আলতাফ মাহমুদের কথা বলতে গেলে প্রথমেই আসে আমাদের পরস্পরের পরিচয়ের কথা। বোধ হয় ১৯৪৯-এর গোড়ার কথা। শুধু গণসঙ্গীত বা গণসঙ্গীত ভিত্তিক নৃত্য পরিবেশন করার লক্ষ্যে আমরা ‘ধুমকেতু শিল্পী সংঘ’ নামে ঢাকায় এক সংগঠন গড়ে তুলি। সে সংগঠনের সংগঠক ছিলেন মূলত জাহানারা লাইজু, মমিনুল হক, শাহাদাৎ প্রমূখ। রাজনৈতিক দল আয়োজিত বিভিন্ন সমাবেশের সভামঞ্চ বা ছাত্র সংগঠন আহুত সমাবেশই ছিল মূলত আমাদের গণসঙ্গীত বা নৃত্য পরিবেশনের ভিত্তিভূমি। শিল্পীকর্মী বলে সংগঠনটি যদিও ছিল খুবই ছোট কিন্তু কার্যক্রমের দিক থেকে তৎপর ছিল অনেক বেশি। অর্থাৎ প্রতিদিনই কোনো না কোনো সভামঞ্চে গণসঙ্গীত গেয়ে সমাবেশ মূখর করে রাখত এই ছোট সংগঠনটি। এমনি করে একের পর এক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে যখন কাটছে আমাদের আবেগতাড়িতগণসঙ্গীত-অন্তজীবন, ওই সময় অর্থাৎ বোধ হয় ১৯৫০-এর প্রথম দিকটায় হঠাৎ একদিন আমার বন্ধু সহপাঠী জুলফিকার আলী আমার কাছে এসে বলে, ‘নিজাম, বরিশাল থেকে আমার কাছে একটি ছেলে এসেছে, নাম ঝিলু, ভালো নাম আলতাফ মাহমুদ, খুব ভালো বেহালা বাজায়। যদি তোদের সংগঠনের কোনো কাজে আসে তবে ও খুব খুশি হয়। সঙ্গে সঙ্গে জূলফিকারকে বললাম, নিশ্চয়ই, পাঠিয়ে দে ওকে আমার কাছে। আমি তখন ঢাকা আর্ট স্কুলের ছাত্র। আর্ট স্কুল প্রাঙ্গণেই জুলফিকার প্রথম আমাকে আলতাফের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়।
মনে পড়ে আলতাফের হাতে ছিল বাক্সবন্দী বেহালা। তখন স্কুলের ক্লাস চলছিল। আমাদের স্কুলের দুই বিল্ডিংয়ের মাঝখানে ছোট একটি মাঠ ছিল। সেই মাঠে গিয়ে আমরা বসি। আলতাফকে বাজাতে বললে আলতাফ বিশেষ একটি রাগের সংক্ষেপ বাজাল। আর ওটুকুতেই ও যেন তার অন্তরেরর গভীর চেহারা আমাকে দেখিয়ে দিল। আমি ওর স্বরূপ চিনলাম বেহালায়। ওকে জড়িয়ে ধরলাম। আমি যে চিনতে ভুল করিনি তা নিশ্চিত হলাম একটু পর ক্লাসে ফিরতেই যখন ওর বাজনার ভূয়সী প্রশংসা করলেন আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক কামরুল হাসান, যিনি ক্লাসরুমের জানালায় আমাদের অলক্ষ্যে দাঁড়িয়ে ওর বেহালা বাদন শুনেছিলেন। সেই থেকে আলতাফ ধুমকেতু শিল্পী সংঘের সদস্য হয়ে গেলেন। ঢাকায় ওর থাকা-খাওয়ার কোনো ব্যবস্থা না থাকায় ও আমার সঙ্গেই থেকে গেল। আমি তখন গ্যান্ডারিয়ায় ছোট একটি ঘরে থাকি। সেই থেকে আমি আর আলতাফ জীবনের অনেক দিন এক বিছানায় থেকেছি, একপাতে খেয়েছি। পয়সার অভাবে সারা দিন না খেয়ে থাকতে হয়েছে অনেক দিন, কিংবা সারা দিন না খেতে পেয়ে রাতে কোনো বন্ধু বা সতীর্থের বাড়িতে চেয়ে খেতে হয়েছে। বোধ করি সেসব দিনের সংখ্যাই বেশি। শুধু রিহার্সেলের জন্য তখন গেন্ডারিয়া থেকে ধানমন্ডি, যোগীনগর, ওয়ারী, আরমানিটোলা, পুরানা পল্টন বিভিন্ন স্থানে পায়ে হেঁটে ফিরেছি। কেননা তখন রিহার্সেলের স্থানের কোনো সুব্যবস্থা ছিল না। একেক দিন একেক জায়গায় আমাদের রিহার্সেলের ব্যবস্থা করতে হয়েছে। আর বাসে বা রিকশায় চলাচল করার মতো আমাদের পয়সা ছিল না, রুচিও হতো না।
