ছোট ছোট স্মৃতি – শিমুল ইউসুফ

১৯৬৩ থেকে ১৯৭১ এর ৩০ আগষ্ট । ভাইয়ার সাথে এই আট বছর অনেক ছোট ছোট স্মৃতির কথা আজ আমার মনে পড়ছে । জীবনের হিসেবে অনেক অল্প সময়-তবে আমার জন্য আমার বেঁচে থাকার প্ররণার জন্য এই ছোট সময়কেই আমি আমার এই জীবনে ও আগামী জীবনে জীবন্ত করে রাখবো । আজ ভাইয়ার কথা বলতে গিয়ে সেই ছোট্ট শিমুল হয়ে যেতে ইচ্ছা করছে ।

৬৩ সালে ভাইয়াকে আমাদের বাড়ীতে প্রথম নিয়ে আসেন চুন্নু মামা । ফুল হাতা র্সাট কালো প্যান্ট পড়া ভাইয়ার সাথে মাকে পরিচয় করিয়ে দেন চুন্নু মামা এইভাবে “ইনি আলতাফ মাহমুদ খুব ভালো গান করেন । তানহা ছবির সংগীত পরিচালক ” । আমার মা ভীষণ খুশী-কারন গান গাইতে পারেন আলতাফ মাহমুদ । অতিথী আপ্যায়নের পরই মা তাকে একটি গান শোনাতে বলনে । ভাই লীনু বিল্লাহ ভাল তবলা বাজাত । হারমোনয়িাম নিয়ে বসলেন ভাইয়া, লীনু তবলা নিয়ে আর আমারা সবাই শ্রোতা । ভাইয়া গাইলেন তার নিজেরই রচিত ও সুরারোপিত একটি গান ” পদ্মাবতী নিত্য যেত জল ভড়তে ঘাটে ” । তারপর একের পর এক গান, কখনো নজরুল কখনো রবীন্দ্র সংগীত কখনো ড,ি এল, রায় । প্রথম দিনই আমার মায়ের মন জয় করে নিয়ে ছিলেন ভাইয়া, তাঁর সংগীত দিয়ে । কিন্ত তারও আগে তিনি যে আমার বড় বোনের মন জয় করে ফেলেছেন তা বাসার কেউ জানতো না । ভাইয়ার সাথে পিয়া মনির (ঝিনু আপার ) বয়সের বিস্তর ব্যবধান ছিল । তাই নিয়ে মা এবং বড় ভাইদের একটু আপত্তি ছিল বিয়েতে । সুফিয়া কামাল খালা ঘটক হয়ে মাকে সম্মত করান এই বিয়েতে । আমার মনে হয় ঐ সময় আমাদের পরিবারে যে সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল ছিল ভাইয়া তাকেও ভালোবেসেছিলেন । ভালো বেসেছিলেন আমার মায়ের ভালোবাসাকে । ৬৩ সাল থেকেই ভাইয়ার কাছে থেকে আমার তালিম নেওয়া শুরু হয়ে যায় ।

১৯৬৬ সালের ১৬ই অক্টোবর পিয়ামনি (ঝিনু আপা) আর ভাইয়ার বিয়ে হয়ে গেল । নতুন বউ নিয়ে উঠলেন আবদুল লতিফ ভাই এর বাসায় । তখন সংগীত পরিচালনার জন্য ভাইয়াকে প্রায়ই রাতের শিফট্ এ কাজ করতে হতো । পিয়া (ঝিনু আপা) রাতে একা থাকতে ভয় পেত সেই কারনে স্হির করা হলো একটা মোটামুটি ভাবে সবাই থাকা যায় এরকম বাসা ভাড়া নেওয়া হবে যাতে আমরা সবাই একসাথে থাকতে পারি । যেমন কথা তেমনি কাজ । হুলস্হুল করে ভাইয়া বাসা ভাড়া করে ফেললো । সেই থেকে শুরু হলো খুব কাছে থেকে ঘরের আলতাফ মাহমুদকে দেখা এবং জানা ।

