আলতাফ মাহমুদ – অধ্যাপক আনিসুজ্জামান

 

আলতাফ মাহমুদ কে আমি প্রথম দেখি পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের কেন্দ্রীও অফিসে । আমাদের ঠাটারিবাজারের বাড়ির অদূরে যোগীনগর লেনের একটি দোতলা বাড়ির ওপর তলায় মোহাম্মাদ তোয়াহা থাকতেন সপরিবারে । নীচের তলায় যুবলীগ অফিস । তখন ১৭/১৮ বছর বয়স হবে তার । সুঠাম দেহ, চোখ দুতি আয়ত । ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের অল্পকাল আগে আমি যুবলীগ এ যোগ দেই । যতদূর মনে পড়ে, সে সময়েই তার সাথে দেখা ।  আলতাফ মাহমুদ অত্যন্ত সুন্দর পোস্টার লিখতে পারতেন । তিনি যখন পোস্টার লিখতেন, তখন দাড়িয়ে দেখতে ইচ্ছা হত । পরে আবিষ্কার করি, তার ছবি আঁকার হাত ছিল । কোলকাতা আর্টস্কুল এ কিছুদিন নাকি পড়াশোনা করেছিলেন । আলতাফ মাহমুদ মনের আনন্দে গান গাইতেন, সে ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন বোধহয় স্বশিক্ষিত । ভাষা আন্দোলনখ্যাত গাজীউল হক এর ছোট ভাই নিজামুল হক নৃত্যগীতে পারদর্শী ছিলেন । অগ্রজের মত তিনিও যুবলীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন । আলতাফ মাহমুদ আর তিনি কিছুকালের জন্য হয়ে উঠেছিলেন যুবলীগের নিজস্ব সঙ্গীত শিল্পী ।

আলতাফ মাহমুদ তখন ছিলেন গন  সঙ্গীত শিল্পী । ভাষা আন্দোলনের পরপর বরিশালের আর এক কৃতি সন্তান ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ উদ্দিন আহমদ উচ্চ সরকারী পদে কর্মরত থেকেই গান লিখেছিলেন – মৃত্যু  কে যারা তুচ্ছ করিল ভাষা বাঁচানোর তরে / আজিকে স্মরিও তারে ।  আলতাফ মাহমুদ এতে সুরারোপ করেছিলেন । গানটি ১৯৫৩ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারীর প্রথম প্রভাত ফেরীতে গাওয়া হয়েছিল । সে সময় ভাষা আন্দোলনের গান ছিল আরও দুটি ।  গাজীউল হক এর – ভুলব না এ একুশে ফেব্রুয়ারী এবং আব্দুল গাফফার চৌধুরীর – আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী । গাফফার এর গানটিতে নতুন সুর দেন আলতাফ মাহমুদ, তার সুরেই গানটি কালজয়ী হয় ।

অল্প বয়শেই আলতাফ মাহমুদ এর রাজনৈতিক চেতনা এবং শিল্পবোধের বিকাশ ঘটে । ঢাকায় আসার আগেই বামপন্থি আন্দোলনের সঙ্গে তিনি যুক্ত হয়েছিলেন । ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী প্রচারণায় তিনি নিজেকে উজাড় করে দেন । তার গান বিশেষ উদ্দীপনার সৃষ্টি করে । পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেও তিনি অংশ নিয়েছিলেন ।

যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙে দিয়ে পূর্ব পাকিস্তান গভর্নর এর শাসন প্রবর্তিত হলে আলতাফ আত্মগোপন করেন । তখনই তার সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায় । তিনি করাচী চলে যান, সেখানে কিছুকাল থেকে সঙ্গীতশিল্পী হিশেবে সুনাম অর্জন করে আবার ঢাকায় ফিরে আসেন । তখন তাকে দেখি বুলবুল ললিতকলা একাডেমীতে একটি অর্গান বাজিয়ে একাগ্রচিত্তে সুর রচনা করছেন । তার সুর যেমন ছিল শোনার মত, তেমনি তার নিবিষ্টতা ছিল দেখার মত । সে সময় চলচ্চিত্রের জগতেই তিনি ক্রমশ বেশী জড়িয়ে যান এবং সঙ্গীত পরিচালক হিশেবে যশস্বী হয়ে ওঠেন । তবু প্রথম জীবনের দৃপ্ত রাজনৈতিক চেতনা তাকে কখনো ছেড়ে যায়নি । সময় এবং সুযোগমত তিনি গনসঙ্গীতে সুর দিয়েছেন, পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক আন্দোলনে সে সব গান বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে । যেমন ১৯৬৯ সালের গনঅভ্যুত্থান কালে তিনি সুরেরডালি নিয়ে অংশ নিয়েছিলেন ।

এই পটভূমিতে এটা অনিবার্য ছিল যে, মুক্তিযুদ্ধে আলতাফ মাহমুদ সম্পৃক্ত হয়ে যাবেন । এবারে তার ক্ষেত্র কেবল সঙ্গীতে সীমাবদ্ধ ছিলনা । তিনি সক্রিয় যুদ্ধে জড়িত হয়ে যান জীবনের ঝুঁকি নিয়ে । এই অবস্থায় অগাস্ট মাসে ধরা পরেন এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নির্মম অত্যাচারে শহীদ হন । আমি তখন কোলকাতায়, সে সময় মুক্তিযুদ্ধের কাজে যারা নিয়মিত আন্তর্জাতিক সীমানা যাতায়াত করতেন, তাদের মধ্যে আমার দুই অনুজপ্রতিম আবুল বারক আলভী ও আহবার আহমেদ ছিল । বেশ কিছুকাল ব্যাবধানে একবার আলভীর সঙ্গে দেখা হল । এতদিন পরে কেন জিজ্ঞেস করায় আলভী বলে, ঢাকায় সে সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পরেছিল । কিন্তু সে যে আলভী এ কথা স্বীকার না করায় বেঁচে যায় । তবে তাকে শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছিল এবং আমার সঙ্গে কথা বলার সময় তার হাতের আঙ্গুলগুলো তার সাক্ষ্য বহন করছিল । আমি সহানুভূতি সূচক কিছু বলায় সে আমাকে থামিয়ে দেয় বলে, এরচেয়ে খারাপ খবর আছে । অস্ত্রসহ আলতাফ মাহমুদ ধরা পরেছেন এবং বন্দীশিবিরে আলভীর পাশের ঘরেই তার ওপর অমানুষিক অত্যাচার করা হয় । দরজা খুলে যাওয়ায় আলভী একঝলক দেখতে পায়, সিলিং ফ্যানের সঙ্গে হাত পা বেঁধে মাথা উল্টো করে আলতাফ মাহমুদ কে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে । এক সময় সে ভেবে নেয় যে আলতাফ মাহমুদ আর বেঁচে নেই ।

খবর পেয়ে আমি স্তব্ধ হয়ে থাকি । আলতাফ মাহমুদের সঙ্গে আমার প্রথম আলাপের দিনগুলো মনে পরে যায় । এই অসাধারণ প্রতিভা দেশের জন্য এভাবে নিজেকে নিঃশেষে বিলিয়ে দিলেন, বয়শ তার ৪০ ও তখন হয়নি । দেশকে আলতাফ মাহমুদ যা দিয়েছেন, তা অতুলনীয় । আর সবকিছু ভুলে গেলেও “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো” ভোলা অসম্ভব । এই একটি গানই তাঁকে অমর করেছে । দেশের জন্য প্রান দিয়ে তিনি আমাদের আরও ঋণী করে গেলেন । এদেশের দুটি বড় ঘটনা ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে আলতাফ মাহমুদ নিজেকে যুক্ত করলেন প্রতিভা দিয়ে এবং জীবন দিয়ে ।