কাছে থেকে দেখা – মাহমুদ আল জামান

চেতনা জাগানো বাষট্টির ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশের সমাজ বিকাশের প্রয়াসে এক বৃহৎ ঘটনা। বাঙালি মধ্যবিত্ত এই আন্দোলনের অন্তপ্রবাহ দ্বারা নানাভাবে আলোড়িত হয়েছে। ১৯৫৮ সাল থেকে পরাক্রমশালী পাকিস্তানি সেনাবাহিনী জগদ্দল পাথরের মতে বাঙালির বুকে জেঁকে বসেছিল। বাক, লেখনী ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা শুধু ক্ষুন্ন হয়নি, মানুষের মৌলিক অধিকারও নানাভাবে এই সময় ভূলিন্ঠিত হয়েছে।

বাঙালি শিক্ষিত মধ্যবিত্তের জন্য এই সময়টি ছিল আত্মজিজ্ঞাসা ও স্বরূপ-চেতনায় আন্দোলিত হওয়ার সময়। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সমাজ যখন তীব্র দহন বুকে নিয়ে প্রথম ফেটে পড়েছিল, তখন কেউ ভাবেননি এই আন্দোলন বাঙালির সমাজ রূপান্তরে কিংবা স্বাধিকারের প্রমত্ত চেতনায় এক সড়ক নির্মাণ করবে। শাসকগোষ্ঠী খুব দ্রুত এই আন্দোলনকে নস্যাৎ করার প্রয়াস গ্রহণ করেছিল। সমগ্র দেশে জুলুম ও নির্যাতনের স্টিমরোলার চালানো হয়েছিল। এই সময় পরিধির দিকে তাকালে কত কথাই তো মনে পড়ে যায়। এই ছাত্র আন্দোলন বাঙালি শিক্ষিতদের জীবনচেতনায় নানা দিক থেকে তাৎপর্যসঞ্চারী হয়ে উঠেছিল। ৬০ এর দশকে শাশ্চাত্যের যুব বিদ্রোহের মতো এই আন্দোলনেরও ছিল আলোড়িত ও স্পন্দিত হবার মতো অনুষঙ্গ। সেজন্য ষাটের দশকের রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক কর্মপ্রবাহ পরবর্তীকালে খুবই প্রভাব বিস্তার করেছে এ ব্যাপারে আজ আর সন্দেহ নেই। ষাটের দশকের ছাত্র আন্দোলন ও সাংস্কৃতিক কর্মপ্রবাহ সমাজজীবনে যে অভিঘাত সৃষ্টি করেছিল এ নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হতে পারে।

সামরিক শাসকের বিরুদ্ধে প্রথম সংঘবদ্ধ প্রতিবাদের পরেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল কেন্দ্রী শহীদ মিনারে একুশের অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানের জন্য মহড়া চলেছিল পুরাতন কলাভবনের ভাষা আন্দোলনখ্যাত আতলার অনতিদূরে ডাকসু কক্ষে। সেখানে সঙ্গীত শিল্পী আলতাফ মাহমুদকে প্রথম দেখি; আত্মসমাহিত ধ্যানমগ্ন এক শিল্পী, যার ব্যক্তিত্বের ধরনেই এমন কিছু আছে, যা যে কোনো মানুষকে আকর্ষণ না করে পারে না। রাশভারী, কথা বলেন কম। গণসঙ্গীত শিল্পী হিসেবে তিনি তখন খ্যাতির শীর্ষে। যুবা বয়সে চারন কবির মতো ঘুরে বেড়িয়েছেন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। যুবলীগের কর্মী হিসেবে সাংস্কৃতিক জাগরনের অগ্রদূত ও মধ্যমনি। তিমিরবিনাশী, দুঃখবিনাশী গান গেয়ে মানুষের মধ্যে আশার আলো সঞ্চারের মহান ব্রতে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। গৃহত্যাগী, সংসারবিমুখ। নিষিদ্ধ বামপন্থায় আগ্রহ ও সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলনে অবিচল আস্থা। মহান এক আদর্শ দ্বারা চালিত এক মানুষ। সে সময় সামরিক শাসনের রক্ত চক্ষুকে উপেক্ষা করে ছাত্রসমাজের একুশে উদযাপনের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা ছিল রীতিমতো বিরুদ্ধ-স্রোতে যাত্রা। এই অনুষ্ঠানে নিজেকে সম্পৃক্ত করা ছিল এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ এবং এক অঙ্গীকারকে ধমনীতে ধারন করে আলতাফ মাহমুদ ডাকসুর একুশের অনুষ্ঠানকে সুচারুভাবে সম্পন্ন করার জন্য এবং উপস্থাপনায় একুশের চেতনাকে পবিত্র এক বোধে গেঁথে তোলার জন্য প্রাণান্তকর পরিশ্রম করছিলেন। আমরা তখন তরুন, ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী। আলতাফ মাহমুদের নিষ্ঠা, প্রাণান্তকর পরিশ্রম আমাদের দারুনভাবে আন্দোলিত করেছিল। আমরা পরম বিস্ময়ে লক্ষ করেছি সমবেত শিল্পীদের তার প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা। তিনিই সম্মেলক গানগুলোকে শিখিয়ে চলছিলেন প্রতিদিন পরম মমতা ও নিষ্ঠায়। আর তার সুরারোপিত অবিনাশী সেই গান তিনি যখন ধ্যাননিবিষ্ট হয়ে শেখাতেন, আমাদের দেহমনে শিহরণ জাগাত। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো….’ বলার সঙ্গে সঙ্গে তার চোখ বুজে আসত, সম্মেলক গনের শিল্পীরাও এই গানের চেতনায় আন্দোলিত হতেন।

