৫৩ বা ৫৪ সাল হবে, আমার ঠিক মনে নেই আলতাফ মাহমুদ করাচি থেকে আসলেন। একদিন আমার সাথে দেখা করে বললেন, “তোমার এই গানটিতে (আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো) আরো ভালো সুর দেয়া যায়।“ আমি বললাম, “আমার তো আপত্তি নেই কিন্তু লতিফ ভাই হয়তো রাগ করতে পারেন। তো চলেন আমরা লতিফ ভাইয়ের কাছে যাই।“ আমরা লতিফ ভাইয়ের কাছে গেলাম, তিনি তো অমায়িক মানুষ। লতিফ ভাই বললেন, “আলতাফ, দাও তুমি নতুন একটা সুর দাও। আরো ভালো হতে পারে।“ এরপর তিনি সুর দিলেন। তখন আবার বিতর্ক চলছিল যে প্রভাতফেরীতে কোন গান গাওয়া হবে সেটা নিয়ে। প্রথম গাওয়া হচ্ছিল গাজীউল হকের গান ‘লাল ঢাকার রাজপথ ভুলব না ভুলব না’। এই গানের সুরটা ছিল হিন্দি ছবির গানের, এটা ‘দুর হাটো ভাই দুনিয়াওয়ালে, হিন্দুস্তান হামারা হে’ এই গানের সুর। পরে এটা নিয়ে আপত্তি উঠল, এবার একটি গান ৫৩ সালে গাওয়া হয় যেটা আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর। যদিও তিনি বলেন যে, এটা তাঁর গান নয়, কার লেখা সেটাও আমি ঠিক জানি না। গানটার প্রথম লাইন ছিল ‘জীবন দিয়েছে যারা ভাষা বাঁচাবার তরে’। কিন্তু আলতাফ মাহমুদের এই গান শোনার পর সবাই বলল যে এটাই প্রভাতফেরীর গান হবে। ফলে ৫৪ সাল থেকে এই গান (আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো) প্রভাতফেরীর গান এবং এই গান জনপ্রিয় হয়। আমি বলব এই গানের ১২ আনা কৃতিত্ব আলতাফ মাহমুদের। তা না হলে আমার কথার এই গান হয়তো এত জনপ্রিয় হতো না। এত সুন্দর সুর উনি দিয়েছেন, সুরের জন্যই এই গান বেঁচে থাকবে।
তারপর জহির রায়হান যখন ‘জীবন থেকে নেয়া’ সিনেমা করবেন বলে ঠিক করলেন, তখন আলতাফ মাহমুদ ঐ গানের সংগীত পরিচালক। তিনি ২টা গান বাছলেন ঐ ছবির জন্য, একটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “আমার সোনার বাংলা”, আরেকটি আমার এই ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’। ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবি যেমন জনপ্রিয় হয়েছিল, কারণ পাকিস্তান সরকার ওটা নিষিদ্ধ করেছিল। এরপর প্রচণ্ড আন্দোলনের মুখে ঐ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করতে হয়। ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবি দেখার জন্য ঢাকার সিনেমা হলগুলোতে ভিড় জমে গিয়েছিল। ছবির সঙ্গে সঙ্গে এই গানটাও জনপ্রিয় হয়। এরপর তো এই গান সবাই গাচ্ছে, প্রভাতফেরীতে গাওয়া হচ্ছে, ২১’শের অনুষ্ঠানে গাওয়া হচ্ছে এবং তাঁর ফলে খুব জনপ্রিয়তা লাভ করে। দুঃখের বিষয় ৭১’এ মুক্তি সংগ্রামের সময় আলতাফ মাহমুদ যে শহীদ হলেন, এর পেছনে আমরা কিছুটা দায়ী, আমিও দায়ী। সেই গ্লানি থেকে আমি এখনও মুক্তি পাইনি। কথা ছিল আমি, জহির রায়হান, চিত্র পরিচালক মাহমুদুল কবির বা মাহমুদুল রহমান বোধ হয় নাম, আমরা এক সঙ্গে বর্ডার ক্রস করব। কিন্তু আলতাফ মাহমুদ রাজি হলেন না, তিনি বললেন, “আমার একটা বিশেষ কাজ আছে, আর এক রাত্রি হলে আমার কাজটা শেষ হয়ে যাবে।“ আমি অনেক অনুরোধ করেছিলাম এক সঙ্গে যাওয়ার জন্য। আমার উচিত ছিল তাঁকে জোর করে নিয়ে যাওয়া, আমরা জোর না করে অভিমান করে বলেছিলাম, “থাক, উনি যখন খুশী যাবে।” আমরা বর্ডার পার হয়ে গেছি, এরপর শুনি তাঁকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছে। শুধু যে মেরে ফেলা হয়েছে তা নয়, তাঁকে অনেক কষ্ট দিয়ে, অনেক যন্ত্রণা দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আমি যদি দেশে থাকতাম তবে এই গানের রচয়িতা এবং সুরকার দু’জনকে এক সাথে হত্যা করা হতো। আমি বেঁচে গেছি, আলতাফ মাহমুদ মরে গেছেন; কিন্তু আলতাফ মাহমুদকে হত্যা করা সম্ভব হয়নি।
আলতাফ মাহমুদ শুধু এই গানটির জন্যই না, তিনি আরো গান লিখেছেন-সুর দিয়েছেন। তাঁর সেই সুরের কোনো তুলনা নেই, তিনি চিরকাল বেঁচে থাকবেন। এই গানের জন্য না, তাঁর সুরের জন্য, তাঁর প্রতিভার জন্য তিনি বেঁচে থাকবেন। তাঁর কথা মনে হলে আমার খুব খারাপ লাগে। আমাকে যখন এই গানের জন্য ‘একুশে পদক’ দেয়া হয়, তখন আমি মনে করেছি যে বাংলাদেশের যত পুরস্কার আছে তার সব ক’টা আলতাফ মাহমুদকে দিলেও তাঁকে প্রকৃত সম্মাননা দেওয়া হবে না। আজ ভাষা আন্দোলনের ৬৯ বছর হয়ে গেছে, শুনেছি আলতাফ মাহমুদ সংগীত অ্যাকাডেমি হয়েছে। সেই অ্যাকাডেমির কী অবস্থা এখন তা জানি না, এই অ্যাকাডেমিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া দরকার। এই জন্য সরকারকে অনুরোধ করে এই অ্যাকাডেমিগুলোকে আরো উন্নত করা দরকার, যাতে আলতাফ মাহমুদের আদর্শে আরো সুরকার তৈরি হতে পারে এবং ২১’শের আদর্শ অম্লান থাকে।
একটি সুখের কথা, এই গানটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের গান হয়ে গেছে। এটা হয়েছে আমার লেখার জন্য নয়, হয়েছে সুরের জন্য। আমি জাপানে গিয়েছিলাম, সেখানে দেখি এই গানের জাপানি তর্জমা করা হয়েছে। আমি শুনতে গেলাম, আমি জাপানি ভাষার একটি কথাও বুঝিনি। জাপানিরা নিজের ভাষায় গেয়েছে, কিন্তু সুরটা আলতাফ মাহমুদের। আজকে ১১টি দেশে গানটি গাওয়া হয়, সুর আলতাফ মাহমুদের। এখানে বক্তব্যের চেয়েও সুরটা মানুষের মনে বেশি দোলা দেয়।