সংগঠনে আলতাফের উপস্থিতি আমাদের কর্মতৎপরতাকে অনেক বিস্তৃত করে দিল। আলতাফ তার প্রাণপ্রাচুর্যে সর্বক্ষণ থাকত উচ্ছল, ভীষণ বেগবান। ও ছিল খুব উঁচুমাপের সংগঠক। আলতাফ একাধিক গুণের অধিকারী ছিল- ভালো বেহালা বাজাত, ভালো বাঁশিও। সে ছিল দরাজ গলা ও গভীর সুরবোধের অধিকারী। তার এই গভীর সুরবোধের কারণে সে সুরকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ওই সময়টাতে আমাদের সঙ্গে যুক্ত হলেন আর একজন, নাম মুসলেহ উদ্দিন। খুব ভালো হারমোনিয়াম বাজাত, আমাদের গান পরিচালনা করত সে। শুধু তা-ই নয়, নৃত্য ও নাটকে তার ছিল অদম্য উৎসাহ। ফলে আমরা তখন আর গণসঙ্গীতে সীমাবদ্ধ থাকলাম না, গণসঙ্গীত ভিত্তিক গণ-গীতিনৃত্যনাট্য ও ছায়ানাট্য পরিবশেন করতে থাকলাম। ওই সময়ে আমাদের গান বা গণনৃত্যনাট্য বা ছায়ানাট্য ছাড়া কোনো রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ-অনুষ্ঠান হয়েছে বলে আমার মনে পড়ে না। রাজনৈতিক সভাগুলোতে বক্তাদের মতো আমাদেরও সমাদর ছিল খুব। জারি-সারি ও ছন্দে লিখা মুসলিম লীগ সরকারকে পরিহাস করা গান, স্বৈরাচারবিরোধী গান, যুক্তফ্রন্টের পক্ষে নির্বাচনী গান, কিষানের পালা (নৃত্যনাট্য), ছাত্র, মজুর, কিষানের জীবনভিত্তিক ছায়ানাট্য এবং ওই সময়ের গণসঙ্গীতগুলো এতই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল যে আরমানিটোলার মাঠে একটি গীতিছায়ানাট্যতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, বর্ষীয়ান নেতা আতাউর রহমান খান, অলি আহাদ, মোহাম্মদ তোয়াহা আবেগে-উচ্ছাসে অভিনয়ে অংশগ্রহন করেছিলেন। আমাদের এই সাংস্কৃতিক কর্মতৎপরতার ফলে ‘৫৪ সালের ৯৪(ক) ধারা জারি হওয়ার পর পুলিশি গ্রেপ্তারের ভয়ে আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি। আমি আসি বগুড়ায়। আলতাফ চলে যায় বরিশাল। ওই সময়টা ছিল আলতাফের সবচেয়ে বড় দুর্দিন। নৌকায় জেলেদের সঙ্গে ওকে থাকতে হয়েছে। নৌকায় নদীর ওপর থাকতে থাকতে ওর টাইফয়েড হয়ে যায়। ওই সময় বরিশাল শহরে সত্যবাবু নামে ওর একজন শুভানুধ্যায়ী ছিলেন। তিনিই ওকে খাইয়ে, সেবা-যত্ন দিয়ে সুস্থ্য করে তোলেন। তবে একটা বিষয়ে ওই সময়টা আলতাফের খুব কাজে লেগেছিল। ও আগে খুব ভালো হারমোনিয়াম বাজাতে পারত না। ওই সময়টাতে কোত্থেকে একটা ভাঙা হারমোনিয়াম জোগার করে হারমোনিয়াম বাজানোটা খুব ভালো করে রপ্ত করে।
