একটি দিবস এবং আমরা – শাওন মাহমুদ

প্রতিবছর ঘুরে বুদ্ধিজীবী দিবস আসে। সেই দিবসভিত্তিক কর্মকা-ে যুক্ত হতে থাকে সব ধরনের গণমাধ্যম। এ সময়ে তাড়াহুড়ো পড়ে যায়, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের বেঁচে থাকা পরিবারগুলোকে নিয়ে। এই একটি দিবসকে কেন্দ্র করে তখন কলাম, টক শো বা মন্তব্য দেওয়ার জন্য তাদের ব্যতিব্যস্ত করে তোলা হয়।
মুক্তিযুদ্ধ এক বিশাল বিষয়, যে যুদ্ধে জেনোসাইড সংঘটিত হয়েছিল। গণহত্যা, ধর্ষণ, লুট, ধর্মান্তরিতকরণ, সংখ্যালঘুর সম্পত্তি দখল, আগুন সংযোজন, বুদ্ধিজীবী হত্যা করা হয়েছিল। একসঙ্গে যার নাম হচ্ছে জেনোসাইড।
এই বিশাল বর্বরতার ব্যাপকতা নিয়ে আমাদের কোথাও তেমন কোনো আস্ফালন নেই। আমাদের সঠিক তথ্যভিত্তিক পূর্ণ কোনো আর্কাইভ করা নেই। আমাদের বিজয়, সাফল্য, পরিচয়ের গৌরবগাথা কখনো বড় করে জানানো হয়নি। নতুন প্রজন্মকে জানানো হয়নি আমাদের বীরত্বের গল্প। বীরদের সাহসী গল্প। বুদ্ধিজীবীদের অবদান। আমরা শুধু দিবসভিত্তিক হয়ে গেছি, দিবসভিত্তিক স্মরণসভা করছি।
গণমাধ্যমগুলোতে কি প্রতি মাস বা পাক্ষিক ভিত্তিতে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কলাম আসতে পারে না? আসে না। শূন্যস্থানগুলো শূন্যতায় ভরপুর হয়ে ওঠে ক্রমাগত। গণমাধ্যম তারামনবিবি বা শহীদ কবি মেহেরুন্নেসাকে নিয়ে কখনো কথা বলে না, তাদের সম্পর্কে খবর প্রকাশ করে না। হিরো আলমকে নিয়ে খবর ছাপাতে ব্যস্ত থাকে। তার পরও প্রশ্ন রেখে যাব বারবার, হিরো আলমের খবর প্রকাশ করার সমানুপাতে শহীদ কবি মেহেরুন্নেসার বীরত্বগাথা যদি প্রকাশ পেত তা হলে কি প্রজন্ম তার নামটাও জেনে যেত কিনা?
প্রজন্মকে দোষ দেওয়া সহজ। তরুণরা কিছু জানে না বলাটা আরও সহজ। কখনো কি আমরা একবারও নিজের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করেছি যে, তাদের জানাতে আমরা কতটা কী করেছি? কতটা জানাতে পেরেছি নিজেদের অস্তিত্বের কথা? আনোয়ার পাশা, সেলিনা পারভীন, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, শহীদুল্লা কায়সার, জহির রায়হানকে নিয়ে সারা বছর কটা কলাম লেখা হয়? তাদের কাজ নিয়ে কজন গবেষণা করে? মুক্তিযুদ্ধের বিখ্যাত অপারেশনগুলো নিয়ে কতগুলো তথ্য পাওয়া যায়? বুদ্ধিজীবীদের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কাজগুলো নিয়ে কজন জানে?
ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের আবাসন প্রকল্পের ছবিগুলো দেখে আমি বিমোহিত। মনে প্রশ্ন জাগে আবারও, এই যে স্বাধীনতার এতগুলো বছর পার করে ফেলল বাংলাদেশ, কারও কি একবারও মনে হয়নি যে বীরাঙ্গনা, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আর শহীদ পরিবারগুলোর জন্য এমন আবাসন প্রকল্প গড়ে তোলা যেত? কতই না কষ্টে জীবনযাপন করেছেন তারা। খেয়ে না খেয়ে, সমাজচ্যুত হয়ে, ভিক্ষা করে, ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হয়েও বেঁচে থেকেছেন। রোহিঙ্গা শরণার্থী থেকেও ক্ষুদ্র চাহিদার জীবন পার করেছেন। তবে কেন তাদের এত কষ্টের জীবনযাপন করতে দিয়েছে বাংলাদেশ? মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা পূর্ণ হয়নি, বীরাঙ্গনাদের চিহ্নিত করা যায়নি, শহীদ তালিকা অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। এমন আরও কত কাজ বাকি। সময় চলে যাচ্ছে। শহীদ জননীরা কেউ বেঁচে নেই। শহীদ জায়াদেরও বয়স হয়েছে। তাদের খবর আমরা কেউ রাখিনি। দুটো প্রজন্ম ধ্বংস হয়ে গেছে নিজেদের অস্তিত্ব রোপণ এবং রক্ষা করার জন্য।
ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ধীরে ধীরে গ্রাস করতে আসে আমাদের অসাম্প্রদায়িক সংবিধান। ফতোয়ার জোরে কম্পিত হয়, মেরুদ-হীন কাপুরুষরা। লালন ভাঙে, জাস্টিসিয়া সরে যায়, হিন্দুদের মূর্তি ধ্বংস করে, সাঁওতালের ঘরে আগুন জ্বলে, রামুতে বৌদ্ধবিহার নিষ্পেষিত হয়। অথচ আমরা বর্ণ, ধর্ম নির্বিশেষ একটি স্বাধীন ভূখ-ের জন্য লড়াই করেছিলাম। নিজেদের বিকিয়ে দিয়ে নয়, রক্তস্নাত মুক্তিযুদ্ধের মাঝ দিয়ে এসেছিল এই স্বাধীনতা। আমাদের মাথা কখনো একবিন্দুও নুয়ে বাঁচার কথা নয়।
এমন অনেক প্রশ্নের উত্তর জানা থাকলেও জানাতে সক্ষম নই আমরা। কারণ এই ধরনের বিশেষ দিন সামনে এলে খুব নির্ধারিত কিছু মানুষ থেকে নির্দিষ্ট বিষয়ভিত্তিক লেখা পাই। চক্রাকারে সেসব কথাই ঘুরেফিরে সবার সামনে আসে। বছর যেতে না যেতে সব ভুলে যাই। কালো-সাদা শোকের রঙে ভাসতে ভাসতে বিজয়ের লাল-সবুজ রঙ নিয়ে মেতে উঠি। যার যায় সে শুধু জানে হায়, যা হারায়।
শাওন মাহমুদ : কলাম লেখক ও নগরচাষী