(১১)
বাকি বন্দীদের ধরার পরে চার পাঁচ ঘন্টা তুমুল অত্যাচার চালিয়ে একটি অন্ধকার রান্নাঘরে এক এক করে আছড়ে ফেলে দেওয়া হল। ঘরে প্রায় ত্রিশ বত্রিশ জন। সবাইকে মুক্তিযোদ্ধা সন্দেহে ধরে আনা হয়েছে। সবাই নিশ্চুম। মুখে কারো রা’ নেই। সবাই বিড়বিড় করে দোয়া-দরুদ পড়ছে। হে আল্লাহ, সহ্য করার শক্তি দাও। কার ভাগ্যে কী আছে কেউই বুঝতে পারছে না। এর মধ্যে এক একজন করে পাশের ঘরে জেরা করার জন্যে নেওয়া হচ্ছে। তারপরে আর্ত চিৎকার ও গোঙানির কান্না। এক এক করে বিল্লাহ পরিবারের নুহেল, খনু ও লিনুকে নিয়ে যাওয়া হল। বেদম প্রহারে হাত পা তাদের গুঁড়ো গুঁড়ো। এরপরে ডাকা হল দীনুকে। তার চুল বড়। কাজেই প্রথম আক্রমন চুলের ওপরে। তাপরে এক ঘুঁষি, চোখের ওপরে। চশমা ভেঙে খানখান। চুলের মুঠি ধরে তাকে হিঁচড়ে তোলা হল। তারপরেই প্রশ্ন –
– তুম মুসলমান হো?
– হাঁ।
– তো বেহেনচোৎ কলমা বোল।
– লা.. ইলাহা ইল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। আশহাদু আল্লা.. ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসুলুহু ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম…।
– খৎনা হুয়া? সালা পাৎলুন উতারো।
দীনু জামাকাপড় খোলার পরে এক সিপাই এসে ভাল করে ওর লিঙ্গ পর্যবেক্ষন করে বলল – হাঁ সাব, উসকা খৎনা হুয়া হ্যায়।
– ইন্ডিয়া সে ট্রেইনিং লেকে কব আয়া?
– জীবনে যাই নি সেদেশে।
– বাকী হাতিয়ার কাঁহা ছুপাকে রাখখা?
– হাতিয়ার কোথায় আমি জানি না।
– সাচ বাত বাতাও তো তুম কো ছোড় দেগা।
– যে কথা জানি না, তা বলব কি করে?
– তুম শালা সাচ্চা মুক্তি হো।
বলেই কিল চড় ঘুসি চলল দীনুর ওপরে। দীনু বুঝতে পারল ওর কানে যে চড়টা পড়েছে তাতে কানের পর্দা ফেটে ফর্দাফাঁই। কান দিয়ে গলগল করে রক্ত পড়ছে।
পাকিস্তান আর্মিদের মারের কোন নির্দিষ্ট ধরন নেই । বুকে ঘুষি, পেটে লাথি, হঠাৎ করে আচমকা পেছেন থেকে ঘাড়ে রদ্দা, রাইফেলের বাট দিয়ে বুকে পিঠে গুঁতো, মাথায়, পিঠে শরীরে সবখানে মার, উপুর করে শুইয়ে বুট শুদ্ধ পায়ে উঠে দাঁড়িয়ে মাড়ানো, হাঁটুর গিটগুলি থেতলে দেওয়া। এর সাথে ব্যঙ্গবিদ্রুপ। বন্দীরা হল খেলার জিনিষ।
বিপজ্জনক বন্দী হিসেবে বিচ্ছু জালাল, বদি, রুমি,জুয়েল, বকর, হাফিজ ও আলতাফকে আলাদা সেলে রাখা হয়েছে। বাকিদের প্রথম প্রস্থ নির্যাতন হয়ে গেছে। এর পরের পালা বিচ্ছু জালালের। তাকে টর্চার সেলে নেয়ার আনুমানিক তিন ঘণ্টা পর দরজা খোলা হল। সেই সময় বুটের আওয়াজ পেয়ে বিচ্ছু দেখল পাকিস্তানি আর্মির ক্যাপ্টেন কাইয়ুমের সঙ্গে আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, মতিউর রহমান নিজামী, চৌধুরী মঈনুদ্দিনসহ আরও দু-একজন সামনে এসে দাঁড়াল। এ সময় নিজামী তার নাম, বাবার নাম সবকিছু ডিটেইলস লিখল। এরপর সরাসরি নিজামী বিচ্ছুর ওপর নির্যাতন শুরু করল। তার হাত ও পায়ের আঙুলটা কেটে দিল। আর একটাই প্রশ্ন – তুই বদি, রুমি,জুয়েল, আলতাফকে চিনিস কি না! কিন্তু বিচ্ছুর একটাই উত্তর- না, চিনি না। মুখ থেকে কোনো কথা বের করতে না পেরে নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় নিজামী ও মুহাজিদ। বিচ্ছু আর পারে না। একপর্যায়ে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে যায়। মেঝেতে পড়ে থাকাবস্থায় তাকে মুজাহিদ এলোপাতাড়ি লাথি মারতে থাকে। অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে। এর পরে তাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে এসে বদি, রুমি, আজাদ, আলতাফ ভাইদের রুমে ঢুকায়। মুজাহিদ এবার তুলে নেয় বদিকে। মারতে মারতে ওদের এমনি কাবু করে ফেলা হয়েছে। অর্ধেক মৃত অবস্থা তাদের। নির্যাতনে কারও মেরুদণ্ড, কারও হাত -পা ভেঙে গিয়েছে। ক্ষতবিক্ষত অবস্থা সবার। ওদের মারতে মারতে হয়রান হয়ে পড়ছে, ঘুরে দাঁড়িয়ে অন্যকেও মারছে। স্টেনগান দিয়ে মুজাহিদ নিজে পৈশাচিক কায়দায় মেরে চলেছে। চড়, লাথি, কিল, ঘুষি যখন যেভাবে ইচ্ছা হয়েছে সেভাবেই মারছে। লাঠি দিয়ে সাপ যেভাবে পেটায় সেভাবে পেটাতে পেটাতে যখন মুজাহিদ হয়রান হয়ে গেছে তখন তুমুল রাগে ক্যাপ্টেন কাইয়ুমকে বলছে – শালাদের গুলি করে মেরে দাও কাইয়ুম আর লাশগুলি পেট্রল জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দাও যাতে কেউ যেন শালাদের কোন চিহ্ন না পায় কোনদিন। ক্যাপ্টেন কাইয়ুম হাসতে হাসতে বলল – হাম লোগো কো হাত উঠানা নেহি পড়তা, শালা বাঙ্গালি লোগই বাঙ্গালিকো পিটতা হ্যায়।
লিনুর হাতে জ্বলন্ত সিগারেট চেপে ধরে সুবেদার বলল – বোল শালা, হাতিয়ার কাঁহা হ্যাঁয়। লিনু উত্তর দিল – আমি কিচ্ছু জানি না। আবার সুবেদার বলল – ঠিক হ্যায়, তু এক নাম বাতা দে। তেরে কো ছোড় দেতা হুঁ। লিনুর একই উত্তর – আমি কিচ্ছু জানি না। সুবেদার উগ্রমুর্তি ধারন করে বলল – শালা, বাঙ্গাল কা কুত্তা হাম কো ঝুট বোলতা হ্যায়? বলেই ছোটখাটো চেহারার লিনুকে দুহাতে শুন্যে তুলে দেওয়ালে আছড়ে ছুঁড়ে ফেলে। লিনু ছিটকে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেল।
ছোট রান্নাঘরে গাদাগাদি করে যে ত্রিশ বত্রিশ বন্দী ছিল তার মধ্যে ছিলেন রুমীর বাবা শরিফ ইমাম। নামী প্রযুক্তিবিদ, ব্যবসায়ী শরিফ ইমাম সমাজের উঁচুতলার লোক। কিন্তু ঢাকার সব কার্লভাট ও ব্রীজের ইঞ্জিনিয়ারিং নকশার কপি তিনি খালেদ মশারফকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। চুড়ান্ত দেশপ্রেমী এই মানুষটিকে আর্মি ধরে এনেছিল শুধু রুমীর বাবা বলে। রুমী আগেই বলে দিয়েছিল যে আমার কার্যকলাপ যে তোমরা জানো সেটা কখনই স্বীকার করবে না। তা সত্ত্বেও একই প্রশ্ন করে গেছে পাকিস্তানী সুবেদার ও আলবদর বাহিনী। শরিফ ইমাম স্বীকার করেন নি কিছুই। একই কথা বলে গেছে তার ছোট ছেলে জামী। রুমীর ব্যাপারে তারা কিছুই জানে না। কিন্তু তাতে তাদের ওপরে অত্যাচারের মাত্রা কমে নি। শরিফের মুখচোখ সব ফোলা। সারা জামায় রক্তের দাগ। তিনি দীনুকে দেখে চিনতে পারলেন। মৃদু স্বরে বললেন যে এখানে কারোর কাছে মুখ না খুলতে, ওদের লোক এখানেও ঢুকিয়ে রেখেছে।
এর মধ্যে সিপাই এসে হাঁক দিল – আলভী কউন হ্যায়? আলভী বীরের মত উঠে দাঁড়াতে গেল। পিছন থেকে টেনে ধরল খনু বিল্লাহ। বেশ কয়েকবার ডেকে সিপাই চলে গেল। খনু রেগে আলভীকে বলল – তুই কি ভুলে গেছিস আলতাফ ভাই কি বলে গেছে তোকে? তুই আবদুল বারেক। আমাদের ভাগ্নে। বেড়াতে এসেছিস। তোর বাপের নাম এই, মায়ের নাম…। সে যাত্রায় আলভী রক্ষা পেল।
আলতাফ যে কোথা থেকে এত প্রাণশক্তি পায় তা আল্লাহই জানেন। তাকে ইন্টেরোগেশন রুমে ঢুকিয়ে তাকে চেয়ারে বেঁধে মাথার ওপরে সার্চলাইট জ্বালিয়ে দিল ক্যাপ্টেন আদেল। আলতাফের মনে হল মাথার তালু দিয়ে গরম লাভা বেরোচ্ছে। চুলগুলো পটপট আওয়াজ করে পুড়ে যাচ্ছে। সারা শরীর দিয়ে দরদর করে ঘাম বেরোচ্ছে। আলবদর বাহিনী ঢুকল এবার ঘরে। তাদের কাজ শুধু মারা। ক্যাপ্টেন আদেল আলতাফকে জিজ্ঞাসা করল –
– তুমহারা পাস হাতিয়ার মিলা। আউর হাতিয়ার কাঁহা রাখখা বেহেনচোৎ?