আলতাফ মাহমুদের ব্যক্তিত্বের ধরনে ছিল এক ধরনের প্রখর আত্নসচেতনতা, যা আকৃষ্ট না করে পারে না। সঙ্গীত নিবেদিত প্রাণ এই মানুষটি মহড়ার জন্য কক্ষে পা দিলেই সমগ্র পরিবেশটিই নিমেষে কেমন যেন পাল্টে যেত। সমবেত সঙ্গীত শিল্পীরা তার উপস্থিতিতে সহসাই সিরিয়াস হয়ে উঠতেন।

আমরা সে সময় সদ্য কলেজের গন্ডি অতিক্রম করেছি। বামপন্থায় দীক্ষা গ্রহণ করেছি। এবং জীবনের এক মানে খুঁজে চলেছি আদর্শিক চেতনাকে ধারন করে। সেই সময় দেশ-ভাবনা দ্বারা আলোড়িত হচ্ছি সর্বক্ষন; উপলব্ধি করছিলাম পাকিস্তানি সামরিক শাসকের পীড়নে বাঙালি এক বিপন্নতার সম্পুখীন। প্রবল এক ঐক্যবন্ধ আন্দোলন গড়ে তোলা ছাড়া এ থেকে পরিত্রানের কোনো পথ নেই।

ডাকসুর একুশে অনুষ্ঠানমালায় কর্মী হিসেবে সে সময় আমি ও আমার অভিন্নহৃদয় বন্ধু মতিউর রহমান প্রতিদিন বিকেলে তখন ডাকসু অফিসে যাই। প্রথম দিন থেকেই আমাদের কাজ হয়ে ওঠে শিল্পীদের মহড়ার সময় তাদের সঙ্গে থাকা, গান কপি করে দেওয়া। আলতাফ মাহমুদের নাম শুনলেও তাকে সামনাসামনি দিখিনি। সেখানেই তাকে প্রথম দেখি। সেই স্মৃতি ভুলবার নয়। সকলে তাকে সমীহ করে, শ্রদ্ধামিশ্রিত দৃষ্টিতে দেখে।

ডাকসুর একুশের এই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আমাদের সাংস্কৃতিক মনোভূমিকে আলোড়িত করেছিল। এই অনুষ্ঠানটিকে সুচারুভাবে সম্পন্ন করার দায় নিয়ে আলতাফ মাহমুদ যেভাবে পরিশ্রম করেছিলেন, এ আমাদের সকলের জন্যই খুবই আগ্রহ উদ্দীপক বলে মনে হয়েছিল। সেদিন আরা যে কজন তরুন সংস্কৃতিকর্মী এই অনুষ্ঠানের কর্মী হিসেবে সমবেত হয়েছিলাম, আমাদের সকলের জন্য এ মিছিল ছিল শিক্ষনীয় বিষয়। এই অনুষ্ঠানের জন্য অনুপুঙ্খবিষয়াবলি নিয়ে তিনি ভেবেছেন; মহড়ার সময় এবং মহড়া শুরুর পূর্বে সকল শিল্পী ও যন্ত্রীদের নিয়ে তিনি কথা বলেছেন এবং গণসঙ্গীতের এই ধরনের অনুষ্ঠান যে দেশের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জীবনেও প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম সে কথা সকলের মধ্যে সঞ্চারিত করার চেষ্টা করেছেন।

