দোতলা লাল টিনের বাড়ি। উঁচু পাকা ভিটে। পেছনে পুকুর। অদূরে ফকিরবাড়ি মসজিদ। সামনে ছোট্ট উঠোন। তার ওপাশে লম্বা টানা সুদৃশ্য একতলা টিনের ঘর। তাও লাল রঙের। একতলা ওই লাল টিনের ঘরের গা ঘেঁষে চলে গেছে ফকিরবাড়ি রোড। একতলা ঘরটির দক্ষিণ পাশ দিয়ে ভেতরবাড়ি যাওয়ার পথ। উঠোনের ডান পাশে আরেকটি একতলা টিনের ঘর। বাম পাশে টিনের বেড়া।
নাজেম মিয়ার বাসা। কিন্তু একসময় ওটি তারচেয়েও বেশি পরিচিত হলো ঝিলুদের বাসা হিসেবে। উঠোনের ঠিক মাঝখানে একটি কাঁঠাল গাছ। তার গায়ে ছুরি দিয়ে খোদাই করা ছিল-‘ঝিলু দি গ্রেট’, শুধু সেই কাঁঠাল গাছেই নয়,বাসার এখানে-সেখানে দেয়ালেও ঝিলু তার এই গ্রেটনেসের ঘোষণা লিখে রেখেছিল। তখন বয়স আর কত হবে, ঝিলু তখন পঞ্চম কি ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র। আজ থেকে সাঁইত্রিশ-আটত্রিশ বছর আগের কথা। খুব সুন্দর ছকি আঁকত ঝিলু। ছবি আঁকা ছিল তার নেশা। কিন্তু সবচেয়ে বড় নেশা ছিল গান গাওয়া। দিন-রাত প্রায় সারাক্ষণ ঠোঁটে লেগে থাকত গানের কলি। মুম্বাই ও কলকাতার ছায়াছবির হিট গানগুলো নির্ভুল সুরে নিখাদ দরদে গাইত ঝিলু।
তখন সে ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র। ঘুম থেকে উঠার পর প্রাতরাশ সেরে তার প্রথমে রুটিন ছিল কোরআন তেলাওয়াত। বরিশাল হালিমা খাতুন গার্লস স্কুলের কারি সাহেবকে তার বাবা এই তেলাওয়াত শিক্ষাদানের জন্য নিয়োগ করেছিলেন। অত্যন্ত সুকণ্ঠ ছিলেন কারি সাহেব। নানা ধরনের এলহান তার কণ্ঠে অত্যন্ত মোহন স্বাচ্ছন্দ্যে খেলা করত। ছাত্রটিও তার কাছে ছিল বেশ প্রিয়। সকলকে বলতেন, অনেক ‘তালবিলিম’ (তালবে ইল্ম) আমি দেখেছি। কতজনই তো আমার কাছে কোরআন শরিফ পড়ে, কতজনকেই তো তেলাওয়াত শেখালাম, কিন্তু ঝিলুর মতো এমনটি আর পাইনি। মাশাআল্লাহ, এত সুন্দর দরাজ গলা, এত সুন্দর এলহানের কাজ, চেষ্টা করলে ও একজন বড় কারি হতে পারবে।
