কমরেড আলতাফ মাহমুদ – কামাল লোহানী

‘সেই লোকটি, নাম তার জানি। কিন্তু সে এখন মস্ত বড়লোক, সেই সময় মুক্তিযোদ্ধা সেজে দালালি করেছে, রাজসাক্ষিও হয়েছে। স্বাধীনতার পর আবার আমারই সামনে দাঁড়িয়ে বলেছে-ভাবি, আলতাফ ভাইয়ের নাম বলে দিয়েছি, কারণ ওরা আমাকে মেরে ফেলত, আমার তো বউ-বাচ্চা আছে’।

কথাগুলো ঘৃণা আর ক্ষোভের সঙ্গে বলছিলেন শহীদ আলতাফ মাহমুদের স্ত্রী সারা আরা মাহমুদ ঝিনু। কারণ ওই লোকটা এখনো বেঁচে আছে, এই স্বাধীন বাংলাদেশে তার ছেলেমেয়ে নিয়ে মহাসুখে। কিন্তু ঝিনু তার একমাত্র মেয়ে শাওনকে নিয়ে সমাজ-সংসারে জীবনের ‘নতুন’ লড়াই শুরু করতে হয়েছিল সেদিন। আজও করছেন। শিল্পকলা একাডেমীতে তাকে আজ চাকরি করে জীবিকা নির্বাহ করতে হচ্ছে। আর যে এই পরিবারকে ধ্বংস করে নিজের পরিবারকে বাঁচাতে দ্বিধা করেনি, সে আজ বিরাট ব্যবসায়ী, শিল্পপতি। তাদের সগোত্রীয় সমাজপতিদের সঙ্গে সগৌরবে দিনাতিপাত করছে। অবশ্য তার নাম স্মরন করছি ঘৃনিত নরককীট হিসেবে। আর আলতাফ মাহমুদের নাম লেখা আছে এ দেশের অগনিত মানুষের প্রাণমনে, হৃদয়ের গভীর প্রান্তরে। সে নাম আজও জনগনের মনে লড়ার প্রেরনা জোগায়। তার মহিমান্ডিত ত্যাগ আমাদের ঈপ্সিত জীবন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আলোকবতিৃকার মত লড়াইয়ের মশাল হয়ে জ্বলছে। মার্কসবাদে বিশ্বাসী এই মহান শিল্পী, আলতাফ মাহমুদ, তাই জাতিসত্তার ঐশ্বর্য ও গর্বে মহিমান্বিত হয়ে আছেন। তার সৃষ্ট একটি গান বাংলার প্রান্তরে, নদীর কলতানে, ঝড়ে-বাতাসে আজও ডাক দিচ্ছে :

জাগো কমরেড, ঈশান কোণে মেঘ জমেছে। ডাকবেও চিরটা কাল।

সমগ্র ভারতবর্ষে, অখন্ডিত ভারতে, একদিন গণসাংস্কৃতিক আন্দোলনের ঢেউ প্রচন্ড গর্জনে আসমুদ্রহিমাচল উন্মথিত করে দেশের সাধারন মানুষকে যেমন নবজীবন প্রতিষ্ঠার সাহস দিয়েছিল, তেমনি পূর্ববাংলা প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলন এবং এ দেশের স্বৈরশাসনবিরোধী লড়াইয়ে নিয়োজিত কর্মিবাহিনীর সঙ্গে নিজেদের মিলিয়ে নিয়েছিল, একাত্মতা ঘোষণা করেছিল। এই প্রাণপণ যুদ্ধের চিরসংঘর্ষে যারা নতুন জীবনের ইঙ্গিত-ক্ষোভকে ক্রোধের আগুনে জ্বালিয়ে নিজ প্রত্যয়কে করতে পেরেছিলেন মহীয়ান, সেই স্মরনীয় ব্যক্তিত্বদের মধ্যে অবিস্মরনীয় চরিত্র গণশিল্পী আলতাফ মাহমুদ।

আলতাফ মাহমুদ আঁকিয়ে ছিলেন। আলতাফ মাহমুদ বেহালাবাদক ছিলেন। আলতাফ মাহমুদ অভিনয় করেছেন। আলতাফ মাহমুদ গান গাইতেন।