আলতাফ মাহমুদ যে কী পরিমাণ গণচরিত্রের অধিকারী ছিল, সে সময়কার একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করলেই বোঝা যাবে। কুমিল্লার চাঁদপুরে একটি কিষানসভায় গণসঙ্গীত গাওয়ার জন্য আমরা যাই। সভামঞ্চে গিয়ে জানতে পারলাম স্থানীয় মুসলিম লীগ গান-বাজনা ইসলামে হারাম’ বলে স্থানীয় মুসল্লিদের উত্তেজিত করেছে। গান-বাজনা করলেই ওরা সভামঞ্চ ভেঙে দেবে। সভা শেষে যথন আমরা গান গাওয়ার জন্য মঞ্চে উঠি, শুনি পেছনে অনেক লোকের চিৎকার- ‘গান-বাজনা চলবে না’ আমরা প্রত্যুত্তরে বলি, হ্যাঁ, ইসলামে যে গান-বাজনা হারাম, সে আমরা সবাই জানি। কিন্তু আমাদের গান যদি ইসলামবিরোধী হয়ে থাকে, সঙ্গে সঙ্গে বলবেন, আমরা গান বন্ধ করে দেব। আলতাফ মাইকে গিয়ে গান ধরল ‘মদিনার গুলবাগিচায় এলো বুলবুল নামের মোহাম্মদ’ গান শেষ করেই আলতাফ মাইকে জনসমাবেশে জিজ্ঞাসা রাখল, এই গান হারাম? দর্শক শ্রোতা সকলেই বলল, ‘না’ আলতাফ আবার গান ধরল, ‘আল্লাহ মেঘ দে, পানি দে, ভাত দে, কাপড় দে- বাঁচতে দে রে তুই’ গান শেষে আবার জিজ্ঞাসা রাখল হারাম কি না। একই জবাব এল সকলের কাছ থেকে। আবার গান ধরল সে ভারতীয় নঘনাট্য সংঘের গান-‘হৈই সামালো ধান হো’ শুধু আলতাফ হেই সামালোর আগে ‘আল্লাহ’ বলেই মূল গানে ফিরে গেল প্রতিবার। এমনি করে সাত-আটটি গণসঙ্গীত গাওয়া হলো শুধু ফাঁকে ফাঁকে ‘আল্লাহ’ বলেই মূল গানে ফিরে যাওয়ার কৌশল অবলম্বন করে। ফলে যে সমাবেশ গান করতে দিতে চায়নি, সেই সমাবেশ থেকেই একের পর এক গানের অনুরোধ আসতে লাগল। স্থানীয় মুসলিম লীগের ষড়যন্ত্র সাময়িকভাবে বানচাল হয়ে গেল। সভায় যারা সংগঠক ছিলেন, তারা সেদিন অনুষ্ঠান শেসে কী সমাদর আর প্রশংসাই যে আমাদের করেছিলেন, তা আজও মনে হয়।আদর্শের প্রতি, দেশপ্রেমের প্রতি আমরা ওই সময় এতই নিষ্ঠানবান ছিলাম যে, ১৮-২০ মাইল রাস্তা পায়ে হেঁটে কাঁধে হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে কোনো কিষানসভার অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ আমাদের অহরহ ঘটত। দেশের প্রতি, মানুষের প্রতি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত গভীর মমত্ববোধ ছিল বলেই আলতাফ সশস্ত্র যুদ্ধেও অংশগ্রহন করতে পেরেছিল।প্রসঙ্গক্রমে এখানে উল্লেখ্য যে, ১৯৫০-এ ‘ধূমকেতু’ নামে যে সংগঠন গড়ে তুলেছিলাম, কিছুদিন পর সেই সংগঠন ‘পূর্ব পাকিস্তান শিল্পী সংসদ’ ও পরবর্তী সময়ে আরো অনেক শিল্পী-সাহিত্যিক নিয়ে আরো বড় পরিসরে ‘পাকিস্তান গণানট্য সংঘ’ হিসেবে আত্নপ্রকাশ করে। ‘৫৪ সালের ৯৪(ক) ধারা জারির কয়েক মাস ব্যতীত ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত পূর্ণ গতিতে আমাদের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড অব্যাহত ছিল।
১৯৫৫ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক জগতের প্রতিনিধি হয়ে আলতাফকে ভিয়েনা কনফারেন্সে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য মনোনীত করা হয় এবং ওর নামে ভিয়েনা থেকে টিকিট আসে। ওর নামে পাসপোর্ট এবং ভিসা করা হয়। আলতাফ করাচি যায়। কিন্তু পরে চিঠির মাধ্যমে ও আমাকে জানায় যে ওর পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে এবং ওর পরিবর্তে নাম বলব না, একজন বিশেষ রাজনৈতিক ব্যক্তি ওর টিকিটে ভিয়েনা কনফারেন্সে যায়।১৯৫৫ সালে আলতাফ করাচিতে যায় এবং ভিয়েনায় যেতে না পেরে কিছু তরুণ বাঙালি ছাত্রের সহযোগিতায় সেখানে থেকে যায়। আমি ‘৫৬ সালে করাচিতে সরকারি চাকরি নিয়ে যাই। তখন আলতাফ মডেল ক্যাপিটাল এরিয়াতে এক বাঙালি পরিবারের সঙ্গে থাকত।
