(৫)
কমান্ডার খালেদ মোশাররফের নির্দেশ এসে গেছে। অস্ত্র এসেছে। শাহাদাৎই অস্ত্র আনার ব্যবস্থা করেছে কমান্ডার খালেদ মোশাররফের নির্দেশে। ৩৭০ আউটার সারকুলার রোডের বাড়িটা ক্রমেই অস্ত্রভান্ডার হয়ে উঠছে। কমান্ডার খালেদ মোশাররফ চাইছেন দ্রুত অ্যাকশন। আলতাফ ঠিক করলেন যে প্রথম অপারেশন হবে ৯ জুন,১৯৭১ । লক্ষ্য ঢাকায় ত্রাস সৃষ্টি করা। পশ্চিম পাকিস্তানের আহ্বানে ঢাকায় আগত বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিনিধিরা ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে উঠবে। এর আশেপাশে ৬ থেকে ৮ মাইলের মধ্যে অপারেশনটা চালাতে হবে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিরা যাতে বুঝতে পারেন যে, ঢাকা এখন আর পশ্চিম পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে নেই এবং বাঙলার প্রতিটি মানুষ পাকিস্তানীদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। আলতাফের বাসার চিলেকোঠায় জরুরী মিটিং। পাকিস্তান সেনাদলের বুকের ওপরে বসে দাড়ি ওপড়ানোর ছক করতে হবে আলতাফকে।
– এবারের অপারেশনের দায়িত্ব বাদল, স্বপন , জিয়াউদ্দিন, মায়া ও আলমের ওপরে। অপারেশন হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টাল। উদ্দেশ্য আমাদের অর্থাৎ গেরিলাদের ঢাকায় উপস্থিতি সারা বিশ্বকে জানানো।
একটু থেমে আবার শুরু করলেন আলতাফ মাহমুদ। হাতে একটা ইঁটের টুকরো। দেওয়ালে আঁক কাটলেন তিনি।
– মনে রেখো জনা ছয়েক সেনা থাকে সামনের গেটে পাহারায়। পাশে একটা কৃষ্ণচুড়া গাছ। সেখানে মাচা বাঁধা। সেখানে একজন টেলিস্কোপিক লেন্স লাগানো রাইফেল হাতে। আর্মির অতিথিদের নিয়ে যখন গাড়ি হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে ঢুকবে তখন এদেরও মনোযোগ থাকবে ওদিকে। তখন উল্টোদিকের রাস্তা থেকে তোমরা হোটেলের দিকে গ্রেনেড চার্জ করবে। ভয়ে লোকজন দৌড়োবে। সেই ভিড়ে মিশে সরে পড়বে তোমরা। বাদল গাড়ি চালাবে। স্বপন পাশে স্টেনগান নিয়ে কভার দেবে। বাকি তিনজন রাস্তা থেকে অপারেট করবে অর্থাৎ গ্রেনেড ছুঁড়বে। গাড়ি, গ্রেনেড, স্টেনগান আমি দিচ্ছি। অ্যাকশন তোমদের। ক্লীয়ার?
– ক্লীয়ার আলতাফ ভাইয়া।
তৈরী হল বাদল, স্বপন , জিয়াউদ্দিন, মায়া ও আলম এই পাঁচজনের দল। এরাই যাবে প্রথম অপারেশন করতে। সব হাতে তুলে দিয়ে চাপা স্বরে আলতাফ বললেন – জয় বাংলা। প্রত্যুত্তরে তারাও বলল – জয় বাংলা।
৯ জুন, ১৯৭১। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা। সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। এফডিসি’র ক্যামেরাম্যান বাদল গাড়ি চালাচ্ছেন। তার পাশের সীটে কামরুল হক স্বপন পিস্তল নিয়ে বসে আছে। আলী আহমেদ জিয়াউদ্দিন, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া এবং হাবিবুল আলম পেছনের সীটে বসা। জিয়াউদ্দিন, মায়া ও আলম তিনজনের হাতে তিনটি করে গ্রেনেড। স্বপনের হাতে স্টেনগান। ওদের গাড়ি রাষ্ট্রপতির বাসভবন পার হয়ে হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালের সামনে গেল। টুপি আর পাঞ্জাবি পরা অনেক লোক হোটেলের বাউন্ডারি দেয়ালের পাশে কোন অতিথির জন্যে উৎসুক অপেক্ষায়।
গাড়িটি হোটেলের সামনে মাঝামাঝি আসতেই পুলিশের গাড়ির সাইরেন শোনা গেল। ময়মনসিংহ রোড ধরে পুলিশের গাড়ির পেছনে আরো তিনটি গাড়ি আসছে। অর্থাৎ পাকিস্তান আর্মির সম্মানিত অতিথিবৃন্দ আসছেন। বাদল গাড়ি দ্রুত ইউ টার্ন নিয়ে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের গেটের সামনে ফুটপাতে রাখল। ঠিক তখনই অতিথির আগমনে দেয়ালের ওপর বসে থাকা লোকগুলো হাততালি দিচ্ছে। পাকসেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের নীল ডাটসন গাড়িটা আর তাদের উপস্থিতি টেরই পেল না। জিয়া, মায়া এবং আলম তিনটি করে গ্রেনেড হাতে নিয়ে ৩-৪ ফুট দূরে দূরে দাঁড়াল। স্বপন তার শার্টের নীচে স্টেনগান ধরে দাঁড়ালো। প্রথমে জিয়া গ্রেনেড ছুঁড়ল। অতিথি বহনকারী গাড়িটি লাফিয়ে উঠলো। গাড়ি থেকে দু’জন নামার চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না। তারপর আলম এবং মায়া পরপর গ্রেনেড ছুঁড়ল। জিয়া আবার গ্রেনেড ছুঁড়লো। তারপরে বাকিরাও পরপর গ্রেনেড ছুঁড়ে দিল। এরপর একটার পর একটা গ্রেনেড ফাটতে থাকলো হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে। আহত বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিদের চিৎকারে বিব্রত পাক বাহিনী। বিদেশিদের কাছে পরিস্কার হল যে এটা যুদ্ধ, নিতান্ত সন্ত্রাস নয়। চারদিকে জমায়েত মানুষ এই প্রথম মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ প্রত্যক্ষ করলো। নিখুঁত সময়জ্ঞানে মাপা প্রথম অপারেশনে চুড়ান্ত সফল হল গেরিলা বাহিনী।
খবর পৌঁছল মেলাঘরে, কমান্ডার খালেদ মশারফের কাছে। পুরো বর্ণনা শুনে খালেদ মশারফ বলে উঠলেন “These are crack people”। খালেদ মোশাররফের এই উক্তি থেকেই এই দলের নাম হয়ে গেল “ক্র্যাক প্লাটুন”।
৩৭০ আউটার সার্কুলার রোডে সুরকার আলতাফ মাহমুদের বাসায় ইদানিং ফকির মিসকিন, ফেরিওয়ালা, পেপারের হকারওয়ালাদের আনাগোনা বেশ বেড়ে গেছে । ঝিনু খানিকটা অবাক হয়, এরা বাড়ির দরজায় এলেই তার স্বামী ঘর থেকে বের হয়ে আসে, নোংড়া ময়লা কাপড় পড়া লোকগুলোর সাথে গুজুর গুজুর করে কথাবার্তায় ব্যস্ত, হয়তো ওদের কাছ থেকে উনি ঢাকার খবরাখবর সংগ্রহ করে, ঝিনু এমনটাই ভাবে । আলতাফকে তো ওদের সাথে কথা বলতেই হবে, ওরা যে সীমান্তে প্রশিক্ষণ শেষে ঢাকায় এসেছে গেরিলাযুদ্ধে অংশ নিতে । টাকা পয়সা, পরিকল্পনা, কাকে কোথায় শেল্টার দেয়া হবে, আলতাফের গাড়ি ব্যবহার করে এই বাসা থেকে ঐ বাসায় অস্ত্র স্থানান্তর, অপরেশন টার্গেট রেকি করতে যাওয়া সহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলতাফের সাথে ওদের কথা হয়, চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পাকিস্তানি দালাল বাঙালি রাজাকারগুলোর চোখ এড়াতেই ওরা আলতাফের সাথে দেখা করতে আসে ছদ্মবেশে ।
– আলতাফ ভাই?
– বলো হাফিজ।
– গাজী দস্তগীর মানে গফুর ভাইয়ারা এসে গেছেন। দুই মতিন, জিন্না ও নীলু।
– ওপরে চিলেকোঠায় বসাও। আসছি আমি। আর সামাদ, জুয়েল, বদিউজ্জামান আলম, পুলু ও স্বপন আসবে। ঝিনুকে বলে দাও যে ওরা যেন আমার গানের ঘরে অপেক্ষা করে।
চিলেকোঠা ঘরে ঘরে ঢুকে আলতাফ দেখলেন গফুর, দুই মতিন, জিন্না ও নীলু অপেক্ষা করছে।
– আলতাফ ভাই। গফুর, মতিনদের বেরোতে দেখলাম মনে হল। ওদের কোন অপারেশনের দায়িত্ব দিলেন?
– সামাদ, তোমার এই অতিকৌতুহল পকেটে পুরে রাখো। গেরিলারা নিজের অপারেশান ছাড়া অন্য অপারেশান নিয়ে কৌতুহল প্রকাশ করুক আমরা চাই না।
– ওহ। দুঃখিত আলতাফ ভাই। আমাদেরটা বরং বলেন।
– তোমাদেরটা অপারেশান ফার্মগেট। ফার্মগেট চেকপোস্টে হামলা। তারপরে একই দিনে গুলবাগ পাওয়ার স্টেশন উড়িয়ে দেওয়া। একই সাথে ওয়াপদা পাওয়ার স্টেশন উড়িয়ে দেওয়া।
– একসাথে এতগুলো?
– একসাথে এতগুলোই। অঙ্কের মত হিসাব করে কাজ করতে পারলে একদিনে এতগুলো অপারেশান সাকসেসফুল হবেই। এগুলিকে অকেজো করে দিতে পারলে শুধু ঢাকা নগরীই অন্ধকারে নিমজ্জিত থাকবে না, বন্ধ হয়ে যাবে দখলদার বাহিনীর রেডিও, টিভির সমস্ত প্রচার ও তাদের কর্মপ্রবাহ।
– আলতাফ ভাই, আপনি গানের শিক্ষক না হয়ে অঙ্কের হলে খারাপ হত না।
– তোমরা আগে মন দিয়ে পুরো অ্যাকশন প্ল্যান শোন। অপারেশন উলান পাওয়ার স্টেশন। আমাদের নেক্সট অপারেশান। গফুর তুমি নেতা। ট্রান্সফরমার উড়িয়ে দিতে হবে। মঞ্জুরের বাসা থেকে অপারেশান শুরু হবে। ওটাই হবে আমাদের “আর ভি”। নীলু ও গাজী আগে স্টেনগান ও গ্রেনেড৩৬ নিয়ে এগিয়ে পাহারাদারদের সারেন্ডার করাবে ও দড়িদিয়ে পিছমোড়া করে বাঁধবে। পিছনে ট্রান্সফরমারের গায়ে চার্জ বসাবে বড় মতিন। ছোট মতিন টেলিফোনের তার কাটবে। ওদের কভার দেবে জিন্না। হাফিজ ওর গাড়ি নিয়ে সবাইকে নিয়ে পৌঁছবে উলান পাওয়ার স্টেশনে। প্ল্যান ক্লীয়ার?
– ক্লীয়ার।
গাজী দস্তগীর (গফুর) এর নেতৃত্বে উলান পাওয়ার স্টেশন উড়িয়ে দেবার পরিকল্পনা হলো। সঙ্গী দুই মতিন, জিন্না, নীলুর সাথে হাফিজ । ট্রান্সফরমার উড়ানোর জন্যে ২০ পাউন্ড পি.কে. ও ১৫ ফুট প্রাইমা কর্ড বা কর্ড এক্স, প্রায় তিন মিনিট মেয়াদী সেফটি ফিউজ ওয়ার এবং ডেটোনোর লাগানোর সিদ্ধান্ত হল । দশ পাউন্ড সম্পন্ন পি.কে এর দুটি চার্জ প্রাইমা কর্ড দিয়ে সংযোজিত করে ট্রান্সফর্মারের দুপাশে ফিট করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল ।
সন্ধ্যা সাতটায় হাফিজের লাল ফিয়াট গাড়ী করে হাফিজের বাড়ি থেকে তারা রামপুরার সেই নির্দিষ্ট “আর ভি”-তে পৌছাবে এবং সেখান থেকে তারা রওয়ানা হবে উলান পাওয়ার স্টেশনের দিকে ।
অপারেশনের দিন রাত আটটায় অপারেশনের ঠিক আগ মূহুর্তে হাফিজের ফিয়াট গাড়িটি গেল বিগড়ে । অগত্য রেক্সিনের ব্যাগে বিস্ফোরক চার্জ গুলো ভরে ওঁরা রামপুরা ডি.আই.টি রোড হয়ে তিনটি রিকশা যোগে সারি বেঁধে উলান পাওয়ার স্টেশন অভিমুখে রওয়ানা হল । শুরুতেই প্ল্যানে কিছু বিপত্তি ঘটলেও, উলান পাওয়ার স্টেশনে পৌছে আর কোন অঘটন ঘটেনি । মেইন গেটের দখল, সেখানে কর্মরত পুলিশদের কানপট্টিতে স্টেনগান ধরতেই তারা অস্ত্রের মুখে সারেন্ডার করল। এবার ট্রান্সফরমারে বিস্ফোরক চার্জ এর প্রতিটি ঘটনা নিখুঁত ভাবে সম্পন্ন করল গেরিলারা ।
কিছুক্ষনের মধ্যেই ট্রান্সফরমার আর বিস্ফোরকের গর্জনে কেঁপে উঠল পুরো এলাকা, ধ্বংস হল ৩০/৪০/৫০ এমভিএ ক্ষমতা সম্পন্ন ট্রান্সফরমারটি, যার ক্ষতির পরিমান প্রায় ১৫ লাখ টাকার সমান এবং যা মেরামত অযোগ্য । ট্রান্সফর্মার বিস্ফোরনের বিকট শব্দে রামপুরা টিভি স্টেশনের সামনে থাকা পাক মিলিটারিরা সাথে সাথে রাস্তার উপর শুয়ে পড়ে পজিশন নিল । গেরিলারা অপারেশন সম্পন্ন করে ফেরার জন্য ঘুরতেই তাঁরা দেখতে পায় ঐদিক থেকে রাস্তায় প্রহরারত পুলিশরা ছুটে এদিকে আসছে এবং পুলিশরাই ওদের অবগত করে যে সামনে আর্মি পজিশন নিয়েছে । সামনে নিশ্চিত মৃত্যু, পেছনে অচেনা বিল। গেরিলারা উপায় না দেখে বিল সাঁতরে পারি দেবার সিদ্ধান্ত নেয় । বিলের ধারে গিয়ে একটি গোপন স্থান নির্বাচন করে সাথে থাকা অস্ত্র ও পাওয়ার স্টেশনের পুলিশদের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া অস্ত্রগুলো লুকিয়ে রাখে। এবারে পানিতে ঝাপিয়ে পড়ে ডুব সাঁতার, কখনো চিৎ সাঁতার দিয়ে এক সময় ওপারে গিয়ে একটি বাড়ির কাছে গিয়ে পৌছায় । তারপরে নিরাপদ আশ্রয়ে।
এরপরে ফার্মগেট অপারেশন চালাল মোট ৬ জন গেরিলা- সামাদ, জুয়েল, বদিউজ্জামান আলম, পুলু ও স্বপন। অস্ত্রশস্ত্রের মধ্যে ছিল আলমের হাতে একটি চাইনীজ এস, এম জি, বাকী সবাইয়ের হাতে স্টেনগান। একটি ফসফরাস গ্রেনেড ও একটি গ্রেনেড-৩৬ জুয়েল ও পুলুর হাতে। অপারেশনটি মাত্র তিন মিনিটেরও কম সময়ের মধ্যে সম্পন্ন হল। এই অপারেশনে মারা গেল হানাদার বাহিনীর ৫ জন মিলিটারী পুলিশ ও তাদের সহযোগী ৬ জন রাজাকার। ঢাকা সেনানিবাস, অপারেশন হেড কোয়ার্টার, এম পি এ হোস্টেল এলাকার কাছাকাছি ফার্মগেটে খান সেনাদের একটি বড় ধরনের কড়া চেকপোস্টের উপর গেরিলাদের এই দুঃসাহসিক হামলা বিশেষ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করল। একই সময় রাত্রি নয়টার দিকে গুলবাগ পাওয়ার স্টেশনটিও উড়িয়ে দেওয়া হল। ক্র্যাক প্লাটুনের পুলু, সাইদ, জুয়েল, হানিফ ও বাশার আরেকটি দলে বিভক্ত হয়ে এই অপারেশন চালায়, নেতৃত্বে ছিল জুয়েল। ওয়াপদা পাওয়ার হাউজ অপারেশন করে মায়া, সামাদ,উলফত মিলে। কাঁটাবনের উত্তর পার্শ্বস্থ কেন্দ্রের উপর হামলাটি চালিয়েছিল আলম, জিয়া, বদি – চুল্লুর গাড়িতে করে।
একটার পরে একটা অপারেশন আলতাফকে আরো আক্রমনাত্মক করে তুলল। পিছনে তাকানো নয়। শুধু সামনে তাকানোর পালা। আলতাফ তার গেরিলা বাহিনীর সাথে বসে যে কোন অপারেশানকে চারটি অংশে ভাগ করে নিতেন। প্রথম – প্ল্যানিং বা পরিকল্পনা, দ্বিতীয় – অরগানাইজিং বা সংগঠিত করা, তৃতীয় – অ্যাকশনিং বা টার্গেটে আঘাত করা ও চতুর্থ – রিট্রিট বা কোন ক্যাসুয়ালিটি ছাড়া ফিরে আসা। আলতাফ পৃথিবীর বিভিন্ন গেরিলা দলের অ্যাকশন পদ্ধতি নিয়ে পড়াশোনা করে একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন যে পৃথিবীর বেশিরভাগ গেরিলা দল তৃতীয় পর্ব অবধি ঠিকঠাক করলেও শেষ পর্বে মাথা ঠিক রাখতে পারে না। অতিরিক্ত আবেগ তাদের টেনে নেয় শত্রুপক্ষের ফাঁদে। তাদের আকুতি থাকে শহিদ হওয়ার। কাজেই এই শেষ পর্বে তারা পরিকল্পনারা বাইরেও আঘাত হানতে যায়। ফলে পেশাদার সৈন্যরা এই গেরিলাদের সহজেই নিকেশ করতে পারে। কাজেই রিট্রিট পর্বে বিশেষ জোর তিনি দেওয়ায় ক্রাক প্লাটুন দলের কাস্যুয়ালিটি বড় কম। তাই তাদের ঢাকার মানুষরা নাম দিয়েছে বিচ্ছু বাহিনী। আলতাফ সবাইকে একটা বই কয়েক কপি দিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পড়তে দিয়েছে হেনরী এলেগের ‘জিজ্ঞাসা’ । বইটাতে আছে শত্রুর হাতে ধরা পড়ার পরে কি কি উপায়ে তাদের টর্চার সহ্য করে নিতে হয়। কি কি পন্থায় টর্চার সহনীয় করে মুখ বন্ধ রাখা যায়। লিয়ন উরিসের লেখা মাইলা – ১৮ পড়তে দিয়েছে। তাতে লেখা জাতিদ্বন্দ্ব থেকে কি করে জার্মানিতে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। ক্রমে ক্রমে আলতাফ মাহমুদের শিক্ষায় ক্র্যাক প্লাটুন বাহিনী পরিণত হল দুর্দমনীয় এক গেরিলা দলে যাদের সাফল্যের খতিয়ান বিশ্বের যে কোন গেরিলা দলের সাথে তুলনীয়।
