আমরা যখন বলি আমি বাঙালী তখন আমাদের হৃদয়ে কিছু সুর, কিছু গান কিছু কবিতা অনিবার্যভাবেই বেজে ওঠে। আপনার হৃদয়ে কোন সুরটা সবচেয়ে গভীরে বাজে? আমার বুকে একেক সময় একেক মিশ্রণ হয়। আমার সোনার বাংলা তো বাজেই, আর সবচেয়ে বেশী যেটা বাজে সেটা হচ্ছে আমাদের প্রভাত ফেরির গান- আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো। বিশেষ করে এই গানের প্রিলিউডটা। আ আ আ আ করে যে প্রিলিউডটা আমরা করি, এর শুরু মাত্রই বুকের ভেতরে শুরু হয়ে যায় মন্থন।
এই দেশ এই মানচিত্র কতদিন থাকবে জানিনা, এই ভাষাও হয়তো একদিন বিনাশ হয়ে যাবে অথবা রূপান্তরিত হয়ে কি রূপ গ্রহণ করবে কে জানে! কিন্তু আমি আপনাকে আজকে এই বিষণ্ণ দুপুরে আমার মানচিত্র বকে চেপে ধরে শপথ নিয়ে বলতে পারি- যতদিন সূর্য আমাদের পুবের পাহাড় থেকে উদিত হয়ে পশ্চিমে অস্ত যাবে ততদিন এই সুর বাঙালীর হৃদয়ে থাকবে। আমাদের এবং আমাদের সন্তানদের এবং ওদের সন্তানদের সন্তানদের সন্তানদের সন্তানদের এইভাবে যতদূর যেতে পারেন ওদের শিরায় রক্ত যতদিন প্রবাহিত হবে ততদিন এই সুর থেকে যাবে।
আমরা হয়তো গাইতে ভুলে যাবো, কিন্তু পৃথিবীর মানুষ কোথাও না কোথাও অবাক বিস্ময়ে দেখবে একটা বাংলা সুর হয়েছিল একটা বাংলা গান হয়েছিল যেটা নিতান্ত গান থেকে ওদের শোণিতের অংশ হয়ে গেছে। তারপর একদিন হয়তো পৃথিবীর কোন কোনায় কোণ এক বিচিত্র ভাষায় একজন কেউ গেয়ে উঠবে সেই সুর, আর পৃথিবীর সর্বত্র মানুষ অবাক হয়ে দেখবে একদল লোকের চোখের জল যেন আর থামে না। ওরা বাঙালী- বাঙালীর বংশধর বাঙালী।
না, এ আমি কল্পনা করে বলি না- স্বপ্ন নয়। পৃথিবীর নানা জাতির এইরকম সুর আছে, যেটা হাজার বছর ধরে জাতির পরিচয়ের সাথে মিশে আছে। ভাষা বদলে গেছে, মানচিত্র বদলে গেছে জাতির চারিত্র্য বদলে গেছে- কিন্তু জাতির বিশেষ একটি সময়ে তৈরি হওয়া সেই সুর কখনো হারায় না। আপনারা কি ইংরেজিতে ‘By the rivers of Babylon’ শোনেননি? খৃস্টের জন্মের ৫৮৬ বছর আগে রাজা নেবুচাদনেজার জেরুজালেম ধ্বংস করে সেখানকার সকল ইহুদীকে দড়ি দিয়ে বেঁধে দাস হিসাবে নিয়ে যায় ব্যাবিলনে। সেই ব্যাবিলনে কবার নদীর ধারে সন্ধের পর আগুণের পাশে বসে কেঁদে কেঁদে গাইতো সেই গান ইহুদীরা।
কোথায় গেছে সেই ব্যাবিলন, কোথায় গেছে ক্যালদিয় রাজা, কোথায় অ্যাসিরীয় সভ্যতা! কিন্তু সেই সুর, জাতির দুঃখের দিনের সুর, জাতির কঠিন দিনের সুর, জাতির বিশেষ দিনের সুর- সেই সুর তো রয়ে গেছে অমর, ছড়িয়ে গেছে বিশ্বময়। পৃথিবীজুড়ে আপনি খুঁজে পাবেন এইরকম বেশ কিছু সুর, যেসব সুর বিশ্বজনীন মানব সংস্কৃতির অনিবার্য অংশ হয়ে রয়ে গেছে হাজার বছর। আর আমাদের এই সুর তো হয়ে আছে আমাদের অপরিচয়ের অংশ, এই সুরটি তো আমাদের জাতির নির্ণায়ক সুর।
আমাদের এই সুরটির অমর স্রস্টা, ঐশ্বরিক প্রতিভায় যিনি রচেছেন এই অমর সুর, সেই সুরস্রস্টা আলতাফ মাহমুদের অন্তর্ধান দিবস আজ। অমর এই শিল্পীকে ১৯৭১ সনের ৩০শে আগস্ট তারিখে আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে যায় ওরা। আমরা চিরদিন অহংকার করে বলবো, আমাদের একজন আলতাফ মাহমুদ ছিলেন, আমাদের একজন আলতাফ মাহমুদ আছেন। তিনি মাথা নত করেননি। আমি সেই দেশের মানুষ, যেদেশে আলতাফ মাহমুদ জন্মেছেন। আমি সেই ভাষায় গান করি, যে ভাষায় আমার ভাইয়ের রঙ্কতে রাঙানো গাওয়া হয়। আমাদের অহংকার আলতাফ মাহমুদ, সেলাম