– আমার কাছে আর কোন হাতিয়ার নেই।
– শালা বাঙ্গাল কা কুত্তা, পাকিস্তান কা গদ্দার, ইন্ডিয়া কি স্পাই। তেরে কো মার মার কে কুচল ডাল দেঙ্গে। বোল, কাঁহা রাখখা হাতিয়ার।
– আমি সত্যি বলছি আমার কাছে আর কোন হাতিয়ার নেই।
– ঠিক হ্যায়, তো শালা মার খা, বোলনা তো তেরে কো পড়েগাহি।
ঝাঁপিয়ে পড়ল আলবদর বাহিনী। হাতে পাকানো ইলেকট্রিকের তার। মোটা করে বেত বানানো হয়েছে। সপাসপ মার। মার খেতে খেতে যতক্ষন আলতাফ সংজ্ঞা না হারল মেরেই চলল আলবদরের পাষন্ডরা।
বিকেলে সবাইকে একপ্রস্থ মারধোর করা হল প্রকাশ্যে। ক্যাপ্টেন কাইয়ুম সবাইকে জানিয়ে দিল যে আজ রাত্রে সবাইকে ডেমরা বাঁধের ওপরে নিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে মেরে ফেলা হবে। তারপরে তাদের ঢুকিয়ে দেওয়া হল সেই রান্নাঘরে। সকাল থেকে কাউকে খাবার তো দূরের কথা, পানিও দেওয়া হয় নি। কিন্তু আল্লাহ সহায়। সেই ছোট ঘরে একটা জলের কল কেউ আবিস্কার করল। প্রত্যেকে পানি খেল প্রাণ ভরে।
রাত নয়টার সময় সবাইকে রান্না ঘর থেকে বার করে বাইরে এনে লাইনে দাঁড় করালো পাক সেনারা। এর পরে একের পর এক জনকে উঠিয়ে দেওয়া হল ট্রান্সপোর্টের বাসে। সবার বুকই ঢিপঢিপ করছে। তাহলে কি ওদের নেওয়া হচ্ছে ডেমরা বাঁধে! ব্রাস ফায়ারের জন্যে? বাস রওয়ানা হয়ে বিশ ত্রিশ মিনিট বাদে থামল রমনা থানায়। তাদের ঢোকানো হল থানার হাজতে। সেখানে আগেই জনা তিরিশেক বন্দী ভরা ছিল। তারা নিতান্তই চোর ডাকাত। তারা সবাই মটকা মেরে পড়ে ছিল। একটু বাদে জিপে করে আনা হল আলতাফ মাহমুদ সহ বাকি বিপজ্জনক বন্দী ক’জনকে। কিন্তু তাদের আনতে হল সিপাইদের কাঁধে করে। প্রায় কারোরই দাঁড়াবার শক্তি নেই। হাত পা কনুই গোড়ালি সব গুঁড়োগুঁড়ো। হাত গুলি থেঁতলে গেছে। রক্ত ঝরছে চুঁইয়ে চুঁইয়ে। আর্মিরা চলে যেতেই সক্রিয় হয়ে উঠল আগে থেকে থাকা চোর ডাকাত বন্দীরা। দ্রুত তারা মুক্তি যোদ্ধা সন্দেহে যাদের মার ধোর করা হয়েছে তাদের শুশ্রূষায় ব্যস্ত হয়ে উঠল। তাদের কাছে থাকা ওষুধ দিয়ে ক্ষতস্থানের পরিচর্যা করতে শুরু করল তারা। আলতাফ মাহমুদ ক্ষীন কন্ঠে বললেন – তোমরা সব ওষুধ দিয়ে দিচ্ছ, তোমাদের তো আর কিছুই রইল না। শশব্যস্ত হয়ে সেই হাজতী উত্তর দিল – স্যার, আমরা পেটের দায়ে পকেট কাটি আর আপনেরা দ্যাশের জইন্যে জীবন দ্যান, আপনাগো সেবা কইরা আমরাও এট্টু দ্যাশের কাজই তো করনের চ্যাষ্টা করতাসি। কিছু বাদেই রমনা থানার ওসি থেকে কনস্টেবল সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ল এদের খাবারের বন্দোবস্ত করতে। ২০/২২ ঘণ্টা কারোর পেটে দানাপানি পড়ে নি। খালি মার আর মার খেয়ে সবাই বিধস্ত। পাশের ভাতের হোটেলে ব্যবস্থা হল। পুলিশরা রাতে বন্দীদের পেট ভরে শুধু ডাল ভাতের ব্যবস্থা করে দিলেন। আলতাফের সামনে গরম ভাত আর ডাল রাখতেই তিনি বললেন সামনের সিপাইকে – ভাইয়া, একাটা কাঁচা মরিচ হবে? সিপাই দৌড়ে একটা কাঁচা লঙ্কা এনে আলতাফের হাতে দিল। আলতাফের হাত রক্তাক্ত। হাড়গুলি ভাঙা। সে হাতে কোনোমতে লঙ্কাটা ধরে দাঁত দিয়ে কাটল। ভাতে মাখতে যেতেই হাতে রক্তে ভাত লাল হয়ে গেল। মাঝে বাংলাদেশের পতাকার রঙের সবুজ লঙ্কা। আলতাফ সেই রক্তে মাখা ভাত খেলেন কাঁচা মরিচ দিয়ে গোগ্রাসে। পরম তৃপ্তিতে বাকি বন্দীরা ভাত ও ডাল খেয়ে নিল। এ যেন তাদের পরমান্ন।
পরদিন ৩১ অগাস্ট। সকাল আটটা নাগাদ আর্মির গাড়ি এল। তালিকা মিলিয়ে প্রথমে আলতাফ মাহমুদ, জালাল, বদি, রুমি,জুয়েল, বকর, হাফিজদের আর্মি জীপে তুলে নিয়ে বেরিয়ে গেল। বাকিদের তুলল বাসে। তাদের ফিরিয়ে আনা হল সেই ড্রাম ফ্যাকটরির পাশের মিলিশিয়া ক্যাম্পে। গেটে তাদের অভ্যর্থনা করল আলবদর বাহিনীর ভারত থেকে আসা বিহারী মুসলমানরা। অশ্লীল গালি ও উল্লাসে বরন করল তাদের। নামানো মাত্রই শুরু হল বেপরোয়া মার। তারপরে যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ত তখন বন্দীদের দাঁড় করানো হল মাঠে প্রচণ্ড রোদের মধ্যে। সেপ্টেম্বর শুরুর উল্লম্ব রোদে সবার প্রাণঘাতী অবস্থা। ঘন্টা দুয়েক পরে ধপাস। পড়ে গেলেন শরিফ ইমাম। পানির তেষ্টায় মারে জর্জরিত ক্ষতবিক্ষত দেহ নিয়ে প্রবল রোদে ঘন্টা দুয়েক দাঁড়ানোর পরে শরীর আর সোজা থাকতে পারে? এর পরে বেশ কিছু বন্দী ভুমিশয্যা নিতেই সিপাইরা সক্রিয় হল। আবার দে ধপাধপ। কিছুক্ষনের মধ্যে আলতাফ মাহমুদের সহকারী হাফিজ নিশ্চল হয়ে পড়ল। তাকে তুলে নিয়ে দুই সিপাই ছুঁড়ে দিল একটা ভাঙা ঘরে।
এর মধ্যে হঠাৎ দেখা গেল অল্প দূরে একটা ঘর থেকে এক সিপাইকে ধাক্কা মেরে এক বন্দী মাঠের দিকে দৌড়ে আসছে আর চিৎকার করছে – মুঝে গোলি সে মার দো। অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে সে চাইছে তাকে গুলি করে হত্যা করা হোক। পিছনে পিছনে ছুটে আসছে আলবদরের শিকারী বাহিনী। তারাই ধরে ফেলল বন্দীটিকে। ওর নাম বদিউল আলম। ঢাকা শহর ও এর আশপাশে বেশ কয়েকটি দুর্ধর্ষ অপারেশনের নায়ক। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল— ৮ আগস্ট ফার্মগেটে পাক বাহিনীর চেকপোস্ট অপারেশন, ১১ আগস্ট হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের ভেতরে বিস্ফোরণ ঘটানো, ১৪ আগস্ট গ্যাস বেলুনের মাধ্যমে ঢাকা শহরের আকাশে বাংলাদেশের অনেক পতাকা ওড়ানো, ১৯ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশনে অপারেশন, ২৫ আগস্ট ধানমণ্ডির ১৮ ও ২০ নম্বর রোডে অপারেশন। ক্রাক প্লাটুনের অ্যাকশন বাহিনীর প্রথম সারির সদস্য। কাজেই তার ওপর আক্রমন ও অত্যাচার যে তীব্র হবে সেটাই তো স্বাভাবিক। গতকাল অত্যাচারের মাত্রা সহ্য করতে না পেরে বিদ্যুতের তারে হাত দিয়ে মৃত্যু বরন করতে চেয়েছিল। সফল হয় নি। কয়েক মিনিটের মধ্যে বদি’কে ধরে ফেলল আলবদর বাহিনী। এবারে মাঠে ফেলে বিস্তর মার। পাঞ্জাবী মেজর এসে বলল – শালা বাঙ্গাল কা কুত্তা কো গোলি সে নেহি মারেঙ্গে, উসকো লিয়ে গোলি খরচা ভি নেহি করেঙ্গে, শালে কো হাড্ডি তোড় দো। বদি মাঠে ফেলে এতটাই মারল যে বদির শ্বাস উঠে গেল। টানতে টানতে ওরা বদিকে নিয়ে ফেলল একটি ঘরে লোহার খাটিয়ায়। সেখানে দীর্ঘ অনিয়মিত শ্বাস পড়তে লাগল বদির। সন্ধ্যের মুখে আলবদরের একজন ক্যাপ্টেনকে এসে বলল- স্যার, বদি’র তো শ্বাস উঠ গিয়া, আর কিছুক্ষন…