রোজ সকালের এ রুটিনের কোনো নড়চড় নেই। এর মধ্যে শুক্রবার ছিল বিশেষ দিন। এ দিন ঝিলুর তেলাওয়াত শেষ হতেই কারি সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, বারে বা ঝিলু, সোবহান আল্লাহ।আজকে তোর তেলাওয়াত খুব ভালো হয়েছে রে। কিন্তু তোকে তো এমনি কোনো এলহান আমি শিখাইনি। কোত্থেকে শিখলি? ঝিলু তখন মিটিমিটি হাসছে। কোনো জবাব দিচ্ছে না। অনেকক্ষণ জিজ্ঞাসাবাদের পর সে যা জবাব দিল তা শুনে কারি সাহেব থ। সে আমলের একটি বিখ্যাত গজলের নাম করে ঝিলু বলল, হুজুর, আমি ওই গজলের সুরে পড়েছি। ভালো হয়নি? জবাব এল মুখে নয়, হাতে। ঝিলুর গালে ঠাস করে এক চড় কশালেন কারি সাহেব। তারপর ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। রাগে মুখ-চোখ তার লাল হয়ে গেছে। বাসার সবাই যখন ব্যাপারটি শুনল তখন আরেক দফা ঝড় বয়ে গেল। ঝিলু নির্বিকার। সে বলল, আমাকে খামোকা গাল মন্দ করছ কেন? আমি অন্যায়টা করলাম কোথায় তাই বলো? সেই ঝড়েরর দাপট থেকে কারি সাহেবই আবার ঝিলুকে রক্ষা করলেন। বিকেলে তিনি নিজে থেকেই বাসায় এলেন। ঝিলুর বাবাকে বললেন, ওকে মাফ করে দিন। কোন গজলের সুরে ও আজ কোরআন তেলাওয়াত করেছে সে কথা এখন আর আমার মনে জাগছে না। যে নির্ভুল উচ্চারণ আর সুন্দর সুরে ও তেলাওয়াত করেছে তার রেশ এখনো আমার কানে বাজছে। সোবহান আল্লাহ, বড় সুন্দর! তবে লক্ষ রাখবেন, গানবাজনার পাগলামি বাতিকে যেন ওর সবকিছু নষ্ট না হয়ে যায়। সারা দিনই তো শুনি গান গায়। সেদিন শুনলাম রাতের বেলা রাস্তার পাশে বসে ও গান গাইছে।
রাস্তার পাশে ঝিলুদের বাসার সেই টানা লম্বা একতলা লাল ঘরটির মাঝবরাবর ছিল শানবাঁধানো দুটি বেঞ্চি। বাবা যখন দেশের বাড়িতে যেতেন তখন ঝিলু রাস্তার পাশের ওই বেঞ্চিতে বসে রাতের বেলা ঘন্টার পর ঘন্টা আপন মনে গান গাইত। রাতের বেলার ওই বেঞ্চি দুটি বোধ করি তাকে কোনো এক মোহন মায়ায় আকৃষ্ট করেছিল। যত বয়স বেড়েছে তত তার সংকোচন ও ভয় কেটেছে, রাতে এই পথের পাশে সঙ্গীত সাধনায় কোনো ছেদ পড়েনি। এটা ছিল ঝিলুর শিল্পীজীবনের উদ্গামকাল। বোধ হয় ভুল বললাম। উদ্গামপর্ব শেষে ওটা ছিল কৈশোরিক জটিলতা, ভীতি আর উদগ্র আগ্রহের টানাপড়েন থেকে উত্তরণের প্রথম ক্রান্তিকাল। একমাথা ঝাঁকড়া চুল, বুদ্ধিদীপ্ত চোখ, চালচলনে কখনো উদাসী বাউল, কখনো নিস্পৃহ নির্লিপ্ততায় সমাহিত, কখনো দুরন্ত ঝড়। অসম্ভব ভাবপ্রবণ, কিন্তু সঙ্গীত সাধনার জন্য সেদিন তিরস্কারেও নিরুৎসাহ নয়। আত্নীয়-স্বজনরা আফসোস করে বলতেন, ঝিলু একদম বখে যাচ্ছে। কেউ কেউ বলতেন, গান আর ছবি আঁকা- এই করে করে নাজেম মিয়ার ছেলেটি গোল্লায় যাচ্ছে। ঝিলু এত ভালো ছেলে, কিন্তু এই গানবাজনার প্রতি এমন নেশা, এরপর তো যাবে অস্থানে-কুস্থানে। ছেলের আচরণে নাজেম মিয়াও বিলক্ষণ বিচলিত ছিলেন। ছেলেকে তিনি স্বভাবতই খুব ভালোবাসতেন, কিন্তু শ্নেহান্ধ পিতা তিনি ছিলেন না। তা ছাড়া তার নিজের ছকেবাঁধা চিন্তাধারা এবং মূল্যবোধের গন্ডির বাইরে ছেলে চলে যাক, পরিবারের ধ্যান-ধারণার বাইরে দলছুট হয়ে ঘুরে বেড়াক, তা তিনি বরদাশত করতে নারাজ ছিলেন। শিল্প ও সঙ্গীতানুরাগ তার কতটুকু ছিল তার পরিমাপ কেউ কোনোদিন করেনি; তবে শুনেছি তিনি চাইতেন ছেলের গান-বাজনার শখ থাকলে আপত্তি নেই, কিন্তু লেখাপড়া শেষ করে আর কিছু না হোক একজন ইঞ্জিনিয়ার হবে। ছেলেকে তিনি বকাঝকা করতে প্রায়ই। বলতেন, ‘বেডার কাণ্ড দেহো। ওরে আবাইগ্যা। গাছডার গায়ে তো লেইখা রাখছস-‘ঝিলু দা গ্রেট’ গান গাইয়া কি আর গ্রেট হইতে পারবি? নাম তো লেখাবি গিয়া যাত্রা বয়াতির দলে। ভাবপ্রবণ ঝিলু এতে খুব দুঃখ পেত। কিন্তু কোনো জবাব দিত না। বাবার এই তিরস্কারের সামনে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকত। কখনো মা (আপন মা নন) এসে ছেলেকে ক্ষুদ্ধ পিতার সামনে থেকে সরিয়ে নিয়ে যেতেন। ছেলেবেলা থেকে বাসার চেয়ে পথের আকর্ষণই ছিল ঝিলুর কাছে লোভনীয়। গানের ভুবনের দামাল পাখির চোখে সে সময় নীড়ের চেয়ে বন্ধনহীন আকাশ নিবিড় ছায়া ফেলত। শুনেছি ঘরের প্রতি তার একমাত্র আকর্ষণ ছিল তার দুই মায়ের জন্য-একজন তার আপন মা, যিনি ছিলেন অপ্রকৃতিস্থ; অপরজন তার বিমাতা, যাকে সে ভাবত ছোট মা এবং যার কাছে সে লালিত-পালিত হয়েছে। বহিমূর্খী এই উড়াল দেওয়া মনের জন্যই বোধ করি স্কুলজীবনে ঝিলু একবার বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এসব পরের কথা। এর আগের অনেক কথা আছে; কথা আছে তার পরের। সেদিনের তারা সবাই কি জানতেন, বরিশাল শহরের ফকিরবাড়ি রোডের লাল টিনের দোতলা বাড়ির নাজেম মিয়ার ছেলে ঝিলু হবে একদিন এ দেশের জনগণের প্রিয়তম স্বজন, গণসঙ্গীতের অমর শিল্পী আলতাফ মাহমুদ?