এরমধ্যে মার্কিন সিনেটর এডোয়ার্ড কেনেডির ভারত হয়ে ঢাকায় আসার কথা। মেলাঘর থেকে কমান্ডার খালেদ মোশারফ আলতাফকে বার্তা পাঠালেন যে বিদেশী অতিথি থাকা অবস্থায় ঢাকায় বড় ধরনের অপারেশন চালাতে হবে। এই বিদেশির সামনে প্রমান করতে হবে পূর্বপাকিস্থানে বাঙালি গেরিলারা যুদ্ধ করে যাচ্ছে দেশ স্বাধীন করার ব্রত নিয়ে। আলতাফ মাহমুদ ও তার সহযোদ্ধারা তৈরী হলেন। অপারেশনা হবে ১১ই আগস্ট, ৭১। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল। আবার একই জায়গায় অপারেশন। হোটেলের মূল ফটকসহ চারদিকে পাক সেনাবাহিনীর অত্যন্ত কড়া পাহারা। প্রয়োজনেও সেখানে ঢোকা কষ্টকর। আবদুস সামাদ সিদ্ধান্ত নিলেন যে-করেই হোক অপারেশন করতে হবে। একটা উপায়ও বের করে নিলেন। থাই ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনসের একটি অফিস ছিল হোটেলের শপিং আর্কেডে। আবদুস সামাদ খবর পান, ব্যবসায়িক মন্দার কারণে ওই অফিস হোটেলেরই ছোট এক কক্ষে স্থানান্তর হবে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে তিনি নিয়নসাইন ও সাইনবোর্ড তৈরির ব্যবসা করতেন। শপিং আর্কেডের কয়েকটি দোকানের নিয়নসাইন তারই করা। এ সূত্রে তিনি খবরটা পান। অন্য কেউ যাতে কাজটা নিতে না পারে সেজন্য তিনি খুব কম দরে কাজটা নেন। কাজের ফাঁকে ফাঁকে হোটেলে কয়েকদিন রেকি করেন। তারপর সিদ্ধান্ত নেন যেদিন কাজ শেষ হবে সেদিন বারের বিপরীত দিকে পুরুষদের প্রসাধনকক্ষের কোনায় দুজন মিলে বিস্ফোরক সামগ্রী রাখবেন। ১১ আগস্ট কাজ শেষ হওয়ার কথা। ওইদিন সকালে তাদের এক সহযোদ্ধা বায়তুল মোকাররম মার্কেট থেকে একটি ব্রিফকেস কিনে আনেন। ওটার ভেতরে তারা সাজিয়ে রাখেন ২৮ পাউন্ড পিকে ও ৫৫ মিনিট মেয়াদি টাইম বোমা। তারপর বিকেলে গাড়িতে চেপে রওনা হন আবদুস সামাদ, আবু বকর, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া ও গোলাম দস্তগীর অর্থাৎ গফুর। হোটেলের গাড়ি পার্কিংয়ে পৌঁছে আবদুস সামাদ ও বকর হোটেলের ভেতরে ঢোকেন। বাকি দুজন গাড়িতে স্টেনগান নিয়ে বসে থাকেন। আবদুস সামাদ ও আবু বকর হোটেল লাউঞ্জে মূল দরজা দিয়ে না ঢুকে ‘সুইস এয়ারের’ অফিস কক্ষের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢোকেন। এ ব্যাপারে সহায়তা করেন ওই অফিসেরই একজন বাঙালি কর্মী। ব্রিফকেসসহ দুজন সরাসরি প্রসাধনকক্ষে যান। আবদুস সামাদ বাইরে থাকেন কভার হিসেবে এবং বকর একেবারে কোনার কক্ষে ঢুকে দরজা আটকে টাইম বোমা চালু করে ব্রিফকেস রাখেন কমোডের পেছনে। দরজা ছিটকিনি লাগিয়ে রেখেই দেয়াল টপকে বেরিয়ে আসেন। তারপর দুজন সোজা চলে যান অপেক্ষমাণ গাড়ির কাছে। গাড়িতে ওঠামাত্র দ্রুত সেটি বেরিয়ে যায়। ৫ টা ৫৬ মিনিটে ঘটে প্রচন্ড বিস্ফোরণ। হোটেলের লাউঞ্জ, শপিং আর্কেড ও আশপাশের কক্ষের কাচ টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ে। ছিটকে যায় দরজা, ভেঙে পড়ে কক্ষের ভেতরের ও লাউঞ্জ-লাগোয়া দেওয়াল। আহত হয় বেশ কয়েজন । বিশ্ব সংবাদপত্রসমূহে বাংলাদেশে মুক্তি-বাহিনীর তৎপরতার আরেকটি রোমাঞ্চকর সচিত্র সংবাদ গুরুত্বের সাথে প্রকাশিত হল । বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি নয়, এই অপারেশনের মূল উদ্দেশ্যই ছিলো ঢাকার সবচেয়ে নিরাপদ স্থানটিতেও যে গেরিলা আক্রমণ করতে সক্ষম- তা পাকিস্তানী জান্তা আর বিশ্বকে জানিয়ে দেয়া, বকররা সেই মেসেজটি ভালভাবেই জানিয়ে দিতে দিল।
আলতাফ কয়েকদিন বেশ চাপে রয়েছেন। সেক্টর টু কমান্ডার মেজর খালেদ মোশারফ, কামালের নেতৃত্বে জনা দশেক গেরিলার সমন্বয়ে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন উড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে ঢাকায় প্রেরণ করেছেন । অপারেশনের জন্যে আট’টা শেল সহ একটা সাড়ে তিন ইঞ্চি রকেট লঞ্চারও দিয়ে দেয়া হয়েছে, এবং তা চালানোর দায়িত্ব দিয়ে সাথে দেয়া হয়েছে আর্টিলারির গানার ল্যান্স নায়েক নুরুল ইসলামকে । অস্ত্রের মধ্যে আরো আছে দুটো এসএলআর, সঙ্গে আন্যার্গী লাঞ্চার । প্রত্যেকের জন্যে একটা করে স্টেনগান, চারটা ম্যাগাজিন, দুটো গ্রেনেড আর অসংখ্য বুলেট । আলতাফ প্ল্যান করে অপারেশনের বিভিন্ন দিক নিয়ে ভাবছেন। তার হঠাৎই চে গুয়েভারার একটি উক্তি মনে এল – আমি কোনো মুক্তিযোদ্ধা নই। মুক্তিযোদ্ধা বাস্তবে কখনো হয় না যতক্ষণ মানুষ নিজে মুক্তিকামী না হয় হয়। মুহুর্তেই আলতাফ ঠিক করলেন যে এবারের অপারেশনের রেকি থেকে শুরু করে সবই যোদ্ধারা করবে তারপরে প্রেক্ষিত বুঝে অ্যাকশন। অপারেশান সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন।
১৯ আগস্ট, ৭১। বাংলা ভাদ্র মাসের প্রথম দিনটা একটা গুমোট ভাব নিয়ে আছে, আকাশে মেঘ । সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন উড়িয়ে দেবার লক্ষ্যে আলতাফের নির্দেশ অনুযায়ী কাজী কামালের নেতৃত্বে অপারেশন স্পট রেকি করতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে । গেরিলারা সন্ধ্যার পর বাড্ডার ওপারে পিরুলিয়া গ্রামের হাইড আউট থেকে দুটো নৌকা যোগে রওনা হলো । প্রথম নৌকায় কাজী, বদি, জুয়েল আর আরো দুজন, অন্য নৌকায় রুমি, ইব্রাহিম, জিয়া, আর আজাদ । আজাদ সেদিন বেশ উত্তেজিত তার প্রথম অপারেশনে আসা নিয়ে, কিছুটা নার্ভাসও । কাজীদের নৌকা কিছু একটা চেক করতে রুমীদের নৌকা ছেড়ে কিছুটা এগিয়ে যায় – অন্ধকার রাত, রুমীরা দূর থেকে কাজীদের নৌকা দেখতে পাচ্ছে না । হঠাৎ রুমিরা ভয়ানক গুলির আওয়াজ শুনতে পেলো । ওরা কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলো না । ভ্যাবাচ্যাকা অবস্থায় পড়ে যায় প্রথম অপারেশন আসা আজাদও । গুলির শব্দ থামতেই কিছুক্ষণ পর কাজীদের ফিরে আসতে দেখে রুমীরা আর জানতে পারে বৃত্তান্ত ।
জুয়েল আর কাজীর স্টেনগান নৌকার পাটাতনে লুকিয়ে রেখেছিলো, কিন্তু কাজীর নিষেধ সত্ত্বের বদি কোলের উপরেই রেখেছিল, টিগারের উপর আঙুল জড়িয়ে বসে ছিলো ও । কাজীরা একটা মিলিটারি ভর্তি নৌকার সামনে পড়েছিলো, মাঝিটা ছিলো রাজাকার – সে বাংলায় জানতে চায় – “কে যায়”, অন্ধকারে মিলিটারিগুলো একদম চুপ মেরে ছিলো । প্রশ্নের উত্তরে কাজী ঘুরিয়ে জবাব দেয় – “সামনে” । নৌকাটা একেবারে কাছে আসতেই ওদের চোখে পড়ে নৌকাভর্তি মিলিটারি । ভাগ্যিস বদি ওর স্টেনগান হাতেই রেখেছিলো – মিলিটারি দেখা মাত্রই কেউ কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই বদি ফায়ার করে, পাকিদের নৌকা বরাবর ব্রাশফায়ার চালিয়ে যায় । বদির ব্রাশের মুখে টিকতে পারেনি পাকিরা, যদিও ওরা গুলি চালিয়েছিলো – সেই গুলিই এসে লাগে জুয়েলের আঙুলে, তিনটি আঙুল ভয়ংকর রকম জখম হয় জুয়েলের । মিলিটারিদের বেশ কয়েকটা মরে, বাকিগুলো পানিতে ঝাপিয়ে পড়ে সাঁতরে প্রাণ নিয়ে পালায় ।
জুয়েল মারাত্মক জখম হওয়ায় ওরা সেখান থেকেই পিরুলিয়ার হাইডহাউসে ফিরে আসে আর ওখানেই রাত কাটায় । জুয়েলকে দ্রুত চিকিৎসা দেয়া প্রয়োজন থাকলেও এই রাতে তা আর সম্ভব ছিলো না । পরদিন কাজী আর বদি মিলে জুয়েলকে নিয়ে যায় ডাঃ রশিদ উদ্দিনের চেম্বারে । ডাঃ রশিদ তাঁর রেডক্রস চিহৃ আঁকা গাড়িতে করে জুয়েলকে নিয়ে যান রাজারবাগে ডাঃ মতিনের ক্লিনিকে । সেখানে অপারেশন করে ব্যান্ডেজ বেঁধে দেন ডাঃ মতিন ।
২৫শে আগস্ট সন্ধ্যায় সাংঘাতিক দুটো ঘটনা ঘটে গেছে, এর ওর মুখে মুখে চড়ে খবরটা ঢাকার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়লো, ছোট ছোট জটলায় ফিসফিস করে বিস্ময় নিয়ে সেই আলাপই চলছে ঘরে বাইরে । উত্তেজনায় ভরপুর কেউ একজন ঘটনার বর্ননা করছে তো অন্যরা চোখ বড় বড় তা গিলছে । জটলার কেউ হয়তো বলে উঠছে – কি সাংঘাতিক ! কেউ হয়তো বলছে – কি বেপরোয়া কান্ড রে বাবা ! কেউ হয়তো বলছে – তারপর কি হলো ? … সাংঘাতিক সেই ঘটনা জনে জনে ফেরি হচ্ছে আর আনন্দে ভরে উঠছে ঢাকাবাসীর হৃদয়কোন। শহর জুড়ে হুলস্থুল ফেলে দেয়া সেই ঘটনাটা ঘটে ২৫ তারিখ সন্ধ্যা ৭টার কিছু পরে, কয়েকজন বিচ্ছুর দল ধানমন্ডী ১৮ নম্বর রোডে এক ব্রিগেডিয়ারের বাড়ির সামনে এ্যাকশন করেছে, সেখানে পাহাড়ারত জনা দশেক মিলিটারি পুলিশকে খতম করে দিয়েছে চোখের নিমেষেই; ১৮ নম্বরে এ্যাকশন শেষ করে ৫ নম্বর রোডের মাথায় চেকপোস্টে বাধার মুখে আবারো গুলিবর্ষণ- এইবার দুজন আর্মি খতম; চেকপোস্ট পেরিয়ে যেতেই আবার নতুন বিপত্তি, পেছনে ফেউ হয়ে তেড়ে আসছে আর্মির জীপ – চলন্ত গাড়ী থেকে বিচ্ছুগুলো নস্যাৎ করলো সেই তেড়ে আসা। নিজেদের গাড়ীর পেছনের কাঁচ ভেঙ্গে তিনটি স্টেনগান থেকে ছুটে যাওয়া গুলির ঝড়ে উল্টে গেলো তেড়ে আসা আর্মি জীপটি, সব কয়টা খতম …।
ঢাকা কাঁপছে খবরে খবরে। বিচ্ছুদের গাজুরিয়া মারে খান সেনা উর্দি নষ্ট করে ফেলছে যখন তখন। ‘মুক্তি’ শব্দতেই কেঁপে উঠছে বাহিনী। ব্যারাক থেকে বেরোতেই ভয় পাচ্ছে তারা। মানুষ বুঝতে পারছে দিন পাল্টাচ্ছে। নতুন সূর্য ওঠার আর বেশি দেরী নেই।
(৬)
আলতাফ ভিয়েনায় যেতে না পেরে কিছু তরুণ বাঙালি ছাত্রের সহযোগিতায় মডেল ক্যাপিটাল এরিয়াতে এক বাঙালি পরিবারের সঙ্গে সেখানে থেকে যায়। এর মধ্যে করাচীতে চাকরী নিয়ে এসে গেছে নিজামুল হক। দুজনে মিলে লালুঘাটের রিকশাওয়ালাদের নিয়ে ‘রিকশা অ্যাসোসিয়েশন’, ‘কুলি অ্যাসোসিয়েশন’ প্রভৃতি সংগঠন তৈরী করে তাদের বামপন্থী কাজকর্মের সূত্রপাত ঘটায় এবং ‘করাচি কালচারাল অ্যাসোসিয়েশন’ নামে আরেকটি সংস্থা তৈরী করে সব বাঙালিকে একজোট করতে সক্ষম হল এই দুই তরুন। তারা তখন মূলত নজরুলসঙ্গীত, পল্লীগীতি ইত্যাদি গাইছে এবং ‘সাইক্লোন’ নৃত্যনাট্য করে তারা যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছে।
ইতিমধ্যে করাচিতে প্রথম গ্রামোফোন রেকর্ড । যার গীতিকার ও সুরকার আলতাফ নিজেই, রীতিমত জনপ্রিয় হয়ে উঠল। পালের নৌকা পাল উড়াইয়া যায় ও কন্যা আর যাইও না ওই না ঘাটেতে । দ্বিতীয় রেকর্ড বেরোতেই আবার জনপ্রিয়তা – দ্বৈত কণ্ঠে জাহানারা লাইজুর সঙ্গে জাল ছাড়িয়া দে রে, জাইলা কাছি তুইলা দে এবং অপর পিঠে – ‘হাতে মেহেন্দি ঝকমক কানে ঝুমকার ফুল’ এ গান দুটির সুরকার আলতাফ মাহমুদ – গীতিকার নিজামুল হক। কিন্তু তখনই সহশিল্পীদের রাজনীতির স্বীকার হতে হল আলতাফকে। আলতাফকে কাজ থেকে বঞ্চিত করা শুরু হল সম্মিলিত উদ্যোগে। কেন? আলতাফ বড় দ্রুত নাম করে ফেলছে যে।
এই টানাপোড়েনের রাজনীতিতে মনটা বড় হাঁচোরপাঁচোর করে উঠল তার দেশের জন্যে। আলতাফ ফিরে এল দেশে। সোজা ঢাকা, সেখান থেকে একেবারে বরিশালে। বরিশালও বহুদিন বাদে আলতাফকে পেয়ে মেতে উঠল সুরের নেশায়। ‘বরিশাল শিল্পী সংসদ’ বরিশাল টাউন হলে আব্দুল মালেক খান পরিচালিত ‘মায়ামৃগ’ নাটক মঞ্চস্থ করল। সঙ্গীত পরিচালনায় সেই আলতাফ মাহমুদ। এই অনুষ্ঠানে আলতাফের অবশ্যই প্রাণের শান্তি মেলে। কিন্তু আর্থিক দৈন্য তো সাথী হয়ে আছে তার সাথে। অতএব পুনরায় ঢাকা যাত্রা। সেখান থেকে করাচী। কখনও কাজ, কখনও কর্মবিহীন। মাঝে মাঝে ঢাকা ফেরা আবার করাচীতে চলে আসা।
ক্যামেরাম্যান আনোয়ারুল ইসলাম যার পরিচিতি বেবী ইসলাম নামেই, তিনি ঠিক করলেন নিজে একটি ছবি বানাবেন। তার তখন খুবই খ্যাতি। ঋত্বিক ঘটক, সত্যজিত রায়, জহির রায়হান – সবার সাথে কাজ করেছেন। এবার নিজে ছবি বানাবেন। ছবির নাম ‘তানহা’। একদিন তিনি করাচীর বাসভবনে ড্রয়িং রুমে বসে বন্ধুদের সাথে গল্প করছেন। টিভি চলছে নিজের মত। হঠাৎ খেয়াল করলেন যে একটি ভারী মত ছেলে বাংলা গান শেখাচ্ছে। তার শেখাবার পদ্ধতি ও অপূর্ব কন্ঠস্বর শুনে বেবী লাফিয়ে উঠলেন সোফার থেকে। অ্যাসিস্ট্যান্টকে ডেকে বললেন ছেলেটির সাথে যোগাযোগ করতে। দু’দিন পরে আলতাফ এল বেবী ইসলামের বাসায়। সাথে সাথেই প্রস্তাব ‘তানহা’ ছবির সঙ্গীত পরিচালনার। বিস্ময়ে আলতাফ নির্বাক হয়ে রইল।
এরপরের ঘটনা আলতাফের সঙ্গীত জীবন বইয়ে দিল অন্য খাতে।
– আদাব, আমি আলতাফ মাহমুদ। আমাকে জনাব আফতাব আহমেদ আসতে বলেছেন।
– হ্যাঁ,হ্যাঁ, আসো আসো, বসো। চা খাবা তো?
