জীবনের চেয়ে বড় স্পৃহার গল্প – শাগুফতা শারমিন তানিয়া

শহীদ আলতাফ মাহমুদের নাম আমি প্রথম শুনেছি আব্বার মুখে- একুশের গান শুনবার সময়। কেমন একটা করুণ সংরক্ত অভিমানময়- আমি কি ভুলিতে পারি। শুনবামাত্র ভালোবেসে  ফেলেছিলাম আমি- সাদাকালো কাপড়-একুশের ভোরে প্রভাতফেরি- আমরা যে নতুন একটি গানের জন্যে যুদ্ধ করি- নতুন একটি কবিতা লিখতে যুদ্ধ করি তার সূচনা আর আলতাফ মাহমুদ এইসবই। আব্বার মুখেই প্রথম শুনি শহীদ আলতাফ মাহমুদের বীরগাঁথা।

পরে যখন একুশের গানের পুরো লিরিক পড়ি, আমার মনে হয়েছে পঞ্চাশদশকীয় এই গীতিকবিতা যা নাগিনী-রজনীগন্ধা-অলকানন্দা এইসব অনুসঙ্গভারে জর্জরিত, তাকে এমন করে সুরারোপ করেছেন আলতাফ মাহমুদ- যেন এ মানুষের নয় গন্ধর্বের কাজ। একটি সাধারণ কবিতা পরিণত হয়েছে জাতীয় শোকগাঁথাতে, হৃদয়ের যাতনার এমন সহজ সুর আমি আর দেখি নাই।
আমার পাঠ্যবইয়ে ভাষা শহীদদের মুখ ঝাপসা- বাদামতলী প্রেসের আর যেকোনো মানুষের মতন বিশেষত্বহীন চেহারা- যেন এঁরা নিজেদের চেহারা নিয়ে আসেননি, আর যেকোনো কয়েক হাজার মানুষের স্মৃতিফলক নিয়ে এসেছেন। আমার ব্যাকরণ বইয়ের লেখক মুনীর চৌধুরী-মোফাজ্জ্বল হায়দার চৌধুরীর জন্যেও অসম্ভব কষ্ট হতে থাকে, আমার এমনকি মনে হতে থাকে জহির রায়হান কোনো না কোনোদিন ফিরে আসবেন। যা কিছু আমি বড় হতে হতে বাঙালির বলে জানি, তার প্রতি অত্যাচার-অবিচার আমার বুকে এসে লাগতে থাকে। একেকজন আগুনের পাখি সব, এমন সব বিরলজাত মানুষকে পিছমোড়া করে চোখ বেঁধে নিয়ে মেরে ফেলা যায়? সেই বেদনায় একটি দারুণ  নাম আলতাফ মাহমুদ। আয়ূর দিক থেকে স্বল্প পরিসরের জীবন, কিন্তু চাঞ্চল্যকর সেই জীবনের চলচ্চিত্র। বাড়ির গাছে কি দেয়ালে উনি ওঁর নাম খোদাই করছেন- ‘ঝিলু দি গ্রেট’, আমার মন বলছে- হতেই হবে!

তাঁর জীবনে আমার সবচেয়ে প্রিয় ঘটনাটি উল্লেখ করতে চাই, শ্রদ্ধেয় দীনু বিল্লাহর বইয়ে এর উল্লেখ আছে। ১৯৫৪ সালের কথা, সুরকার আলতাফ মাহমুদ চাঁদপুরের এক কিষাণসভায় গেছেন গান গাইতে। স্থানীয় মুসলিম লীগাররা ‘গানবাজনা ইসলামে হারাম’ এইসব বলে দেহাতি মুসলমানদের উত্তেজিত করে রেখেছে। গানবাজনা করলেই এরা সভা ভেঙে দেবে। আলতাফ মাহমুদ মঞ্চে উঠে  বললেন, “ইসলামে গানবাজনা হারাম আমরা সবাই জানি, কিন্তু আমাদের গান যদি ইসলামবিরোধী হয়ে থাকে, সঙ্গে সঙ্গে বলবেন আমরা গান বন্ধ করে দেব।” এই বলে তিনি গাইলেন একটি নাত-এ রাসুল, ‘মদিনার গুলবাগিচায় এলো বুলবুল নামের মোহাম্মদ’ এরপর জিজ্ঞেস করলেন, এই গান কি হারাম?
সমবেতরা সবাই বললেন- না।
এরপর তিনি গাইলেন- ‘আল্লা মেঘ দে পানি দে’। জিজ্ঞেস করলেন- এই গান কি হারাম?
দর্শক-শ্রোতা বললেন- না।

এইবার আলতাফ মাহমুদ ধরলেন ভারতীয় গণনাট্য সংঘ বা আইপিটিএ’র গান, ‘হেই সামালো ধান হো, কাস্তেটা দাও শান হো’, শুধু হেই সামালোর আগে প্রতিবার বললেন ‘আল্লাহ’। এমনি করে সাত আটটি গণসংগীত গেয়ে ফেললেন। যে সমাবেশ তাঁকে গান গাইতে দিতে চায়নি, সেই সমাবেশ থেকেই একের পর এক অনুরোধ আসতে লাগলো। স্থানীয় মুসলিম লীগারদের ষড়যন্ত্র বানচাল হয়ে গেল।

আমাদের ধর্মান্ধ সমাজ ব্যবস্থার ভিতর দিয়ে মুক্তি আনতে গেলে অনেক কিছু গায়ে মাখলে চলে না, আবার অনেক কিছু আপাতদৃষ্টে মেনে নিতে হয়। মানুষের সবচেয়ে বড় শক্তি তার ভিশন, তার দূরদৃষ্টি, চিন্তায়-কাজে-আচরণে সেই দূরদৃষ্টিকে সফল করে তুলতে ছোট ছোট কম্প্রোমাইজ করা চলে, সেই নতিস্বীকার সামনের জীবনে বড় বড় জয় নিয়ে আসে। সেটির একটি দৃষ্টান্ত এই কিষাণসভা।

আলতাফ মাহমুদের আর ফিরে না আসাই জানিয়ে দেয় তাঁর অসম্ভব অনমনীয় আদর্শের কথা, জানিয়ে দেয় জীবনের চেয়ে বড় স্পৃহার গল্প। বাংলাদেশ যতদিন থাকবে এই নামটা বাঙালিকে চিরদিন অশ্রুপাত করাবে আর অসম সাহস দেবে আর কিছুতেই ভুলতে দেবে না পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আর তার দেশীয় দোসরদের হাতে লাখো লাখো মানুষের সাথে এইরকম দারুণ আধুনিক ক্ষণজন্মা মানুষের মৃত্যুর কথা। আমার মৃত্যু লিখতে ভালো লাগে না। মৃত্যুর কথা লেখা থাক ট্রাইবুনালে, হত্যার কথা গমগম করে বাজুক আদালতে, আমাদের মনের আঙিনায় আলতাফ মাহমুদ সেই ফাল্গুনের শিরীষ গাছ, যার পাতার ঝরোখায় আকাশ দেখে বাঙালির প্রাণ কাঁদবে আজীবন- হায় গো আমার ভাগ্যরাতের তারা নিমেষ গনন হয়নি কি মোর সারা…