ক্যাপ্টেন উত্তর দিল – শালে কো মরনে কা ফেলে পোলাও ভেজওয়া দো।
পাক সেনারা কোন বন্দীর মৃত্যুর আগে পোলাও পাঠায়। বদির জন্যে পোলাও রেখে গেল এক সিপাই। বদি তাকিয়েও দেখল না। কিছুক্ষনের মধ্যে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল বদি। ক্রাক প্লাটুনের বন্দীযোদ্ধার প্রথম মৃত্যু হল। ক্যাপ্টেন এসে বলল – শালে কো পেট্রল জ্বালাকে দাফনা দো। পুরা রেকর্ড ভি উস কা সাথ জ্বালা দো। কই নাম নিশান রাখখো মৎ।
(১২)
১ মার্চ দুপুর একটায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া রেডিওতে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষনা করতেই ঢাকা শহরে হৈ হৈ পড়ে গেল। লোকেরা দলে দলে অফিস আদালত ছেড়ে বেরিয়ে এল। শেখ মুজিব হোটেল পূর্বানীতে প্রেস কনফারেন্স ডেকে বসলেন। রাস্তাঘাট জ্যাম ভীড়ে অবরুদ্ধ। আলতাফ বাসায় এসেছিলেন দুপুরের খাবার খেতে। এসে শুনলেন শিমুল গেছে ঢাকা স্টেডিয়ামে ভাইদের সাথে ক্রিকেট খেলা দেখতে। খেতে খেতে শুনলেন ইয়াহিয়ার অধিবেশন বন্ধের খবর ও ঢাকা নগরীর কী হাল হতে পারে সে সম্পর্কে তার সম্যক জ্ঞান আছে। খাওয়ার পাত থেকে দ্রুত উঠে কোনরকমে হাত ধুয়েই ছুটলেন ঢাকা স্টেডিয়ামের দিকে। এদিকে স্টেডিয়ামে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে, জনতা সব কিছুতে আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছে । কোন মতে স্টেডিয়াম থেকে বের হয়ে ভাইদের হাত ধরে শিমুল দৌড়চ্ছে। টায়ার জ্বলছে,বাস জ্বলছে,মানুষ যে যেদিকে পারছে দৌড়াচ্ছে। এর মধ্যে শিমুল দেখল তার ভাইয়া রাস্তা দিয়ে উদভ্রান্তের মতো ছুটে আসছে পড়নে লুঙ্গি আর হাফ হাতা সাদা শার্ট । শিমুলকে দেখে ভাইদের হাত থেকে ছোঁ মেরে নিয়ে বাসার দিকে হাঁটতে লাগল। অসম্ভব রেগে রয়েছে ভাইদের উপর। কারণ তারা শিমুলকে এই বিপদের মধ্যে নিয়ে এসেছে । দেশের অবস্হা ভালো না সেটা সবাই জানে । যে কোন সময় র্দুঘটনা ঘটতে পারে । রাগে গজগজ করতে করতে শিমুলের হাত ধরে হাঁটা দিলেন বাসার রাস্তায় ।
এদিকে শেখ সাহেব প্রেস কনফারেন্সে আগামী দুই দিন সর্বাত্মক হরতালের ডাক দিলেন এবং জানালেন ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে গনজমায়েত। সারা ঢাকা জুড়ে মানুষ উত্তাল হয়ে উঠছে। চারিদিকে শুধু জয় বাংলা ধ্বনি। ইয়াহিয়া জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করে ভীমরুলের চাকে ঘা দিয়েছেন।
২ ও ৩ মার্চ সারা পূর্বপাকিস্তানে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হল। দফায় দফায় বিক্ষোভ মিছিল ও মিটিং ছাড়া সারা শহর জুড়ে বাকি সব স্তব্ধ। ছাত্রদের, ন্যাপের, কৃষক সমিতির বিভিন্ন সংগঠনের বিক্ষোভ ও দাবীর কাছে আইন রক্ষকদের কোন ভূমিকাই দেখা গেল না। এদিকে পল্টনের জনসভায় শেখ মুজিবের উপস্থিতিতে প্রথমে ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’ গানটা গাওয়া হল। তারপরে স্বাধীন বাংলার সবুজের ওপর লাল গোলাকার সূর্যের মাঝে হলুদ রঙের পূর্ব বাংলার মানচিত্র সম্বলিত পতাকা তোলা হল। স্বাধিকারের থেকে স্বাধীন বাংলার দাবী আবার উঠে পড়ল এ সভায়। কথাটা শুনে আলতাফ আশায় বুক বাঁধল। শেখ মুজিব এবার স্বাধীনতার ঘোষনা দিতে বাধ্য। আলতাফ দীর্ঘদিন রাজনীতি করে পশ্চিমাদের সাথে মিশে এই ব্যাপারে নিশ্চিত যে স্বাধিকার পশ্চিমারা কখনই দেবে না। এ শুধু কালক্ষেপনের মতলব।
এদিকে কারফিউ জারি হয়েছে শহরে। আলতাফের বাসার কাছেই মালিবাগ মোড়ে ক্ষুব্ধ জনতা কারফিউ লঙ্ঘন করতেই গুলি চালিয়েছে মিলিটারি। নিহত হয়েছে ফারুক ইকবাল নামে এক ছাত্র। সে অন্যান্য ছাত্রদের সাথে মালিবাগে ব্যারিকেড বানিয়েছিল। তার মৃত্যুর পরে ক্ষুব্ধ ছাত্ররা ফারুককে কবর দিয়েছে মালিবাগ মোড়ের ট্রাফিক আইল্যান্ডে। মালিবাগ লেভেল ক্রসিংয়ে ছাত্ররা রেলের একটি বগি টেনে রাস্তায় ব্যারিকেড তৈরী করেছে। আলতাফ বাসা থেকে বেরোলেন ফারুকের কবর দেখতে। এসে দেখলেন কবর ঘিরে দড়ির রেলিং। আগরবাতি জ্বলছে। কয়েকজন মোমবাতি জ্বালিয়ে দিয়েছে। দুজন মৌলবী সাহেব কবরের সামনে কোরআন শরিফ পড়ছেন। আলতাফের মনটা বিষন্ন হয়ে উঠল।
প্রথম দু’দিনের সর্বাত্মক হরতালের পরে ৪, ৫, ৬ মার্চ হরতাল হল সকাল ছ’টা থেকে দু’টো অবধি। শেখ মুজিব বেতন পাওয়া ও অন্যান্য সুবিধার জন্যে আদেশ দিয়েছেন সব অফিস, রেশন দোকান দুপুর আড়াইটা থেকে বিকেল চারটে অবধি খোলা থাকবে। জরুরী সার্ভিস হিসেবে হাসপাতাল, ওষুধ, অ্যাম্বুলেন্স, ডাক্তার, সংবাদপত্র, পানি, বিদ্যুৎ, টেলিফোন ইত্যাদি হরতালের আওতা থেকে বাদ। সারা পূর্বপাকিস্তান এখন চলছে শেখের কথায়। সরকারের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। ৬ মার্চ দুপুর একটা পাঁচ মিনিটে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশ্যে বেতার ভাষন দিলেন। সে ভাষন শুনে সবাই ক্ষুব্ধ উত্তেজিত। পাকিস্তান ভাঙার ষড়যন্ত্র করছে পূর্বপাকিস্তানের আন্দোলনকারীরা। এদের সহজেই শায়েস্তা করা হবে মিলিটারি শাসন কায়েম করে। বাঙালিদের তুমুল গালমন্দ করলেন তার বেতার ভাষনে। ১ তারিখে শেখ সাহেব হোটেল পূর্বানীতে বলেছিলেন বাংলার মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার অর্জনের কর্মসূচী তিনি সাত তারিখে ঘোষনা করবেন। কিন্তু আলতাফের মনে হল যতই উনি নির্বাচনে জিতে জনপ্রতিনিধিদের নির্বাচিত হয়ে দাবির জোরে সরকার গঠনের পরিকল্পনা করুন না কেন, স্বায়ত্ত্বশাসন পশ্চিমারা কিছুতেই দেবে না। ইয়াহিয়ার আজকের ভাষন সেই ইঙ্গিতই দিল। কাজেই আগামীকাল শেখ সাহেবের উচিৎ সরাসরি স্বাধীনতার কথা ঘোষনা দেওয়া। তাতে কিছু মানুষ হয়ত মরবে, কিন্তু সর্বাত্মক গৃহযুদ্ধ হবে না। কারণ পূর্বপাকিস্তানে মিলিটারি পুলিশের সংখ্যা বড় নগন্য। সময় দিলে পশ্চিম থেকে সামরিক বাহিনী চলে আসবে ঢাকায়। প্রথমেই দখন করতে হবে বিমানবন্দর ও চট্টগ্রাম বন্দর। ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস শুধু শেখ সাহেবের আদেশের অপেক্ষায়। পুলিশ বাহিনীও তৈরি। সংখ্যাধিক্যে তারা উপস্থিত মিলিটারি পুলিশকে কাবু করতে সক্ষম হবে। কি করবেন শেখ সাহেব?