সঙ্গীত পরিচালক দেবু ভট্টাচার্যর করাচীর বাসায় সেদিনই প্রথম এল আলতাফ মাহমুদ। করাচীতে এসে আলতাফ বুঝেছিল যে সঙ্গীত জগতে প্রতিষ্ঠা পেতে হলে গুণী শিল্পী ও গুরুর সান্নিধ্যে যেতে হবেই। ইতিমধ্যে দিকপাল সরোদিয়া পন্ডিত তিমির বরণ সঙ্গীত পরিচালনার কাজে করাচীতে এসেছেন। তিনি আবার সঙ্গীত সম্রাট বাবা আলাউদ্দিন খাঁ’র ছাত্র। ‘দেবদাস’ ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনা করে তিনি আকাশ ছোঁয়া জনপ্রিয়তা পান। সাথে এসেছেন তাঁরই ছাত্র ও সহকারী আরেক ওস্তাদ দেবু ভট্টাচার্য। এদের সুর করা গান ছোটবেলা থেকে আলতাফের কন্ঠে। চলচিত্রের সঙ্গীত পরিচালনার জন্য তাঁরা করাচীতে এসেছেন। আলতাফের খুব ইচ্ছে এঁদের সাহচর্য পাওয়ার। খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয় নি আলতাফকে। করাচী রেডিওর বাংলা সংবাদ পাঠক আফতাব আহমেদ ও দেবু ভট্টাচার্য ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কথায় কথায় আফতাব দেবুকে জানালেন আলতাফের কথা, তার সঙ্গীত প্রতিভার কথা, শাসক দ্বারা নিগ্রহের কথা। দেবু আফতাবকে বললেন যে ছেলেটিকে পাঠিয়ে দিও।
– আলতাফ, তোমার সুখ্যাতির কথা তো আফতাব বলেছে। তুমি ভাল বেহালা বাজাও, কন্ঠস্বরও ভাল, ভাষাশহিদদের জন্য গানে সুর দিয়ে তুমুল জনপ্রিয়। পাক্কা দেশপ্রেমিক। কিন্তু এখানে যে বাঙালিদের মধ্যে আটকে গেছো তাতে কি তুমি এগোতে পারবে?
– না, না, সেজন্যেই ভাবছি আপনার নির্দেশমত চলব। সেজন্যেই এসেছি।
– ঠিক আছে, তাহলে আমার সাথে কাল দেখা করো।
– সে কী! কোথায়? কিসের জন্য?
– কাল তুমি এই ১০৯ আলমগীর রোড অর্থাৎ এই বাসায় চলে আসবে সকাল দশটায়। আমি জানি তোমার দামী কিছুই নেই, তবু যা আছে মানে যদি কিছু থাকে সব নিয়ে চলে আসবে। এখানে, আমার সাথে থাকবে। আমার যা আয় দুজনের চলে যাবে।
স্বপ্ন যখন সত্যি হয় এমন অপ্রত্যাশিত ভাবে হয় বুঝি? ঘটনার অভিঘাতে নির্বাক হয়ে রইল আলতাফ।
এর পরে আলতাফকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয় নি। দেবু ভট্টাচার্যের মাধ্যমে পন্ডিত তিমির বরণের শিষ্যত্ব গ্রহণ করল আলতাফ। শুধু বাঙালিদের মধ্যে নিজেকে বিলিয়ে না দিয়ে উর্দু ভাষা ও সংস্কৃতি থেকে মণিমুক্তো সংগ্রহ করতে লাগল আলতাফ। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের ভাব ও চলন শিখতে সে নাড়া বাঁধল ওস্তাদ আবদুল কাদের খাঁ’র কাছে। ধীরে ধীরে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে রীতিমত পারদর্শী হয়ে উঠল আলতাফ।
‘তানহা’ ছবিতে আলতাফ তার অর্জিত সঙ্গীত শিক্ষাকে সম্পূর্ণভাবে প্রয়োগ করল। ছবির তিনটি গান ও আবহ সঙ্গীতে নিজেকে ঢেলে দিল আলতাফ। ছবি মুক্তি পেতে বেশ দেরী হচ্ছিল। কিন্তু আলতাফের কন্ঠে গাওয়া গান ‘ও রাহি নাদান’ জনপ্রিয়তার লেখচিত্রে নতুন মাত্রা সংযোজন করেছিল। কিন্তু সেটা পরবর্তী কাহিনী।
আজ মেহফিল বসেছে করাচীর এক বিশিষ্ট মানুষের আলিসান প্রাসাদে। গাইবেন ওস্তাদ বড়ে গোলামা আলি খাঁ সাহেবের সু্যোগ্য পুত্র ওস্তাদ মুনাওয়ার আলি খাঁ। সাথে সুর সম্রাজ্ঞী রৌশোন আরা । ভাব গম্ভীর পরিবেশ। মেহমানরা সব একে একে এসে তশরীফ নিচ্ছেন। আলতাফ ভাবছে ওস্তাদ মুনাওয়ার আলি খাঁর পাতিয়ালা ঘরানার দ্রুত তৈরী তান ও ঠুংরী অঙ্গের গান আজ শুনে যতটা সম্ভব আত্মস্থ করতে হবে। ‘ইয়াদ পিয়া কি আয়’ বা ‘ কা করু সজনী’ কিংবা ‘হরি ওম তৎসৎ’ গাইতে গাইতে ওস্তাদ অন্য স্তরে চলে যান। ওদিকে রৌশন আরা’র গলার আওয়াজ চড়া। আবদুল করিম খাঁ’র স্টাইলে ঠুঙরী গাইতে গাইতে গলা সুন্দরভাবে ভাঙেন। বিলম্বিত আড়া চৌতালে বা তিলওয়ারা তালে এক দমে তান নিয়ে অনায়াসে মুখে ফিরে আসা , এ শুধু রৌশন আরা’র পক্ষেই সম্ভব।
– আভি ম্যায় আজ সাম’কা পহেলা উস্তাদকো পেশ করনে যা রহা হুঁ… অল্প থামলেন
এই সন্ধ্যার সুত্রধর বয়োবৃদ্ধ ওস্তাদ ফকির আলী খাঁ। সবাই উৎসুক মুখে ওস্তাদের দিকে তাকাল। কে সেই প্রথম শিল্পী।
– আজ কা পহেলা উস্তাদ বাংগাল কা শের উস্তাদো কি উস্তাদ আলতাফ মাহমুদ।
চমকে উঠল আলতাফ। তাকেই ডাকা হচ্ছে যে। মুখ থেকে স্বতঃপ্রনোদিত হয়ে বেরিয়ে এল –
– ইয়ে মেহমিল মে ম্যায়? কেয়া গাঁউ ওস্তাদ।
– তুম তো ফনকার হো বেটে। ফনকার কা দিল মে যো গানা চাহে ওহি সহি হোগা।
আলতাফ ধরলেন দরবারী রাগে বাংলার রাগসম্রাজ্ঞী ইন্দু বালার গাওয়া ‘ওরে মাঝি, তরী হেথা বেঁধো নাকো’। ধীরে ধীরে তার যেন চেতনা লুপ্ত হয়ে যাচ্ছিল। চশমা ঢাকা চোখ দু’টি বোঁজা। সারা মুখে ধ্যানমগ্নতার প্রশান্তি। আত্মভোলা সুরের নীরব পদচারনা সমস্ত আসর জুড়ে। পূর্বের ভূগোল থেকে উঠে আসা এই আলতাফ নামধারী ফনকারের গায়ন অঙ্গের কাজরি, পূর্বী, চৈতির যে কী ভাব, অনুভূতি, কথন, বলন, দোলন ও রকমের বিস্তার তা নির্বাক করে রেখেছে ঘরভর্তি সমস্ত রসিকদের। অবশেষে আলতাফ গান শেষ করল। ঊস্তাদ ওমরাও বুলু খাঁ আনন্দে বলে উঠলেন – শোভান আল্লাহ, য্যায়সা আওয়াজ, ওহি সা ধুন, এক সে এক বেহতর হ্যায়। একবার মেরা ঘর আনা ভাই।
প্রখ্যাত উর্দু কবি হাফিজ জলন্ধরী ও ফয়েজ আহমেদের সাথে বন্ধুত্বের সুবাদে আলতাফ দ্রুত উর্দু ভাষায় চোস্ত হয়ে উঠল। এর মধ্যে করাচী রেডিওতে সঙ্গীত পরিবেশনা সে করছে নিয়মিত। কখনও বাংলা, কখনও উর্দু, কখনও লালন, কখনও হাছন রাজা, কখনও রবি ঠাকুর। কখনও নজরুল।
প্রখ্যাত বাংলা উপন্যাস ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ র ওপরে ভিত্তি করে এ জি কারদার নতুন সিনেমা ‘ জাগো হুয়া সাভেরা’ শুরু করছেন। সে ছবিতে একটিই গান। তিনি নিলেন আলতাফকে। অতএব ছবির একমাত্র গান ‘হাম হর নদি কা রাহা’য় কণ্ঠদান। আবার জনপ্রিয়তা। এই গানটির সুর ও এ ছবির আবহসংগীত আলতাফ করেছিলেন তার অজ্ঞাতবাসের সময় এক জেলের বাসায় থাকার সময় শোনা মাঝি মাল্লার গানের সুরে। গাঙমোহনার সুর যে সারা পাকিস্তানে এত জনপ্রিয় হবে আলতাফ ভাবেই নি। আসলে সুরের সঙ্গীতের কোন দেশ বা কাল হয় না, এ কথাটা নতুন করে উপলব্ধি করল আলতাফ।
দেরী করে হলেও এতদিনে ‘তানহা’ ছবি মুক্তি পেয়েছে। মুখে মুখে ফিরছে তার গান। আলতাফ চলে গেলেন খ্যাতির মধ্যগগনে। ‘তানহা’ ছবির আর্থিক সাফল্যের পর ঢাকার পরিচালকরা ঝুঁকলেন উর্দু ছবি তৈরীর দিকে। সবাই আলতাফকে চায়। কাজেই চলে এল ঢাকার ডাক। প্রস্তুত হল আলতাফ। এবারে ঢাকায় ফিরবে সে। এবারে কর্মক্ষেত্র হোক দেশের মাটি।
– ক্যায়া জনাব, আজ ক্যায়া খ্যায়াল হ্যায়? মেরা সাথ যাওগে ইয়া ঘরপেই রহোগে?
– কাঁহা যানে কা বাত কর রহে হো, দোস্ত ?
– কিঁউ সামীম ভাই কা কোঠি মে। হিন্দুস্তাঁ সে এক তওয়ায়েফওয়ালি আয়ি। বহোত খুব গাতী হ্যায়।
এখানেই প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে আলতাফের। ভাল সঙ্গীতের জন্যে সে দোজখে যেতেও প্রস্তুত। সঙ্গী কবির সাথে সন্ধ্যের মুখেই বেরোল আলতাফ।
কিন্তু আলতাফ পৌঁছে দেখল নিতান্ত ব্যক্তিগত আয়োজন করা হয়েছে তার জন্যে। আরো দুজন উর্দু কবি ও শায়ের এসে যোগ দিলেন তাদের সাথে। সবাই পূর্ব পরিচিত। আসলে শোনাবার মত মানুষ আর গাইবার মত মেজাজ এই দুই মিলে না গেলে যে কোন গানের আসরই হাট সংকীর্তনের আসর হয়ে ওঠে। দুই গাইয়ে। একজন অবশ্যই ভারতের। আরেকজন পাকিস্তানি। ভারত থেকে আসা বিজলিবাই শুরুতেই ধরল একটি কাজরী গান। কাজরী দেবীর পুজোর দিন সালাঙ্কারা হয়ে হিন্দু ও মুসলমান নারীরা এ গান গায়। আলতাফের বেশ লাগছিল এই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির গানটি। চোখের সামনে যেন বর্ষার রূপ ফুটে উঠল। গান শেষ হতেই আলতাফের কন্ঠ থেকে ছিটকে বেরোল – যদি ছুন্নত দিলে হয় মুসলমান, নারীর তবে কি হয় বিধান… গান শেষ হতেই পাকিস্তানি গায়িকাটি বলে উঠল-
– সে কী, আপনি লালন ফকিরও জানেন।
– বাঙালি যখন লালন তো জানবই। কিন্তু আপনি কি বাঙালি?
– না না। আমি করাচীর। আমার নাম মেহের। মেহেরুন্নিসা। আমার মা বাঙালি। তাই ভাষাটাও বলতে পারি আর কিছু গান তো অবশ্যই জানি।
তাদের বাংলা কথোপকথনে অন্যান্যদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটছিল। মেহের ধরল একটি ঠুমরি – পিয়া পরদেশ মোরা মনহ/ রহে কৌন মোতন কি দ্বার… ঠুমরির এই ছটফটানিহীন শান্ত ভাবটা ভারী ভাল লাগে আলতাফের। যদিও এই শান্ত ভাবটা ধ্রুপদে আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মেহের শান্ত সমাহিত হয়ে উঠল গানের সঞ্চরনে। দেদীপ্যমান হয়ে উদ্ভাসিত ঔজ্জ্বল্যে স্থির। এক-একটি খটকা অথবা মুর্কীর ছোট ছোট কাজ লাগছে ওর চিকন গলায়। ভাল গায়িকার মত তাৎক্ষণিক সম্রাজ্ঞী বোধ হয় সত্যিকারের কোন সম্রাজ্ঞী কখনই হতে পারেন না। গায়িকার সাথে শ্রোতার হৃদয়ের যে যোগাযোগ তা মুহুর্তের মধ্যেই ঘটে। গান শেষ হতেই আলতাফ ধরল – বাবুল মোরা নৈহর ছুটেহি যায়। সাঁঝের এই প্রহরে দরবারী কানাড়া ধরলে বেশ হত হয়ত। অথবা মালকোষ। কিন্তু আলতাফের আত্মশ্লাঘা এই অসময়ে তাকে দিয়ে ভৈরবী ধরাল। ভর সন্ধ্যায় যদি সে ভৈরবী গেয়ে আসর না মাত করতে পারে তাহলে কিসের শিল্পী সে! আল্লাহ, কখনও কখনও যেমন সাধকদের ওপরে ভর করেন, গানও ভর করে গায়কের ওপরে। আজ যেন গান ভর করেছে আলতাফের ওপরে। মুহুর্তে এই গানের আসর যেন পরিণত হল আওয়াধের শেষ নবাব ওয়াজেদ আলী শাহের দরবারে।
আসর শেষ হতেই মেহের আলতাফকে বলল যে সে অপেক্ষা করে। আলতাফ তার বন্ধুর সাথে একই জায়গায় বসে রইল। বন্ধু এই ফাঁকে রসিকতা করতে ছাড়ল না।
– মিয়া, আভি আগর ইয়ে লড়কি ঘর বসানে কা বাত করে তো কেয়া করোগে?
– পেড় মে কাঁঠাল, মোচ মে তেল।
– কেয়া?
– সমঝোগে নেহি। ইয়ে বাঙ্গাল কা কহাওত হ্যায়।
কিছু সময়ের মধ্যেই অন্দরমহল থেকে ডাক এল। মেহের ডাকছে। আলতাফ মহালে ঢুকতেই সে বলল-
– আপনার গান শুনে তো আমি পাগল হয়েছি কিন্তু আমি কেমন গাইলাম বললেন না তো।
– একটা বাংলা কবিতা মনে পড়ছে। শুনবে?
– শোনান।
– আমার এমন কিছু দুঃখ আছে যার নাম তিলক-কামোদ/ এমন কিছু স্মৃতি যা সিন্ধুভৈরবী/ জয়জয়ন্তীর মত বহু ক্ষত রয়ে গেছে ভিতরে দেয়ালে/ কিছু কিছু অভিমান/ ইমন-কল্যাণ। /সরোদ বাজাতে জানলে বড় ভাল হতো/ পুরুষ কীভাবে কাঁদে সে-ই শুধু জানে।/ কার্পেট সাজানো প্রিয় অন্তঃপুরে ঢুকে গেছে জল।/ মুহুর্মুহু নৌকোডুবি, ভেসে যায় বিরুদ্ধ নোঙর।/পৃথিবীর যাবতীয় প্রেমের সপ্তডিঙা ডুবছে যেখানে/ সেখানে নারীর মত পদ্ম ফুটে থাকে।/ সবকিছু কেড়ে নেয়, কেড়ে নিয়ে ফের ভরে দেয়/ বাসি-হয়ে-যাওয়া বুকে পদ্মগন্ধ, প্রকাণ্ড উদ্যান।/এই অপরূপ ধ্বংস, মরচে-পড়া ঘরের-দোরে চাঁপা রঙে এই চুনকাম/ দরবারী কানাড়া এরই নাম ?
– বাব্বা, ইতনা বড়া তোফা আমাকে কেউ কখনও দেয় নি। আমিও বদলি তোফা দেব। নেবেন তো?
