এক তারের বীণায় বাঁধা – শাওন মাহমুদ

কোন তরুণ আমায় যখন মুক্তিযুদ্ধ করে জন্ম নেয়া বাংলাদেশকে নিয়ে আমার প্রত্যাশার কথা জানতে চায়, তখন আমার সেই তরুণকে একই প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমার প্রত্যাশাগুলো তো তার মাঝেই বাহিত হবার কথা। এবং তরুণের সুউত্তর পাওয়ার আশায় আবারও দেশপ্রেমের আয়নায় নিজেকে লুকিয়ে দেখতে ইচ্ছে হয়।

ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ। আমাদের দেশে এক ঝাঁক অলৌকিক মানুষ এসেছিল। তাঁদের গঁদ বাধা শব্দের উপাধী অর্থাৎ ‘বুদ্ধিজীবী’ বিশেষণে ডাকতে আমি একদম পছন্দ করি না। তাঁরা হয়তো পেশায় কেউ শিল্পী, লেখক, সাংবাদিক, ডাক্তার, কবি অথবা গীতিকার, সুরকার, রাজবীতিবিদ, চলচ্চিত্রকার, চাকুরিজীবী, শিক্ষক, ভাষাবিদ, ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন কিন্তু মননে তাঁদের দেশপ্রেম ছিল এক তারের বীণায় বাঁধা। সেই মানুষগুলো নিজেদের ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক মতাভেদকে মাথার একদিকে ফেলে এক হয়ে দেশের জন্য কাজ করতেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে জেনোসাইড সংঘটিত হয়েছিল। জেনোসাইডের অনেকগুলো ধারার মাঝে একটি জনপদকে মেধাশূণ্য করাবার ধারাও থাকে। ঠিক ২৫ মার্চ কালরাত্রি থেকে তাই পাকিস্তানী সেনারা আক্রমণ করবার সময় থেকে পরবর্তীতে যে কোন জায়গায় বুদ্ধিজীবী পেলেই তাঁদের হত্যা করা শুরু করে। নভেম্বরের শেষ দিকে নিজেদের হার আসছে দেখতে পেয়ে যুদ্ধাপরাধীদের সাহায্য নিয়ে একটি বুদ্ধিজীবীর তালিকা তৈরী করে। ১০ডিসেম্বর শুরু হয় বুদ্ধিজীবী নিধন। চলে ১৭/১৮ তারিখ পর্যন্ত। মুক্তিযুদ্ধের নয়মাসে ‘৫২ থেকে ‘৭১ পর্যন্ত রাজনৈতিক আন্দোলনে সক্রিয় বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয় সবচেয়ে বেশী৷ বাংলাদেশের ইতিহাস আর বুদ্ধিজীবীদের তালিকা নিয়ে বসলে রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় মেধাদের নাম খুঁজে বের করা কোন বিষয় নয়। ঠিক সেভাবেই পাকিস্তান খুবই নিখুঁত উপায়ে আমাদের মেধাশূণ্য করবার কাজটি শেষ করেছিল।

আজকের বাংলাদেশে সেই এক ঝাঁক নবীন অলৌকিক মানুষ দেখবার অপেক্ষায় সময় পার করি। একাত্তরের পরিকল্পিত বুদ্ধিজীবী হত্যা, এক বিশাল মেধা শূণ্যতার বলয় সৃষ্টি করে দিয়ে গেছে। বুদ্ধিজীবী হত্যার প্রধাণ কারণ হচ্ছে তাঁরা জাতীয় পরিচয় বহন করেন, পরিচয় করিয়ে দেন। এবং বর্তমান পরিস্থিতির
দিকে সজাগ চোখ রাখলে স্পষ্ট দেখায় যায় যে প্রগতিশীল, ধর্মনিরপেক্ষ, উদার, সচেতন প্রজন্ম তৈরীর পথ কতটা গতিশীলতা হারিয়েছে। সেই সহজ পথ রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক বা অর্থনৈতিক শিক্ষায় দৃঢ়তা আনতে পারেনি। একটা যুদ্ধ দুটি প্রজন্মকে নড়বড়ে করে দিয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধেও তাই ঘটেছিল। এক প্রজন্ম যুদ্ধ করেছে, আত্মত্যাগ করেছে, শহীদ হয়েছে। তাঁদের উত্তরসূরী ভেঙ্গে যাওয়া মাথার ছাদ জোড়া দিতে দিতে বড় হয়েছে। এর মাঝে ‘৭৫ এসেছে, জাতীর পিতার শূণ্যতা তাদেরকে আরো উদভ্রান্ত আর দিশেহারা বানিয়েছে। তবে রাজনীতির উঠোন শূণ্য থাকেনি, মেধাশূণ্য এক জোট সুবিধাবাদীরা সেই স্থান পূর্ণ করেছে। সেই সাথে এদেশে বসবাস করা বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধীরা নিজেদের অবস্থান শক্ত করেছে, ক্রমশ। একাত্তরের বুদ্ধিজীবী হত্যা এবং মেধাশূণ্য নবীন বাংলাদেশের পট বদলে গিয়েছে মাত্র কয়েক বছরে। যে দেশের শিক্ষক, সাংবাদিক, শিল্পী, কবি রাজনৈতিকভাবে সচেতন নয়, সে দেশের উন্নতি বাঁধা পরে থাকে সুবিধাবাদী দলের কাছে।