বাবার পুরো নাম, এ এেম নাজেম আলী। সাকিন বরিশাল জেলার মুলাদি থানার পাতারচর গ্রাম। হাল সাকিন ছিল বরিশাল শহরের ফকিরবাড়ি রোড। নাজেম আলী সাহেব কর্মজীবনে প্রথমে ছিলেন আদালতের পেশকার। পরে তিনি জেলা বোর্ডের চাকরি নেন। তিনি জেলা বোর্ডের সেক্রেটারি ছিলেন। সঙ্গতিপন্ন সচ্ছল মানুষ ছিলেন নাজেম মিয়া। সেই সঙ্গে তার ছিল তেজস্বী পৌরুষ। নাজেম মিয়ার ছিল চার স্ত্রী। আলতাফ মাহমুদ ওরফে ঝিলু ছিল তার তৃতীয় স্ত্রীর সন্তান। এ পক্ষে তার অন্য কোনো সন্তান ছিল না। অন্যান্য পক্ষে ঝিলুর আরো ভাইবোন ছিল। ঝিলুর মা পরবর্তীকালে অপ্রকৃতিস্থ হয়ে যান। ঝিলুর ছোট মা অর্থাৎ নাজেম মিয়ার চতুর্থ স্ত্রী ছিলেন নিঃসন্তান। প্রধানত বরিশালের বাসায়ই তিনি থাকতেন। ঝিলুকে তিনি আপন সন্তানের মতো লালন-পালন করেছেন। ঝিলু যখন ছোট্ট তখন নাজেম মিয়া এক মিথ্যে মামলায় জড়িয়ে পড়েন। অনেক ঝক্কি পোহানোর পর তিনি বেকসুর খালাস পান। নাজেম মিয়া এমনিতেই ছিলেন বেশ ধর্মভীরু এবং একটু গৌঁড় ধরনের লোক। শুনেছি, মামলা থেকে অব্যাহতি লাভের পর তিনি শর্ষিনার মরহুম পীর সাহেবের মুরিদ হন।
ঝিলু ছিল বরিশাল জিলা স্কুলের ছাত্র। মেধাবী এবং বুদ্ধিমান হিসেবে শিক্ষকদের কাছে তার সুনাম ছিল। সেই সঙ্গে শিক্ষকরা এ জন্য ও দুঃখ করতেন যে ঝিলুর পড়াশোনার প্রতি তেমন আগ্রহ নেই, যতটা রয়েছে ছবি আঁকা আর গান গাওয়ার প্রতি। সে সময় জিলা স্কুলে সপ্তাহের একটি দিন ছাত্রদের ‘অ্যাসেম্বলি’ বসত। তাতে গান গেয়ে ঝিলু অনুষ্ঠানকে করে তুলত সরগরম। আবার স্কুলের বার্ষিক মিলাদ মাহফিলে কোরআন তেলাওয়াতে ঝিলু সবাইকে রাখত মুগ্ধ করে। কোনো অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে তোরণ নির্মাণ ও সাজসজ্জার প্রয়োজন রয়েছে, সেখানেও ছিল খুদে ঝিলুর একচ্ছত্র আধিপত্য।
ফকিরবাড়ি, কালীবাড়ি এবং সংলগ্ন অন্যান্য মহল্লার ছেলেমেয়েদের কাছে সেই স্কুলজীবনেই ঝিলু ছিল রূপকথার নায়কের মতো। অনেক পরিবারের অভিভাবক ঝিলুর ব্যাপারে শঙ্কিত ছিলেন- ঝিলুর সংসর্গে পড়ে পাছে তাদের ছেলেমেয়েরা আবার উচ্চণ্নে না যায়; গানবাজনার নেশায় সওয়ার হয়ে আবার বোহেমিয়ান না হয়ে পড়ে। কিন্তু এই অভিভাবকরাই আবার বলতেন, ঝিলুর মতো এমন কর্মনিষ্ঠ ছেলে হয় না, সে যখন যে কাজে হাত দেবে সফল না হওয়া পর্যন্ত তাতে লেগে থাকবে। ঝিলুকে ডেকে বলতেন তাদের কেউ কেউ, বসো বাবা, একটা গান শোনাও।
ঝিলু সেই ছেলেবেলা থেকেই ছিল অনেকটা ধরাছোঁয়ার বাইরে। এই তো এত কাছে রয়েছে ঝিলু অথচ সে যেন কোন সুদূরে নিবদ্ধ; আপন করে পেয়েও তাকে যেন সব সময় বোঝা যায় না; দুরন্ত প্রাণচঞ্চল ছেলেটির বুকের ভেতর কোথায় যেন এক উদাসী বাউল বাসা বেঁধে রয়েছে; কখনো মনে হয় উদাসী আপনভোলার মধ্যে অন্তঃসলিলা ধারার মধ্যে বয়ে যাচ্ছে সবকিছু উজার করে পাওয়ার আর্তি; সে যেন কেবল পালিয়ে বেড়ায় দৃষ্টি এড়ায় ডাক দিয়ে যায় ইঙ্গিতে- ঝিলু সম্পর্কে এ ধরনের মন্তব্য করেছেন তার আজীবনের ঘনিষ্ঠজনদের একজন। এই যার ছেলেবেলার পরিচয়, সে রূপকথার পঙ্খীরাজ ছোটানো কিশোর রাজকুমারের চেয়ে কম কিসে!
