাকায় যুগিনগরে আস্তানা গাড়ল আলতাফ। ইতিমধ্যে ‘পূর্ব পাকিস্তান শিল্পী সংসদ’ এর নাম পালটে করা হয়েছে ‘পাকিস্তান গননাট্য সংঘ’। প্রখ্যাত ছাত্রনেতা গাজিউল হকের রচনায় নিজামুল হকের পরিচালনায় ছায়ানাট্য ‘শিল্পী’তে সুরসৃষ্টি ও মূল গায়ক হল আলতাফ মাহমুদ। দিকে দিকে সাড়া জাগালো এই নাটক। তুমুল জনপ্রিয়তা। কিন্তু আলতাফের অভাবের জীবনে বিশেষ পরিবর্তন এল না। কারণ সবাই শুনতে, প্রত্যক্ষ করতে চায় শিল্প কিন্তু পয়সার ব্যাপারে সবারই বজ্রমুষ্ঠি। আলতাফকে তাই খুঁজে বার করতে হয়েছে সস্তাতম খাওয়ার জায়গা। সদরঘাটে রূপমহল সিনেমার উলটো ফুটপাথে হকার্স মার্কেটে গরম ধোঁয়া তোলা ভাত ও লাল গোস্ত – ছয় আনায় উদরপুর্তি। পকেটে অনেক সময় কপর্দকও থাকে না। কখনও কখনও কেরোসিন তেল বিক্রি করতে হয় তাদের পেটের ভাত জোটানোর জন্যে। তা সত্ত্বেও মাঝে মাঝেই উপোস দিতে হয়। একবার তো টানা তিন দিন উপোস দেওয়ার পরে এক বিকেলে এক বন্ধু এল বরিশাল থেকে। কাছেই র্যাঙ্কিন স্ট্রীটে ওয়েসাইড রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেল বন্ধুটি। কয়েকটা কাগচা বিস্কুট ও চা খেয়ে বাসায় ফিরে আলতাফ আর দাঁড়াতে পারল না। আধভরা পেটে ক্লান্তিতে শুয়ে পড়ল সে। ঘুম যখন ভাঙল তখন পরেরদিন সকাল।
– আপনি আলতাফ মাহমুদ?
– হ্যাঁ, বলুন। কি ব্যাপার?
– আমি পাকিস্তান সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগের কর্মী। আপনার জন্যে একটা আমন্ত্রণ পত্র আছে।
– কিসের?
– ভিয়েনা যাওয়ার। বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে আপনাকে ডেকেছে সুরকার ও সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে। এক মাস বাদেই যাত্রা। আপনার পাসপোর্ট আছে?
– না। তা তো নেই।
– তাহলে আপনি তাড়াতাড়ি করাচী চলে যান। পাকিস্তানের পাসপোর্ট তো ঢাকা থেকে ইস্যু হয় না। ওখান থেকে পাসপোর্ট করিয়ে নিন। টিকিটও ওখান থেকে দেওয়া হবে।
আলতাফ কালো মেঘের আড়ালে স্বচ্ছ আলোর আভাস দেখতে পেল। বন্ধুরা খুব খুশি। কিন্তু অর্থ কোথায়? করাচী যাওয়ার! পাসপোর্ট করানোর। একমাত্র ছোট’মা ভরসা। কাজেই চলো বরিশাল। শুধু ছোট’মা নয়, এগিয়ে এল বন্ধুরাও। করাচী যাওয়ার ও আনুসঙ্গিক কাজের অর্থ উঠে এল। আলতাফ আর দেরী করল না। বিমানের টিকিট কেটে সোজা করাচী।
– আপ কা পাসপোর্ট নেহি মিলেগা।
– কিঁউ। মেরা কসুর কেয়া হ্যায়?
– আপ কমিউনিস্ট হো। রাস্ট্র কা দুশমন হো। আই বি নে রিপোর্ট দিয়া হ্যায়।
মাথায় ছাদ ভেঙে পড়ল আলতাফের। এ কী! সে রাস্ট্রদ্রোহী! বিরোধী রাজনীতি করার আজব খেসারত দিতে হচ্ছে তাকে। পূর্ব থেকে পশ্চিমে রিপোর্ট চলে এসেছে যে সে কমিউনিস্ট! আলতাফ ছুটল তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরে। সেখানে কেউই কিছু বলতে পারে না। শেষে প্রায় মরিয়া হয়ে এক বড় অফিসারের ঘরে ঢুকে পড়ল সে। তাকে বিস্তৃত বলতেই তিনি বসতে বললেন। অফিসারটি বাঙালি। ফলে আলতাফের প্রতি একটু যেন নরম হল। সব শুনে ফাইল চেয়ে পাঠালেন। ফাইল খুলেই তাঁর ভুরু কুঁচকে গেল। সোজাসুজি তাকালেন আলতাফের দিকে।
– আপনি কমিউনিস্ট পার্টির হাঙ্গামা ব্রিগেডে ছিলেন?
– না তো। তবে যুক্তফ্রন্টের প্রচার সভায় নিয়মিত গান গেয়েছি।
– কিন্তু আই বি তো রিপোর্ট দিয়েছে যে আপনি সাংঘাতিক কমিউনিস্ট। রাস্ট্রের শত্রু। ভয়ংকর এলিমেন্ট।
– এ সব মিথ্যা।
– সে তো আমি বুঝলাম। কিন্তু তাতে তো আপনার ভিয়েনা যাওয়া হবে না।
– তাহলে?
– দেখুন তাহলে বলে কিছু নেই। আপনার বিরুদ্ধে আই বি রিপোর্ট আমি বললাম। এতে পাসপোর্ট হয় না। আর আপনার রাস্ট্র বিরোধী কার্যকলাপ জানিয়ে ভিয়েনা থেকে আরেকজনের নামে আমন্ত্রণপত্র আনানো হয়েছে।
– সে কী! সে কে?
– একজন পশ্চিমা আমলা। শান্তি বা সংস্কৃতির সাথে কোন যোগাযোগ নেই। বাঙালি হয়ে জন্মেছেন, খেসারত তো দিতেই হবে।
ক্ষনিকের আলোর হাতছানি আলতাফকে আবার ডুবিয়ে দিল গভীর অন্ধকারে। তীব্র রাগ, দুঃখ, লজ্জা তাকে গ্রাস করে ফেলল। মানসিক আঘাতে বিপর্যস্ত সে। কিন্তু রাজধানী করাচীতে তখন বেশ কিছু বাঙালির বাস। আফরোজা বুলবুল, আমানুল হক, আলী হোসেন – সব বাঙালি শিল্পীরা এসে দাঁড়ালেন আলতাফের পাশে। তাদের উৎসাহে আলতাফ সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি আবার নতুন করে শুরু করবেন তার জীবন এবং করাচীতেই। তারাই প্রথমেই আলতাফের থাকা ও খাওয়ার বন্দোবস্ত করে দিলেন। কিছুদিনের মধ্যে পুরোন বন্ধু নিজামুল হক সরকারী চাকরী নিয়ে এলেন করাচীতে। সাথে শেখ লুতফর রহমান। সে এল করাচী রেডিওর চাকরী নিয়ে। ব্যস, ত্র্যহস্পর্শ। আলতাফ আবার ঝাঁপ দিলেন সংস্কৃতির জগতে।