ঝড়ের পাখির অসমাপ্ত গান – মতিউর রহমান

আমাদের আলতাফ ভাই, শহীদ আলতাফ মাহমুদের কথা মনে পড়ে না, এমন দিন যায় না। যেকোনো গান বা লড়াইয়ের কথা কিংবা একত্তরের মুক্তিযুদ্ধের কথা মনে হলেই তাঁর কথা ভাবি। আর তখনই মন বিষাদে ভরে যায়। তখন বারবার মনে ভিড় জমায় কত-না স্মৃতি, দূরস্মৃতি। ষাট দশকের সেই উত্তাল দিনগুলোতে আমাদের গানের, সংস্কৃতির, সংগ্রামের এক বড় প্রেরণা ছিলেন শহীদ আলতাফ মাহমুদ। আর, এটা ভেবে আরো কষ্ট পাই, আমরা সকলে মিলে তাকে কতটুকু মনে রেখেছি। আমাদের বহু ব্যর্থতার মধ্যে এ এক বড় ব্যর্থতা!
‘আমি এক ক্ষ্যাপা বাউল’
একুশে ফেব্রুয়ারী, মহান একুশের মর্মবানী, যার সুরে যার কন্ঠে অমরত্ব লাভ করেছে, যা অনাদি ভবিষ্যতেও বাঙালিকে উদ্ধুদ্ধ করবে, তিনি হলেন আমাদের আলতাফ ভাই, শহীদ আলতাফ মাহমুদ। তার কন্ঠে ছিল দুরন্ত এক ঝড়, ক্ষ্যাপা বুনো, যা জনসমুদ্রে তরঙ্গমালা সৃষ্টি করে আছড়ে পড়ত শ্রোতার মনের গহিন গভীরে। যারা তাকে কাছে থেকে দেখেছেন, গান শুনেছেন, তাদের পক্ষে ‘আমি এক ক্ষ্যাপা বাউল’ গণশিল্পী আলতাফ মাহমুদকে ভোলা কি সম্ভব?
আলতাফ মাহমুদের গান প্রথম শুনেছি, সে কোন কালের কথা, ‘৫৫ বা ‘৫৬ সালে, আরমানিটোলা মাঠে, ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করিলি রে বাঙালি/তোরা ঢাকা শহর রক্তে ভাসাইলি’- এ গান তার কন্ঠে পেয়েছিল অনিন্দ্য এক মহান রূপ। পরে এ গান শুনেছি কাজী আনোয়ার হোসেন, রথীন্দ্রনাথ রায়ের কন্ঠে। কিন্তু আলতাফ মাহমুদের গলায় সে গান অতকুলনীয়। একইভাবে বলা চলে, যে গানই তিনি গেয়েছেন একবার, তা অন্যের কন্ঠে সে রকম আর হয়নি, তেমন ভালো লাগেনি। গানের কথা, সুর, উদাত্ত কণ্ঠ আর তাঁর মুদিত আঁখি মিলে যে পরিবেশ সৃষ্টি হতো, এমনটা আর কারো কাছ থেকে পাইনি। তেমন আর হয় না। মনে পড়ে, তিনি ‘আমাদের নানান মতে নানান দলে দলাদলি’ গানের এক পর্যায়ে এসে চোখ বন্ধ, ঘাড় আর মাথার সঙ্গে সঙ্গে চুল ঝাঁকিয়ে ঝড় তুলে যখন একক কন্ঠে গেয়ে উঠতেন ‘যখন প্রশ্ন ওঠে যুদ্ধ কি শান্তি’, তারপর সমবেত কন্ঠে ‘শান্তি, শান্তি’ সে দৃশ্য, সে স্মৃতি কখনো মুছে যাবার নয়।
‘৬৪ সাল থেকে ‘৬৯ সাল পযন্ত একুশের অনুষ্ঠানের রিহার্সেল বা অনুষ্ঠানে ‘আমার বাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী গানটি বারবার শুনে শুনে, একবারও ক্লান্ত হইনি আমরা। আজও শুনে একইভাবে অনুপ্রাণিত হই। এই একটি গান, যাকে বলা যায় আমাদের শোনা সব গান, সব গণসঙ্গীতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, এ রকম একটি গানের সুর রচনার জন্যই একজন শিল্পী চিরদিনের জন্য অমর হয়ে থাকতে পারেন। বিগত পাঁচ/ছয় দশকের সব গান, সকল গণসঙ্গীতের সেরা গান বললে কি খুব বেশি বলা হবে? শুধু একটি নয়, একুশে ফেব্রুয়ারী নিয়ে প্রতিটি গানই তার কণ্ঠে পেয়েছে এক অপূর্ব বাঙময়। এমনকি, শিল্পী আবুদল লতিফ রচিত ও সুরারোপিত আরেটি মহৎ গান ‘ওরা আমার মুখের ভাষ কাইড়া নিতে চায়” নিৎসন্দেহে আলতাফ মাহমুদের কন্ঠে অনেক বেশি সফল হয়েছে।