সর্বোপরি আলতাফ মাহমুদ ছিরেন নিঃশঙ্কচিত্ত সচেতন রাজনৈতিক কর্ম। যার মরনে ছিল না কোনো ভয়। যিনি প্রচলিত জীবন বিধানে ধারবাহিকতা মানতে গিয়ে বিশ্বাসকে মাঝেমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত করে পিছলে পড়েছিলেন, শ্রেণী চরিত্র ঝেড়ে উঠতে পারেননি বলে এ চরিত্র তাকে মাঝে মাঝ পিছু টানত। অথচ আলতাফ পিছুটান বলে কোনো কিছুকেই প্রশ্রয় দিতে চাইতেন না, যা আজো আমাদের রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে বড় সংকট। সেইসংকট সততা ও আন্তরিকতা দিয়ে কাটিয়ে উঠেছিলেন বলে তিনি রাজনৈতিকভাবে সংকট উত্তরণের পথে দ্বিধান্বিত হয়ে যেতেন। আর তাই তার সম্ভাবনাময় উদ্ভাসিত, সফলতার উজ্জ্বল জীবনের বিশাল প্রান্তরে এ খাদ তাকে শঙ্কিত করত। অথচ মৌল আদর্শ থেকে তিনি কোনোদিন সরে দাঁড়াননি।

একাত্তরে লড়াইয়ে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসক-শোষকরা তাঁবেদার সেনাবাহিনীর হাতে বন্দি আলতাফ মাহমুদকে অকথ্য নির্যাতনের মাধমে কাবু করতে চেয়েছিল। পিশাচেরা যতই যাতনা বাড়িয়েছে তার রক্তমাংশের দেহের ওপর, ততই যেন ইস্পাতদৃঢ় আদর্শ মানুষ, অনুকরনীয় চরিত্র আর অকুতোভয় সৈনিক হিসেবে দৃষ্টান্ত তৈরি করেছেন তিনি। তাই আলতাফ মাহমুদ আজ একটি জ্বলন্ত নাম, বারুদের মতো ছড়িয়ে আছে এ দেশের পথে-প্রান্তরে কোটি কোটি হৃদয়ের উষ্ণ আবাসে।

১৯৭১। ৩০ আগস্ট ভোর ৬টা। আলো ফুটেছে। পূর্ব আকাশ রক্তিম করে সূর্য উঠেছে। সবুজ শ্যামলিমায় ঘেরা স্নিগ্ধ বাংলাকে সকালের সোনালি রোদ্দুরে চমকে দিতে । আলতাফ মাহমুদসহ বাড়ির সবাই তখনো ঘুমিয়ে। আচমকা দরজায় করাঘাত। আতঙ্কে কম্পিত মন অজানা আশঙ্কায় কেঁপে ওঠে। দরজা খুলতেই হানাদাররা হামলে পড়ে। তারা আলতাফ মাহমুদকে ধরে নিয়ে যায়। ফিরে আসেননি আর কখনো। ফিরবেন না কোনো দিনও। তবে তিনি থাকবেন, তাঁকে আমরা যে গানের সুরে জেনেছি, সে গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রম্নয়ারী’ এখনো বাজে। আজও আমাদের কাছে শিল্পী আলতাফ মাহমুদ মানেই সেই অমর সঙ্গীতের মহান সুরকার তবে একুশের ঘটনায় আবদুল গাফফার চৌধুরীর কবিতা অবলম্বনে সুরারোপিত অসামান্য ওই গানের পাশাপাশি আলতাফ মাহমুদ একুশকে নিয়ে আরো একটি গান গাইতেন, যা লিখেছিলেন খুলনা-বাগেরহাটের মাঠে-ময়দানে, হাটে-বাজারে গান গেয়ে বেড়ানো, সাধারন মানুষের প্রিয় গায়ক শেখ সামসুদ্দিন আহমদ।

ঢাকার মিছিলে গুলির খবর তখন গিয়ে পৌছেছে বাংলার ঘরে ঘরে। কামার তার হাঁপর থামিয়ে দিয়েছে। মাঝি দাঁড় বাইছে না। কিষানেরা লাঙ্গল কাঁধে তোলেনি-এমনি এক মুহূর্তে খুলনা- বাগেরহাটের মাঠে-ময়দানে, হাটে-বাজারে গান গেয়ে বেড়ানো, সাধারন মানুষের প্রিয় গায়ক সামসুদ্দিন আহমদ রচনা ও সুর করলেন এই গানটি। গলায় গলায় ঢাকায় এল। উঠল আলতাফের দরদি দরাজ গলায়। এ গান পেল এক নতুন রূপ ও রস। সত্যি কথা বলতে কি, আলতাফ মাহমুদরে গলা ছাড়া এ গান যেন মানায়ই না, তেমন হৃদয়গ্রাহী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করত না। কিন্তু যখনই আলতাফ গেয়েছেন এ গান, তখনই যেন কেমন একটা শিহরন সারা দেহ-মনে খেলে যায় ।