– কি দেবে?
এক ঝটকায় নিজের বুকের মাঝে এক রক্তবর্ণ দাগের ওপরে তর্জনী রাখল মেহের।
– এটা আমার জন্মদাগ। যেদিন মর্জি হবে সেদিন এসে এই জন্মদাগের ওপরে নিজের মালিকানা জারি করবেন। আমি অপেক্ষায় থাকব।
আলতাফ দ্রুত বেরিয়ে এল ঘর থেকে। সঙ্গী বন্ধুকে নিয়ে বেরিয়ে এল মহাল থেকে। বন্ধুটি বারেবারে জিজ্ঞাসা করল – কি বলল মেহের? আলতাফ উত্তর দিল – তেমন কিছু না। যেতে বলল আবার যদি ইচ্ছে হয়।
বাসায় ফিরেও আলতাফ কিছুতেই ভুলতে পারল না দৃশ্যটি। এভাবেও প্রেম নিবেদন করা যায়! এত সরাসরি! ঘুমের মধ্যেও ঘুরে ফিরে আসতে লাগল দৃশ্যটি। আলতাফ আর দেরী করল না। কয়েক দিনের মধ্যেই সে উড়ে গেল ঢাকার উদ্দেশ্যে।
(৭)
শরীফ ইমাম বাসায় ফিরে নিজের জ্যেষ্ঠ পুত্র রুমিকে দেখে গর্জে উঠলেন –
– “তুমি ফিরে এসেছো কি করতে ? তোমার তো ঢাকায় থাকার কথা না!”
– না আব্বা, কিছু অস্ত্র রাখার জন্যে আসতে হয়েছে।
– কিসের অস্ত্র?
– নতুন কিছু স্টেনগান ও গোলাবারুদ এসেছে মেলাঘর থেকে। সেগুলো রাখার জন্যে আসতে হল।
– সে কী! তুমি এত বড় অ্যাকশন করে এলে, এতগুলো আর্মি মারলে, তারপরে নিজের বাসায় অস্ত্র নিয়ে এসেছ? আর্মি কি চুপ করে বসে থাকবে? এতগুলো ক্যাসুয়ালিটি হয়েছে ওদের। ওরা ঢাকা শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছে পাগলের মত তোমাদের ধরতে। আর তোমরা… কোথায় রেখেছ অস্ত্রগুলো।
– গ্রাউন্ডফ্লোরের ট্যাঙ্কে। ট্যাঙ্ক খালি করে দুটো টুল ভেতরে ট্যাঙ্কের কোণায় রেখে তার ওপরে আর্মসগুলো ছালা আর প্লাস্টিক দিয়ে বেঁধে রেখে আবার পানি ভর্তি করেছি। কোণায় এমনভাবে টুল রাখা আছে যে- শুধু উঁকি দিয়ে দেখার উপায় নাই, কেউ যদি নামে, তাহলেই দেখতে পারবে ।
– কতদিন রাখবে?
– একরাতের ব্যাপার, কালই সরিয়ে ফেলা হবে।
– গেরিলা যুদ্ধের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল যুদ্ধ ব্যাপারটাকে খুব সহজ ও সরলভাবে নেওয়া। শত্রু সৈন্যদের আক্রমণ করে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পালিয়ে যাওয়া। পালানোটা যুদ্ধের একটি কৌশল।
– আব্বা, আমরা কাল রাতে বা পরশু সকালেই চলে যাব।
আলতাফ মাহমুদের কাছে কমান্ডার খালেদ মশারফের অবিলম্বে দেশ ছাড়ার নির্দেশ এসে পৌঁছেছে। আলতাফ ভেবেও রেখেছেন সেপ্টেম্বরের ৩ তারিখ তিনি মেলাঘর চলে যাবেন। কিন্তু ইতিমধ্যে তাদের গেরিলা দল ক্র্যাক প্লাটুন যে পরপর এতগুলো সফল অপারেশন করতে পারবে এতটা প্রত্যাশা তিনি করেন নি। এদিকে পাক সেনারা পাগলা কুকুরের মত হিংস্র হয়ে উঠেছে। সমস্ত ঢাকা জুড়ে আর্মি ব্যারিকেড করে চুড়ান্ত খানাতল্লাসি চালাচ্ছে। এদিকে হোটেল ইন্টারকনে ১১ অগাস্টের বিস্ফোরনের জন্যে পাঠানো প্রচুর অস্ত্র ও গোলা বারুদ বেঁচে গেছে। কিন্তু রাখা হবে কোথায়? কোথায় পাঠানো হবে? কোন জায়গাই নিরাপদ নয়। সবাই খুবই বিব্রত, শঙ্কিত ও চিন্তিত। বয়োজ্যেষ্ঠ দলনেতা আলতাফ মাহমুদ দায়িত্ব নিলেন। রাতের অন্ধকারে তাঁর কালো অস্টিন ক্যাম্ব্রিজ গাড়ির পিছনে ভরে সব অস্ত্র গোলাবারুদ আনা হল আলতাফের বাসায়। রাতারাতি আলতাফের তাঁর দুই শালা, সহকারী হাফিজ ও ক্র্যাক প্লাটুনের যোদ্ধা আবদুস সামাদের সাহায্যে অস্ত্র আনা হল। সামাদ চলে যেতেই উঠোনের কাঁঠাল গাছের নীচে সমস্ত অস্ত্র পুঁতে ইট বালি দিয়ে ঢেকে দেওয়া হল। এই অস্ত্রাগারের দায়িত্ব কার হাতে দেবে আলতাফ? এই উদ্বেগে তিনিও ভাঙলেন গেরিলা যুদ্ধের থাম্ব রুল তা হল অ্যাকশনের পরে এলাকা থেকে সরে যাওয়া। তিনি থেকে গেলেন ঢাকায়।
২৯শে আগস্ট। আলবদরের কর্মীদের তথ্য মতো সকাল ১১ টায় বদিউল আলম ধরা পড়ে ঢাকা কলেজের প্রিন্সিপাল জালালউদ্দিনের বাসা থেকে। বিকাল ৪ টার সময় ধরা পড়ে আব্দুস সামাদ। দুজনের উপর চালানো হয় অমানুষিক নির্যাতন, সহ্য না করতে আবদুস সামাদ মুখ খুলে এক এক করে বলে দিল সকল সহযোদ্ধার ঠিকানা, অপারেশনের বৃত্তান্ত । দ্রুত তৈরী হল পাক বাহিনীর অ্যাকশন লিস্ট। ৩৫৫ এলিফ্যান্ট রোড – শফি ইমাম রুমী, ২০ নিউ ইস্কাটন – হাফিজ উদ্দিন , ২৮, মগবাজার – মাগফার উদ্দিন চৌধুরী আজাদ ও আবদুল হালিম চৌধুরী জুয়েল , গুলশান-২ এর ৯৬ নম্বর সড়কের ৩ নং বাড়ি – আবু বকর, ৩৭০ আউটার সার্কুলার রোড আলতাফ মাহমুদ, ৩০ নম্বর হাটখোলা – ফতেহ আলী চৌধুরী আর শাহাদাৎ চৌধুরী।
বদি আর সামাদের ধরা পড়বার খবর পেয়ে ইশতিয়াক আজিজ উলফাত ঊর্ধ্বশ্বাসে বেরিয়ে যায়। বেবিট্যাক্সিতে চড়ে চলে যায় ৩০ নম্বর হাটখোলা, ফতেহ আলী চৌধুরী আর শাহাদাৎ চৌধুরীর বাসায়। গেটের সামনেই পেয়ে যায় ফতেহকে, জানায় রেইড আসন্ন। শাহাদাৎ চৌধুরী তখন মেলাঘরে চলে গেছেন, কিন্তু রিস্ক তারপরও ছিল। বাবা ডিসট্রিক্ট জাজ আবদুল হক চৌধুরী, মা, তিনটা বোন মারিয়াম, ঝিমলি আর ডানা- প্রত্যেকেই ছিল মুক্তিযোদ্ধা। অস্ত্র গোলাবারুদ লুকিয়ে রাখা, সেগুলি পরিচর্যা করা, যত্ন নেওয়া, মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেওয়া, আপনজনের মতো দেখভালসব কিছুই এরা অদ্ভুত নিষ্ঠার সাথে করতেন। তাই খবরটা পাওয়ামাত্র তিন বোনকে উলফাতের বেবিট্যাক্সি করেই আরেক বোনের বাসায় নিয়ে যায় ফতেহ। তারপর সেইখান থেকে চলে যায় এলিফ্যান্ট রোডে, জাহানারা ইমামের বাসা খুঁজতে। কিন্তু বহু খুজেও প্রিয় সহযোদ্ধা রুমির বাসাটা খুঁজে পায় না ও। ভয়ংকর দুর্ভাবনায় বিফল মনোরথে ফিরে যায় ফতে।
যুদ্ধের কঠিন সময়ে দিনরাতের কোনো আলাদা প্রহর হয় না।
“মামা আমায় কিছু অস্ত্র যোগাড় করে দিতে পারো? আমি পাকিস্তানি হায়েনাদের দেখিয়ে দিতে চাই সারাদেশের মতো ঢাকা শহরেও মুক্তিযুদ্ধ চলছে। আমি আমার বন্ধুদের নিয়ে ঢাকা শহরে অপারেশন চালাবো। এদেশকে আমরা সত্যি সত্যিই একদিন স্বাধীন করে ছাড়বো। নতুন আলোতে উদ্ভাসিত হবো আমরা…”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এ ফাইনাল পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল বদির। কিন্তু এরই মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়াতে পরীক্ষাটা আর দেওয়া হল না। ওদিকে বদির বন্ধুরাও সব যুদ্ধে যোগ দিয়েছে। কিন্তু বাবা মায়ের কঠোর অনুশাসন ভেদ করে বদি তখনো যুদ্ধে যোগ দিতে পারছিলো না।
২৫ শে মার্চ রাতে পাক হানাদার বাহিনী যেভাবে নির্বিচারে বাঙালি হত্যা করেছে, সেই দৃশ্যটা বদির বার বার মনে পড়ছে। দেশের এই পরিস্থিতিতে সে ঘরে বসে আছে- একথা কিছুতেই সে মানতে পারছে না।
বদিদের বাড়িতে দুটো পত্রিকা রাখা হতো; দৈনিক পাকিস্তান আর মর্নিং নিউজ।
“ঢাকা শহর সম্পূর্ন শান্ত। পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্ত এলাকায় বিচ্ছিন্নভাবে কিছু গোলাগুলি চলছে।” …
দৈনিক পাকিস্তানের এই হেডিং দেখে বদির চোখদুটো স্থির হয়ে যায় । বদি ভেতরে ভেতরে উত্তেজিত হয়ে যায় এবং সাথে সাথে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে, সে যুদ্ধে যাবে!
মায়ের কাছ থেকে অনুমতি নিয়েই বদি কিশোরগঞ্জে তাঁর ছোটমামা এনামুল হকের কাছে চলে যায়। সেখান থেকে মামার যোগাড় করে দেয়া এস.এম.জি আর কিছু গ্রেনেড নিয়ে বদি ঢাকায় ফিরে আসে। যোগ দেয় গেরিলা গ্রুপে ; যার নাম “ক্র্যাক প্লাটুন”। ততদিনে ঢাকা শহরে ক্র্যাক প্লাটুনের গেরিলাদের ভয়ে পাক সেনাদের পা রীতিমত কাঁপতে শুরু করেছে।
কোথা থেকে একটা গাড়িতে করে এক ঝাঁক গেরিলা এসে পাকিদের মাটিতে মিশিয়ে দিয়ে যায়, কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই!
প্রতিটা অপারেশনের পরেই বদি যখন বাড়ি ফেরে, তখন বদির মা ঠিক ধরে ফেলে, ছেলে নিশ্চয়ই বড় কোন অপারেশনে ছিল। মা শুধু বদিকে সাবধানে থাকতে বলেন, তাছাড়া আর কিছুই বলেন না। বদির নিজ এলাকা ঢাকার মনিপুরী পাড়া। এরমধ্যে ফার্মগেট, সিদ্ধিরগঞ্জ, ধানমণ্ডি, এলিফ্যান্ট রোড, গ্রীন রোড অপারেশনসহ একটার পর একটা সফল অপারেশন চালিয়ে ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্যরা হানাদার বাহিনীর ঘুম হারাম করে দিলো। ওদিকে পত্রিকায় এই বিচ্ছুবাহিনীর সদস্যদের ধরিয়ে দিতে দু’হাজার টাকাও ঘোষণা করা হল!
২৯ আগস্ট দুপুর ১২ টা; বদি কিছু জরুরী পরামর্শের জন্য বন্ধু ফরিদের বাসায় যায়, হঠাৎ দরজায় ঠক…ঠক…ঠক আওয়াজ।
দরজা খুলতেই কিছু পাকি আর্মি ঘরে ঢুকে পরে।বদি কিছু বলবার আগেই এক পাকি আর্মি বলে উঠলো, “তুম মুক্তি হ্যায়। বহুত দিনকো বাদ হারামি কা বাচ্চা মিল গয়া।” কথাগুলো বলতে বলতে হানাদার বাহিনীর একজন বদির তলপেটে সজোরে লাথি মারলো। লাথি খেয়ে বদি কুঁকিয়ে উঠলো। বদির চোখ বেঁধে ওরা তাঁকে নিয়ে গেলো অজানা অন্ধকারে।
পূর্ব পাকিস্তান ক্রিকেটে জুয়েল যেন ছিলেন চিত্রকর লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চি। ভিঞ্চি যেমন তুলির আচড়ে শৈল্পিক সব ছবি আঁকতেন তেমনি মাঠের সবুজ ঘাসের ২২ গজের পিচে ব্যাট হাতে তিনি দক্ষ শিল্পীর মত অপূর্ব সব শটের পসরা সাজাতেন। এক গেরিলা অপারেশন থেকে নৌপথে ফেরার সময় রাজাকার ও পাকবাহিনীর অতর্কিত বুলেটের আঘাতে জুয়েলের হাতের তিনটি আঙ্গুলে মারাত্মক জখম হয়েছিল। ক্রিকেটার জুয়েলের মনে তখন আতংক ” এই হাত দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে ক্রিকেট খেলতে পারব তো ” ?
আহত হয়ে জুয়েল, বড় মগবাজারে আজাদ এর বাসায় চিকিৎসাধীন ছিলেন। আব্দুস সামাদের স্বীকারোক্তির সুত্রে এই খবর পৌঁছে যায় পাকিস্তান হানাদারদের কাছে। ঐ বাসায় হানা দিয়ে পাকিস্তানি সেনারা আটক করে জুয়েল, আজাদ সহ আরও অনেকে। জুয়েলের মুখ থেকে কথা বের করার জন্য ব্যান্ডেজে বাধা ভাঙ্গা আঙ্গুল মোচড়াতে থাকে পাক সেনারা। জুয়েলের বুক ফাটা আর্তনাদে ভারী হতে থাকে ঢাকার আকাশ, সেই আর্তনাদে মিলিয়ে যেতে থাকে স্বাধীন বাংলাদেশে ক্রিকেট খেলতে চাওয়া এক ক্রিকেটারের স্বপ্ন।
আজাদের বন্ধু রুমী, হাবিবু্ল, আলম, বদি, জুয়েল প্রমুখ গেরিলা অপারেশনে অংশ নিচ্ছে আগরতলা থেকে ফিরে এসে। আজাদ তাদের সঙ্গে যোগ দিল। আজাদদের বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধা্দের শেল্টার । অস্ত্র লুকিয়ে রাখত। ৩০ অগাস্ট আজাদদের বাড়ি পাকিস্তানি সৈন্যরা ঘিরে ফেলে। গোলাগুলি হয়। আজাদসহ মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি মিলিটারি।
ঢাকার বড় লোক পরিবারের ছেলে মাগফার উদ্দিন চৌধুরী আজাদ। তাদের বাড়িতে হরিণ ছিল, সরোবরে সাঁতার কাটত ধবল রাজহাঁস, মশলার বাগান থেকে ভেসে আসত দারুচিনির গন্ধ। আজাদ যখন ক্লাস সিক্সে পড়ে, সেন্ট গ্রেগরি স্কুলে। ১৯৬০ এর দশক। আজাদের বাবা আরেকটা বিয়ে করবেন। আজাদের মা বললেন, তুমি বিয়ে করবে না, যদি করো,আমি একমাত্র ছেলে আজাদকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাব। আজাদের বাবা আরেকটা বিয়ে করলে আজাদের মা সাফিয়া তার বালকপুত্রের হাত ধরে ওই রাজপ্রাসাদ পরিত্যাগ করেন এবং একটা সাধারন বাসায় আশ্রয় নেন। ছেলেকে লেখাপড়া শেখান। আজাদ ১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্ন্তজাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে মাস্টার্স পাস করে। তার বন্ধুরা যোগ দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধে, ফিরে এসেছে আগরতলা থেকে, ট্রেনিং নিয়ে। তার ঢাকায় গেরিলা অপারেশন করে। বন্ধুরা আজাদকে বলল, চল, আমাদের সাথে, অপারেশন করবি। তুই তো বন্দুক পিস্তল চালাতে জানিস। তোর আব্বার তো বন্দুক আছে, পিস্তল আছে, তুই সেগুলো দিয়ে অনেকবার শিকার করেছিস।
আজাদ বলল, এই জগতে মা ছাড়া আমার কেউ নেই, আর মায়েরও আমি ছাড়া আর কেউ নেই। মা অনুমতি দিলেই কেবল আমি যুদ্ধে যেতে পারি। মাকে আজাদ বলল, মা, আমি কি যুদ্ধে যেতে পারি? মা বললেন, নিশ্চয়ই, তোমাকে আমার প্রয়োজনের জন্য মানুষ করিনি, দেশ ও দশের জন্যই তোমাকে মানুষ করা হয়েছে। আজাদ যুদ্ধে গেল। দুটো অপারেশনে অংশ নিল। তাদের বাড়িতে অস্ত্র লুকিয়ে রাখা হলো। গেরিলারা আশ্রয় নিল।
এই দিনে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঘেরাও করল ঢাকার ২১/২২ টি মুক্তিযোদ্ধা আশ্রয়-বাড়িতে। আজাদদের বাড়িতে গোলাগুলি হলো, কাজি কামাল গুলি করে পালিয়ে যেতে পারলেন, কিন্তু আজাদ, ক্রিকেটার জুয়েলসহ অনেকেই ধরা পড়ল।
১১ আগস্ট ১৯৭১, ঢাকা ইন্টারকন্টিনেনালে দ্বিতীয় দফায় একটি মারাত্মক বিস্ফোরণ ঘটানোর নেপথ্যে মূল নায়ক ছিল ১৮ বছর বয়সী একটি ছেলে, ক্র্যাক প্লাটুনের সর্বকনিষ্ঠ গেরিলা- মোহাম্মদ আবু বকর। ঢাকা ইন্টারকন্টিনেন্টালে তার সেই দুঃসাহসিক এ্যাকশনের খবর বিশ্ব গণমাধ্যমে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল, ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিল পাকিস্তানী মিলিটারিদের দাম্ভিকতা, যারা ঢাকাকে সবচেয়ে বেশি সুরক্ষিত করে রেখেছিল। ১৮ বছর বয়সী এক বাঙালী ছোকরা সেই উঁচু নাকের দাম্ভিকতার ওপর পাঁড়িয়ে গিয়ে ওদের সবচেয়ে নিরাপত্তাবেষ্টিত জায়গায় হামলা চালিয়ে স্বগৌরবে বের হয়ে এসেছিল। পাক মিলিটারি পাগলা কুকুর হয়ে গিয়েছিল। তারপর এই দুঃসাহসী যুবককে ৩০ আগস্ট ভোরে গুলশান-২ এর বাসা থেকে যখন তাকে তুলে নিয়ে যায় পাক আর্মিরা, সে শুধু শুনেছিল ক্যাপ্টেনের গলা – ইতনা কম উমর মে এক লোন্ডা ক্যায়সে ইতনা খতরনাক বন সকতা হ্যায়?