জন্ম নেয়ার সময় থেকে ‘৭৫ এর বাংলাদেশ। লাখো শহীদ পরিবার, বীরাঙ্গনা, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের পূণর্বাসন এবং তালিকা তৈরীর প্রক্রিয়া চলছিল। স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকা এবং বিচার শুরু হয়েছিল। ধ্বংসস্তুপে পরিনত হওয়া গ্রামের পর গ্রাম, রেল, সড়ক আর নৌপথ। সংস্কারের কাজ চলছিল। খাদ্য ঘাটতি মেটানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছিল। একটু একটু করে হাঁটিহাঁটি পায়ে গুছিেয় বাংলাদেশ সামনে চলবার পথ তৈরী করছিল। জাতীর পিতা এবং তাঁর পরিবারের নৃশংষ হত্যাকান্ডের মাধ্যমে দৃশ্যপট একদমই বদলে দেয় হয়। ধ্বংসস্তুপ থেকে মাত্র মাথা ঝেড়ে উঠে দাড়ানো বাংলাদেশকে ধরে বেঁধে জট পাকানো রাজনৈতিক আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলা হয়। সেই সময় জাতীর পিতার দেয়া আশ্রয়গুলো থেকে বেশীর ভাগ শহীদ পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচয়হীন দিশেহারা অবস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের যতটুকু স্মৃতি সংরক্ষিত ছিল, তার বেশীর ভাগই ধ্বংস হতে থাকে উচ্ছেদ, উৎখাত আর অবহেলায়। স্বাধীনতার ৪৮ বছর পরও একেবারে ম্রিয়মান শহীদ স্মৃতি স্থাপনার উপর এখনও ভূমিদস্যুর নজর স্থির হয়। জাল দলিলে ভূমিদস্যুরা সেটা দখল করবার জন্য উচ্ছেদ নোটিস পাঠায়। বাংলাদেশের একজন সুশীলকেও ভূমিদস্যুর
বিরুদ্ধে রুখে দাড়াতে দেখা যায় না। আজকাল প্রগতিশীল, মুক্তমনা আধুনিক, সাহসী মানুষের বড্ড অভাব। যাদের হাতের ছোঁয়ায় বেঁচে থাকবার কথা উজ্জ্বল নক্ষত্রসম শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মৃতি, ভাবনা, চেতনা, কর্ম।

সেই এক ঝাঁক অলৌকিক মানুষ, তাঁদের চেতনায়, মননে, কর্মে তৈরী করতে চেয়েছিলেন বর্ণ ধর্ম শ্রেনী ভেদাভেদের উর্ধ্বে এক অসম্প্রদায়িক বাংলাদেশের। যে দেশে উগ্রমৌলবাদ, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি, অসমঅধিকার, স্বৈরাচার, মুক্তবাক রুদ্ধতার দেখা মিলবে না। অথচ বাংলাদেশ সে সব কথা মনে রাখেনি। মনে রাখবার জন্য যে চর্চা করা প্রয়োজন, তা করেনি, করছেও না। বেঁচে থাকা স্বাধীনতা বিরোধী গোষ্ঠি নীরবে উগ্র মৌলবাদের জাল বুনেছে। যুদ্ধাপরাধীরা প্রায় চার দশক বিচারের বাইরে অবস্থান নিয়েছে। তাদের রাজনীতি করবার ব্যবস্থা করার পথ খুলে দেয়া হয়েছে। পিছিয়েছি আমরা, থমকে গেছে প্রগতিশীল, সৃষ্টিশীল মানুষ তৈরীর পথগুলো। যে দেশে চার দশজ পরেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচা হয় এবং রায় কার্যকর করা হয়েছে, সে দেশে মুক্তচিন্তাবিদ হত্যার বিচারও হবে বলে আমি বিশ্বাস করি। তবে মুক্তচিন্তা সজাগ রাখবার প্রচেষ্টা কতটুকু ধারাবাহিকতা বজায় রাখবে, তা নিয়ে সন্দেহ রয়ে যায়।

আমরা দিনভিত্তিক স্মৃতিচারণে অভ্যস্ত হয়েছি। আমাদের গর্ব, কৃষ্টি, ঐতিহ্য এখন নির্দিষ্ট চব্বিশ ঘন্টা সময় ধরে চলে। একে অন্যকে দোষ চাপানোর অভ্যাসে, কাজ করি কম, কথা বলি বেশী। নিজের সাধ্যে যতটা কুলায় ঠিক ততটুকু কাজ কি আমরা দেশের জন্য করি!! দেশ আমাদের পরিচয় দিয়েছে, স্বাধীন ভূমি দিয়েছে, নাগরিকত্ব দিয়েছে। আমরা দেশকে কি দিয়েছি? প্রত্যাশা শুধু আশা নয়, দায়িত্ব বলে বিশ্বাস করি এবং এখন তা নিজেদেরকে খুব করে ভেবে দেখবার সময় এসেছে।