আজ ৭ মার্চ রমনা রেসকোর্সে গনজমায়েত। আলতাফ সকাল থেকেই ভিতরে ভিতরে বেশ উত্তেজিত। আজ কোন কাজ রাখেন নি। তাড়াতাড়ি খেয়ে রেসকোর্সের মাঠে গিয়ে দেখেন লোকে লোকারণ্য। কমপক্ষে ত্রিশ লাখ লোক এসেছে। টঙ্গী, জয়দেবপুর, ডেমরা, ঘোড়াশাল থেকে লোক এসেছে মিছিল করে। চারিদিকে উড়ছে স্বাধীন বাংলার সবুজ লাল পতাকা। সবাই স্বাধীনতার ঘোষনা শুনতে চায়। শেখ মুজিব শুরু করলেন..।।
…ভায়েরা আমার, আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়। কী অন্যায় করেছিলাম? নির্বাচনের পরে বাংলাদেশের মানুষ সম্পূর্ণভাবে আমাকে, আওয়ামী লীগকে ভোট দেন। আমাদের ন্যাশনাল এসেম্বলি বসবে, আমরা সেখানে শাসনতন্ত্র তৈরি করবো এবং এদেশকে আমরা গড়ে তুলবো। এদেশের মানুষ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ…
১৮ মিনিট স্থায়ী এই ভাষণে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদেরকে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানালেন। সামরিক আইন প্রত্যাহার এবং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবীটির ওপর গুরুত্ব আরোপ করে তিনি ভাষন শেষ করলেন এই বলে…
…তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। রক্ত যখন দিয়েছি, আরো রক্ত দেবো। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম জয় বাংলা।…
আলতাফের মনে হল সবই বললেন শেখ মুজিব শুধু সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষনা দেওয়া ছাড়া। তাহলে আওয়ামী লীগ সূত্রে যে খবরটা পেয়েছিলেন সেটা ঠিকই। পূর্ব পাকিস্তানের জি ও সি আওয়ামী লীগ নেতাদের স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন যে , পাকিস্তানের সংহতির বিরুদ্ধে কোনো কথা বলা হলে তা শক্তভাবে মোকাবেলা করা হবে। বিশ্বাসঘাতকদের হত্যার জন্য ট্যাংক, কামান, মেশিনগান সবই প্রস্তুত রাখা হবে। প্রয়োজন হলে ঢাকাকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হবে। শাসন করার জন্য কেউ থাকবে না কিংবা শাসিত হওয়ার জন্যও কিছু থাকবে না।
তাহলে কি শেখ মুজিব ভয় পেলেন ! আলতাফ তাকে যতটা চেনেন তিনি তো ভয় পাওয়ার বান্দা নন। তাহলে কি শেখ সাহেব সারা বিশ্বকে এটা বলার সুযোগ দিলেন না যে, মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন, কাজেই আঘাত হানা ছাড়া পাক শাসকদের আর কোনো বিকল্প ছিল না। তাই তিনি চাইছেন আগে পাকিরা আঘাত হানুক এবং জনগণ তা প্রতিরোধ করুক। আলতাফ বেশ ঘোরের মধ্যে পড়লেন। সেদিনই পূর্বপাকিস্তানের গভর্নর বদল হল। মাত্র ছ’দিন আগে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল লেফটেন্যান্ট জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খানকে। ছ’দিনের মাথায় আনা হল লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খানকে। আলতাফ এই বদলে অশনি সংকেত দেখলেন। তার বারেবারে মনে হচ্ছে তার বাংলা কোন রক্তক্ষয়ী অধ্যায়ের দিকে পা বাড়াচ্ছে।
চারিদিকে এখন আর স্বাধিকারের কথা নেই। একটাই শব্দ উচ্চারিত হচ্ছে স্বাধীনতা। এমন কি মওলানা ভাসানী এক বক্তৃতায় বলে দিলেন – বর্তমান সরকার যদি আপসে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা না দেয়, তাহলে ’৫২ সালের মত মুজিবের সাথে একসঙ্গে বাংলার মুক্তি সংগ্রাম করব।
দ্রুত স্বাধীনতার স্বপক্ষে লেখক সাহিত্যিকরা ও শিল্পীরা সংগঠন গড়ে তুললেন। লেখকরা হাসান হাফিজুর রহমান, রণেশ দাশগুপ্ত, আলাউদ্দিন আল আজাদের নেতৃত্বে গঠন করলেন ‘লেখক সংগ্রাম শিবির’। শিল্পীরা তৈরি করলেন ‘বিক্ষুব্ধ শিল্পী সংগ্রাম পরিষদ’। নেতৃত্বে আলী মনসুর, সৈয়দ আবদুল হাদী, আলতাফ মাহমুদ প্রভৃতি।
অর্থাৎ সংগ্রামের জন্যে প্রস্তুত হল সবাই। এদিকে বিদেশী দূতাবাসগুলি দ্রুত তাদের নাগরিকদের সরিয়ে নিচ্ছে ঢাকা থেকে। এই পদক্ষেপ মোটেই ভাল ইঙ্গিত নয়। পাক প্রেসিডেন্টের সাথে আলোচনা শুরু হয়েছে শেখ মুজিবের। প্রতিবাদের কালো পতাকা উঁচিয়ে শেখ মুজিব গেলেন ইয়াহিয়ার সাথে দেখা করতে। ইয়াহিয়া ঢাকা এসেছেন শেখ মুজিবের সাথে আলোচনা করতে। কিন্তু সাথে এনেছেন সেনাবাহিনীর প্রধান সহ ১০ অতি উচ্চপদস্থ সেনাকর্তাকে। আলতাফ কিছুতেই বুঝে উঠলেন না এর কারণ কি! চারিদিকে সংগ্রামী গান বাজছে – সংগ্রাম, সংগ্রাম, সংগ্রাম, চলবেই দিনরাত অবিরাম। এদিকে আলোচনা চলছেই কিন্তু কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে না। এর মধ্যে পাকিস্তানী পরাজিত নেতা জুলফিকার আলি ভুট্টো বার’জন উপদেষ্টা নিয়ে ২১ মার্চ এলেন ঢাকায়। এসেই প্রেসিডেন্টের সাথে রুদ্ধদ্বার আলোচনা। শেখ মুজিবের সাথে আর কোন আলোচনায় বসেন নি। ক্ষুব্ধ মুজিব ২৩ তারিখে ডাক দিলেন প্রতিরোধ দিবসের।
সব বাড়িতে ওড়ানো হল কালো পতাকার সাথে স্বাধীন বাংলার সবুজ লাল পতাকা। এমন কি সরকারী অফিসেও। বাংলাদেশ টেলিভিশনও দখল হয়ে গেল স্বাধীনতাপন্থীদের হাতে। ২৩ মার্চ সারাদিন চলল বাংলা অনুষ্ঠান। রাত বারো’টার পরে বাজল – পাক সার জামিন শাদবাদ। এদিকে মুজিব-ভুট্টো- ইয়াহিয়ার মিটিং চলছে। কিন্তু সামান্যতম আশার বানী শোনা যাচ্ছে না। ঢাকায় শোনা যাচ্ছে প্রতিদিন সাদা পোশাকে মিলিটারি নামছে ঢাকায়। সাধারন যাত্রীদের জন্যে প্লেনের টিকিট দেওয়া হচ্ছে না। চট্টগ্রামে এসে ভিড়েছে অস্ত্রবাহী জাহাজ।
আজ ২৫ মার্চ। আলতাফ সকালে আর বেরোলেন না। চারিদিক থেকে খালি নৈরাশ্যজনক খবর আসছে। আজ আর্মি মার্চ করবে শহরে। ক্ষমতা দেবে না ইয়াহিয়া। স্বাধীনতা এভাবে কেউ কাউকে দেয়? বিশ্বের ইতিহাসে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেওয়ার জিনিষ। অর্জন করতে হয়। শেখ মুজিবের অসহযোগ আন্দোলন সম্পর্কে একটা উপলব্ধি আলতাফের আছে। সচিবালয় নয়, ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের দোতলা বাড়িটি থেকে শেখ মুজিব দেশ পরিচালনা করছেন। মহল্লার অপরিচিত কোনো রাজনৈতিক কর্মী থেকে শুরু করে হাইকোর্টের বিচারকরা পর্যন্ত সেখানে এসে তাঁর পরামর্শ নিচ্ছেন। তার মানে দেশের নিয়ন্ত্রণ যখন তার হাতে তিনি নেতৃত্ব কোন পথে দেবেন সেটাও দেখতে হবে। কমিউনিস্ট আলতাফ বিশ্বাস করেন সশস্ত্র সংগ্রামে। তাই ধীরে ধীরে পেট্রল কিনে তিনি বাসায় জমাচ্ছেন। যুদ্ধ লাগলে বোমার জ্বালানি লাগবেই।
(১৩)
দ্বিতীয়দিন সকালে টর্চার সেল থেকে বিচ্ছু জালালকে এমপি হোস্টেলে ইন্টেরোগেশন রুমে নিয়ে এল ক্যাপ্টেন কাইয়ুম। সেখানে একজন পাঞ্জাবি ডিসিকে দেখে চমকে উঠল জালাল। ইস্কাটনের সার্কিট হাউসের একই বিল্ডিংয়ে তাদের বাস ছিল। জালালের বাবা গোয়েন্দা বিভাগের এসপি ছিলেন, তাঁর সাথে এই ডিসি একসাথে চাকরি করেছেন। তাকে দেখে জালাল মনে মনে ভাবছে, এই পাঞ্জাবি ডিসি বোধহয় তাকে ধরিয়ে দিয়েছে। পাঞ্জাবি ডিসি বাংলাতে জালালকে বলল, ‘জালাল তুমি এখানে।’ জালালকে ধরা হয়েছিল বাংলামোটরের টিএমসি ভবনের সামনে। উনি সব শুনে তাদের কাছ থেকে জালালকে ছেড়ে দেয়ার ব্যবস্থা করলেন। তিনি এও বলেন, ‘এখন থেকে তুমি আমাদের হয়ে কাজ করবে।’ তিনি তাকে নিজে পঞ্চাশ টাকা দিয়ে বললেন, তুমি আর এলাকায় থেকো না। তুমি চলে যাও।’ এই বিপজ্জনক গ্রুপ থেকে প্রথম ছেড়ে দেওয়া হল বিচ্ছু জালালকে।