কামরুল হক স্বপনের বাসায় গিয়ে তাকে হাতে পেয়েও ধরতে পারল না পাক বাহিনী। বাড়ির সামনের দিক ঘিরে ফেলতেই স্বপনের মা তাকে ঠেলে পিছনের দরোজা দিয়ে বার করে দিল। একতলা বাড়ির পিছনে কচুবন, ঝোপঝাড় তারপরে একটা বস্তি ছিল। সেই ঝোপঝাড় পেরিয়ে পালিয়েছিল স্বপন। তারপরে ছুটে গেছিল রুমীর বাসাতে। মিলিটারি পুলিশ স্বপনের বাবাকে পেটাতে পেটাতে জীপে তুলল।
বনেদী ঘরের ছেলে ছিল ফতেহ আলী চৌধুরী, বাবা ছিলেন তৎকালীন পাকিস্তান আমলের ডিসট্রিক্ট জাজ। একটা আলাদা লেভেলে চলাফেরা ছিল ওর, অভিজাত বংশের কুল ডুড বলতে যা বোঝায়। রংচঙে হালফ্যাশনের জামাকাপড়, চোখে ব্যান্ড লাগানো চশমা। মাঝে মাঝে বাবার সরকারী গাড়িতে করে ভার্সিটিতে যাওয়া-ইত্যাদি ছিল তার নিত্যনৈমিত্তিক রুটিন। একটা মেয়েকে খুব পছন্দ করতো, নাম গুড়িয়া। অবাঙ্গালী। থাকতো হাটখোলাতেই, ফতেহদের বাড়ির তিন চার বাড়ি পর। প্রতিদিন একবার করে গুড়িয়াকে না দেখলে দিনটাই মাটি হয়ে যেত ওর। পড়াশোনাতেও বেশ চৌকষ ছিল ফতেহ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তখনকার সময়ের অন্যতম হাইপ্রোফাইল সাবজেক্ট ইংলিশ পড়ত , ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র ছিল ও। খেলাধুলাতেও ছিল সমান দক্ষ। বাস্কেটবলটা সবচেয়ে ভালো খেলতো, প্রিয় বন্ধু কাজী কামালউদ্দিনের সাথে পরিচয় বাস্কেটবল খেলতে গিয়েই। কাজী কামালউদ্দিন ততদিনে তুমুল শোরগোল ফেলে দিয়েছে অসাধারন পারফর্ম করে, পাকিস্তান ন্যাশনাল বাস্কেটবল টিমে জায়গা পাবার দাবীটা বেশ জোরালো করে তুলেছে। তবে ফতেহ ছিল সব্যসাচী। ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাবে কেবল বাস্কেটবলই খেলতো না, ক্রিকেটটাও চালিয়ে যেত সমানতালে।ঢাকা কলেজে পড়বার সময় রানা ভাইকে যেদিন এসে বলল ও ক্রিকেটটাও ভালো খেলে, পৃথিবীর ইতিহাসে নৃশংসতম এক আঁধার রাতের শুরু ছিল সেটা, যে অমানিশার গালভরা নাম ছিল অপারেশন সার্চলাইট। পরদিন বাইরে বেরিয়েছে ফতেহ, হঠাৎ ওর চোখ পড়ল ভিসতিওয়ালার উপর, ওদের বাড়ির সামনে মানুষটা মরে পড়ে আছে, গুলিতে গুলিতে বুকটা ঝাঁঝরা। সকালে বোধহয় পানি দিতে বেরিয়েছিল, পাকিস্তানী সেনারা কুকুরের মত গুলি করে মেরেছে ওকে, চেহারায় বিস্ময় আর অবিশ্বাসের ছাপটা তখনো স্পষ্ট, যেন এভাবে বিনা কারনে মরে যাওয়াটা মেনে নিতে পারছে না। স্থির হয়ে যায় ফতেহর চোয়ালটা, একটা অস্ত্রের বড্ড দরকার…শাহাদাৎ চৌধুরী ছিল ফতেহর বড় ভাই, পাঁচ বছরের বড়। অসাধারন ব্যক্তিত্ব, চমৎকার চেহারার এই মানুষটি খুব ভালো প্ল্যান করতে পারতেন। একাত্তরের ২৬শে মার্চ সকালে কেবল প্রতিশোধের প্ল্যান ঘুরছিল তার মাথায়।
২ সেপ্টেম্বর। মেলাঘর। দুই নম্বর সেক্টরের হেডকোয়াটার। খালেদ মোশাররফ আর এটিএম হায়দারকে ক্র্যাক প্লাটুনের ছেলেপুলের দুর্ধর্ষ সব অপারেশনের গল্প বলছেন শাহাদাৎ চৌধুরী। শুনছেন আর প্রচণ্ড খুশিতে চোখ-মুখ ঝলমল করছে দুই সেনানায়কের, শহিদুল্লাহ খান বাদল প্ল্যান করছেন ভারী অস্ত্র আর আরও বেশি গোলাবারুদ কবে পাঠানো যায় সেটা নিয়ে। নতুন আর্মসগুলো নিয়ে ৬ই সেপ্টেম্বরের আগেই পৌছাতে হবে , এটা ভাবতে ভাবতে বাইরে এসে একটা সিগারেট ধরালেন শাহাদাৎ চৌধুরী। ধোঁয়াটা ছাড়তেই হঠাৎ খেয়াল হল পাহাড় থেকে ঝড়ের বেগে কেউ একজন নেমে আসছে। একটু সামনে আসতেই চেনা যায় মানুষটাকে, ফতেহ আলী চৌধুরী। রেগে যান শাহাদাৎ, ঢাকার অপারেশন ফালায়া এইখানে কি তোর? ফতেহ সামনে এসে দাঁড়ায়। ততক্ষনে তাঁবুর বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে বাকিরা। ক্র্যাক প্লাটুনের প্রায় সবগুলো অপারেশনে অংশ নেওয়া দুর্ধর্ষ বীরযোদ্ধা ফতেহ আলীর চেহারাটা বিধ্বস্ত দেখায়। ভাঙ্গা ভাঙ্গা কণ্ঠে সে ধীরে বলে যায়, সব শেষ হয়ে গেছে স্যার। সব শেষ হয়ে গেছে। রেইড হইছিল, ওরা সবাই ধরা পড়ছে।
উপস্থিত মানুষগুলার উপর যেন হুট করে বজ্রপাত হয়। মেজর হায়দার হঠাৎ কাউকে কিছু না বলে চলে যায়, বাকিরা স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে ভয়ংকর অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। যন্ত্রণাটুকুও বোধহয় তাদের স্পর্শ করতে দ্বিধায় পড়ে যায়। অসামান্য দৃঢ় ভাবলেশহীন পাথর মেজর হায়দারকে পাওয়া যায় তাঁর তাবুতে, বালিশটা তুলে তাতে মুখ গুঁজে শিশুদের মতো হাউমাউ করে কাঁদছেন তিনি, গুমরে গুমরে কান্নার শব্দের সাথে সাথে অস্ফুট শব্দ শুনতে পায় তাঁবুর বাইরের কেউ কেউ- মাই বয়েজ… মাই বয়েজ…
(৮)
শিল্পীরা চিরদিনই কিছুটা বোহেমিয়ান হন। বাস্তবের পরোয়া তারা খুব একটা করেন না। আলতাফ ঠিক কেন যে করাচী থেকে ফিরে এল তার উত্তর স্বয়ং আলতাফের কাছেও নেই। বিশেষতঃ কোন স্থায়ী রোজগারের ব্যবস্থা না করে শুধু কিছু খ্যাতির অলঙ্কার সাথে নিয়ে তার ঢাকা ফেরা। ভালই তো থাকতে পারত সে করাচীতে। শিল্পীদের প্যাঁচপয়জারে সাময়িক কিছু রোজগার কমলেও যা আয় হচ্ছিল তাও মন্দ কী! তবু পরিযায়ী পাখির মত তার এই গতায়াতের ব্যাখ্যা তার কাছে ছিল না। তবে কি মেহেরকে এড়ানোর জন্যে পালিয়ে আসা? না না এতটা আনস্মার্ট অন্ততঃ আলতাফ মাহমুদ নয়। তার কুলুঙ্গিভরা প্রেমপত্র। তার মত কন্দর্পকান্তি ক’জনের থাকে? তার ওপরে সঙ্গীতের বরপুত্র। সাক্ষাৎ আগুন যেন। সে আগুনে ঝাঁপ দিতে পতঙ্গরা তো উন্মুখ হবেই। ঢাকায় ফিরে তিনি আস্তানা গাড়লেন ফজলুল হকের বাসায়। ফজলুল হক গত হয়েছেন। তার স্ত্রী আছিয়া হক আলতাফকে নিজের ছোট ভাইয়ের মত ভালবাসেন। এই আপুর অনুরোধে আলতাফ উঠলেন তার বাসায় ৫ নং নয়া পল্টনে। থাকা খাওয়ার বিনিময়ে আলতাফ তার ছোট মেয়েকে গান শেখাবার দায়িত্ব নিলেন। সেই ছোট মেয়েটি শাহিন, শাহনাজ রহমতুল্লাহ, ভাবীকালের জনপ্রিয় কন্ঠশিল্পী।
‘তানহা’ ছবিটি পাকিস্তানে দর্শক নন্দিত হতেই পূর্ব পাকিস্তানের চিত্র পরিচালকদের মধ্যে উর্দু ছবি বানানোর হুজুগ ওঠে। লগ্নি করা অর্থের ঝুঁকি কম কারণ পূর্ব বা পশ্চিম পাকিস্তানের যে কোন একটিতেই জনপ্রিয়তা পেলেই আর্থিক সফলতা। জহির রায়হানও দুটি উর্দু ছবি করলেন। ‘বাহানা’ ও ‘ক্যায়সে কহো’ । দুটোতেই সুর দিলেন আলতাফ মাহমুদ। ছবি যে দারুন কিছু চলল তা নয়, কিন্তু আলতাফের সুরারোপিত গান রসিক মহলে প্রশংসা পেল। চলচিত্র পরিচালকরা এবার ঝুঁকলেন লোকগাঁথা, লোকজ সাহিত্য ভিত্তিক, ধর্মভিত্তিক ছবির দিকে। আলতাফ সুর দিলেন ‘বেহুলা’ ছবিতে। সুপার ডুপার হিট। হলের ভিতর দর্শকরা উলুধ্বনি দিচ্ছে। ‘কি সাপে দংশিল লখাই রে’ গানের সময় বুক চাপড়ে বিলাপ – সব কিছুর সাক্ষী হয়ে থাকল সিনেমা হলগুলি। আলতাফের জনপ্রিয়তা আকাশ ছুঁল। একের পর এক ছবিতে আলতাফ সুর দিলেন। কখগঘঙ, অবুঝ মন, এই নিয়ে পৃথিবী, আঁকাবাঁকা, কার বউ, আগুন নিয়ে খেলা, নয়নতারা, দুই ভাই, সংসার, আপন দুলাল, প্রতিশোধ। এর মধ্যে আলতাফ কাজের সুবিধার জন্যে উঠে এসেছে চাচাতো ভাই সিরাজুল হক মন্টুর বাসায়। মধুমিতা সিনেমার পিছনেই সে বাসা।
এদিকে পঞ্চাশ দশকের মাঝামাঝি বিল্লাহ পরিবার দু’দশকের বেশি ভৈরবে বাস করার পরে তাদের পাট গুটিয়ে এনে ঢাকার উত্তর কমলাপুরে বসবাস শুরু করে। পৈত্রিক বাড়ি ঢাকা জেলার বিক্রমপুরে। বাড়ির কর্তা মেহতের বিল্লাহ খুব ভাল গান গাইতেন। তিনি বিয়ে করেন আসামের ধুবড়ী জেলার বিলাসীপাড়ার মেয়ে আমেনাকে। তার আট সন্তান, পাঁচ ছেলে, তিন মেয়ে। সবার জন্মই ভৈরবে। আমেনা বিল্লাহ খুবই উদারচেতা সংস্কৃতিমনা ব্যক্ত্বিত্ব। অসম্ভব ভাল রান্না করেন। বিশেষতঃ সাদা জিরে ফোড়ন দিয়ে তৈরী তার হাতের সব্জী যে খেয়েছে তাকে বলতেই হত – আহা, কী খেলাম। এটা আসামের হিন্দু সংস্কৃতির প্রভাব। আসাম ও পূর্ব বাংলার এই মিশ্রণ বিল্লাহ পরিবারে ইসলামী ধারার সাথে সাথে উদার অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির ভিত গড়ে তুলেছিল। কর্তা মেহতর বিল্লাহ’র ইন্তেকাল ঘটে ১৯৬৩ তে। বড় ভাই নুহেল বিল্লাহ ও মা আমেনার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে বাকি ভাই বোনেরা সংস্কৃতির বিভিন্ন শাখায় জড়িয়ে পড়ে। প্রত্যেকের গানের গলা অসম্ভব ভাল। সে সময়ের প্রগতিশীল সংস্থার তারা সক্রিয় সদস্য। নাচ গান কবিতা সব শাখায় তাদের অবাধ সঞ্চরন। পাকিস্তান রেডিওর নিয়মিত শিশু শিল্পী কেউ কেউ। ১৯৬৫ সালে তো খোদ প্রেসিডেন্ট আয়ূব খানের হাত থেকে শ্রেষ্ঠ শিশুশিল্পীর খেতাব গ্রহণ করেন ছোট কন্যা শিমুল। বাড়িতে সব গুণি মানুষের যাতায়াত। কবি বেগম সুফিয়া কামাল, কবি জসীমুদ্দিন, অধ্যাপক অজিত কুমার গুহ, শিল্পী কামরুল হাসান, শিল্পী হাসেম খান, রফিকুল নবী, শাহাদাৎ চৌধুরী… কে আসতেন না। পুরোনো ঢাকার ইসলামপুরে বেগম পত্রিকার অফিসে ‘কচিকাঁচার মেলা’ সংগঠনের অফিস। সেখানে আবার দেড়শ আসন বিশিষ্ট ছোট মঞ্চসহ একটি হল ছিল। সেই হলে যাবতীয় অনুষ্ঠান হত। রিহার্সাল হত উয়ারী এলাকার রেঙ্কিন স্ত্রীটে। আলতাফ মাহমুদ সেই অনুষ্ঠানের সঙ্গীত পরিচালনার ভার নিলেন।
সেদিন তন্ময় হয়ে গান শেখাচ্ছেন আলতাফ। অন্যেরা সাথে গাইছেন। সেই মুহুর্তে ঘরে প্রবেশ করলেন এক ছোটখাটো পরী। গায়ের রঙ যেন ভোরের ফোটা আকাশ, দীঘল চুল অন্ধকার বিদিশার নিশা, চোখে হাজার বছরের বাংলা কবিতার পদচারনা, আড় চোখের চাউনি রবি ঠাকুরের লাবন্যকে লজ্জা দেয়। আলতাফের মনে এল এক টুকরো জীবনানন্দ – এ পৃথিবী একবার পায় তাকে, পায় না কো আর। গলা কেঁপে গেল আলতাফের। সুর ভুল হল। রিহার্সাল থামিয়ে দিলেন আলতাফ। হাতটা বেশ ভারী হয়ে উঠেছে তবু হাত উঠে এল আলতাফের অভিবাদনের ভঙ্গিতে।
– আমি আলতাফ মাহমুদ।
– আমি সারা আরা বিল্লাহ। আপনি আমায় ঝিনু নামে ডাকতে পারেন।
এক একটি গান এমনভাবে কানে, হৃদয়ে বসে যায় যে, সেইসব গান জীবনের অঙ্গ হয়ে ওঠে। কিছু মুহুর্ত, কিছু স্মৃতি, সেই সব গানের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে গেঁথে যায় বিনি সুতোর মালায়। কী জানি কেন, মন খারাপ হলে, মনের মন কী করবে তা না জানলে, মনে ঝড় উঠলে অথবা মন গভীরতায় শান্ত হলেও সেই সাদা-চুল, সাদা-দাড়ি, আলখাল্লা-পরা ঋষিতুল্য মানুষটির কথা মনে পড়ে যায় ঝিনুর। আর কেবলই তার গান মনে পড়ে… যদি প্রেম দিলে না প্রাণে, কেন ভোরের আকাশ ভরে দিলে এমন গানে গানে… মৃদু গলায় গানটা ধরল ঝিনু। এই সকালের মিষ্টি উষ্ণ রোদকে যেন শোনাচ্ছিল সে এ গান।
– কার মুখ দেখে যা আজ উঠেছিলাম।
ভরাট কন্ঠস্বরে চমকে গেটের দিকে তাকাল ঝিনু। স্মিত হাসিতে ভরা একটি মুখ। আলতাফ মাহমুদ। বোকার মত কিছুক্ষন সে চেয়ে রইল খোলা চোখে। নানা শব্দ চেতনার চারিদিকে তারাবাজির থেকে উৎক্ষিপ্ত কণার মত ছিটকে যাচ্ছে। মস্তিষ্কের শ্লথ কোষগুলি জড়াজড়ি করে সকালের কবোষ্ণ শীতের আশ্লেষে ঘুমিয়ে আছে যেন এখনও আরামে।
– কি হল? ভেতরে আসতে বলবে না?