গান শিখিয়েছিলেন তিনি নবীন সঙ্গীত শিল্পীদের। এ ছাড়া সঙ্গীতশিল্পী লায়লা মোজাম্মেলকে শিখিয়েছেন বিম্মৃতপ্রায় গান। এই অনুষ্ঠানের জন্য স্ক্রিপ্ট লিখেছিলেন শিল্পী কামরুল হাসানের অনুজ প্রয়াত বদরুল হাসান। এই স্ক্রিপ্টের সঙ্গীত অংশটি আলতাফ মাহমুদের প্রস্তাব মতোই অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। আলতাফ যে শুধু তার সঙ্গীত ও অঙ্গীকার দ্বারা চালিত হয়ে সঙ্গীত অংশটি সমৃদ্ধ করেছিলেন তা-ই নয়, তিনি সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে একুশের চেতনা ও দেশ-আত্মার মর্মবেদনা তুলে ধরতে সচেষ্ট ছিলেন। একুশের এই অনুষ্ঠানে সেভাবেই গীত হয়েছিল ফাহমিদা খাতুনের কন্ঠে রবীন্দ্রনাথের গান, মাহমুদ আলী সিদ্দিকীর কন্ঠে সলিল চৌধুরীর গণসঙ্গীত। আর সেদিন সর্বাধিক আলাড়িত করেছিল যন্ত্রীদের বাদ্যসমবায়।

ঢাকার তরঙ্গহীন সাংস্কৃতিক জীবনে এই অনুষ্ঠানটি সত্যিকার অর্থেই এক মাত্রা সংযোজন করেছিল। শহীদ মিনারের উন্মুক্ত মঞ্চে এই প্রথমবার একটি অসাধারন অনুষ্ঠান হয়েছিল। আলতাফ মাহমুদই ছিলেন এই অনুষ্ঠানকে সুচারুভাবে সম্পন্ন করার কাজে মধ্যমণি। শিল্পীদের পোশাক, গান আবৃত্তি, উপস্থাপনা ও মঞ্চের আলোকসম্পাত সংযোজিত করেছিল সাংস্কৃতিক জগতে নব্য রুচি। সব কিছুতে স্নিগ্ধ, সৌম্য ও পবিত্রতার স্পষ্ট ছাপ ছিল। সামরিক শাসনের জগদ্দল পাথর এবং দহন জ্বালা বুকে নিয়ে অঙ্গীকারলগ্ন ও একুশের চেতনাকে নব আলোকে প্রজ্বলিত করার শপথ উচ্চরিত হয়েছিল।। নবীনেরা প্রণিত হয়েছিল।

এই চেনাজানা, এই দেখা অমোচনীয়ভাবে হৃদয়ে গেঁথে থাকে। ষাটের দশক জুড়ে প্রভাবসঞ্চারী যে সাংস্কৃতিক কর্মপ্রবাহ চলেছে ছাত্র সমাজর মধ্যে, তাতে আলতাফ মাহমুদ আমাদের নিত্যদিনের কাজের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে ছিলেন। এই সাংস্কৃতিক কমৃপ্রবাহ আমাদের রুচি, জাতিসত্তা নির্মান ও স্বরূপ চেতনাকে প্রখর করেছিল। একদিকে বাঙালি হওয়ার সাধনা, অন্যদিকে আন্তর্জাতিকতার মানবিক বোধে উজ্জীবনের পথ নির্মাণ করেছে এই সাংস্কৃতিক কর্মচাঞ্চল্য। এই সময়ে আদর্শিক ধারায় বিরোধ, দ্বিধা-দ্বন্দ্বের সূচনা ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক শিবিরে পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস, ব্যবধান সৃষ্টি করলেও আলতাফ মাহমুদ প্রগতির আদর্শে অবিচলিত ছিলেন। তিনি প্রগতির পথ থেকে সরে আসেননি। বরং সকল পক্ষেরই যেকোনো প্রগতিশীল কর্মকান্ডে অংশ নিয়েছেন।