তৃতীয় রাতে অর্থাৎ ২ সেপ্টেম্বর রাতে বদি ছাড়া রাতে বাকিদের আনা হল রমনা থানায়। আসলে পাকিস্তান গোয়েন্দারা রিপোর্ট দিয়েছিল মুক্তিযোদ্ধাদের একটা বড় দল এই বন্দীদের মুক্ত করার জন্যে মিলিশিয়া হেড কোয়ার্টারে হামলা চালাতে পারে। তাই রাতে বাঙালি পুলিশের জিম্মায় রেখে ওরা নিরাপদ দূরত্বে থাকতে চায়। মুক্তিযোদ্ধারা বাঙালি পুলিশদের সাথে যুদ্ধ করবে না বলেই পশ্চিমাদের ধারনা ছিল। সেই রাতে কিছু নতুন মুখ দেখা গেল। অনেককে জেরা না করে কিছু না পেয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। কাল থেকে শরীফ ইমাম ও জামীকে দেখা যাচ্ছে না। তাদের হয়ত ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। সে রাতেও আজাদ, রুমি,জুয়েল, বকর ও আলতাফকে আনা হল রমনা থানায়। তবে তাদের অবস্থা অত্যাচারে মৃতপ্রায়। একই ভাবে অন্যেরা তাদের শুশ্রূষা করলেও তারা আর পেরে উঠছে না। আলতাফের গায়ে তুমুল জ্বর। নড়তে গেলেও অসহ্য যন্ত্রনা। রুমির চোখ মুখ এতই ফোলা যে তাকানোর ক্ষমতাও নেই। গত রাত থেকে আর ভাত জুটছে না কারোর। শুকনো রুটি ও আলু চচ্চড়ি। শক্ত রুটি খাওয়ার ক্ষমতা নেই অনেকেরই। মিলিটারি পুলিশ স্পষ্ট বলে গেছে যে ভাত যেন দেওয়া না হয়। রুটি তবু চলতে পারে। না দিলেও ক্ষতি নেই।
৩ সেপ্টেম্বর মিলিশিয়া ক্যাম্পে নিয়ে যেতেই সকাল সকাল আলবদরের নতুন এক দল এসে এক এক জন বন্দীকে নিয়ে গিয়ে পেটাতে লাগল। তাদের মূল লক্ষ্য এদের আঙুল ও গিঁটগুলি ভেঙে দাও। সে দিন মেজরের আগমন হল। পাঞ্জাবী মেজর এসে প্রথমেই এই বিপজ্জনক গ্রুপটির ওপরে ইন্টেরোগেশনের নামে অত্যাচার বন্ধ করার আদেশ দিলেন – সব কো কোঠি মে বন্ধ কর কে রাখখো। একটি বাতরুমে সবাইকে ঢুকিয়ে দেওয়া হল। সেখানে আগেই পড়ে আছে তিন জন – আলতাফ, হাফিজ আর রুমি। মুখগুলি ক্ষতবিক্ষত, দাঁত ভাঙা, শরীরের অস্থিসন্ধিগুলি আস্ত নেই, তুমুল জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। জ্বর একেক জনের এতটাই যে বাতরুমে ভিজে মেঝে শুকনো হয়ে যাচ্ছে মুহুর্তেই। কারোরই চেতনা নেই, চলৎশক্তিহীন মৃতবৎ তিনটি প্রাণ। এদের বেঁচে থাকার আর কোন মানে হয় না। মৃত্যুই এদের উপযুক্ত মুক্তি।
ঘন্টা দুয়েক বাদে ডাক পড়ল আলতাফের চার শালার। ওদের নাম হয়ে গিয়েছিল – পাকিস্তান কা গাদ্দার চার ভাই। সাথে আলভীরও ডাক পড়ল। আলভী এখানে আবু বাকের। তাদের হাজির করা হল কর্ণেল রমিজ খানের সামনে। সাথে মেজর হেজাজী। কর্ণেল বললেন – হাম তুম পাঁচকো ছোড় দেঙ্গে। লেকিন তুম খেদামত করো। তুম পাকিস্তান কা বান্দা হো। একজন সিপাইকে বললেন – যাও, কোরআন শরীফ লেকে আও। কোরআন শরীফ আসতেই বললেন – উস কা উপর হাত রাখকে ম্যায় যো বোলতা হুঁ, ওহি বোলো। এবার কর্ণেল বলতে লাগলেন – আর কোনোদিন পাকিস্তান বা ইসলামের বিরুদ্ধে কাজ করব না। আমরা সহি সালামত পাকিস্তানের হেফাজত করব।
এরপরে এক সেপাইকে ডেকে কর্নেল বললেন – ইয়ে পাঁচ আদমী কো ছোড় দিয়া, দে আর ফ্রী, ইয়ে পাঁচো কো গেট কা বাহার নিকাল দো। আলভী ও বিল্লাহ পরিবারের চার ভাই ছাড়া পেয়ে গেল। কিন্তু রয়ে গেলেন আলতাফ মাহমুদ।
৩ সেপ্টেম্বর রাতে রমনা থানায় যখন সবাইকে নিজে যাওয়া হল তখন ছেলের সাথে দেখা করতে এলেন আজাদের মা।
– কেমন আছিস বাবা?
– মা, এরা আমাদের অনেক মারে, মারছে। একই কথা বলে, নাম বলে দে, ছেড়ে দেব।
– তুই বলিস নি তো ?
– না মা।
– মার খেলেও বলবি না। সহ্য কর। তোরা খেতে পাচ্ছিস?
– অনেকদিন ভাত খাই নি মা, ভাত খেতে খুব ইচ্ছা হয়।
– আচ্ছা কাল আমি তোর জন্যে ভাত করে নিয়ে আসব।
– আচ্ছা মা।
আজাদ বড়লোকের ছেলে। জীবনে কষ্ট করে নি। আজ দুমুঠো ভাতের বড় কাঙাল হয়ে উঠেছে।
৪ সেপ্টেম্বর সকালে জীপ এসে তুলে নিল আজাদ, রুমি , বকর ও আলতাফকে। কাল জুয়েল আসে নি। জুয়েল ছিল নাম করা ক্রিকেটার। ১৯ আগস্ট সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন অপারেশনের সময় রেকি করতে গিয়ে পাক বাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণে তিনি আহত হন। এর পর তাকে মগবাজারে প্রখ্যাত সুরকার আলতাফ মাহমুদের বাসায় চিকিৎসার জন্য আনা হয়। সেখান থেকে তাকে পাঠানো হয় ডাঃ রশীদের চেম্বারে। কিন্তু সেখানে অপারেশনের ব্যবস্থা না থাকায় তাকে আনা হয় রাজারবাগ পুলিশ লাইনের উলটো দিকে ডাঃ মতিনের চেম্বারে। সেখানে অপারেশন করে গুলি বার করা হয়। আহত অবস্থায় জুয়েল ধরা পড়ে। যে হাত দিয়ে একদিন স্বাধীন বাংলাদেশের ওপেনিং ব্যাটসম্যান হিসেবে প্রতিপক্ষের বোলারদের ওপর চড়াও হতে চেয়েছিলেন, সেই হাতের দুটি আঙ্গুল কেটে ফেলে পাক বাহিনী নির্মম নিষ্ঠুরতায়। প্রচণ্ড নির্যাতনের মুখেও একটা কথা বলেননি তিনি। কিন্তু গতকাল জুয়েলেরও জীবন দীপ নিভে যায়।
মিলিশিয়া ক্যাম্পে ঢুকতেই আলতাফ লক্ষ্য করলেন যে পাক সেনাকর্তাদের মধ্যে তুমুল বিতন্ডা বেধেছে। সাথে আলবদর বাহিনীর মুজাহিদ, নিজামী সহ আরো সব নেতারা আছে। সবাই দারুন উত্তেজিত। চোস্ত উর্দুতে কথা বলছে নিজেদের মধ্যে। কি ব্যাপার? ইয়াহিয়া নাকি ৫ সেপ্টেম্বর বন্দীদের ক্ষমা ঘোষনা করতে পারে। তাই নিয়ে ভয়ানক ক্ষুব্ধ তারা।
– কোন মানে হয় এই ধরনের সিদ্ধান্তের?
– ওই লোকটা সবার সামনে হিরো সাজতে চায়। তাই একসময় মারার ঘোষনা দেয় একসময় ক্ষমার ঘোষনা দেয়।
– প্রেসিডেন্টের কি আমাদের সেনাদের নিহত হওয়ার কথা মনে নেই?
– এই ভারতীয় দালালরা আমাদের ধরে ধরে যখন মেরেছিল তখন কোথায় ছিল এই লোকটা?
– এর চেয়ে ভুট্টো ভাল। শালা মুজিবকে কিছুতেই ক্ষমতা দিতে দেয় নি।
– এই যে ভারতের দালালগুলোকে কিছুতেই শায়েস্তা করা যায়? শালারা এত মার খেল একটাও নাম বলল?
– এইসব বাঞ্চোতরা কোন ক্রমেই ক্ষমার যোগ্য নয়।
– কি হবে তাহলে এদের? ছাড়া পেয়ে যাবে? ছাড়া পেলে শালারা আরো কত পাকিস্তানী মারবে তার ঠিক কি?
– কিন্তু ইয়াহিয়া সাধারন ক্ষমা ঘোষনা করলে আইন অনুযায়ী এদের ছেড়ে দিতে হবে।
– আরে প্রেসিডেন্ট তো ক্ষমা ঘোষনা করবে কাল ৫ সেপ্টেম্বর। যে কটা বেঁচে আছে আজ শালাদের নিকেশ করে দেই।
– তাহলে তো মেজর সাবের অনুমতি লাগবে। সে তো না মারার আদেশ দিয়ে গেছেন।
– আব্বে চুতিয়া, তেরে কো আক্কল নেহি হ্যায়। মেজর সাব কি রোজ রোজ আসবে? আজ শালাদের ব্রাশ ফায়ার করে উড়িয়ে দেব।
– কখন? রাতে?