– আসুন, আসুন। আসলে আমি ভাবতেই পারছি না এত সকালে আপনি আসবেন।
– দু’দিন রিহার্সালে যাও নি। শুনলাম খুব জ্বর তাই।
– হ্যাঁ জ্বর এসেছিল খুব। মনে হচ্ছে সেরে গেছে। আচ্ছা, আপনি ভেতরে আসুন।
– সে যাচ্ছি। তোমাকে কয়েকটা কথা বলার ছিল, সে সব লিখে এনেছি, এই যে রাখো তোমার কাছে।
ঝিনু আলতাফের হাত থেকে তুলে নেয় একটি ভাঁজ করা কাগজ। তারপরে বাসার ভেতরে নিয়ে যায় তাকে।
আলতাফের চলে যাওয়ার অপেক্ষাতেই ছিল ঝিনু। কী কথা আজ লিখেছে সে! চা-পান করে শিমুলের মাথা ঘেঁটে দিয়ে সবার সাথে হৈ হুল্লোড় করে আলতাফ যখন বেরিয়ে গেল বড্ড অভিমান হয়েছিল ঝিনুর। এমন ভাব দেখাল যেন ঝিনুকে চেনেই না। কস্মিনকালেও দেখে নি। চলে যেতেই ছাদে চলে গেল ঝিনু। খুলে দেখল আলতাফের মুক্তোর মত হাতের লেখায় ঝিনুকে লেখা প্রথম পত্র।
ঝিনু,
আমার জীবন আদৌ হিসেবী নয়। বড্ড হৃদয়তাড়িত। সে আমি বুঝি। তাই গত দুদিনেই তোমাকে না দেখে মনটা বড় বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। মন বসছে না কোন কাজেই। এমন কি সঙ্গীতেও।
শীত আসছে। পাতা ঝরে যাচ্ছে গাছের। বিবাগী হচ্ছে ভোগী। রিক্ততার দিন আসছে সামনে। তোমার কন্ঠ শুনতে চাইছি বারেবারে। চাইলেই বা পাচ্ছি কই? এ দু’দিন শুধু তোমার কথা মনে পড়ছিল। তাই ভাবলাম যে তোমায় কিছু পাঠাই আজ। কিছু কথা। যা ধ্রুব সত্যি আমার জীবনে।
জানি না, কী যে দেখেছিলাম তোমার ওই মুখটিতে ঝিনু! এত যুগ ধরে কত মুখই তো দেখল এই পোড়া চোখদুটি। কিন্তু এমন করে আর কোন মুখই তো আমার সর্বস্বকে চুম্বকের মত আকর্ষণ করে নি। ভাল না বাসলেই হয়ত ভাল ছিল। তুমি এত ছোট আমার থেকে। কিন্তু কী করব! ভাল তো কাউকে পরিকল্পনা করে বাসা যায় না। ভালবাসা হয়ে যায়; ঘটে যায়। তখন আর কিছুই করার থাকে না।
যারা হারাবার ভয় করে না কিছুতেই, একমাত্র তারাই ভালবেসে সব হারাতে পারে। তাই জীবনের প্রাপ্তিকে অর্থবাহী করে তোলে ভালবাসা। যে ভালবাসা পায় নি তার জীবন বৃথা। তাই তোমার কাছে একটাই জিজ্ঞাসা – তুমি কি আমার ভালবাসা স্বীকার করবে?
জানিও।
আলতু
ঝিনু কথাগুলি স্বীকার করতে করতে লজ্জায় রঙিন হল। ভালবাসা যে কত মহার্ঘ, কত দামী অনুভব করে সে। সে এক মহাবোধ। ধীরেধীরে ঝিনু আলতাফের সাথে প্রবেশ করে এক স্বপ্নলোকে। স্বপ্নগুলো উড়তে থাকে। নীল নদীতীর চমকে ওঠে, ওরা দুজন হেঁটে বেড়ায় মাঘী মাঠের শুন্যতাতে। বুকের গভীর থেকে ওঠা স্বপ্নগুলো ঝাপটে ডানা উড়ে বেড়ায় নীল আকাশে। স্বপ্নে ওড়া পাখিগুলো ফিরে আসে, অনেক নদী মাঠ পেরিয়ে ভালবাসা ঠোঁটে করে। স্বপ্নগুলো খুব ভীতু হয়, যদি আঘাত আসে তবে, কার বুকে সে রাখবে মাথা, কোথায় গেলে উচ্চগ্রামের স্বর ফুলিয়ে, হাত উঁচিয়ে স্বপ্নপাগল একলা হাঁটে। স্বপ্নে ওরা ভাবতে থাকে অনেক কিছুই। বাড়ি করব পাহাড়চুড়োয়, পায়ের কাছে বইবে নদী, বাধ্যতা আর নাব্যতা নীল। হাতের সাথে হাত মিলিয়ে, মিলিয়ে যায় ওরা দুজন। দিগন্তকে সাক্ষী মেনে মন বিনিময় আগল খোলা পাগল হয়ে মিলিয়ে যায় দূর নিলীমায়।
বিল্লাহ পরিবারের গৃহ শিক্ষক কেশববাবু সেদিন সন্ধায় পড়ানোর পরে একটু উসখুস করছেন। গৃহকত্রী আমেনা বিল্লাহ বুঝলেন যে তিনি কিছু বলতে চাইছেন।
– হ্যাঁ, কেশববাবু, আপনি কিছু বলবেন মনে হচ্ছে।
– ঠিকই ধরেছেন আপা। বলার মত একটি জরুরী কথা আছে। কিন্তু কী করে যে বলব বুঝতে পারছি না। আপনি কি ভাবে নেবেন…
– না, না, আপনি তো ঘরের মানুষ। নিঃসঙ্কোচে বলতে পারেন।
– আপনি তো আলতাফকে চেনেন। আলতাফ মাহমুদ। সঙ্গীতকার। সে ঝিনুকে বিয়ে করতে চায়।
– কী বলছেন আপনি। ঝিনু তো মাত্র ক্লাস টেনে পড়ে। আর আলতাফের বয়েস তো বত্রিশ তেত্রিশ।
– সেটা ঠিক। কিন্তু আলতাফ এত গুণী ছেলে…
– সে কথা অস্বীকার করছি না। কিন্তু আয় করে তো সিনেমা থেকে। আজ আছে কাল নেই। চালচুলোও তো তেমন কিছু নেই বলে জানি।
– মানছি আপনার উদ্বেগ যুক্তিযুক্ত। কিন্তু শিল্পীরা তো একটু অন্যরকম হয়…
– শিল্পী বলে আপত্তি ততটা নয়, যতটা বয়সের ফারাকের জন্যে। ১৬/১৭ বছরের পার্থক্য। বাবা নেই বলে কি পানিতে ফেলে দেব মেয়েটাকে? না, না কেশববাবু, আপনি মানা করে দিন। এ বিয়েতে আমাদের মত নেই।
ঝিনু আড়াল থেকে সব শুনল। ভাবল মা বোধহয় তাকে কিছু জিজ্ঞাসা করবেন। কিন্তু কোথায় কী! মা কিছুই বললেন না। একপক্ষীয় সিদ্ধান্ত হয়ে গেল আলতাফের সাথে বিয়ে নৈব নৈব চ। আলতাফ সব শুনে ঝিনুকে বলল – তুমি শান্ত থাকো, দাঁড়াও দেখি কি করা যায়, মা’র আশীর্বাদ নিয়েই বিয়ে করব।
– খালাম্মা, একটা কথা ছিল।
– বল আলতু।
– খালাম্মা, আমি ঝিনুকে বিয়ে করতে চাই। কিন্তু ওরা তো রাজী হচ্ছে না।
– আমি লুলু টুলুর মুখে শুনেছি। ওদের ঝিনুই বলেছে। আমাকেও ঝিনু বলেছে।
– কি বলেছে ঝিনু?
– ঝিনু বলেছে যে সে তোমাকে ভালবাসে, বিয়ে করতে চায়।
– কিন্তু ওরা তো রাজী হচ্ছে না।
– কি করে একবারে মত দেবে বাবা? তুমি বয়সেও অনেক বড়। সিনেমা থেকে রোজগার। বাসা বাড়ি কিছুই নাই।
– তা হলে কি হবে? আমরা কি মত পাবো না?
– দাঁড়াও, এত অধৈর্য হয়ো না। মত তুমি পাবে। আমাকে একটু সময় দাও।
কবি বেগম সুফিয়া কামাল আলতাফের সাথে এই আলাপচারিতার পরে বেশ চিন্তিত মুখে বসে থাকলেন বেশ কিছুক্ষন। আলতাফ তার সন্তানের মত। নিজের জেলা বরিশালের ছেলে। এদিকে তার কন্যা সুলতানা কামাল ওরফে লুলুর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেছে ঝিনু। ওদিকে আমেনা বিল্লাহ তার নিজের দিদির মত। তাঁর যুক্তিকেও ফেলে দেওয়া যায় না। তিনি নিজের মেয়ে হলে কি করতেন? কিন্তু আল্লাহ যার যেখানে জুটি বেঁধেছেন সেখানে তো বিয়ে হবেই। কাজেই দেখা যাক একবার শেষ চেষ্টা করে। আলতাফের মন না হলে ভেঙ্গে যাবে। কয়েকদিন পরে একও বিকেলে বেগম সুফিয়া কামাল এলেন আমেলা বিল্লাহের বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটের বাসায়। এ বাসাটি চাকরীসুত্রে ঝিনুর বড় ভাই নুহেল বিল্লাহের পাওয়া।
– দিদি, তোমার কাছে আমি কোনদিন কিছু চাই নি, আজ চাইব, তোমার সবচেয়ে প্রিয় বস্তু। তুমি কিন্তু না বলতে পারবে না।
– কি সেটা?
– আমি তোমার বড় মেয়ে ঝিনুকে চাই আমার আলতাফের জন্যে।
– সে কী! আলতাফের তো কোন স্থায়ী রোজগার নেই।
– না, না, তানহা ছবি হিট করার পরে তার খুব নামডাক। আয়ও মন্দ নয়।
– আলতাফের বাসা কোথায়?
– সে তো বন্ধুর সাথে থাকে। নিজের বাবার সাথে বিশেষ সম্পর্ক নেই। নিজস্ব কোন বাসা নেই।
– এমন ছেলের সাথে কি করে বিয়ের কথা বলছ! না আছে নিজের কোন বাসা, না আছে কোন স্থায়ী রোজগার, দেশ ভিটে কিছুই নেই…
– তবু বলছি দিদি, এ বিয়ে তুমি দাও। আলতুর মত এত ভাল ছেলে তুমি পাবে না। শিল্পীরা একটু অমন হয়। ঘাড়ে দায়িত্ব পড়লে দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।
আমেনা বিল্লাহ কিছুক্ষন স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন। তারপরে বললেন-
– আমার মেয়ে ঝিনু তো তোমারও মেয়ে। তুমি যদি মনে কর এতে ওর ভাল হবে, তবে তাই হোক। আমি আজ ঝিনুকে তোমার হাতে তুলে দিলাম।
(৯)
ঢাকা শহর আজ শান্ত। বিকেল হতেই জাহানারা ইমাম শুনলেন কলিং বেলের শব্দ। দরোজা খুলতেই দেখলে হাফিজ দাঁড়িয়ে।
– রুমী আছে? আমি আজই ফিরলাম গ্রামের বাড়ি থেকে।
– না তো। কি জানি সে কোথায় গেছে। ওকি কিছু বলে আমাকে? গোল্লায় গেছে।
– উঁহুঁ, যা খুশি করার ছেলে রুমী নয়। নিশ্চয়ই কোন কাজে গেছে।
– আচ্ছা, তুমি ভিতরে এসো হাফিজ।
হাফিজ ঘরে ঢুকতেই দরোজা বন্ধ করে দিলেন জাহানারা ইমাম। রুমী ফিরল সন্ধ্যার পরে। হাফিজকে দেখে খুশিতে জড়িয়ে ধরল। আজ রুমীর বড্ড খাটনি গেছে। দুপুরে মিটিং ছিল, তারপরে চুল্লুর বাসা হয়ে ফিরেছে। রুমী হাফিজকে নিয়ে চলে গেল ছাদের ঘরে। নিরিবিলি গল্প করবে।
রাত ন’টা বাজতেই খাওয়ার ডাক পড়ল। রুমী নীচে এসে ঘোষণা করল – আম্মা, হাফিজ আজ রাতে থাকবে। আমাদের গল্প শেষ হয় নি। হাফিজের জন্যে একটা ক্যাম্প খাট পাতা হল। রুমী, জামী ও হাফিজ পাশাপাশি শুয়ে গল্প করছে। জাহানারা ইমাম রুমীর চুলে বিলি কেটে চলেছেন। ওরা গল্প করছে। সব অ্যাকশনের কাহিনী। শুনে হাফিজ উত্তেজিত হয়ে উঠছে। পাশে সাইড টেবিলে রেডিও বাজছে। একের পর এক বাংলা গান। সম্ভবতঃ কলকাতা। হঠাৎ বেজে উঠল – একবার বিদায় দে মা, ঘুরে আসি…
রুমী বলল – আজ দুপুরেও এই গান শুনেছি। জানি না কপালে কী আছে।
হঠাৎ নীচে ধুমাধুম শব্দ। জানলা দিয়ে বাইরে চোখ রাখলেন জাহানারা ইমাম। রাস্তায় গিজগিজ করছে মিলিটারি পুলিশ। পশ্চিমের জানলায় এলেন। সেখানেও আর্মি। দক্ষিনেও। রুমীর ঘরে দৌড়ে গেলেন তিনি। ওরা পাথরের মত দাঁড়িয়ে আছে। মুখচোখ সাদা। বাড়িটা মিলিটারি পুলিশ চারিদিক দিয়ে ঘিরে ফেলেছে। কোনদিক দিয়ে বেরোনর রাস্তা নেই।
ওদিকে দরোজায় ক্রমাগত বাড়ি পড়ছে। বাসার কর্তা শরীফ উঠে এলেন। বারান্দায় এসে জিজ্ঞাসা করলেন – কে ডাকেন? কি চাই? উত্তর এল – দরোয়াজা খোলিয়ে। ইতনা দের কিঁউ হো রহা হ্যায়? শরীফ সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামলেন। ঘড়ির কাঁটা বারোটা পেরিয়েছে সবে। ঘন্টা দিয়ে সে জানান দিয়েছে। তারিখও পালটে গেছে। ২৯ পেরিয়ে আজ ৩০ অগাস্ট।
সদর দরোজা খুলে শরীফ দেখল এক অল্পবয়েসী সেনা অফিসার। পিছনে তাগড়া চেহারার আরো অনেক মিলিটারি।
– হোয়াট ক্যান উই ডু ফর ইউ?
– মাইসেলফ ক্যাপ্টেন কাইয়ুম। তোমাদের বাড়িটা একটু সার্চ করব।
– কেন?
– এমন কিছু না। রুটিন সার্চ। তোমাদের বাড়িতে কে কে আছেন?
– আমি, আমার স্ত্রী, বাবা, দুই ছেলে। ভাস্তে…
– ছেলেদের নাম কি?
– রুমী ও জামী।
ক্যাপ্টেন কাইয়ুম সঙ্গের সুবেদারকে বলল – সার্চ। তারা ছড়িয়ে পড়ল একতলা ও দোতলায়। অভ্যস্ত নিপুনতার সাথে তারা প্রতি ঘরের আলমারি, দেরাজ খুঁজতে থাকল। রুমীদের সবার নাম জিজ্ঞাসা করে বলল নীচে নামতে।
জাহানারা ইমাম জিজ্ঞাসা করলেন – কেন, ওদের নীচে যেতে বলছেন কেন?
ক্যাপ্টেন কাইয়ুম বলল – কিছু না, একটু রুটিন ইন্টারোগেশন করব। শরীফকে বলল – এটা আপনার গাড়ি? চালাতে পারেন? তবে গাড়ি নিয়ে আমাদের সঙ্গে আসুন।
জাহানারা ইমাম চেঁচিয়ে বললেন – কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন ওদের?