পিয়ামনির (ঝিনু আপার ) বাবু হবে-আমি পেটে কান দিয়ে শোনার চেষ্টা করতাম বাবুটা আমার সাথে কথা বলে কিনা । বলতো না । আমার ভাই দীনু একটা বানর পুষত । মা এবং ভাইয়া ঠিক করলেন বানরটাকে চিড়িয়াখানায় দিয়ে আসবে কারণ সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে ঝিনু যদি বানরের মুখ দ্যাখে তাহলে সন্তানের চেহারা যদি বানরের মত হয় ? বানরের বিদায় হলো মিষ্টির (দীনু) অনেক চোখের জলের মধ্যে । এখন ভাবি শাওন এত সুন্দর হয়েছে যে আমার কন্যা এশা, শাওনের সৌর্ন্দযে মুগ্ধ হয়ে আধফোটা কথা বলা এশা, ওর নাম বলল “সুন্দর ” । এখন আমরা সবাই শাওনকে ‘সুন্দর’ নামেই ডাকি ।

৬ আগষ্ট শাওন হলো হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে রাত সাড়ে দশটার দিকে । ভাইয়া মায়ের পেছনে শিশুর মতো লুকিয়ে আছে আর বলছে “মা মনি আপনি আগে দ্যাখেন, আমার মতো কালো হয়নি তো ? ঝিনুর মতো রং পেয়েছে কিনা আগে দ্যাখেন। “মা শাওনকে দেখে ভাইয়াকে বলল ” ঝিনুর চেয়েও সুন্দর হয়েছে তোমার মেয়ে আলতু ” । মা ভাইয়াকে আদর করে আলতু ডাকতেন ।
সন্তান সম্ভবা অবস্হায় পিয়ামনি একদিন পাশের বাসা থেকে এক বোতল ঠান্ডা পানি এনে পান করছিল তখন সব ঘরে ঘরেই ফ্রিজ ছিল, আমাদের ছিলনা । ভাইয়া দুপুরে খেতে এসে দেখলেন এ দৃশ্য – তারপর সন্ধ্যায় একটা ফ্রিজ কিনে আনলেন ।
পিয়াকে আর অন্যের বাড়ী থেকে যেন ঠান্ডা পানি চেয়ে খেতে না হয়।

শাওন তখন দুই আড়াই বছরের হবে-পাশের বাড়ীর জাম গাছে জাম ধরেছে, জামগুলো ভাল করে পাকেনি কিন্তু শাওন খাবেই । বাড়ির মালিক বলেছিল ” জাম পাকলে খেও ” । ভাইয়া বাসায় ফিরে এসে দেখলো শাওন জাম খাওয়ার জন্য বায়না করছে । ভাইয়া গাড়ী নিয়ে বাজারে গিয়ে গাড়ির বনেটে ভরে এক ঝুড়ি জাম নিয়ে হাজির । মা বলছিলেন ” এত জাম কেন আনলে আলতু সবতো নষ্ট হবে । কটাই বা শাওন খাবে ? ভাইয়া বলছিলেন ” পাড়া প্রতিবেশীর বাড়ী দিয়ে দেন, আমার মেয়ে জাম খেতে চেয়েছে আমিতো আর আধাসের জাম নিয়ে আসতে পারি না-ওকে জামের ঝুড়ির ওপর বসিয়ে দেন,দেখি ও কত খেতে পারে ” । এই হলো আমার ভাইয়া ।