– তাহলে দেখা যাক, দিনের বেলায় কিছু নাম পাওয়া যায় কি না।
– না না আর দরকার নেই। শালারা কিচ্ছু বলবে না।
– তাহলে আমরা যাই। সন্ধ্যের আগেই চলে আসব।
আলবদর বাহিনীর নেতাগুলো বেরিয়ে গেল। আলতাফ উর্দু থেকে বাংলা তর্জমা করে পুরো ব্যাপারটা বাকিদের বললেন। রুমী বলে উঠল-
– এই ক্ষমা পাওয়াটা হবে আমার জন্য সব থেকে বড় অপমান। বরং ব্রাশ ফায়ারে মরে যাওয়া ভাল।
– রুমী, দেশ যখন স্বাধীন হবে, তখন সব থেকে বেশি দরকার হবে তোমার মত মেধাবী ছেলেদের। কাজেই মরার কথা ভুলে যাও। বাঁচার আশা জিইয়ে রাখো।
– আলতাফ ভাই, আজ আমার বয়স ২০। আজ যে ছেলেটা জন্মাবে সে ২০ বছর পর এই দেশটাকে যাতে ঠিক মত এগিয়ে নিতে পারে তাই তো আমরা জীবন দিয়ে যাচ্ছি। স্বাধীনতার জন্য সামান্য তো একটা জীবন, তাই দিয়ে যাব।
তাদের আচ্ছন্নতা পুরোপুরি কাটে নি। তবে আজ কুকুরপেটাই হচ্ছে না বলে কিছুটা বাঁচোয়া। জ্বর সামান্য কম। একটু পরেই ঘরের তাল খোলার শব্দ। আলতাফ মাহমুদকে ডাকল সেপাই। কোনমতে দেওয়াল ধরে উঠলেন আলতাফ। তাকে আনা হল নতুন আসা এক ক্যাপ্টেনের সামনে।
– আপ আলতাফ মাহমুদ হো?
– হ্যাঁ।
– করাচীমে রহতে থে?
– হ্যাঁ।
– কলাকার ভি থে?
– হ্যাঁ।
– এক চীজ মুঝে বাতাইয়ে দুনিয়া মে আপ য্যায়সে এক ভি কলাকার কো দিখা সকতে হো যো আপনা জিন্দেগী দাও পে লাগাকে দেশ কা আজাদী কে লিয়ে লড়া থা।
– না, না। অনেক শিল্পী আছেন যারা খুবই গুণী।
– ঘর পে বিবি হ্যায়, বাচ্চী হ্যায়, ফির ভি দেশ কে লিয়ে ইতনা পেয়ার! মেরা বিবি ঠিকই বোলি থী আপ কে বারে মে।
– আপনার স্ত্রী? আমার ব্যাপারে বলেছেন? আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।
– মেহের। মেহেরুন্নিসা। আপ কা বহুত আভারি হ্যায়।
– হাঁ হাঁ করাচীর। দারুন গায়িকা। খুব বড় শিল্পী। তা তিনি কি বলেছেন?
– বাঙ্গাল কা সব সে মাসুর কলাকার থা আলতাফ মাহমুদ। আগর চান্স মিলে তো মিলো উস কো। ম্যায় ভি সঙ্গীত বহুত পসন্দ করতা হুঁ। লেকিন অ্যায়সা মহল মে আপ কো মিলনা মেরে লিয়ে বহুত দর্দ কি কারণ হোগা।
– কেন? আল্লাহ’র যেখানে ইচ্ছে সেখানেই মিলিয়ে দেন। ভালই তো হল।
– নেহি আলতাফ ভাই। ম্যায় উনকো কভি বাতা ভি নেহি পায়েঙ্গে ম্যায় আপ কো মিলা থা।
– কেন?
– আপ লোগো কা ফায়ারিং কা অর্ডার আ চুকা। ম্যায় ক্যাপ্টেন জরুর হুঁ। লেকিন আপ কে লিয়ে কুছ নেহি কর পায়েঙ্গে। আপ তো ইন লোগো কা লীডার হ্যায়।
– আজই ফায়ারিং হবে?
– আজই হোগা। সব কো মার দিয়া যায়েগা। কাল তক আপলোগো কো জিন্দা রাখনা খতরনাক হো সকতা হ্যায়। কিঁউ কি আগর প্রেসিডেন্ট মার্সি অ্যানাউন্সমেন্ট কর দিয়া তো আপলোগো কা ছুটকারা মিল সকতা হ্যায়। পাকিস্তান আর্মি নেহি চাহতে আপলোগো কা ছুটকারা। ইসি লিয়ে।
– ঠিক আছে। আপনিই বা কি করবেন? মেহেরকে আমার প্রীতি জানাবেন যদি কখনও সম্ভব হয়।
হাত মিলিয়ে উঠে এল আলতাফ। সেই ছোট বাতরুম বন্দীশালায় এসে শুয়ে পড়ল সে।
– আলতাফ ভাই, কি শুনে এলেন?
– আজই গুলি করে মারবে।
– বাহ। তাহলে তো সমস্যা নাই। একটা কবিতা শোনেন আলতাফ ভাই…
…দেখতে কেমন তুমি? অনেকেই প্রশ্ন করে, খোঁজে/ কুলুজি তোমার আতিপাতি! তোমার সন্ধানে ঘোরে / ঝানু গুপ্তচর, সৈন্য পাড়ায় পাড়ায়।/ তন্ন তন্ন করে খোঁজে প্রতি …।
– বাহ। এটা কার কবিতা? ঢাকার এক বিখ্যাত কবির। নাম ভুলে গেছি। ‘গেরিলা’ নাম। শাহাদাৎ ভাই নিয়ে গেছিলেন মেলাঘরে।
সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। সারাদিন আর কোন সিপাই এসে ডাকে নি। ওরা পড়ে আছে আচ্ছন্নের মত। ঠিক তখনই সেলের তালা খুলে পাকিস্তানী কয়েকজন এসে ঢুকল সেই ছোট্ট সেলে। রুমি আলতাফ মাহমুদ সহ বাকিদের তুলে নিয়ে গেল। ঠিক ছিল ফায়ারিং করেই মারা হবে। আলবদর বাহিনী আবদার জুড়ল প্রকাশ্যে ফাঁসি দিতে হবে। পাকিস্তানি এক ক্যাপ্টেন সঙ্গে সঙ্গে তাদের গালি দিয়ে বল – নেহি, উনলোগো কা কোই নাম নিশান নেহি রহেগা। কিন্তু আলবদরের নিজামী লোকটা সবার সামনে হিরো সাজতে চায়। সে তার দিয়ে তৈরী চাবুক দিয়ে নির্মম ভাবে পেটাতে লাগল আধমরা বন্দীদের। পাকিস্তানীরা আর বেশিক্ষন এই প্রহসন টানতে চাইল না। তাই একটু বাদে গুলি মারার ঘোষনা দিয়ে দিল। বন্দীদের সোজা হয়ে দাঁড়ানোর ক্ষমতাই নেই। দাঁড় করানো হচ্ছে তো তারা লুটিয়ে পড়ছে কাটা কলাগাছের মত। উল্টোদিকে দাঁড়িয়েছে পাকিস্তানী ঘাতক বাহিনী। আলতাফ কোনক্রমে সোজা হল। ভাঙা হাত দিয়ে ইশারা করল মেজরকে। কাছে আসতে। মেজর জানত যে এই দুর্ধর্ষ দলের নেতা এই লোকটি। আলতাফের দিকে এগিয়ে গেল সে।
- হাঁ, বোল, তেরে কো কুছ কহেনা হ্যায় ?
- তোমরা জিজ্ঞাসা করেছিলে না আরো হাতিয়ার কোথায় ?
- হাঁ, হাঁ, কাঁহা হ্যায় বোল।
- আরো কাছে এসো, চেঁচিয়ে বলা যায় না কি?