আবার সেই গানের কথায় ফিরে যাচ্ছি। স্কুলজীবনে ঝিলুর মুখে বেশির ভাগ সময়ই শোনা যেত মুম্বাই ও কলকাতার ছায়াছবির হিট গান। খেমচাঁদ প্রকাশ, নওশাদ, রাইচাঁদ বড়াল, অনিল বিশ্বাস, শঙ্খর জয়কিশন প্রমূখ সঙ্গীত পরিচালকের সুরারোপিত হিন্দি ও বাংলা গান নির্ভুল সুরে হুবহু অনুকরণ করে গাইত ঝিলু। বরিশাল ফকিরবাড়ির কাজী বাহাউদ্দিন আহমেদ (তৎকালীন বিশিষ্ট ছাত্রনেতা ও সংস্কৃতিসেবী; বর্তমান পাসপোর্ট বিভাগের মহাপরিচালক) স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আমাকে বলেছিলেন কিশোর ঝিলুর সেদিনের কথা। বাহাউদ্দীন সাহেব নিজেও তখন সঙ্গীতচর্চা করতেন। ঝিলুকে ডেকে তিনি একদিন বললেন, দিনরাত তো গান গাইছস। খুব ভালো লাগে? ঝিলু বলল, হ্যাঁ। ভালো না লাগলে কেউ গায়! আমার ভালো লাগলে গান গাই, আর যখন খারাপ লাগে তখনো ভালো লাগার জন্যই গাই। ঝিলুর জবাব শুনে বাহাউদ্দীন সাহেব হতবাক। ঝিলুর বয়সী পাড়ার অন্য ছেলেমেয়েরা ভয়ে অথবা সমীহ করে তার ধারে-কাছে বেশি ঘেঁষত না। কথা বলা তো দূরের কথা। খানিক্ষণ চুপ করে থেকে বাহাউদ্দীন সাহেব আবার জিজ্ঞেস করলেন, কিন্তু সারাদিন গান আর ছবি আকা নিয়ে এত মেতে থাকা কি ভালো? তোর বাবা তোর জন্য কত চিন্তা করেন জানিস? এত কেন?ঝিলু মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল। বলল, তোতা মামা (বাহাউদ্দিন সাহেবের ডাক নাম), আমি কি খারাপ ছেলে? আমি খারাপ ছেলে নই, তোতা মামা। দেখবেন আমি একদিন ‘ঝিলু দা গ্রেট’ হব। আর সব কেন’র কি জবাব আছে?ঝিলু চলে গেল। বাহাউদ্দীন সাহেব তখন ভাবছেন ইলিস্টিক দেওয়া কালো হাফপ্যান্ট পরা এই ছেলেটি কে? ঝিলু না অন্য কেউ?