বাজার করতে খুব ভালোবাসতেন তিনি । প্রায়ই আরিচা ঘাটে চলে যেতেন গাড়ী নিয়ে, নানা রকমের মাছ,সবজী বোঝাই করে নিয়ে আসতেন-তারপর বিলানো হতো বাড়ী বাড়ী । ভাল খেতে খুব ভালোবাসতেন ভাইয়া । মায়ের হাতের চিংড়ি মাছের মালাইকারী খুব পছন্দের ছিল তার । ভাইয়া চলে যাবার পর মা আর কোনদিনও চিংড়ি মাছের মালাইকারী বাসায় রান্না করেননি । আমিও আর কোনদিন এই ৩৪ বছরে একবারও ছুয়ে দেখিনি চিংড়ি মাছের মালাইকারী । মা শিঙ মাছ, মাগুর মাছ ও মুরগী খেতেন না । তবে ভাইয়ার জন্য খুব যত্ন করে শিঙ মাছ ও মাগুর মাছ রান্না করতেন । মা খেতেন না বলে আমরা তিন বোনও ঐ মাছগুলো খেতাম না । খাবার টেবিলে বসে ভাইয়া কয়েকদিন এই ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছেন । তারপর একদিন দুপুরে আমরা সবাই খেতে বসেছি ভাইয়া মাকে বললেন ” মামনি আপনিও আমাদের সাথে খেতে বসে যান অনেক বেলা হয়ে গেছে ” । মা তখনও জানতেন না এর পর ভাইয়া কি করতে যাচ্ছেন । প্রথমইে ভাত বেড়ে দিলেন মা সবার পাতে এরপর ভাইয়া শিঙ মাছের তরকারীর বাটিটা নিয়ে বললেন ” মামনি আপনার থালাটা দেন আমি আপনাকে তরকারী বেড়ে দিচ্ছি ” । মা যতই বলেন না আলতু তুমি আগে নাও আমরা পড়ে নেব । ভাইয়া ততই জেদ করে মাকে বলেন ” শোনেন মা, আমি জানি আপনি এই মাছ খাননা, কিন্তু কেন বলেন ? এত ভাল মাছ আপনি খাননা বলে ঝিনু, মিনু, শিমুল ওরাও খায়না । এটা কি ঠিক । মুরগীর কথা আজ বাদ দিলাম কিন্তু আজকে আপনি যদি শিঙ মাছ না খান তবে আমিও ভাত খাবনা । মা, আমরা তিন বোন চুপ করে বসে আছি । তখন ভাইয়া নিজেই ভাত মেখে আমাদের সবার মুখে নলা তুলে দিল, মা এবং আমরা কোন মতে পানি দিয়ে তাই গিললাম ।

আমার একটা কুকুর ছিল । ওকে আমি কমলাপুর বৌদ্ধ মন্দির থেকে এনেছিলাম। ওর নাম ছিল “কিলার ” । তার আবার অদ্ভুত অভ্যাস ছিল । সে কাকাবাবু (বিশুদ্ধনন্দ মহাথরেো) শুদ্ধানন্দ ভান্তে যখন আমাদের বাসায় আসতেন তখন সারাক্ষণ ওনাদের সাথে থাকতো । ওনারা চলে গেলে আমার সেই কিলারও হলুদ কাপড়ের পেছনে পেছনে বৌদ্ধ মন্দির চলে যতে । ও শেষবারের মতো চলে যায় ৭০ এর শেষের দিকে আর ফিরে আসেনি । সেই কিলার যখন ঘুমাত ভাইয়া আশা যাওয়ার পথে ওর নাকে নস্যি গুজে দিত । ঘুমন্ত কিলারের নস্যির সুড়সুড়িতে হাঁচি দিতে দিতে জীবন বেড়িয়ে যাওয়ার উপক্রম । ঘাসে নাক ঘসে তো সামনের দু’পা দিয়ে নাক চুলকিয়ে প্রচন্ড ভয় পেয়ে লাফালাফি শুরু করে দিত । সে যে কি বেকায়দা অবস্হা কিলারের । ভাইয়া এই দুষ্টমী গুলো শিশুর মতো উপভোগ করতেন ।

ছুটির দিনগুলোতে মাঝে মধ্যে ভাইয়া দুপুরে বাসায় বিশ্রাম নিতেন । তখন আমার ডাক পড়তো কারণ আমার কাজ ছিল ভাইয়ার পিঠের উপর বসে একটা দশ পয়সার কয়েন দিয়ে ভাইয়ার পিঠ চুলকানো । ভাইয়া ঘুমাতেন বালিশের মধ্যে থুতনী দিয়ে উপুর হয়ে-মাঝে মাঝে মনে হতো খুব গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন-আবার মাঝে মাঝে দু’চোখের পাতা, ভুরু কুচকিয়ে চোখ বন্ধ করে রাখতেন । তখন মনে হতো খুব গভীর কোন ধ্যানে মগ্ন তিনি । হয়তো এর কিছুক্ষণ পরই ঘুম,বিশ্রাম, সবকিছু ভুলে ডুবে যেতেন হারমোনিয়ম নিয়ে সুরের সমুদ্রে । ভাইয়ার পেটের উপর বসেও কত খেলা খেলেছি । আসলে আমিতো শাওনকে তার পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত করে সব আদর একাই নিয়ে নিয়েছিলাম ভাইয়ার কাছ থেকে ।