১৯৬৭ সালে পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত সোভিয়েত বিপ্লব বার্ষিকীতে শহীদুল্লা কায়সার রচিহত ‘আমি মানুষের ভাই স্পারটাকাস ‘ গানটি যখন গেয়েছিলেন আলতাফ মাহমুদ, তখন তিনি নিজেই যেন হয়ে গিয়েছিলেন দাস বিদেওাহী নেতা স্পারটাকাস। আর, ১৯৬৭ সালে কবি নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার যে নতুন সুর করেছিলেন, সে রকম অন্য কারো পক্ষে সম্ভব ছিল কি? সে কবিতার কথা আর সুরের সঙ্গে মিলেমিশে গিয়ে আলতাফ মাহমুদ ও যেন মঞ্চে বিদ্রোহী হয়ে উঠতেন, শ্রোতা-দর্শকদের মধ্যে সে রকম পরিবেশই সৃষ্টি হতো। ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে অনুষ্ঠিত ছায়ানটের নজরুলের গানের অনুষ্ঠানের জন্য এই গানটির নতুন সুর তৈরি করেছিলেন। একক ও সমবেত কণ্ঠে গানটির পেরিবেশনা এখনো খুব মনে পড়ে। একই অনুষ্ঠানে গেয়েছিলেন নজরুলের আরেকটি গান আমি এক ক্ষ্যাপা বাউল, সত্যি যেন সে জগতেই চলে গিয়েছিলেন তিনি।১৯৫৩ সালে একুশে ফেব্রুয়ারির প্রথম বার্ষিকীতেই কতগুলো গানের সুর করেন আলতাফ মাহমুদ, যেগুলো অমরত্ব লাভ করল। ভাষা আন্দোলন আর ভাষা শহীদের উদ্দেশে নিবেদিত সেসব গানের সংগ্রামী প্রত্যয় আজও আমাদের উজ্জীবিত করে। সে সময়েই আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী রচিত আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী কবিতায় নতুন করে সুর দেন। আর, সে গানটি প্রায় পাঁচ দশক ধরে বাঙালির মুক্তিসংগ্রামে পতাকা হিসেবে সামনে রয়েছে। শোক, ঘৃণা, প্রতিরোধের আগুন রয়েছে সে গানের কথা আর সুরে। প্রতিবছরের ফেব্রুয়ারী মাস জুড়ে এ গান আমাদের হৃদয়-মনকে মথিত করে, ব্যথিত করে, আবার প্রতিবাদে প্রজ্বলিত করে।
সারা জীবনই থেকেছেন আন্দোলনে, সংগ্রামে
আমরা জানি, ১৯৪৮ সাল থেকেই গণ সঙ্গীতের সঙ্গে আলতাফ মাহমুদের সংযোগ। তারপর এ জগৎ থেকে তিনি কখনোই সরে যাননি। পেশা হিসেবে নয়, একজন সচেতন রাজনৈতিক ব্যক্তি হিসেবে গণশিল্পী আলতাফ মাহমুদ স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র আর প্রগতির সংগ্রামের যেকোনো আহ্বানে সাড়া দিয়েছেন। ১৯৫০ সালে যুবলীগের প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই একনিষ্ঠ কর্মী, গায়ক ও সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন। বায়ান্নর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে ছিলেন একজন সক্রিয় কর্মী।
বরিশাল শহরের ফকিরবাড়ী রোডে ছিল আলতাফ মাহমুদের পিত্রালয়। সেখান থেকে ১৯৪৮ সারে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ন হন। শৈশবকাল থেকে গান আর ছবি আকার প্রতি তার প্রবল আকর্ষণ ছিল। বরিশালের ব্রজমোহন কলেজে অল্পদিনের জন্য আইএসসিতে পড়াশোনা করেন। কিছুদিন কলকাতার আর্ট কলেজেও পড়াশোনা করেছিলেন। সে সময়েই বেহালাবাদন শিক্ষা শুরু করেন। তখনই গণসঙ্গীতের প্রতি তার