১৯৬৫-৬৬ সালে তিনি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছেন এবং অন্যদিকে তার ব্যস্ততা বেড়ে গেছে। কিন্তু যখনই আমরা ছুটে গেছি সংস্কৃতি সংসদ আর ছাত্র ইউনিয়েনের কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য গান গাইবার কিংবা গান শেখাবার অনুরোধ নিয়ে, তিনি সে অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেননি। সারা রাত জেগে রেকর্র্ডিং করেছেন চলচ্চিত্রের। বেলা এগারো কিংবা বারোটায় এসে নবীন শিল্পীদের গান শিখিয়েছেন। মহড়ায় অংশ নিয়েছেন। এমনকি বিস্মৃত গান শিখিয়েছেন অনুজ কোনো কণ্ঠশিল্পীকে। সামরিক শাসন জারির পর গণসঙ্গীত গাওয়া বেশ দুঃসাধ্য কাজই হয়ে উঠেছিল। গণচেতনাসঞ্চারী যে কোনো কাজই অপরাধ বলে বিবেচনা করা হতো। সে জন্য গণসঙ্গীত চর্চায় ভাটা পড়েছিল। বিশেষত পঞ্চাশের দশকে গীত গণনাট্য সংঘ আর সলিল চৌধুরী সুরারোপিত গানগুলো পর্দার আড়ালে চলে গিয়েছিল। আলতাফ মাহমুদ সে গানগুলো শেখালেন। এই গান পূর্ববাংলার সামজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় নতুন প্রাণ পেয়েছিল।

১৯৬৭ সালের অক্টোবরে মহান অক্টোবর বিপ্লবের পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত হয়েছিল দুদিনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। অসাধারন এক স্ক্রিপ্ট লিখেছিলেন আলবদর ঘাতকদের হাতে নিহত সাংবাদিক-সাহিত্যিক শহীদুল্লাহ কায়সার। পল্টন ময়দানের উন্মুক্ত মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয়েছিল ‘আমরা চলি অবিরাম’ ছায়ানাট্য। শহীদুল্লাহ কায়সার এই ছায়ানাট্যের জন্য দুটি নতুন গান লিখেছিলেন ‘আমরা চলি অবিরাম’ ও ‘আমি মানুষেরই ভাই স্পার্টাকাস’ এই দুটি গানেই সুর সংযোজন করেছিলেন আলতাফ মাহমুদ। এই অনুষ্ঠানটি সব দিক থেকে আগ্রহসঞ্চারি হয়ে উঠেছিল নজরুল ইসলামের বিদ্রোহি কবিতায় সুরারোপে এবং তাতে গভীরতা সঞ্চারী শিল্পিত মাত্রা সংযোজনের ফলে। দীর্ঘ চার মাস মহড়া চলেছিল এই অনুষ্ঠানের। প্রথম দিকে শহীদুল্লাহ কায়সারের কায়েৎটুলির ভবনে এবং পরে বিজয়নগরে তাঁর এক অবঙালি বন্ধুর বাড়ির একটি কক্ষে। এই সময় আলতাফ মাহমুদকে দেখেছি ছায়ানাট্যের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিষয়াবলি নিয়ে ভাবিত হতে। সঙ্গীত শিল্পী অজিত রায় বিদ্রোহির গানের একটি অংশে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। আলতাফ মাহমুদ এই গানটি শিখিয়েছিলেন পরম নিষ্ঠায়। খ্যাতনামা চিত্র পরিচালক নূরুল হক বাচ্চু ছায়ানাট্যের নির্দেশক ছিলেন। নাচে অংশ নিয়েছিলেন একসময়ের খ্যাতনামা নৃত্যশিল্পী শারমিন হাসান। আর শহীদুল্লাহ কায়সারের অনুজ খ্যাতনামা চলচ্চিত্র পচিালক জহির রায়হান প্রচ্ছন্নে সকল রকম সহযোগিতা করেছিলেন।