দিনকয়েক পরের কথা। দুপুর বেলা সেদিন ঝিলুর স্কুল ছুটি। হনহন করে পায়ে হেটে কোথায় যেন যাচ্ছিল ঝিলু। সদর রোডে বাহাউদ্দিন সাহেবের সঙ্গে দেখা। ঝিলু পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিল। বাহাউদ্দিন সাহেব ডাকলেন, কোথায় যাচ্ছিস এই দুপুর রোদে? ঝিলু জবাব দিল, নদীর পাড়ে। অবাক হলেন বাহাউদ্দিন সাহেব। বললেন, চল বাসায় চল। গান শোনাবিখন। ঝিলু দারুন খুশি। বলল, চলুন তোতা মামা। কোন গান শুনবেন। বাহাউদ্দিন সাহেব বললেন, আমি একটা গান গাইব। তুই শুনে তারপর গেয়ে শোনাবি। বাসায় এসে বাহাউদ্দিন সাহেব খুরশিদের গাওয়া একটি গান ধরলেন। গানের প্রথম কটি কলি ছিল পহলে যো মোহাব্বত সে ইনকার কিয়া হোতা। দুবার গানটি গেয়ে শোনালেন বাহাউদ্দিন সাহেব। পরেরবার গেয়ে শোনাল ঝিলু। এক পর্যায়ে সে বলল, মামা, আমি যদি এ জায়গাটি এমনভাবে গাই? তারপর সে একটি কলিতে সুন্দর তানের কাজ করে দেখাল। বাহাউদ্দিন সাহেব বললেন, তোর ক্ল্যাসিক্যালের ভালো গলা। একে নষ্ট করিস না।
আরেক দিনের কথা। বাসার পেছনে পুকুরে গোসল করছিলেন বাহাউদ্দিন সাহেব। হঠাৎ ঝপাং শব্দ শুনতে পেয়ে দেখতে পেলেন, কালো হাফপ্যান্ট পরা ঝিলু পুকুরে ঝাপিয়ে পড়েছে। ঝিলু বলল, মামা, আমিও সাতার কাটব। পুকুরে ভাসছিল একটি লম্বা মোটা বররা বাঁশ। তার ওপর চেপে বসে ঝিলু বলল, মামা, আমি গান গাইব। তারপর গলা ছেড়ে গান ধরল। নজরুলের পদ্মার ঢেউরে/ আমার শূন্য হৃদয় নিয়ে যা যারে। গানের সঙ্গে সঙ্গে পরামানন্দে দুলছে সে। দেখতে দেখতে পুকুরপাড়ে লোক জমে গেল। গান থামিয়ে হঠাৎ সাতরে পাড়ে উঠে চম্পট দিল ঝিলু।
১৯৪৫-৪৬ সালে বরিশাল ফকিরবাড়ি রোডে একটি সাহিত্য সাংস্কৃতিক সমাজকল্যান সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। নাম ছিল তরুন মহফিল। প্রতিষ্ঠানটির উৎসাহী কর্মীরা একটি সুন্দর পাঠাগার গড়ে তুললেন। বই সংগ্রহ অভিযানেও ঝিলু কারো চেয়ে কম ছিল না। আবার দেখা গেল পাঠাগারের নিবিষ্ট পাঠকদের মধ্যেও ঝিলু অগ্রগন্য। তরুন মহফিলকে কেন্দ্র করে ঝিলু এক নতুন উদ্যম নিয়ে কাজে ঝাপিয়ে পড়ল। মহল্লার তার বয়সী ছেলেমেয়েদের জুটিয়ে সে ছবি আঁকার ক্লাস শুরু করে দিল। এ ছাড়া তার গানের কিছু শিল্পী-সাগরেদও জুটে গেল। পাকিস্তান আন্দোলনের তখন শেষ পর্যায়ের সংগ্রাম চলছে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সপক্ষে চূড়ান্ত জনমত গড়ে তোলার জন্য শহরের বিভিন্ন স্থানে স্কোয়াড গঠিত হয়েছে। স্কোয়াডের কর্মীদের কেউ কেউ সভা-সমাবেশ সংগঠনের কাজে সহায়তা করে। কেউ কেউ সাহায্য করে মঞ্চ তোরণ নির্মাণে। আর কিছু কর্মীকে নিয়ে গঠিত হয়েছিল কন্ঠশিল্পীদের দল। স্কুলছাত্র কিশোর ঝিলু ছিল এই গাইয়েদের মধ্যে সবচেয়ে চিহ্নিত ব্যক্তি। ঝিলুর পরিবর্তে তখন সে তার আসল নাম আলতাফ মাহমুদে বেশি পরিচিত। এই শিল্পীরা তখন সভা সমাবেশে ইসমাইল হোসেন সিরাজী, কাজী নজরুল ইসলাম প্রমূখের গান গাইতেন। সে আমলের একটি বিখ্যাত গান ছিল ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ বরিশাল শহরে আলতাফ মাহমুদ এই গানটিকে অধিকতর জনপ্রিয় করে তুলেছিল। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দিনটিতে বরিশাল শহরে যে সব বিজয়তোরণ নির্মিত হয়েছিল তার বেশ কটির শিল্পনির্দেশক ছিল আলতাফ। ‘৪৭ সালের ১৩ আগস্ট রাত ১২ টা ১ মিনিট তরুণ মহফিলের পক্ষ থেকে স্বাধীনতা বরণের জন্য যে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল তার প্রথম গানের কণ্ঠশিল্পী ছিল আলতাফ মাহমুদ।
১৯৪৮ সালে কোলকাতা বোর্ডের পরীক্ষায় বরিশাল জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করলেন আলতাফ মাহমুদ। ছেলের পরীক্ষার ফলে নাজেম মিয়া দারুন ক্ষুদ্ধ হলেন। তিনি আশা করেছিলেন, আলতাফ অন্তত লেটারসহ প্রথম বিভাগে পাস করবে। পরীক্ষার ফল জানা গিয়েছিল বিকেলবেলায়। তারপর থেকে বাসায় বইছে ঝড়ো হাওয়া। রাত ৯ টার দিকে দেখা গেল, বেলপার্কের কাছে কীর্তনখোলা নদীতীরের রাস্তার পাশে এক বেঞ্চিতে বসে আলতাফ মাহমুদ গাইছেন সায়গলের গাওয়া একটি বিখ্যাত গজল-দুনিয়া মে হু দুনিয়াকি তলবগার নহি হু/বাজার সে গুজরা হুয়া খরিদ্দার নহি হু’ সঙ্গে তার এক বন্ধু।
১৯৪৮ সালে ম্যাট্রিক পাসের পর আলতাফ মাহমুদের জীবন এক নতুন খাতে বইতে শুরু করে। ১৯৪৮ সাল থেকে আলতাফ দেশের রাজনৈতিক আন্দোলন সম্পর্কে অধিকতর আগ্রহশীল হয়ে ওঠেন। বামপন্থি প্রগতিবাদী রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের সঙ্গে তার যোগাযোগ স্থাপিত হয় । ম্যাট্রিক পাসের পর তিনি কিছুদিন বরিশাল ব্রজমোহন কলেজে আইএসসি ক্লাসে পড়াশোনা করেন। কিছুদিন বরিশালে শ্রী সুরেন রায়ের কাছে বেহালাও শেখেন । সুরেনবাবু তার এই প্রিয় ছাত্রকে একটি বেহালাও উপহার দিয়েছিলেন।
‘৪৮ সাল থেকে আলতাফ মাহমুদের শিল্পীজীবনে আরেকটি লক্ষণীয় পরিবর্তন সূচিত হয় । তিনি ‘গণসঙ্গীতে’র দিকে ঝুঁকে পড়েন। এ সময়ের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ১৯৪৯ সালে বরিশাল অশ্বিনীকুমার টাউন হলে পাটচাষী ও নদী-শিকস্তি কৃষকদের দাবিদাওয়া নিয়ে একটি জনসভা । সভার এক পর্যায়ে ছিল গণসঙ্গীত। পরিবেশন করেন আলতাফ মাহমুদ। সেদিনের জনসভায় তিনি গেয়েছিলেন তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির পরিচালিত ভারতের গণনাট্য সংঘের একটি জনপ্রিয় সঙ্গীত ‘ম্যায় ভূখা হুঁ’ বরিশাল শহরে জনসভায় পরিবেশিত এই গান আলতাফ মাহমুদকে যেন রাতারাতি এক নতুন পরিচিতির আলোকে চিহ্নিত করল। ১৯৫০ সালে আলতাফ মাহমুদ পাড়ি জমালেন ঢাকার পথে।