মেজর নাগালে আসতেই আলতাফের ভাঙা অস্থিসন্ধি যুক্ত হাত শ্বাপদের মত পেঁচিয়ে ফেলল মেজরের কন্ঠ। শ্বাপদ ক্ষিপ্রতায় তার আজানু লম্বিত হাত মেজরের শ্বাসনালী চেপে ধরেছে। ক্রমেই নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে মেজরের। পাক সেনারা কিংকর্তব্যবিমুঢ়। দুজন সেপাই দৌড়ে এসে আলতাফের হাত ছাড়ানোর প্রবল চেষ্টা করছে। পিছন থেকে পা হেঁচড়ে এল রুমী। যেটুকু সামর্থ তা দিয়ে পাক সিপাইদুটিকে বাধা দিতে চাইল সে। পাক বাহিনী গুলি চালাতেও পারছে না। মেজরের গায়ে গুলি লাগতে পারে। বাকি পাক সেনারা তাদের প্রাথমিক বিমুঢ়তা কাটিয়ে সম্মিলিত গায়ের জোরে আলাদা করে ফেলল আলতাফকে। আলতাফের মনে হল সম্ভবতঃ মেজরের দেহে আর প্রাণ নেই। অজ্ঞান মেজরকে নিয়ে দ্রুত অফিস ঘরের দিকে ছুটল চার সিপাই। আলতাফের দীর্ঘদেহ চেপে আছে চার সিপাই। কর্ণেল উঠে এল। হাতে খোলা রিভলবার। ‘শালা, মরতে মরতে ভি এক কো লেকে যানা থা তেরে কো?’ বলেই দ্রাম করে গুলি চালাল আলতাফের বুকে। সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়ল আলতাফ। ঘাস তার মুখ ছুঁয়েছে। বাংলার সবুজ ঘাস। তার ওপরে আলতাফের রক্তস্রোত জমা হচ্ছে। সবুজ লালের অদ্ভুত কোলাজ। যেন তাঁর দেশের পতাকা।
এর পরে গুলি চলল বৃষ্টির মত। একে একে লুটিয়ে পড়ল বন্দীরা। আজাদ, রুমি , বকর, সহ আরো বেশ কিছু বন্দী। একেক জন মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ছে। আর দুই সিপাই লাশটা নিয়ে জমা করছে পাশে একটা সিমেন্ট বাঁধানো চত্বরের ওপরে। কিছু পরে শেষ বন্দীর লাশ জমা পড়ার পরে ক্যাপ্টেন আদেশ দিল – পহেলে পেট্রল ডালকে জ্বালা দো, উসকা বাদ সব লাশকো নদী মে ফেক দো। অর্থাৎ জ্বালিয়ে বিকৃত করে নদীতে ফেলে দাও যাতে কেউ কোন লাশকে সনাক্ত না করতে পারে। লাশ হয়ে যাওয়া সূর্যসন্তানেরা ধীরে ধীরে নিখোঁজ হয়ে গেল তাদের প্রিয় মাতৃভুমির মাটি থেকে।
(১৪)
মানুষের যখন সব হারিয়ে যায় সে তখন অলৌকিকে বিশ্বাস করে। এই অলৌকিকের কারবারী পাগলা পীর সম্প্রতি বেশ নাম করেছে। সেই আশাতে তার কাছে ছুটে ছুটে আসছেন রুমীর মা জাহানারা ইমাম, রাজশাহীর ডি আই জি’র স্ত্রী মোসফেকা মাহমুদ, এস পি আবদুল মজিদের স্ত্রী নাজমা মজিদ, চট্টগ্রামের এস পি শামসুল হকের স্ত্রী মাহমুদা হক, আলতাফ মাহমুদের স্ত্রী ঝিনু মাহমুদ। পুতুলের মত সুন্দর সোনার বরনী ঝিনু এই ক’দিন কাঁদতে কাঁদতে কালিবর্ণ হয়েছেন। শাওনকে কোলে নিয়ে শিমুল ও মা আমেনা সহ পুরো পরিবার এসেছে। ঝিনু অঝোরে কাঁদছে। পাগলাবাবা ঘরে প্রবেশ করতেই ঝিনু কেঁদে তার পায়ের ওপর পড়ল। বাকিরাও কাঁদতে শুরু করল। পাগলাবাবা সবাইকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দিলেন – তোরা কোথা থেকে কি সব ভুল খবর শুনে মাতম করিস। আমি বলছি আলতাফ সহি সালামত আছে। শিগগিরি তার খবর পাবি। বাকিরা সবাই ভাল আছে। ঝিনু আশার বানী শুনে গা থেকে একটি গয়না খুলে পাগলাপীরের পায়ের কাছে রাখল।
প্রতি বৃহস্পতিবার পাগলা পীরের আস্তানায় মিলাদ-মাহফিল হয়। পাগলাবাবা রুমী, আলতাফ মাহমুদ, আবদুল মজিদ, শামসুল হক, ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর – সবার জন্যে কোরান খতম শুরু করিয়েছেন। সবাই প্রচুর মিষ্টি অমৃতি এনেছে। বাড়ির পিছনে বেড়ার জামাত ঘর। পাগলা বাবা নিজে মিলাদ পড়াচ্ছেন। বাবা সবাইকে বলেছেন যে তিনি জায়নামাজে বসে ঝাস দেলে ধ্যান করে জেনেছেন সবাই বেঁচে আছেন। তিনি সবাইকে বার করে আনবেন। যে যা বলছে এই মানুষ হারানো পরিবার গুলি তাই করছে। কেউ বলছে – খাসি কোরবানি দাও, জানের সদকা। তারা তাই দিচ্ছেন। পাগলা পীরের মহানন্দ। এদের বাড়ি গিয়ে নামাজ পড়ে আসছেন। এদের গাড়ি চড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আর মুখে বলছেন – একটুও ঘাবড়াস না, তারা ভাল আছে, আমি শিগগিরই বার করে আনব।
পাগলা পীরের কাছে এসে এই সব হারানো মানুষগুলি বসে থাকে। পরস্পর দুঃখের কাহিনী শোনে। আলোচনা করে। আবার কাঁদে। মুখে মুখে কাহিনী ছড়ায়। কাহিনীরা ডালপালা মেলে। পাগলা পীরের ব্যবসা জমে ওঠে। কিন্তু কারোর কাছে কোন খবর নেই। এর মধ্যে একটা খবর ঢাকা শহরে ছড়িয়েছে যে চার সেপ্টেম্বর রাতে অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে গুলি করে মারা হয়েছে। জাহানারা ইমামের কাছে কোন খবর নেই। আজাদের মা বললেন যে তিনি প্রথমে আজাদকে দু’দিন রমনা থানায় দেখেছিলেন। তারপরে কোন খবর নেই। চুল্লুর ভাবী ইশরাতও জানাল যে সে কিছু জানে না। ঝিনু এখন আর কোথায় যায়!
মাঝে মাঝে সুফিয়া কামাল ঝিনুর বাসায় আসেন। তিনি শব্দ করে কাঁদতে পারেন না। কিন্তু বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলে যেভাবে কথা বলেন মনে হয় তার বুকের সব পাঁজরা ভেঙে যাচ্ছে। নিজের হাতে যে ঝিনুর দায়িত্ব নিয়ে আলতাফের সাথে চার হাত এক করেছিলেন আজ সেই আলতাফই নেই। এদিকে রুমী নেই, জুয়েল নেই, বদি, বাশার, হাফিজ, আজাদ নেই, নেই, নেই, ওরা কেউ নেই। আলভী এসেছিল ছাড়া পেয়ে। তাকে যেভাবে মেরেছে তা দেখে নিখোঁজদের প্রাণের আশা তিনি প্রায় ছেড়ে দিয়েছেন। কিন্তু ঝিনুকে কিছু বলতে পারছেন না। তার আত্মা গুমরে গুমরে মরছে।
ঝিনুরা বাসা পালটেছে। ও বাসায় আলতাফের এত স্মৃতি জীবন্ত হয়ে আছে যে কিছুতেই থাকা যায় না ও বাসায়। আজ ১৭ অক্টোবর এই নতুন বাসায় মিলাদ। সুফিয়া কামাল, জাহানারা ইমাম সবাই এসেছেন। মান্নান সাহেবের ভাই বাকি সাহেবের ছেলে ইকু খুব গোপনে ঝিনুদের বাসায় এসেছে। তার কাছে শোনা গেল ষাট জন গেরিলার বিরাট একটা দল ঢাকার বাইরে বাইগদা নামে একটি গ্রামে ঘাঁটি গেড়েছে। কিছু মুক্তিযোদ্ধা গোপীবাগের পিছন দিয়ে ঢাকায় ঢুকেছে। এরা আবার ক্র্যাক প্লাটুনের মতই অ্যাকশন চালাবে। ক্যাপ্টেন হায়দার অনেক অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে ঢাকায় পাঠিয়েছে। এরা সবজির ঝুড়িতে লুকিয়ে বা শস্যের নীচে বস্তাবন্দী করে ঢাকায় নিয়ে আসছে অস্ত্রগুলি। এই দলটির লিডার ছাত্রলীগের মানিক আর ডেপুটি লিডার নাসিরুদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু। সে আবার ভাসানীর ন্যাপ রাজনীতিতে বিশ্বাসী। কিন্তু দেশের স্বার্থে তারা আজ এককাট্টা।
মেলাঘরে খালেদ মশারফ আজ বসেছেন মেজর হায়দারের সাথে। খুবই গুরুত্বপূর্ণ আজকের মিটিং। খালেদ মশারফের মনটা আজ দিন কয়েক খুবই বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে।
- হায়দার, ক্রাক প্লাটুনের কোন অ্যাকশনের খবর নেই। যে দলটা গোপীবাগের পিছন দিয়ে ঢাকায় ঢুকেছে তারা করছে কি?
- মনি ভাই, ওরা সুবিধা করতে পারছে না। ঢাকায় এখন চুড়ান্ত সতর্কতা।
- এটা কোন কথা হল? আগেও একই রকমের পাহারা ছিল। কিন্তু নেতৃত্বে ছিল আলতাফ। ক্ষুরধার মাথা। আর কাউকে সে রকম নেতৃত্বের জন্যে পেলে না?
- মনি ভাই, আলতাফ একটাই হয়, চে গুয়েভারা পর্যন্ত গেরিলা যুদ্ধে যে ভুল করেছিলেন আলতাফ সেটাও করে নি।
- কিন্তু ৩০ অগাস্টের পরে একটা অ্যাকশনও বলার মত হচ্ছে না যা ঢাকায় ত্রাস সৃষ্টি করতে পারে। আমায় দেখাও একটা হয়েছে।
- তা হয় নি। তবে বাচ্চু ও মানিককে পাঠানো হয়েছে। দেখা যাক ওরা কি করে।
- আসলে আলতাফ আর ওর বাহিনী ধরা পড়ায় ক্র্যাক প্লাটুনের অস্তিত্ব আর কেউ জানতে পারছে না। উই নিড নাউ অ্যাকশন। একজন এত নামী গায়ক ট্রেনিং না নিয়ে এভাবে নিজের বুদ্ধির জোরে ঢাকা কাঁপাতে পারে, আর আমরা তার সাবস্টিটিউট খুঁজে পাচ্ছি না।
- আলতাফের সাবস্টিটিউট হয় না মনি ভাই। ও রকম অঙ্কের মাথা ক’জনের থাকে। একা হাতে টিম তৈরী করেছিল। হি ওয়াজ দ্য গ্রেটেস্ট গেরিলা লিডার অফ দ্য ওয়ার্ল্ড।
এভাবেই চলতে চলতে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে যুদ্ধ বেধে গেল ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে। এতদিন চোরা গোপ্তা আক্রমন চলছিল বর্ডার জুড়ে। সেটা হয়ে গেল ঘোষিত যুদ্ধ। ভয়ানক ক্কড় ক্কড় শব্দে প্লেনের দৌড়োদৌড়ি ঢাকার আকাশে। সবাই ছাদে হাজির। দুই প্লেনের এরকম মল্ল যুদ্ধ আগে ঢাকাবাসী প্রত্যক্ষ করে নি। কিন্তু কয়েকদিনের মাথায় ঢাকার আকাশে ইন্ডিয়ার প্লেনের একচ্ছত্র আধিপত্য। শোনা গেল রানওয়েতে নাকি বড় বড় গর্ত হয়ে গেছে ইন্ডিয়ান বোমায়। যতবার সারাচ্ছে, সারাবার আগেই ইন্ডিয়ান ফাইটার প্লেন বোমা ফেলে নতুন নতুন গর্ত করে দিচ্ছে। পাকিস্তানী প্লেনের ওড়ার উপায় নেই।
ঝিনুর সারা শরীর শিরশির করছে। কারফিউ মোড়া এ শহরে ব্ল্যাক আউটের কালো কাগজে মোড়া কবরের মত ঘরে বাস করতে করতে সে শুধু স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখছে। হয়ত আলতাফ এখন বন্দী। স্বাধীনতা এলেই আবার সে ফিরে আসবে। আবার আগের মত জীবন গানে হাসিতে হুল্লোড়ে ভরে যাবে বাসা। ঝিনু তাই স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখে। দিনের মধ্যে অর্ধেক সময়ই কারফিউ। এরমধ্যেই ভয়ানক খারাপ খবর এল। জাহানারা ইমামের স্বামী শরীফ ইমাম মারা গেছেন। বাড়ির ছেলেরা কারফিউয়ের মধ্যেও গেল জাহানারা ইমামের বাড়িতে। স্রেফ ব্যাক আউট চলার কারণে বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকায় হাসপাতালে ডিফিব্রিলেটার মেশিন চালু না করতে পারার কারণে শরীফ হার্টফেল করে মারা গেছেন।
ঢাকায় ভারতীয় প্লেন খুব নীচু দিয়ে সমানে উড়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝেই বোমা ফেলছে। পাকিস্তানীদের জানাতে চাইছে যে তোদের আকাশে আমরা হা ডু ডু খেলছি, পারলে ঠেকা। যুদ্ধ চলছে প্রায় পনের দিন হয়ে গেল। কান ঝালাপালা করে রকেটিং ও স্ট্রেফিং চলছে। আকাশবানী কলকাতা থেকে বারেবারে ঘোষনা করা হচ্ছে – পাক আর্মি সারেন্ডার করো। তবে কি যুদ্ধ শেষ হয়ে আসছে?