তিনি আমার পিতাসম, তিনি আমার শিক্ষক, আমার গুরু । সকালে যদি কোনদিন গলা না সাধতাম সেদিন ভাইয়ার সামনে যেতে পারতামনা ভয়ে । কেন রেওয়াজ করিনি বা কোনদিন হয়তো স্কুলে যেতে দেরি হবে ভেবে তারাহুরা করে রেওয়াজ শেষ করেছি সেদিনও ভয় এই বুঝি দরজা খুলে এসে সামনে দাঁড়াবে । আর সুর থেকে বিচ্যুত হলে তো কথাই নেই । দড়াম করে দরজা খুলে বেড়িয়ে এসে একবার শুধু বড় বড় চোখ দুটো আরও কঠিন এবং রাগ নিয়ে দাঁড়াতেন । আমার কন্ঠ দিয়ে তখন আর কোন আওয়াজই বের হতোনা ভয়ে । সেই র্মুতিতে তখন কোন ক্ষমা থাকতোনা,কোন আদর থাকতোনা । কঠিন দৃষ্টি । যারা তাঁকে কাছে থেকে দেখেছেন এবং জানেন তারা নিশ্চই আমার অবস্থা বুঝতে পারবেন । আবার এমনও অনেক সময় গেছে তিনি ঘরে বসে সুর করছেন, আমি দরজার পাশেই ঘুরঘুর করছি । আমাকে ডেকেই জিজ্ঞাসা করেছেন ” কেমন হলো বলতো ? পুরো গানের সুর হয়ে গেলে মাকে বসিয়ে শোনাতেন মাকেও জিজ্ঞাসা করতেন কেমন হল মা মনি ” মনে পড়ে ” হাজার তারের বীনা”, “রাজপথ জনপথ”, বাদল বরষিণে এই গীতনিাট্যের সুর এবং সংগীত পরিচালনা করার সময় আমি তাঁর খুব কাছাকাছি ছিলাম । অনেক গান প্রথমে আমিই তুলে রাখতাম । কারণ ভাইয়া সুর করে যখন মিউজিক কম্পোজ করতেন তখন মূল গানটা আমি গাইতাম আর তিনি র্কডগুলো বের করতেন । ” এই ঝঞ্জা মোরা রুখবো ” “আমি মানুষরে ভাই র্স্পাটাকাস ” এই দুটো গণসংগীত এর সুর করার সাথে সাথেই আমি গলায় তুলে নিয়েছিলাম

ভাইয়া যখন ঘরে বসে সুর করতেন তখন আমার মায়ের নির্দেশে পুরো বাড়িতে পিনপতন নিস্তব্ধতা বিরাজ করতো । এমনকি ছোট্ট শাওনকেও আমরা আমাদের ঘরে নিয়ে এসে ঘুম পাড়াতাম । যদিও শাওন ছোট বেলা থেকেই খুব লক্ষী ছিল, একদম কান্নাকাটি করতো না । ভাইয়া যে কি ভালো সরোদ বাজাতে পারতেন তা অনেকেরই অজানা । বেহালা, সরোদ, বাঁশী, গিটার, তবলা, পিয়ানো, যাইলোফোন, ভাইব্রোফোন, আরও কত রকমের পারর্কেশন বাজাতে পারতেন । এই যন্ত্র গুলো তার সংগ্রহে ছিল । স্বাধীনতার পর কিছুই আমারা ফেরত পাইনি যাদের কাছে এগুলো ছিল । কিছু বাসা থেকেও লুট হয়েছে । পুরোনো লং প্লে রের্কড সংগ্রহ করা তার নেশা ছিল । বিখ্যাত সব কম্পোজারদের কম্পোজিশন ছিল তার সংগ্রহে । শুধু মাত্র তানপুরাটা হাদী ভাইয়ের কাছে আছে । তিনি সেটাকে যত্ন করেন তার সন্তানের মতো । তবুও একবার স্পর্শ করে দেখতে ইচ্ছা করে নিজের হাতে । মন বলে ভাইয়ার লম্বা লম্বা আঙ্গুলগুলো এখনো বোধহয় ঐ তার গুলোকে ছুঁয়ে যায় ।