এ দেশের প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের আরেক দিকপাল সংগঠক বদরুল হাসান ১৯৫৯ সালে একটি গান রচনা করলেন।

ঘুমের দেশের গুম ভাঙাতে ঘুমিয়ে গেল যারা………..।

গানটির সুর করেছেন আলতাফ মাহমুদ। মধুর আবাহনী সুমূর্ছনায় হৃদয় নিংড়ানো ব্যাথা উপচে পড়েছে এতে। গানটি বহুল প্রচারিত না হলেও তার ছাত্র ছাত্রীরা আজও প্রভাতফেরি বা ট্রাক অনুষ্ঠানে, সড়কের মোড়ে দাঁড়িয়ে এ গান পরিবেশন করে থাকেন।

১৯৫৩ সাল। কুমিল্লায় অনুষ্ঠিত হলো সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলন। এক অভুতপূর্ব সাড়া জাগিয়েছিল এই সম্মেলন। বিরোধী পরিবেশ, মুসলিম লীগ সরকারের নিপীড়ন-নির্যাতনের মধ্যে এই প্রতিবাদী সমাবেশ এ দেশের প্রগতিমনা শিল্পী-সাহিত্যিকদের সম্মিলিত করে। এই সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তান শিল্পী সংসদ অংশগ্রহণ করে গণসঙ্গীত ও দুটি নৃত্যনাট্য নিয়ে। এর নেতৃত্বে ছিলেন বগুড়ার নিজামুল হক, নওগাঁর মোমিনুল হক (ভুটি ভাই) আর বরিশালের আলতাফ মাহমুদ। তারা উপস্থাপন করেছিলেন সমসাময়িক সমস্যা নিয়ে রচিত নৃত্যনাট্য। একটি কৃষকদের সমস্যাবর্নিত ‘কিষানের কাহিনী’ এবং অন্যটি শ্রমিকদের দাবিদাওয়া ও নিপীড়নবিরোধী শক্তি জাগ্রত করার লক্ষে প্রযোজিত ‘মজদুর’ দারুন সাড়া জাগিয়েছিল তা সম্মেলনে। সঙ্গীত পরিচালনা করার দায়িত্ব ছিল আলতাফ মাহমুদের।

‘৫৩-এর সারা বছর আর ‘৫৪- তে পূর্ববাংলায় জনগনের চাপে দেওয়া সাধারন নির্বাচনের প্রচারাভিযানে সর্বদলীয় মোর্চা যুক্তফ্রন্টের পক্ষে আলতাফ মাহমুদের অবদান অবিস্মরনীয়। নিজাম, ভুটি, লাইজু- এদের সঙ্গে নিয়ে চারনের মতো আলতাফ ঘুরে বেড়িয়েছেন মানুষকে জাগানোর জন্য। গ্রামে-গঞ্জে, মাঠ-ময়দানে, নগরে-বন্দরে অসংখ্য জনসভা আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গণসঙ্গীত পরিবেশন করে মানুষের চেতনাকে শানিত করেছেন। এ সময় যে গানগুলো বাংলার গণমানুষকে উদ্বেলিত করেছে, সংগ্রামে জুগিয়েছে অনুপ্রেরনা, সেগুলোর মধ্যে আলতাফ পরিবেশন করেছেন কীর্তন, কাওয়ালি কিঙবা উর্দূ, হিন্দি, বাংলা গণসঙ্গীত।