ক্যাপ্টেন কাইয়ুম উত্তর দিল – এই একটু রমনা থানায়। রুটিন ইন্টোরোগেশোন। এক ঘন্টার মধ্যেই সবাই চলে আসবেন। ক্যাপ্টেন আইয়ুম শরীফের গাড়িতে উঠে বসল। মিলিটারি পুলিশ বাকিদের হাঁটিয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল বাসার থেকে।
মেইন রোডে তাদের পাঁচজনকে লাইন করে দাঁড় করানোর পর ক্যাপ্টেন কাইয়ুম জিপের কাছে গিয়ে কারো সঙ্গে কথা বলে এসে রুমীকে নিয়ে তুলল একটি জিপে। শাহবাগের মোড় ঘুরে এয়ারপোর্ট রোডের দিকে, এমপিএ হোস্টেলে গিয়ে গাড়ি থেকে নামার আগেই সেখানে ইন্টেলিজেন্সের চিফ এসে জানতে চান ‘রুমী কৌন হ্যাঁয়?’ এতে বাকিদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায় যে, এতক্ষণ যা ঘটেছে তা শুধু রুমীকে ধরার জন্যই।
রাত ভোর হয়ে আসছে। আকাশে তখনো আলো ফোটে নি। নিস্তব্ধ ঢাকা শহর। রাজারবাগ পুলিশ লাইনের মসজিদে সুললিত কন্ঠে মুয়াজ্জিনের ফজরের আজানের পরে নামাজ শেষ হয়েছে। মুসুল্লিরা ঘরে ফিরছেন। আমেনা বিল্লাহ নামজ শেষে জায়নামাজে বসে গুনগুন করে কোরআন শরীফ পড়ছেন। বাসার ছোট মেয়ে শিমুল ভৈরবীতে গলা সেধে চলেছে। সেজ ভাই মেওয়া বিল্লাহ ও মেজ বোন মিনু নেই। ওরা জুন মাসেই আগরতলা হয়ে মেলাঘরে চলে গেছে সরাসরি মুক্তি যুদ্ধে যোগ দিতে । বাসায় আছেন আলতাফ মাহমুদ, স্ত্রী ঝিনু, চার শালা নুহেল, খনু, দীনু, লিনু আর ক্রাক প্লাটুনের আরেক সদস্য আবুল বারেক আলভি। আলভি কাল রাতেই এসেছে মেলাঘর থেকে কমান্ডার খালেদ মশারফের বার্তা নিয়ে। মনি ভাই লিখেছেন – আলতাফ যেন অবিলম্বে মেলাঘরে চলে আসেন। আলতাফ ঠিক করেছেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেদ্রের জন্যে কিছু টেপ করে নিজেই স্পুলগুলি নিয়ে ৩ সেপ্টেম্বর চলে যাবেন।
হঠাৎ এই আলো আঁধারের মধ্যে বুটের ভারী আওয়াজে আমেনা বিল্লাহ ও শিমুল চিৎকার করে উঠল – আর্মিরা বাসা ঘিরে ফেলেছে। বেশ কয়েকটি আর্মি ট্রাক ও জীপে করে আসা পাক সেনারা পুরো এলাকা ঘিরে ফেলেছে। তাদের চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেল সবার। কয়েকজন মিলিটারি পুলিশের দমাদ্দম লাথি পড়ছে দরোজায়। নুহেল দরোজা খোলামাত্র হুড়মুড় করে ঢুকে সবার বুকের ওপর বন্দুক ধরল পাকসেনারা। আমেনা বিল্লাহ ঝিনু শিমুল ও আলতাফ কন্যা শাওনকে আড়াল করে আর্তনাদ করে উঠলেন – ওরা আলতুকে ধরে নিতে এসেছে। বড়মেয়ে একুশ বছরের ঝিনুকে আড়ালে রেখেছেন পাকসেনাদের লোলুপ দৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্যে। কিন্তু তার কন্ঠ থেকে বেরিয়ে আসছে হাহাকারের সাথে দোয়া। হঠাৎ হট্টগোলে সাদা গেঞ্জি ও লুঙ্গি পরা আলতাফ মাহমুদ ঘুম থেকে সামনের ঘরে আসতেই পাকসেনাদের ক্যাপ্টেন চিৎকার করে বলল – আলতাফ মাহমুদ কৌন হ্যায়?
– আমিই আলতাফ মাহমুদ।
– হাতিয়ার কাঁহা হ্যায়?
– কিসের হাতিয়ার? আমার কাছে কোন হাতিয়ার নেই।
মুহুর্তেই ক্যাপ্টেন পিস্তলের ডাঁট দিয়ে আলতাফের মাথায় সজোরে আঘাত করল। আলতাফ মাটিতে লুটিয়ে পড়তেই ক্যাপ্টেন ইশারা করল। কয়েকজন সেপাই তাকে তুলে বন্দুকের বাঁট দিয়ে মারতে মারতে বাইরে বাড়ির সামনে নিয়ে দেয়ালের পাশে কাঁঠাল গাছের পাশে দাঁড় করিয়ে দিল। আলতাফের চার শালা ও আবুল বারাক আলভিকে পিছমোড়া করে আলতাফের কিছু দূরে দাঁড় করানো হল। এবার শুরু হল একই প্রশ্ন ও একই উত্তর। ক্যাপ্টেন জিজ্ঞাসা করে চলছে ‘হাতিয়ার কাঁহা হ্যায়’ আর আলতাফ বলে চলেছে ‘আমি জানি না।‘ এই জবাবে ক্যাপ্টেনের ইশারায় সেপাইরা বারেবারে হিংস্র নেকড়ের মত আলতাফের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। রাইফেলের বাটের ক্রমাগত আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল আলতাফ। পবিত্র মাতৃভুমির মাটিতে। যে মাতৃভুমির জন্যে তারা স্লোগান দিয়েছিল – লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান। আলাদা হল ভারতের থেকে। আলাদা জাতি আলাদা ধর্ম আলাদা দেশ। সেই পাকিস্তানে পাকিস্তানিদের হাতে বাঙালির জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান আলতাফ মাহমুদ পড়ে পড়ে মার খাচ্ছেন। আর দেখছে পাকিস্তানের অস্তগামী চাঁদ তারা।
এরমধ্যে ক্যাপ্টেনের আদেশে সারা বাড়ি তল্লাশি চালিয়ে পাওয়া গেল ছুরি, বঁটি, দা। ক্যাপ্টেন তো এই সামান্য অস্ত্রের খোঁজে এই বাসায় অভিযান চালায় নি। আবার পিস্তলে বাট দিয়ে সজোরে আঘাত করল আলতাফের মুখে। আলতাফ বুঝল তার দুটি দাঁত স্থানচ্যুত হল। তীব্র যন্ত্রনায় কঁকিয়ে উঠল সে। এবারের আঘাত মাথায়। রক্ত পড়ছে গলগল করে। পুরো শরীর রক্তে রাঙা। যেন স্বপ্নের বাংলাদেশের পতাকার মধ্যবর্তী বৃত্তাকার অংশ। সাদা গেঞ্জি পুরো লাল। পাগলের মত মেরে চলেছে ক্যাপ্টেন আর তার অনুগত সেপাইবৃন্দ। বারেবারে জিজ্ঞাসা করছে – হাতিহার কাঁহা হ্যায়, বোল। আলতাফ কাটা রেকর্ডের মত বাজিয়ে চলেছে – আমি জানি না। সেপাইরা আলতাফের শালাদের ও আলভিকেও চুড়ান্ত মার মেরে চলেছে। তাও আলতাফ অটল। ক্যাপ্টেন বুঝল- নাহ, এই পর্বতকে টলানো যাবে না। শেষ অস্ত্র প্রয়োগ করল সে। এক সিপাইকে ডেকে বলল – শালেকো ইধার লে আও।
দুই জওয়ান আর্মি ট্রাক থেকে ধরাধরি করে একজন প্রচন্ড আহত একটি লোককে আলতাফের সামনে দাঁড় করিয়ে দিল। প্রচন্ড নির্যাতনে সে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। মাথা ঝুঁকে আছে সামনে। ক্যাপ্টেনের নির্দেশে তার চুলের মুঠি ধরে মাথা সোজা করে আলতাফের দিকে দৃষ্টি ফেরানো হল। আলতাফ চমকে উঠলেন। এ তো ক্র্যাকপ্লাটুনের কমান্ডার আবদুস সামাদ। নিওন বাতির ব্যবসায়ী। হোটেল ইন্টারকন হামলার অন্যতম কুশীলব। সামাদও ধরা পড়েছে। তাহলে কি নির্যাতন সহ্য না করতে পেরে সামাদ সব বলে দিয়েছে? সেই তবে পাকসেনাদের পথ চিনিয়ে আলতাফের বাড়ি চিনিয়ে দিয়েছে? নিজের জীবন বাঁচাবার জন্যে সব মুক্তিযোদ্ধাদের হদিশ পাকসেনাদের বাতলে দিয়েছে? সে কি তবে পাকসেনাদের এজেন্ট ছিল? তা কি করে হবে? তা হলে সে কি করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এতগুলো অপারেশনে গিয়েছিল ? ক্যাপ্টেন সামাদকে আলতাফের সামনে দাঁড়িয়ে বলল – ইয়ে আদমী কেয়া আলতাফ মাহমুদ হ্যায়?
– জী হুজুর
– হাতিয়ার উস কো পাস রাখখা থা?
– জী হুজুর হামে উসকা পাসই হাতিয়ার রাকখা থা।
আবদুস সামাদ সবই বলে দিল। আলতাফ মাহমুদের কাছে গচ্ছিত অস্ত্রের কথা, মুক্তিযোদ্ধাদের নাম ঠিকানা, কীর্তি কলাপ – সব কিছু। যার ওপর অগাধ বিশ্বাস ছিল মুক্তিবাহিনীর সে প্রাণের ভয়ে, মার খাবার ভয়ে চুড়ান্ত বিশ্বাসঘাতকতা করল। এবার ক্যাপ্টেন আলতাফকে বলল –
– আভি তো বোল হাতিয়ার কাঁহা ছুপাকে রাখখা?”
– বলছি তো হাতিয়ার কোথায় আমি জানি না।
– ইয়ে তো শালা অ্যাইসা নেই মানেগা।
ক্যাপ্টেন দ্রুত আলতাফের কাছে এসে কানপট্টির ওপরে পিস্তল ঠেকিয়ে বলল –
– দশ গিননে কা পহেলে আগর তু হাতিয়ার কা পতা নেহি বাতাতে তো তেরা বেটি কো পহেলে, উস কা বাদ এক এক কর কে পুরা পরিবার কো খাল্লাস কর দেঙ্গে। উস কা বাদ তেরে কো রাস্তে কা বিচ খাড়া করকে গোলি সে উড়া দেঙ্গে। শোচ তু, বাতায়গা ইয়া নেহি।
আলতাফ পড়ে ফেললেন পুরো পরিবারের ভবিষ্যৎ লিপি। সামাদের মত বিশ্বাসঘাতক এদেশে আগেও জন্মেছে। তাই এই পাকিরা জানতে পেরেছে যে অস্ত্র এ বাড়িতে আছে, কিন্তু কোথায় আছে সামাদ সম্ভবতঃ বলে নি। সে চাইছে আলতাফ নিজেই দিক অস্ত্রের খোঁজ। কিন্তু কেন? আলতাফ উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না। ইতিমধ্যে পাকিরা পাগল হয়ে গেছে অস্ত্র উদ্ধারের জন্য। কিন্তু এরপরে আলতাফের আর কি করার আছে! তার জীবনের জন্য বা কিছু অস্ত্রের জন্যে এতগুলো নিস্পাপ প্রাণ বাজি রাখা যায় না। ধীরে ধীরে আলতাফ হেঁটে গেলেন দেয়ালঘেঁসা কাঁঠাল গাছের নীচে। ক্যাপ্টেনকে বললেন – এহিঁ হ্যায় আপ কা হাতিয়ার।
– তু খুদ উঠা।
আলতাফ মাহমুদ পাঁচিলের পাশে রাখা কোদাল তুলে নিলেন। মাটি সরাতে লাগলেন কাঁঠাল গাছের নীচের। গাছের নীচে শান বাঁধানো হাউজের নীচ থেকে একে একে বেরোল চারটি বড় ট্রাঙ্ক। তার মধ্যে কষ্টার্জিত সব অস্ত্র। আলতাফকে দিয়ে ওঠানো হল সেই অস্ত্রসমূহ। কয়েকজন সিপাই অস্ত্রগুলি নিয়ে উঠে পড়ল ট্রাকে। আলতাফের চার শালা ও আলভিকে ওঠানো হল জিপে। আলতাফকে আলাদা করে ফেলা হল। তাকে মারতে মারতে তোলা হল আলাদা জিপে। আমেনা, ঝিনু, শিমুল, শাওনের আর্তনাদ ও আহাজারির শব্দ কেটে কেটে মিলিটারি কনভয় রওয়ানা হল ড্রাম ফ্যাক্টরির পাশে এম পি হোস্টেলে মিলিশিয়া বাহিনীর হেডকোয়ার্টারের দিকে।
হেড কোয়ার্টারে পৌঁছে কড়া নিরাপত্তার মধ্যে সবাইকে লাইন করে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হল। সামনে অস্ত্র রেখে ছবি তোলা হল। ছবিগুলি পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠানো হবে। প্রচার করা হবে সেনা বাহিনী কত বাঙালি দুষ্কৃতি ধরেছে। এবারে এল এক জমাদার। হাতে লম্বা এক খাতা। তাতে সবার নামের লিস্ট করে প্রত্যেকের ঠিকুজী কোষ্ঠী লেখা হল। এর পরে পাকিস্তানি আর্মির ক্যাপ্টেন কাইয়ুমের সঙ্গে পাকিস্তান আলবদর বাহিনীর সেকেন্ড ইন কমান্ড আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, মতিউর রহমান নিজামী, চৌধুরী, মঈনুদ্দিনসহ আরও দু-একজন সামনে এসে দাঁড়াল। আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ হঠাৎ চৌধুরী মঈনুদ্দিনের হাতের স্টেনগানটা তুলে নিয়ে তার বাঁট দিয়ে পিটিয়ে আলতাফ মাহমুদের ঠোঁট ও আঙুল ফাটিয়ে দিল।
– বাইঞ্চোৎ, ভারতের দালাল তুমরা পাকিস্তান ভাঙার তাল করতাসো। মাইরা মাইরা তগো গাঁড় ফাটামু। দ্যাখ এই বার মজা। অস্ত্র কই ক’।
– আমি জানি না। আর কোন অস্ত্র নাই।
– নাই কইলেই হইল। পুরা ঢাকা শহররে তরা বোমাবাজি কইরা নষ্ট কইরা ফালাইসস। ভাবস কি আমাগোরে।
সমানে মার পরছে আলতাফ মাহমুদের সারা শরীরে। আর একই প্রশ্ন – আর হাতিয়ার কোথায়? আলতাফ মার খাচ্ছেন আর বলে যাচ্ছেন – আর অস্ত্র আমাদের কাছে নাই।
– শালাকো লে যাইয়ে কাপ্তান ছাব। থুরা মেরামতি কিজিয়ে।
আলতাফকে সেপাইরা টানতে টানতে নিয়ে গেল চারতলা স্টাফ কোয়ার্টারের পিছনের দিকে একটা ঘরে। ঢুকেই আলতাফ বুঝল এটা ইন্টারোগেশনের ঘর। ওখানে একটা চেয়ারে বসাতেই আলতাফ বুঝল এবার আবার শুরু হবে জিজ্ঞাসাবাদের পালা। পাক সেনার উর্দি পরা যে লোকটি ঢুকল তার বুকে লেখা হেজাজী। মেজর হেজাজী।
– আলতাফ সাব, আপ তো পাকিস্তান কা মাসুর কলাকার হ্যায়। তো খুদ কা মুলুক কো তোড়নে কা ইরাদা কিঁউ হ্যায়?
– আমার কাছে হাতিয়ার ছিল, কিন্তু এর বাইরে আমার কিছুই জানা নেই।
– আপ হামলোগো কো চুতিয়া সমঝা? আবদুস সামাদ হামলোগো কো সবকুছ বোলা। এক কা বাদ এক হামলা আপ কা গ্রুপ কিয়া। আউর আপ ইয়ে সব লোগো কা লিডার হ্যায়। ইউ আর দ্য মেইন ব্রেইন বিহাইন্ড এভরি অপারেশন।
– আপনি যাই বলুন মেজর সাহেব, আপনার খবর একেবারেই ঠিক নয় । আমি কিচ্ছু জানি না। ওই সামাদ আমাকে হাতিয়ার রাখতে বলেছিল, আমি সরল বিশ্বাসে রেখেছি, কারন ও আমার পুর্বপরিচিত। বিপদে পড়েছে তাই সাহায্য করতে চেয়েছিলাম-
– দেখিয়ে আলতাফ সাব, হাম আপ কা গীত কা বহুত গুনেগার হুঁ। আপ এক কাম কিজিয়ে। আপ সব কা নাম পতা আউর যো যো কাম কিয়া থোড়া ডিটেইলস মে বাতা দিজিয়ে, হাম আপ কো ছোড় দেতা হুঁ।
– আমি সত্যি কিছু জানি না।
– হামারা তিন চার আদমী কো তালাশ হ্যায়। আলভী, ফতেহ, শাহাদাৎ আউর গাজী। আপ বাতা দিজিয়ে ইন লোগো কা হুলিয়া। ম্যায় আপ কো আউর আপ কা শালে লোগকো ছোড় দেতা হুঁ।
– আরে মেজর সাহেব, আমি এদের চিনি না, জানি না, খোঁজটা দেব কোত্থেকে?