১৯৬৯ এ বুলবুল ললিতকলা একাডেমি থেকে ২০শে ফেব্রেুয়ারী রাতে অনুষ্ঠান হবে শহীদ মিনারে । একসময় প্রচন্ড গোলমাল শুরু হলো । এন, এস, এফ এর গুন্ডারা অনুষ্ঠান পন্ড করার জন্য ইট পাটকেল ছূড়তে লাগলো । বাফার অনেক নাচের মেয়েরাও ছিল সেদিন । ভাইয়া আমাকে “নাকের বদলে নরুন পেলাম টাক ডুমা ডুম ডুম ” এই গানটি শিখিয়েছিল গাইবার জন্য । হঠাত্‍ আমি বুঝতে পারলাম আমি শূন্যে ঝুলছি । ভাইয়া আমাকে চিলের মতো ছোঁ মেরে শহীদ মিনারার পেছন দিকে নিয়ে গিয়ে ‘মারুফ মারুফ শিমুলকে ধর বলেই উপর থেকে ছেড়ে দিলেন । নীচে বাফার মারুফ ভাই আমাকে ততক্ষনে ধরে নিয়েছেন । সেই অবস্হায় মেয়েদের সবাইকে মেডিকেল কলেজের ভেতরে রেখে আবার গেলেন হারমোনিয়াম তবলা আনতে শহীদ মিনারে । কেমন করে ভুলবো ভাইয়াকে ।

একবার রাতের বেলা আমি আর মেঝমনি (মিনু আপা) জানালার পাশে পড়ার টেবিলে পড়ছিলাম । আমাদের ঘরের সাথেই বারান্দা তারপর উঠান । বারান্দার লাইট জ্বলছিল কিন্তু কখন অফ করে দিয়েছে টের পাইনি । হঠাত্‍ জানালায় ঠক্ ঠক্ শব্দ-অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না । তবুও আলো আধারীতে দেখলাম একটা সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি বারান্দা দিয়ে হাঁটছে । দেখেই আমরা দুজন ভয়ংঙ্কর-চিত্কার আর বারান্দা থেকে হা-হা- হাসি । আসলে ভাইয়া লুঙ্গি কাঁছা মেরে স্যান্ডো গেঞ্জেটাকে হাঁটু অবধি টেনে এনে এমন ভাবে হাঁটছিল যে মনে হচ্ছিল একটা মানুষহীন স্যান্ডো গেঞ্জি হাঁটছে অন্ধকারে ।

মাঝে মাঝে আমাদরে ঘরের দরজার র্পদা ফাঁক করে শুধু মাথাটা বের করে পুরো শরীরটা পর্দার মধ্যে ঢেকে সামনের দুটি দাঁত বের করে খরগোশের মতো একটা দুষ্টু চেহারা বানাতেন । তখন মনেই হতোনা যে এই ভাইয়া সেই কঠিন শিক্ষক-যিনি একফোটা ভুলভ্রান্তি পছন্দ করতেন না । তাকে দেখে এমন অনেক কিছুই শিখিছি যার কোন মূল্য আমি আমার জীবন দিয়েও দিতে পারবো ।

৬৯ এর গণআন্দোলনের সময় ঢাকায় ক্রিকেট খেলা হচ্ছিল । হঠাত্‍ স্টেডিয়ামে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লে সেখানেও সব কিছুতে আগুন জ্বালিয়ে দেয় । আমি আমার ভাইদের সাথে খেলা দেখতে গিয়েছি । কোন মতে স্টেডিয়াম থেকে বের হয়ে ভাইদের হাত ধরে দৌড়াচ্ছি । টায়ার জ্বলছে,বাস জ্বলছে,মানুষ যে যেদিকে পাড়ছে দৌড়াচ্ছে-এর মধ্যে দেখি ভাইয়া রাস্তা দিয়ে উদভ্রান্তের মতো ছুটে আসছে পড়নে লুঙ্গি আর হাফ হাতা সাদা শার্ট । আমাকে দেখে ভাইদের হাত থেকে আমাকে ছোঁ মেরে নিয়ে ভাইদের উপর অসম্ভব রেগে গেল । কারণ তারা আমাকে এই বিপদের মধ্যে নিয়ে এসেছে । দেশের অবস্হা ভালোনা সেটা সবাই জানে । যে কোন সময় র্দুঘটনা ঘটতে পারে । রাগে গজগজ করতে করতে আমার হাত ধরে হাঁটা দিলেন বাসার রাস্তায় । এই কথাগুলো আজ এতদিন পরে লিখছি একারণইে যে আমি সেই মহত্‍ মানুষটার আদর, স্নেহে, ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত । ভালোবাসার কাঙাল আমি চিরকাল এবং তিনি দু’হাত ভরে উজার করে আমাকে তা দিয়েছিলেন ।