আকর্ষণ দেখা যায়। ১৯৫০ সারে আলতাফ মাহমুদ ঢাকায় আসন। তারপর থেকে ১৯৭১ সালের আগস্ট পর্যন্ত ঘাম, শ্রম, অর্ধাহার-অনাহার আর মনপ্রান সবকিছু দিয়ে বাঙালি জাতির মুক্তির লক্ষে যে স্বাধীনতা সংগ্রাম গড়ে তুলেছিলেন, সে মহান সংগ্রামেই রক্ত ঝরল তাঁর। তিনি শহীদ হলেন। কী মহান এই আত্মোৎসর্গ! বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পর থেকে ৫৫ বা ৫৬ সালের শুরুতে করাচি যাওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি সারা বাংলাদেশে গান গেয়ে বেড়িয়েছেন। গান লিখেছেন, সুর দিয়েছেন, ছায়ানৃত্যে অংশ নিয়েছেন। এমনকি প্রয়োজনে নৃত্যেও অংশ নিয়েছেন। আমরা জানতে পারি, সে দিনগুলোতে পূর্ব পাকিস্তান শিল্পী সংসদ, যুবলীগ, যুক্তফ্রন্টের মঞ্চ বা কোনো সাহিত্য-সংস্কৃতির যে কোন সম্মেলন বা অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন দ্বিধাহীনভাবে। কোনো প্রাপ্তি নয়, মানুষকে সংঘবদ্ধ, অনুপ্রাণিত এবং সংগ্রামের মিছিলে শামিল করার লক্ষ থেকেই এসব অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন আলতাফ মাহমুদ।
‘৫৫ বা ‘৫৬ সালের কোনো এক সময়ে ভিয়েনায় আন্তর্জাতিক শান্তি সম্মেলনে অংশ নেওয়ার জন্য করাচি পর্যন্ত গিয়ে, শেষ পর্যন্ত যেতে পারেননি। তারপর কয়েক বছর, প্রায় পাঁচ-ছয় বছর করাচিতেই থেকে যান আলতাফ মাহমুদ। ‘৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বচনের সময় আলতাফ মাহমুদ তাঁর পিতার বিরুদ্ধে প্রচারাভিযানে অংশ নিয়েছেন, গান গেয়েছেন। তাঁর পিতা নাজেম আলী তাঁর পক্ষে মুলাদীতে গিয়ে ক্যানভাস করতে অনুরোধ করেছিলেন যা তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। এ রকম বিরল সংগ্রামী সতত আর সৎসাহস এখন কোথায়? এই নির্বাচনের সময় আলতাফ মাহমুদ বহু গানে সুর দিয়েছিলেন। সে গানগুলো সারা বাংলার মানুষের মনে দারুন জোয়ার সৃষ্টি করেছিল, সেসব গান হারিয়ে গেছে।’৫০ সালে যুবলীগ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর,বেশির ভাগ সময় আলতাফ মাহমুদ এই সংগঠনের অফিস ৪৩/১ যোগীনগর লেনে (মোহাম্মদ তোয়াহার বাসভবন) থাকতেন। অর্থাভাব আর কষ্টকে নিত্যসঙ্গী করে তিনি মনপ্রাণ ঢেলে দিয়েছিলেন এই সংগঠন আর সংগ্রামের কাজে।
আরো কাছ থেকে দেখা
গণশিল্পী আলতাফ মাহমুদের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয়েছিল ১৯৬৪ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির কেন্দ্রীয় অনুষ্ঠানের রিহার্সেল ও প্রস্তুতিমূলক অন্যান্য কাজের মধ্য দিয়ে। ডাকসুর উদ্যোগে কেন্দ্রীয় অনুষ্ঠানটি সে-বারই প্রথম হয়েছিল শহীদ মিনারে। সমগ্র অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেছিলেন আলতাফ মাহমুদ। সে সময়ে ডাকসু নেতৃত্ব ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের হাতে। সে সুযোগে তখন আমাদের সব সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের মূল কর্মী