– ঠিক হ্যায় সোচ লিজিয়ে। জওয়ানো, মেরে কো ইয়ে ইনফরমেশন চাহিয়ে। আলভী, ফতেহ, শাহাদাৎ আউর গাজী কাঁহা হ্যায়। আউর ইয়ে লোগো কা হুলিয়া ইয়ে আলতাফকা পাসই হ্যায়।
মেজর হেজাজী উঠে যেতেই এক জন বিহারী এসেই আলতাফের চুলের মুঠি ধরে সোজা করে দিল। ইয়ে শালা আসলি মুক্তি কমান্ডার হ্যায় – বলে পেটাতে শুরু করল। এবারে আরেক সিপাই এসে আলতাফকে উপুড় করে পা’দুটি বেঁকিয়ে ধনুকের মত চেপে ধরল। আলতাফের মনে হল পেটের চামড়া ছিঁড়ে নাড়ি ভুঁড়ি বেরিয়ে পড়বে। তারপরে শুরু হল কাঁধ থেকে পায়ের পাতা অবধি বেত দিয়ে কেটে কেটে মার। হঠাৎ জেলের সুবেদার মেজর গুল ঢুকল ঘরে। চুল ধরে মুখ সোজা করে জিজ্ঞাসা করল – হাতিয়ার কাঁহা? আলতাফ উত্তর দিলেন – জানি না। সাথে সাথে এক ঘুঁষিতেই দেওয়ালে ছিটকে পড়ল আলতাফের হাত পা বাঁধা শরীর। চিৎকার করে জ্ঞান হারালেন আলতাফ।
(১০)
১৯৬৬ সালের ১৬ই অক্টোবর ঝিনুর বিয়ে হয়ে গেল আলতাফ মাহমুদের সাথে। সকাল থেকেই ভীষন ব্যস্ততা। বিল্লাহ পরিবারের এই প্রজন্মে প্রথম বিয়ে। খাওয়া দাওয়ার দায়িত্বে পারিবারিক বন্ধু অজিত গুহ। দু’পক্ষের প্রায় দুইশ নিমন্ত্রিতের উপস্থিতিতে বেশ ধুমধাম করেই বিয়ে হল ঝিনু আলতাফের। শিমুল আজ নতুন জামা পড়েছে। তার তো আজ দুই জনের বিয়ে। ভাইয়া আলতাফ আর তার বড়বোন পিয়ামনির। পরীর মত সে ছুটে বেড়াচ্ছে বাসা জুড়ে। তার সবচেয়ে ভাল লাগছে ভাইয়া আর পিয়ামনির উজ্জ্বল মুখ। মাঝে মাঝেই মনে হচ্ছে কেন যে এই বিয়ে নিয়ে বড় ভাই নুহেল বিল্লাহ মা আমেনা বিল্লাহ এত আপত্তি করেছিলেন। বইয়ে পড়া রাজপুত্র রাজকন্যার বিয়ের মত পাত্রপাত্রী এই বিয়েতে। আর কে কতটা খুশি হয়েছে শিমুল জানে না। কিন্তু সে যে আজ খুব খুশি সেটা আর বলে দিতে হচ্ছে না। তিন বছর ধরে যার কাছে সে গানের তালিম নিয়ে চলেছে সেই গুরু ও বন্ধু আলতাফ ভাইয়া আজ তার দুলাভাই হলেন। দুত্তোর, নিকুচি করেছে দুলাভাইয়ের। আলতাফ মাহমুদ তার ভাইয়া। তার নিজের। আর কারোর নয়।
নতুন বউ নিয়ে উঠলেন আলতাফ উঠলেন প্রথম রাতে তাদের তিন বন্ধুর মেসবাসায় । পরের দিন উঠে এলেন র্যাঙ্কিন স্ট্রিটের বাসা বাড়িতে। সম্পূর্ণ দুজনের নীড়। বিয়ের পরে নতুন সংসার। ‘তানহা’ ছবির মুক্তির পরে আলতাফ মাহমুদের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। সাথে সাথে ব্যস্ততাও। একদিকে একটার পর একটা ছবিতে সুর দিচ্ছেন আলতাফ অন্যদিকে রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের অনুষ্ঠান, রিহার্সাল, রেকর্ডিং। সব মিলে আলতাফ সময়ের গন্ডীতে তীব্রভাবে বন্দী। প্রতিদিন মধ্যরাতে ফেরা। কখনও কখনও রাত ভোর করে বাসায় ফেরা। আবার সকাল হতেই বেরোন। এদিকে ঝিনু বেশ ভীতু, বয়েসও কম। রাতে একা থাকতে ভয় পায়। আলতাফও বুঝতে পারতেন যে ঝিনুকে তার একটু সময় দেওয়া দরকার। কিন্তু সুরের জগৎ তাকে সে সুযোগ দিলে তো। মা আমেনা বিল্লাহ প্রমাদ গুনলেন। একা বাসায় থাকতে গিয়ে ঝিনুর যদি কোন মানসিক বিপর্যয় ঘটে! এদিকে সংগীত পরিচালনার জন্য আলতাফকে প্রায়ই রাতের শিফট্ এ কাজ করতে হচ্ছে। সেখানেও তো কিছু বলা যায় না। কাজেই আলতাফকে প্রস্তাব দেওয়া হল যে আলতাফ ঝিনুসহ পুরো বিল্লাহ পরিবার আরো বড় বাসা নিয়ে একসাথে থাকতে পারে কি না। চিরদিন পিতৃমাতৃসাহচর্য বঞ্চিত আলতাফ মাহমুদ প্রস্তাবটা লুফে নিলেন। তিনি প্রবল উৎসাহে কিছুদিনের মধ্যেই রাজারবাগ পুলিশ স্টেশনের উলটো দিকে ৩৭০ নং আউটার সার্কুলার রোডের বাকি সাহেবের বড় বাসা ভাড়া নিয়ে চলে এলেন ঝিনুকে নিয়ে। পুরো বিল্লাহ পরিবারও উঠে এলেন সেই বাসায়। কিছুদিনের মধ্যেই আলতাফ হয়ে গেলেন বাসার বড় ছেলে, আমেনা বিল্লাহ’র চোখের মনি আলতু। বাকি সবার ভাইয়া।
রাতে সবাই একসাথে খেতে বসাটা বেশ দস্তুর হয়ে উঠেছিল এই পরিবারে। আলতাফ প্রায়ই তাড়াতাড়ি ফিরতেন একসাথে খেতে বসার আড্ডায় যোগ দিতে। যথারীতি মা আমেনা বাসার বড় ছেলে আলতাফের পাতে বড় মাছটা পরিবেশন করতেন। সেদিনও তাই হয়েছিল। বিল্লাহ পরিবারের বড় ছেলে নুহেল আলতাফের সাথে কিছুটা রসিকতার ঢঙয়ে কথা বলতেন। তিনি বলে উঠলেন –
– যাহ, আমার জায়গাটা দখল হয়ে গেছে।
– নুহেল, মা ভাল করেই জানেন যে তার বড় ছেলেটি কে!
– সে যাই বলো ভাইয়া, জামাই তো জামাই হয়, ছেলে ছেলেই।
– শোন, কিছুদিন অভিমান করে আমি দূরে ছিলাম বলে মায়ের বড় ছেলের জায়গা তুমি দখল করে ছিলে। আমি মা’র কাছে চলে এসেছি। এখন তোমার কোন জারিজুরি চলবে না।
এর মধ্যে ঝিনু সন্তানসম্ভবা হলেন। বাড়িজুড়ে সে এক হৈ চৈ। ঝিনুকে কোথায় বসাবে, কি খাওয়াবে তা নিয়ে বিস্তর গবেষনা। শিমুলের পিয়ামনির বাবু হবে। শিমুল পেটে কান দিয়ে শোনার চেষ্টা করত বাবুটা কথা বলে কিনা। বলতো না । এদিকে সেজ ছেলে দীনু একটা বাঁদর পুষেছিল। রোজ সেই বাঁদরের মুখ দেখতে দেখতে যদি ঝিনুর ছেলে বাঁদরমুখো হয়! মা আমেনা ও আলতাফ ঠিক করলেন যে বানরটাকে চিড়িয়াখানায় দিয়ে আসবে। দীনুও মেনে নিল। বাঁদর বিদায় হল।
তখন খুব গরম। ঝিনু পূর্ণগর্ভা। একদিন পাশের বাসা থেকে এক বোতল ঠান্ডা পানি এনে পান করছিল। তখন সব ঘরে ঘরেই ফ্রিজ ছিল, আলতাফের ছিল না । আলতাফ দুপুরে খেতে এসে দেখলেন এ দৃশ্য – তারপর সন্ধ্যায় একটা ফ্রিজ কিনে আনলেন যাতে ঝিনুকে আর অন্যের বাড়ী থেকে যেন ঠান্ডা পানি চেয়ে খেতে না হয়।
সেদিন আলতাফ মাহমুদ বেশ ঘাবড়ে ছিলেন। তার প্রথম সন্তান পৃথিবীতে আসছে। ৬ আগষ্ট হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে রাত সাড়ে দশটার দিকে ঝিনুর সন্তান প্রসব হল । আলতাফ মা আমেনার পেছনে শিশুর মতো লুকিয়ে বললেন “মা মনি আপনি আগে দ্যাখেন, আমার মতো কালো হয়নি তো ? ঝিনুর মতো রং পেয়েছে কিনা আগে দ্যাখেন। মা সন্তানকে দেখে আলতাফকে বললেন ” ঝিনুর চেয়েও সুন্দর হয়েছে তোমার মেয়ে আলতু ” । জন্ম হল শাওনের । আলতাফের একমাত্র কন্যা। আলতাফ ভাবলেন ওর আরেকটা নাম দেবেন – তান।
শাওন বাবা মায়ের স্নেহে ও আদরে বড় হতে লাগল। আলতাফের প্রাণ এই শাওন। শাওন যখন দুই আড়াই বছরের -পাশের বাড়ীর জাম গাছে জাম ধরেছে, জামগুলো ভাল করে পাকেনি কিন্তু শাওন খাবেই । বাড়ির মালিক বলল ” জাম পাকলে খেও ” । আলতাফ বাসায় ফিরে এসে দেখলেন শাওন জাম খাওয়ার জন্য বায়না করছে । তিনি গাড়ী নিয়ে বাজারে গিয়ে গাড়ির বনেটে ভরে এক ঝুড়ি জাম নিয়ে হাজির । মা আমেনা বললেন ” এত জাম কেন আনলে আলতু সবতো নষ্ট হবে । কটাই বা শাওন খাবে ? আলতাফ উত্তর দিলেন ” পাড়া প্রতিবেশীদের দিয়ে দেন, আমার মেয়ে জাম খেতে চেয়েছে আমিতো আর আধাসের জাম নিয়ে আসতে পারি না-ওকে জামের ঝুড়ির ওপর বসিয়ে দেন,দেখি ও কত খেতে পারে ” ।
বাজার করতে খুবই ভালবাসেন তিনি । প্রায়ই আরিচা ঘাটে চলে যান গাড়ী নিয়ে, নানা রকমের মাছ,সবজী বোঝাই করে নিয়ে আসেন -তারপর বিলানো হয় পাড়ায়। আলতু এনেছে। ভাল খেতে খুব ভালোবাসতেন আলতাফ । মা আমেনার হাতের চিংড়ি মাছের মালাইকারী তার খুব পছন্দের। মা আমেনা ছিলেন আসামের ধুবড়ি জেলার মেয়ে। আসামে আঁশহীন মাছ বাঙালিরা খুব একটা খায় না। মুরগীও ততটা নয়। তাই তিনি শিঙ মাছ, মাগুর মাছ ও মুরগী খেতেন না । তবে আলতাফের জন্য খুব যত্ন করে শিঙ মাছ ও মাগুর মাছ রান্না করতেন । মা খেতেন না বলে ঝিনুরা তিন বোনও ঐ মাছগুলো খেত না । খাবার টেবিলে বসে আলতাফ কয়েকদিন এই ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছেন । একদিন দুপুরে সবাই যখন খেতে বসেছে আলতাফ মাকে বললেন ” মামনি আপনিও আমাদের সাথে খেতে বসে যান অনেক বেলা হয়ে গেছে ” । মা তখনও জানতেন না এর পর আলতু কি করতে যাচ্ছেন । প্রথমইে সবার পাতে ভাত বেড়ে দিলেন মা। এরপর আলতাফ শিঙ মাছের তরকারীর বাটিটা নিয়ে বললেন ” মামনি আপনার থালাটা দেন আমি আপনাকে তরকারী বেড়ে দিচ্ছি ” । মা যতই বলেন না আলতু তুমি আগে নাও আমরা পড়ে নেব । তিনি ততই জেদ করে মাকে বলেন ” শোনেন মা, আমি জানি আপনি এই মাছ খান না, কিন্তু কেন বলেন ? এত ভাল মাছ আপনি খান না বলে ঝিনু, মিনু, শিমুল ওরাও খায় না । এটা কি ঠিক? মুরগীর কথা আজ বাদ দিলাম কিন্তু আজকে আপনি যদি শিঙ মাছ না খান তবে আমিও ভাত খাবনা । আমেনা বিল্লাহের এতদিনের অভ্যাস ভেঙে শুরু হল আঁশবিহীন মাছ ও মুরগী খাওয়া।
বাসায় একটা কুকুর আছে । নাম কিলার। সেই কিলার যখন ঘুমায় আলতাফ আশা যাওয়ার পথে ওর নাকে নস্যি গুজে দেয় । ব্যস, ঘুমন্ত কিলারের নস্যির সুড়সুড়িতে হাঁচি দিতে দিতে জীবন বেড়িয়ে যাওয়ার উপক্রম । ঘাসে নাক ঘসে তো সামনের দু’পা দিয়ে নাক চুলকিয়ে প্রচন্ড ভয় পেয়ে লাফালাফি শুরু করে দেয় । সে যে কি বেকায়দা অবস্হা কিলারের। এতেই আলতাফ মজা পায় শিশুর মত।
ঢাকার বিউটি বোর্ডিং ও মতিঝিলে ইত্তেফাক অফিসের সামনে দেশবন্ধু মিষ্টান্ন ভান্ডারে আলতাফদের আড্ডা। সৈয়দ শামসুল হক, জহির রায়হান – সবাই আসেন এই আড্ডায়। একদিন শামসুল ভাই বললেন –
– আলতাফ, তোমার কি হয়েছে বলো তো ? আজকাল মেয়ে হওয়ার পরে অনেক সংযত হয়ে গেছো।
– তা হয়েছি, স্বীকার করছি। ওই মেয়ের মুখ দেখলেই তো চাঁদপানা মুখ শব্দটা মনে পড়ে।
– করতলের স্বপ্ন-আমন ধানের গন্ধ তুমি/ তুমি আমার চিত্রকলার তুলি।/ পদ্য লেখার ছন্দ তুমি−সকল শব্দভুমি/ সন্তানের মুখে প্রথম বুলি।
– বাহ, দারুন বললে তো।
– আমার কবিতার পঙক্তি। আরেকটা শুনবে ?
– বলো।
– আমারে তলব দিও দ্যাখো যদি দুঃখের কাফন/তোমারে পিন্ধায়া কেউ অন্যখানে যাইবার চায়/ মানুষ কি জানে ক্যান মোচড়ায় মানুষের মন,/ অহেতুক দুঃখ দিয়া কেউ ক্যান এত সুখ পায়?
শামসুর দেখেন টানা লম্বা লম্বা আঙুল দিয়ে দিয়ে যাওয়া ভাত মাখছেন আলতাফ আর মন দিয়ে কবিতা শুনছেন।
এক সন্ধ্যায় আলতাফ ঝিনুকে বলে গেছেন রাতে আর ফিরবেন না। একটি ছবির সুর দেবেন। কিন্তু রাত এগারোটার সময় আলতাফ ফিরে এলেন আরে এসেই শুয়ে পড়লেন।
– তোমার কি শরীর খারাপ করছে?
– না ঝিনু।
– তবে?
– আরে আজ রিহার্সালের সময় রাজা হুসেন খান বেসুরো বাজাচ্ছিল। কিছুক্ষনের মধ্যেই বুঝলাম মিয়া আজ খেয়ে টই টম্বুর। বললাম বেরিয়ে যেতে। তাও যাবে না। দিয়েছি ব্যাটাকে তুলে দোতলা থেকে ফেলে।
– কি?
– হ্যাঁ। সেজন্যেই মনটা খুব বিক্ষিপ্ত।
– চট করে এত যে কেন রেগে যাও, তারপরে কষ্ট পাও, মেয়েটাও হচ্ছে তোমার মত।
বাইরে গলা শোনা গেল – আলতাফ, আলতাফ। বন্ধু নির্দেশক জহির রায়হানের গলা। আলতাফ দ্রুত উঠে কাল প্যান্ট সাদা শার্ট পরে নিলেন। জহির ঢুকতেই আলিঙ্গনাবদ্ধ হলেন দুই বন্ধু। জহর বললেন – আলতাফ, তুমি সত্যি পাগল, চলো। বেরিয়ে গেল দুই বন্ধু সারা রাত কাজ করবে। ওদিকে রাজা হুসেন খানের নেশা নেমে পগার পার।
গানের রেওয়াজের ব্যাপারে আলতাফ একেবারেই আপোষহীন। শিমুল সকালে যদি কোনদিন গলা না সাধে সেদিন শুধু বড় বড় চোখ দুটো আরও কঠিন করে সমস্ত রাগ নিয়ে দাঁড়ান । সেই মুর্তিতে কোন ক্ষমা নেই ,কোন আদর নেই । কঠিন দৃষ্টি । আবার অনেক সময় তিনি ঘরে বসে সুর করছেন, শিমুল দরজার পাশেই ঘুরঘুর করছে । তাকে ডেকেই জিজ্ঞাসা করেছেন ” কেমন হলো বলতো ? অনেক গান প্রথমে শিমুলই তুলে রাখত । কারণ আলতাফ সুর করে যখন মিউজিক কম্পোজ করতেন তখন মূল গানটা গাইত শিমুল আর তিনি কর্ডগুলো বের করতেন ।
এদিকে দেশের অবস্থা ক্রমেই উত্তাল হয়ে উঠছে। জীবিকার টানে চলচিত্র সঙ্গীতের সাথে যতই ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে থাকুন না কেন আলতাফ প্রাণের টানে একের পর এক গণসংগীতে সুর দিয়ে চলেছেন। ‘উদিচী’ শিল্পী গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে। আলতাফ সুর দিচ্ছেন তাদের জন্যেও।
১৯৬৯ এর গণ অভ্যুত্থানের ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়েছে জনমানসে। একুশে ফেব্রুয়ারীর সব অনুষ্ঠান ফিরে এসেছে শহিদ মিনারে। সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্বে আলতাফ মাহমুদ।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লিগ ৩১০ আসনের মধ্যে ২৯৮ টা আসনে বিজয়ী হল। এ এক অবিস্মরনীয় জয়। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের পুঁজিবাদী মহল ও সামরিক জান্তারা ক্ষমতা প্রদানে রাজী হল না। ১৯৭১ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি আলতাফ মাহমুদ তার সমস্ত মেধা ও দরদ দিয়ে এই অনুষ্ঠানটা করলেন। সেদিন মধ্যরাতে শেখ মুজিবর রহমান তার ভাষনে বললেন যে বাংলার স্বাধিকার ফিরিয়ে আনতে হবে। তার জন্যে সংগ্রাম প্রয়োজন। ভাষনের পরেই আলতাফের সাথে দেখা হতেই আলতাফ বললেন – শেখ সাহেব, যত দ্রুত পারেন, স্বাধীনতা ঘোষনা করে দেন। না হলে এদের থেকে চেয়েচিন্তে কিছু পাওয়া যাবে না। শেখ সাহেব বললেন – আলোচনা তো শুরু হতে চলেছে। দেখাই যাক না। আগে থেকে চ্যালেঞ্জ করে বসলে তো মুশকিল। ওরা তো রাস্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আনবে।
আলতাফের মনটা বড্ড খারাপ হয়ে গেল। ভোর রাতে বাসায় ফিরে ঝিনুকে বললেন-
– বুঝলে ঝিনু, এদেশ আগে থেকে কোন পদক্ষেপ নিতে দ্বিধা করে। শেখ সাহেবের ওপরে পুরো ভরসা করি। কিন্তু মানুষটা বড্ড ভালমানুষ। কি করে যে এখনও পশ্চিমাদের বিশ্বাস করছেন কে জানে! ওরা তো আমাদের মুসলমান বলেই গন্য করে না। ভাবে ভারতীয় এজেন্ট। কী যে হবে কে জানে।
ঝিনু বড় বড় চোখে সব শুনে বললেন – তুমি বরং ওসব না ভেবে শুয়ে পড়ো। তোমার তো বিশ্রাম দরকার। ঘুমিয়ে নাও। কথা বললে শাওন জেগে যাবে। আমি একটু চুলে বিলি কেটে দেই?
আলতাফ পাশ ফিরে শুলেন।