ডিসেম্বরের ১৪ তারিখে যখন মানিকগঞ্জ-সাভার এলাকায় নাসিরুদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর দলটি ক্রমে স্থানীয় ছাত্র-যুবকদের অংশগ্রহণের ফলে বড় হয়ে গেছে তখন তাঁরা শেষবারের মতো ঢাকায় ঢোকার চেষ্টা করলেন। নাসির উদ্দিন ইউসুফের নেতৃত্বে
এক মাস আগে, নভেম্বরের ১৩ তারিখে তাঁর পাশে শহীদ হয়েছেন লিডার মানিক। তখন দলনেতা মানিক। তাঁরা ঠিক করলেন ঢাকা-আরিচা সড়কের ভায়াডুবি সেতুর দখল নেবেন। ৫৫ জনের মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে এগোলেন নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু। মানিকগঞ্জের দিকে একদল মুক্তিযোদ্ধা, ঢাকার দিকে আরেকদল। বাচ্চু ব্রিজে চার্জ বসাচ্ছেন। হঠাৎ মানিকগঞ্জের দিক থেকে ছুটে আসছে শত্রুসৈন্যের গাড়ি। অন্যদলের দায়িত্ব ছিল শত্রুদের ঠেকানোর। ওরা কী করল! ওরা কি পারল না ঠেকাতে! বাচ্চু দৌড়ে গেলেন দ্বিতীয় দলের দিকে। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের এলএমজি নিয়ে ট্রেঞ্চে বসে। দ্রুত ছুটে আসছে শত্রুর গাড়ি। গুলি ছুড়ল একজন এবং সঙ্গে আরও কয়েকজন। শত্রুর গাড়ি এখন বেসামাল। ওরা বুঝল ফাঁদে পড়ে গেছে। তাই বেপরোয়া হয়ে গাড়ি চালিয়ে চলে যাচ্ছে ঢাকার দিকে। প্রচণ্ড গোলাগুলির মাঝে হঠাৎ বাচ্চু লক্ষ্য করলেন মানিক নেই। তিনি চিৎকার করে সহযোদ্ধা সাবুকে জিজ্ঞেস করলেন, “মানিক কোথায়?” সাবু শুধু বলল, “পানিতে দেখ।” সাবু আবার ট্রিগার টিপল সামনে শত্রুর গাড়ি লক্ষ্য করে। মানিকের লাশ পানি থেকে তোলা হল। তখনো তার শরীর গরম। বাচ্চুর বিশ্বাস হয়নি মানিক মারা গেছে।’
আর ১৪ ডিসেম্বরে মারা গেল ছোট্ট ছেলে টিটো। ও নাসির উদ্দীনদের দলে যোগ দিয়েছিল কুমিল্লার মনিহন্দ থেকে। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে সঙ্গে থাকত এই কিশোর। ১৪ ডিসেম্বর নাসির উদ্দীন ইউসুফের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ করেছিল টাঙ্গাইল থেকে মার খেয়ে ঢাকার দিকে আসতে থাকা দুর্ধর্ষ ৩৩ পাঞ্জাব রেজিমেন্টকে। অ্যাম্বুশের একপর্যায়ে নাসির উদ্দীন ইউসুফ পার্শ্ববর্তী যোদ্ধাকে নির্দেশ দেন, ‘নুরুকে গিয়ে বলো ওদের এম জি ম্যানকে খতম করতে।’ সেই নির্দেশ নিয়ে অতি উৎসাহে ছুটে যায় কিশোর টিটো। সে যুদ্ধের নিয়ম জানত না। সঙ্গে সঙ্গে মেশিন গানের গুলি এসে ঝাঁঝরা ফেলে টিটোর ছোট্ট শরীরটাকে।
আজ ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১, যুদ্ধ বিরতি চলছে। আকাশবানী কলকাতার খবর অনুযায়ী সারা বাংলাদেশ ভারতীয় সেনা ও মুক্তিবাহিনীর দখলে। শুধু ঢাকা অবরুদ্ধ। পাক সেনাদের বলা হয়েছে বিকেল তিনটে অবধি যুদ্ধবিরতি চলবে। তার মধ্যে যদি পাক বাহিনী আত্মসমর্পন না করে তবে লড়াই হবে শেষ তক। তাতে হতাহতের সংখ্যা বাড়বে। কিছু বাদেই খবর পাওয়া গেল আজ পাক সৈনাধ্যক্ষ জেনারেল নিয়াজী নব্বই হাজার পাকিস্তানী সৈন্য নিয়ে আত্মসমর্পণ করছে বিকেল তিনটের সময়। ঝিনু বাংলাদেশের পতাকাটা টেনে বার করল। যে পতাকা আলতাফ নামাতে বাধ্য হয়েছিল ২৫ মার্চ সন্ধ্যায়, তা আজ আবার তুলতে হবে। ছাদে গিয়ে একটা বাঁশের লাঠিকে ফ্ল্যাগপোল বানিয়ে সবুজ লাল পতাকাটা উড়িয়ে দিল ঝিনু। চারিদিকে তাকিয়ে দেখল প্রায় সব বাড়িতে উড়ছে সবুজ লাল পতাকা। অবশেষে স্বাধীনতা এল।
স্বাধীনতার বয়স দু’দিন হতে চলল। সবাই বাড়ি ফিরছে। ঝিনু অপেক্ষা করে আছে কখন বাসায় ফিরবেন আলতাফ। ভর সন্ধ্যায় হঠাৎ কড়া নাড়ার শব্দ। দৌড়ে গেল ঝিনু। পিছনে পিছনে বাকি সব্বাই। কাঁধে স্টেনগান ঝুলিয়ে কয়েকটি তরুন।
– আমি মেজর হায়দার, আমার সঙ্গে আছে এই যে শাহদাৎ, ফতেহ, আলম, আনু, জিয়া আর এই যে চুল্লু।
মেজর হায়দারকে কাল বাংলাদেশ টিভিতে প্রথম স্বাধীনতার ঘোষনা দিতে দেখেছে ঝিনু। তারপরে টিভিতে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখে্ন ফতেহ চৌধুরী। শাহদাৎ, চুল্লুকে তো আগেই চিনতেন। ঝিনু চুল্লুকে বলেন-
– তুমি অ্যাদ্দিন কই ছিলা?
– ভাবী সেন্ত্রাল জেলে। পরশু সন্ধ্যায় ছাড়া পাইসি।
– আলতু ভাই ছিল না?
– না, না, সে কখনই জেলে ছিল না। তাকে জেলে কখনও আনাই হয় নাই।
– কিন্তু সে তবে কোথায়?
– আমি জানি না ভাবী।
– ও হায়দার সাহেব, আলতু কি তবে বেঁচে নেই? কখনই ফিরবে না? তাহলে তাকে কবর দিসে কই?
– ভাবী, মনিভাই একটা কথা খুব বলতেন। স্বাধীন দেশ জীবিত গেরিলা চায় না, চায় রক্তস্নাত শহীদ। আলতাফ ভাইরা বোধ হয় বেঁচে নেই। থাকলে এতক্ষনে জেনে যেতাম।
– তাহলে তাদের লাশ? কবর?
– খোঁজ আমরা করব। আলতাফ ভাই ছিলেন ক্র্যাক প্লাটুনের বটগাছ। শাখাপ্রশাখা ছড়িয়ে ক্র্যাক প্লাটুনকে সেরা গেরিলা দল হিসেবে তৈরী করেছিলেন। তার কথা ভাবলেই আমার চে গুয়েভারার কথা মনে পড়ে যায়। চির বিপ্লবী। এদেশের মাটি এই নিখোঁজ শহীদদের হয়ত নিজের বুকে আশ্রয় দিয়েছে। আর তারা আছেন আমাদের সবার বুকে। গাছ হয়ে।
শহীদ আলতাফ মাহমুদের স্ত্রী সারা আরা মাহমুদের অনুমতি নিয়ে এই উপন্যাসটি প্রকাশিত