১৯৭১ এর আগষ্ট মেজদা আর মেঝমনি শাহাদাত্‍ ভাইয়রে সাথে আগরতলা চলে যায় । ভাইয়ারও যাবার কথা-কিন্তু কিছু গানের রেকর্ডিং করা বাকি ছিল তাই ঠিক হলো ৩ সেপ্টেম্বের স্পুল নিয়ে একবারেই যাবে । ওরা চলে যাবার পর সবারই মন খারাপ বিশেষ করে মায়ের । ভাইয়া মাকে ব্যস্ত রাখার জন্য ঠিক করলেন যে কাঁচাবেলের মোরম্বা বানাবেন । কাঁচা বেলের উপররে অংশ কাটা যে কি ভীষণ কঠিন কাজ সেদিনি দেখলাম । খোলশটা খুবই শক্ত । ভাইয়া বেলের ভেতে থেকে শাঁষ বের করে গোল গোল করে কেটে দিচ্ছিলিন আর মাকে চিনির সিরা তৈরি করতে বললেন । বলে সিদ্ধ করে চিনির সিরায় তেজপাতা, এলাচ, দারুচিনি দিয়ে ঘণ করে নামালেন । আমরা সবাই খেয়েছিলাম, ভীষণ স্বাদ হয়েছিল । বাকিটুকু রাখা ছিল ফ্রিজে । ৩০ আগষ্ট ভাইয়া ধরা পড়লনে পাকিস্তানী আর্মিদের হাতে অস্ত্র রাখার দায়ে । আমার চার ভাই, নাসের ভাইরা দুই ভাই, আলভী মামা, আরও অনেকে ধরা পড়লেন । সব মিলে ১১ জন হবে । ১ সেপ্টেম্বের সবাই ফিরে এলো শুধু ভাইয়া আর ফিরে আসেনি। সেই বেলের মোরাব্বা মা কাউকে ধরতওে দিতিন না ফেলেতেও দিতেন না । ফ্রিজ এর ভেতরেও কালো পিপড়া ঘিরে ফেলেছিল গোল গোল মোরাব্বা গুলোকে-যেমনি ভাবে পাকস্তানী আর্মিরা ঘিরে ফেলেছিল ভাইয়াকে ।

আমি ভাইবোনদের মধ্যে সবার ছোট তাই মায়ের আদরের ভাগ, বাবার স্নেহ, আমার ভাগে সবচেয়ে কম পরেছে। আমার বড় ভাই বোনরো যত পেয়েছে তার থেকে অনেক কম, যদি জীবনের হিসাব করি । ভাইয়াও চলে গেলেো আমাকে ফেলে । বিয়ের দেড় বছর পর আমার শ্বশুর, যিনি কখনোই আমাকে “মা শিমুল বিল্লাহ ” ছাড়া আর কোন নামেই ডাকতেন না তিনিও চলে গেলেন । তাই ঈশ্বররে কাছে আমার একটাই প্রশ্ন, যতদিন বেঁচে থাকবো ততদিন করবো, আমাকে আর কতবার এইভাবে অনাথ, এতিম হতে হবে? আমি এই জীবনে আরতো তাদের ফিরে পাবোনা । বড় অভিমান আমার ঈশ্বর, বড় অভিমান । এখন আমার একা এবং একা চোখ ভরে কাঁদতে ইচ্ছা করছে।

 

শিমুল ইউসুফ

বিশিষ্ট সঙ্গীতশিল্পী ও নাট্যাভীনেত্রী

* ফুট নোটঃ ভাইয়া-আলতাফ মাহমুদ, পিয়ামনি-সারা আরা মাহমুদ, মেঝমনি -মিনু বিল্লাহ, মিষ্টি-দিনু বিল্লাহ, মেঝদা- মেওয়া বিল্লাহ ।