যেমন : স্বর্গে যাব গো স্বর্গে যাব গো, স্বর্গে যাব গো।

মোরা উজিরে নাজিরে বাঁচায়ে রাখিতে চির উপবাসী হবে। মোরা কি সুখে বাঁচিয়া রবো।

কিংবা

মরি হায়রে হায় দুঃখ বলি কারে পাঁচ শ টাকার বাগন খাইলো পাঁচ সিকার ছাগলে।

বা হুনছনি ভাই দেখছনি, দেখছনি ভাই হুনছনি স্বাধীনতার নামে আজব দেইখছনি

অথবা

ম্যায় ভুখা হু অনাথ হামারা লাড়কা-লাড়কি রাস্ত্মে হাম মউতক জিম্মেদার।

১৯৫৪ সালের সাধারন নির্বাচনে আমরা বাংলার মানুষ মুসলিম লীগ সরকারকে পরাজিত করে নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করলাম। এ বিজয়ে আলতাফ মাহমুদ এক জ্বলন্ত অগ্নিপিন্ডের মতো ছুটে বেড়ালেন। তিনি গ্রামবাংলার মানুষের হৃদয়কে দিয়েছিলেন সূর্যতাপ। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তির লোলুপ দৃষ্টি আর তাঁবেদার পাকিস্তানি শাসকচক্রের শোষনের চক্রান্তে জনগেনের রায় উপেক্ষিত হলো। মাত্র কয়েক দিন পরই যুক্তফ্রন্টকে ক্ষমতাচ্যুত করে এল গভর্নরি শাসন। ৯২ক ধারা জারি হলো। পূর্ববঙ্গের মন্ত্রিসভা ভেঙে দেওয়া হলো। প্রেপ্তার করা হলো অগনিত রাজনৈতিক কর্মী ও নেতাকে। হুলিয়া জারি করা হলো আরো অসংখ্য কর্মী ও নেতার বিরুদ্ধে। তাই রাজনীতিসচেতন সাংস্কৃতিক কর্মী আলতাফ মাহমুদকেও আত্মগোপন করতে হলো। কয়েক মাস পর যখন হুলিয়া তুলে নেওয়া হলো, তখন ‘পূর্ব পাকিস্তান শিল্পী সংঘ’ এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হলো ‘পাকিস্তান গণনাট্য সংঘ’ এ সময় পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ ছিল আদর্শ সমাজ গড়ার সুসংগঠিত ও সুশৃঙ্খল সৈনিক সংগঠন। যুবকদের নতুন এই সংগঠন তখনই তাগিদ বোধ করেছিল একটি সাংস্কৃতিক ফ্রন্ট বা সংগঠনের। রাজনীতিসচেতন ও শ্রেণীসংগ্রামে বিশ্বাসী কর্মীরাই এ দায়িত্ব তুলে নিলেন কাঁধে। এই সাংস্কৃতিক সংগঠনকে পরিণত করলেন যুবলীগের সাংস্কৃতিক ফ্রন্টে। ফ্রন্ট হিসেবে কাজ করতে গিয়ে একে সরকারি রোষানলে পড়েতে হয়েছে বহুবার। তাই নাম পরিবর্তন করতে হয় কৌশলের জন্য।

এ সময় আমাদের এই অঞ্চলে গণসঙ্গীত রচনা করার মত তেমন কেউ ছিলেন না। ধীরে ধীরে তৈরি হচ্ছিল কেবল। তাই আমাদের পূর্ববাংলার সমস্যা উপযোগী যেকোনো গান আমরা তখন গেয়েছি। আইপিটি এর বহু গান একাত্তর অবধি আমাদের দেশে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে গীত হয়েছে। আরমানিটোলার ময়দানে, কারফুন লেনের ভেতরের মাজার, ঢাকা কলেজের মঞ্চ, প্যারাডাইস সিনেমা হল, মাহবুব আলী ইনস্টিটিউট, পল্টন ময়দান, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তন থেকে গ্রামবালার পথঘাট-প্রান্তরের জনসমাবেশকে উচ্চকিত করেছে গণসঙ্গীত। অগনিত প্রাণমন আন্দোলিত করেছে। এর অধিকাংশ গানই পুরম্নজ্জীবিত করেছে অগ্রণীই শিল্পী সংসদ ও পাকিস্তান গণনাট্য সংঘ। আর গেয়েছেন আলতাফ মাহমুদ, মোমিনুল হক। অবশ্য নিজামুল ও পরে গণসঙ্গীত গাইতে শুরু করেন।