তখন করাচিতে ‘ইস্ট পাকিস্তান অ্যাসোসিয়েশন’ নামে এক সংগঠনের সহযোগিতায় একটি বাড়ি পাই এবং আমি আর আলতাফ একসঙ্গে আবার কাজ শুরু করি। তখন লালুঘাটের রিকশাওয়ালাদের নিয়ে ‘রিকশা অ্যাসোসিয়েশন’, ‘কুলি অ্যাসোসিয়েশন’ প্রভৃতি সংগঠন করি এবং আমরা সব বাঙালিকে একজোট করতে সক্ষম হই আমাদের সংগঠনের মাধ্যমে, যার নাম ছিল ‘করাচি কালচারাল অ্যাসোসিয়েশন’ ডক্টর হোসেন আলী, জি এস চৌধুরী এদের সহযোগিতায় এই সংগঠন গড়ে তুলি। তবে তখন সেই সংগঠনে আমরা গণসঙ্গীত কমই গাইতাম। আমরা মূলত নজরুলসঙ্গীত, পল্লীগীতি ইত্যাদি গাইতাম এবং বিভিন্ন দূর্যোগের ওপর ভিত্তি করে নৃত্যনাট্য ও গীতিনাট্যের পরিকল্পনা করতাম। তখন ‘সাইক্লোন’ নৃত্যনাট্য করে আমরা যথেষ্ট সুনাম অর্জন করি। সেই নৃত্যনাট্যে শেখ লুতফর রহমানও গান গেয়েছেন। তখন লুতফর ভাই করাচি রেডিওতে চাকুরি করতেন এবং নজরুল পরিষদের শিক্ষক ছিলেন। পরে আলতাফ ঢাকায় চলে আসে এবং কিছুকাল ঢাকায় অবস্থান করার পর আবার ১৯৬৩-তে ‘জাগো হুয়া সাবেরা’ ছবিতে প্লে-ব্যাক করার জন্য করাচিতে যায়। এরপরে তানহা ছবিতে মিউজিক করার জন্য আবার ঢাকায় আসে এবং মুক্তিযুদ্ধে নিহত হওয়ার আগে পর্যন্ত ঢাকাতেই অবস্থান করে।করাচিতে থাকাকালীনই চলচ্চিত্রে আলতাফের অভিষেক ঘটে এবং এই কাজের সুত্রেই তিমির বরণের সঙ্গে তার পরিচয়। ওই সময় সে তিমির বরণ এবং দেবু ভট্টাচার্যের কাছ থেকে অর্কেস্ট্রেশন সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করে।১৯৬৪ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত আলতাফ চলচ্চিত্রের সঙ্গে জড়িত ছিল। এ সময় বিভিন্ন ছবিতে সে সঙ্গীত পরিচালকের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল এবং যথেষ্ট সুনামও অর্জন করেছিল। তার সঙ্গীত পরিচালনায় প্রথম ছবি বেবি ইসলামের ‘তানহা’।
আলাতফের সঙ্গে আমার শেষ সাক্ষাৎ হয় ২৫ মার্চ কাকরাইলে চলচ্চিত্র পরিচালকদের একটা সভায়। সেখানে জহির রায়হান, খান আতা আমরা সবাই ছিলাম। তারপর আর দেখা হয়নি। ২৫ শে মার্চের পর আমি চলে যাই ঢাকার বাইরে। সেখানে বসেই শুনি আলতাফকে আর্মিরা ধরে নিয়ে গেছে।
আলতাফ সম্পর্কে স্মৃতিকথা বলা এই ছোট পরিসরে আমার পক্ষে খুবই দুরূহ। আলতাফ মাহমুদ সম্পর্কিত কথা দেশবাসীর কাছে প্রকাশে যারা উদ্যোগী হয়েছেন, তাদের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা আর ভালোবাস জানিয়ে আমার এই স্মৃতিকথা তাদের হাতে তুলে দিলাম।