ধারা বর্ণনা পাঠ করেছিলেন সেলিনা বাহার জামান। গীত, নৃত্য ও ছায়ানাট্যের মিশ্রনে পুরো অনুষ্ঠানটি দর্শক-হৃদয়ে স্থায়ী আসন করে নেয়। এই অনুষ্ঠানের জন্য প্রতিদিনই মহড়া হতো, আলতাফ মাহমুদই ছিলেন মহড়ার প্রাণপুরুষ। এই চার মাস আমরা হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেছিলাম। এই অনুষ্ঠানটিকে সুচারুভাবে সম্পন্ন করার কাজে যুক্ত হওয়ার ফলে আলতাফ মাহমুদ আর শহীদুল্লাহ কায়সার-এ দুজন মানুষের সান্নিধ্যে আসার সুযোগ হয়। যদিও ১৯৬৫ সালের জানুয়ারি মাস থেকে সংবাদের বার্তা বিভাগে চাকরির সুবাদে শহীদুল্লাহ কায়সার আমার কর্নধার। তাঁরই প্রযত্নে ও সার্বিক তত্ত্বাবধানে সরকারের বৈরিতা ও অথৃকষ্ট বুকে নিয়ে সংবাদ তখন বেরুচ্ছে এবং দেশের গনতান্ত্রিক আন্দোলনে বিরাট ভুমিকা পালন করছে। আমি সংবাদের একজন সহ-সম্পাদক। আমরা চলি অবিরাম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজনে যুক্ত হয়ে শহীদুল্লাহ কায়সারের সঙ্গে যে দূরত্ব ছিল তা ঘুচে যায়। আলতাফ মাহমুদ ও শহীদুল্লাহ কায়সার-এ দুজনের নৈকট্যে এসে উপলব্ধি করি তাদের মানবিক গুনাবলি, ব্যক্তিত্ব এবং মানুষের জন্য দুজনেরই অনুভব কত গভীর। তাদের মানুষকে আপন করে নেওয়ার আশ্চর্য ক্ষমতা আমাদের আলোড়িত ও মুগ্ধ করে।

পরবর্তীকালে উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে এ দেশের ছাত্রসমাজ যে অসম সাহসের পরিচয় দিয়েছিলে তার কোনো তুলনা নেই। সমগ্র দেশ ও জাতি এক মোহনায় এসে মিশেছিল। এই সময়ে সাংস্কৃতিক কর্মপ্রবাহও থেমে ছিল না। জীবনলগ্ন নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল । সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে উদ্দিপ্ত সঙ্গীত পরিবেশনাও রাজপথে জনগনের স্বাধিকারের প্রমত্ত সংগ্রামকে নতুন মাত্র দান করেছিল। এসব অনুষ্ঠানে নবীনদের কন্ঠে আলতাফ মাহমুদ, শেখ লুৎফর রহমান, অজিত রায় সুরারোপিত সঙ্গীত গীত হওয়া অপরিহার্য ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কৃতি সংসদ সত্তরের ১ ও ২ জানুয়ারি বাংলা একাডেমীর উন্মুক্ত মঞ্চে এক সাংস্কৃতিক উৎসবের আয়োজন করেছিল। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এ নাটকটির মঞ্চায়ন এক ‘উল্লেখযোগ্য সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি’ বলেই অভিহিত হয়েছে। এই নাটকটিতে আবহ সঙ্গীতের স্রষ্টা ছিলেন আলতাফ মাহমুদ। খুব বেশি যন্ত্র তিনি ব্যবহার করেননি। কিন্তু তবুও সঙ্গীত অংশটি সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল তার সাঙ্গীতিক বোধে। রক্তকরবী নাটকটির অন্তর্নিহিত শক্তি ও চেতনা তার আবহ সঙ্গীতে মূর্ত হয়েছিল।

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আলতাফ মাহমুদ তার এই সামাজিক অঙ্গীকারকে বুকে ধারন করে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায়্যের হাত প্রসারিত করবেন- এ তো স্বাভাবিক। সেজন্য তাকে প্রাণ বির্সজনই দিতে হয়েছে। তাকে ও শিল্পী আবুল বারক আলভীকে পাকিস্তানি মিলিটারী ধরে নিয়ে গিয়ে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে অকথ্য নির্যাতন চালায়। একদিন আমি শিল্পী আলভীর মুখে এই নির্যাতনের কাহিনী শুনে শিহরিত হয়েছিলাম। আলভী ও সে বর্ণনা শেষ করতে পারেননি। কোনো বিবেকবোধসম্পন্ন মানুষের পক্ষেই এই নারকীয় নির্যাতন বর্ণনা করা খুবই কষ্টকর ও দুরহ। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অকথ্য পীড়ন চালিয়েছিল, আলতাফ মাহমুদের মৃত্যু হয়েছিল নির্যাতনে; তিনি কেমন করে সহ্য করেছিলেন সে নির্যাতন? তিনি তো স্বপ্ন দেখতেন বাংলাদেশের। সেই স্বপ্নই কি তাকে সাহায্য করেছিল এই নির্যাতন সহ্য করবার। কে জানে?