আলতাফ মাহমুদ ভিয়েনা শান্তি সম্মেলনে যোগদানের জন্য আমন্ত্রিত হলেন সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি হিসেবে ১৯৫৬ সালে। তিনি গেলেন করাচি। কিন্তু তার পাসপোর্ট বাতিল করে দেওয়া হলো। তিনি শান্তি সম্মেলনে যেতে পারলেন না। চোট লাগল মনে। ক্ষুব্ধ হলেন তিনি। আর ঢাকা ফিরলেন না। সেখানে থেকেই তিমির বরন ও তার সুযোগ্য সহাযোগী দেব ভট্টচার্যের সান্নিধ্য পেলেন। দেবুদার ওখানে থাকলেও বহুদিন। ওস্তাদ কাদের খাঁর কাছে নাড়া বেঁধে তালিম নিলেন উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে। ওস্তাদ ওমরাও বান্দু খাঁ, তবলাবাদক ওস্তাদ আলস্নাদিত্ত খাঁ, সেতারিয়া কবির খাঁ, বীকার হাবিব খাঁর মতো গুনীজনের সাহচর্যে তিনি এসেছেন। তাঁদের আশিস তাঁকে সমৃদ্ধ করেছে। ১৯৫৬ সালে আলতাফ মাহমুদ করাচিতে প্রথম আধুনিক গান গেয়ে বেতার শিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। সেটি ছিল একটি বাংলা প্রেমের গান। লিখেছিলেন এ দেশের অন্যতম একনিষ্ঠ সংস্কৃতিসেবী কেশব চ্যাটার্জি। সুর আলতাফেরই। এ ছাড়া আলতাফ মাহমুদ তার গণসঙ্গীত পরিবেশনকালে আইপিটি এর বহু গানই গেয়েছেন। তার মধ্যে উলেস্নখ্যযোগ্য হলো :

ধন্য আমি জন্মেছি মা তোমার ধূলিতে।

বিচারপতি তোমার বিচার কবরে যারা, আজ জেগেছে সেই জনতা।

আমাদের নানান দল নানান মতে দলাদলি/কেউবা চলে ডাইনে বা কেউ বাঁয়ে চলি।

নওজোয়ান নওজোয়ান/বিশ্বে জেগেছে নওজোয়ান।

নাকের বদলে নরুন পেলাম/তাক ডুমা ডুম ডুম।

জান দিয়ে জানোয়ার পেলাম লাগল দেশে ধুম।

এসো মুক্ত করো এসো মুক্ত করো/অন্ধকারের এই দ্বার।

ও আলোর পথযাত্রী এ যে রাত্রি/এখানে থেমো না।

পথে এবার নামো সাথী/পথেই হবে পথ চেনা।

কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি/কালো যারে বলে গাঁয়ের লোক।

এমনি বহু গানেরই উল্লেখ করা যায়, যার মধ্যে অনেক গান এখনো গাওয়া হয়ে থাকে।

এছাড়া আলতাফ মাহমুদ বাংলাদেশের একমাত্র গীতিনাট্য ‘হাজার তারে বীণা’র লংপ্লে রেকর্ড প্রকাশনার কৃতিত্বের অধিকারী।

১৯৭১ সালেও আলতাফ মাহমুদ ছিলেন সংগ্রামী জনতার সচেতন সৈনিক। বিক্ষুব্ধ শিল্পীসমাজের ক্রোধের মিছিলে আলতাফ মাহমুদ ছিলেন বজ্রনিনাদ। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার কিংবা বাংলা একাডেমীর বটতলা অথবা রাজপথ উচ্চকিত মিছিলে আলতাফ মাহমুদের কণ্ঠনিঃসৃত গান ছিল স্লোগান, এক লড়াকু মানুষের। তাই তো দেখি তিনি মুক্তিবাহিনী, গেরিলা ক্র্যাক প্লাটুনের হয়ে স্বাধীন বাংলা বেতারের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করে চলেছেন আমৃত্যু। হারমোনিয়ামের রিড যে হাতে বাজত সে হাতেই উঠেছিল মলোটভ ককটেল, গ্রেনেড, এএমজি, এসএমজির ট্রাঙ্ক; গোলাবারুদ লুকিয়ে রাখতেন/ পেট্রল সরবরাহ করেতেন গেরিলাদের; নদীর ওপারে জিনজিরা গিয়ে গোপনে রানা হোসেন খান আর হাফিজ ভাইকে সঙ্গে নিয়ে গণসঙ্গীত সুর আর রেকর্ড করে স্বাধীন বাংলা বেতারে পাঠাতেন বাজারের থলে ভর্তি করে- এই তো আলতাফ মাহমুদ।

দরাজ গলার দরদি কন্ঠের অধিকারী আলতাফ মাহমুদ মানুষকে মোহমুগ্ধ করে রাখতেন। সুরেলা সুষমামন্ডিত স্নিগ্ধ মানসিকতার সেই সচেতন যোদ্ধা আলতাফ মাহমুদ আজ আর নেই। কিন্তু রয়ে গেছে তার স্মৃতি, অপূর্ব সুরসৃষ্টি, বলিষ্ঠ কন্ঠের গান-শ্লোগান-আমাদের বাঁচার প্রেরনা হয়ে।