সাইফউদ্দিন আহমেদ মানিক একুশে ফেব্রম্নয়ারী অনুষ্ঠানের মূল সংগঠক হিসেবে কাজ করেছিলেন। ধারবর্ণনা লিখেছিলেন শিল্পী কামরুল হাসানের ভাই প্রয়াত অধ্যাপক বদরুল হাসান। আলতাফ মাহমুদ ছাড়া অন্যান্য শিল্পীর মধ্যে ছিলেন জাহিদুর রহী, ফাহমিদা খাতুন, অজিত রায়, লায়লা মোজাম্মেল প্রমুখ। আজকে ভাবতে অবাক লাগে, সে সময়ের একজন সেরা শিল্পী জাহেদুর রহীম শুধু সমবেত সঙ্গীতে অংশ নিয়েছিলেন। বিশিষ্ট রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী ফাহমিদা খাতুন আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী গানটির একটি স্তবক গেয়েছিলেন একক কন্ঠে। আর, সে-বারই প্রথম অজিত রায়ের কন্ঠে আলতাফ মাহমুদ সে গান তুলে দিয়েছিলেন ‘বিচারপতি’ তোমার বিচার করবে যারা…..।’ সে গান শুনে আমাদের স্তম্ভিত হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়েছিল। একক ও সমবেত কন্ঠেও এ গানটি পরিবেশিত হয়েছিল। আর, দেশের সেরা যন্ত্রীদেরও সমবেত করা হয়েছিল। শহীদ মিনারে অনুষ্ঠিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানটি সে সময়ে সবমহলে বিশেষ সাড়া জাগিয়েছিল।অবশ্য ‘৬৩ সালে ছাত্র ইউনিয়নের সম্মেলনের পর, দ্বিতীয় রাতে বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গনে যে অনুষ্ঠান হয়েছিল, তাতে আলতাফ মাহমুদসহ দেশের সেরা প্রায় সব গণশিল্পীই অংশ নিয়েছিলেন। সে অনুষ্ঠানটিই এ যাবৎকাল পর্যন্ত অনুষ্ঠিত সব গণসঙ্গীতের অনুষ্ঠানের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলা যায়। সেই অনুষ্ঠানে সর্বপ্রথম আমরা আলতাফ মাহমুদকে দেখেছিলাম। ওই অনুষ্ঠানে তিনি গেয়েছিলেন আবদুল লতিফের লেখা ও সুর দেওয়া গান ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়’।’৬৪ সালের পর থেকে ‘৬৭ সাল পর্যন্ত প্রতিটি একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত থাকার মধ্য দিয়ে শিল্পী আলতাফ মাহমুদরে সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুযোগ হয়েছিল। শুধু একুশে ফেব্রুয়ারি নয়, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সম্মেলন উপলক্ষে অনুষ্ঠান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কৃতি সংসদ, সোভিয়েত মৈত্রী সমিতি, কলেজ শিক্ষক সমিতি বা বিভিন্ন ছাত্র হল সংসদের অনুষ্ঠানে তিনি অংশ নিয়েছেন। সেগুলোতে আবুল হাসনাতসহ অন্য সহযোগী বন্ধুরা আমরা একত্রে যুক্ত ছিলাম। উদ্দীপ্ত সে দিনগুলো, সে রাতগুলোর সব কর্মকাণ্ড আজও বড় বেশি পিছু টানে।সে সময়ে প্রতি একুশে ফেব্রুয়ারি সামনে এলেই আমরা আলতাফ মাহমুদের শরনাপন্ন হতাম। এবং প্রায় শেষ সময়ে তার কাছে যেতাম। এতে তিনি কিছুটা ক্ষুব্ধ হতেন। কেন সময় থাকতে আসি না, কেন এ রকম অল্প সময়ের প্রস্তুতি নিয়ে একুশকে পালন করতে যাই, এখানেই তাঁর আপত্তি ছিল। তারপরও তিনি এসেছেন। রিহার্সেলে ঠিক সময়মতো আসতেন। অন্যরা বিলম্বে। এতে কোনো কোনো দিন খুব অসন্তুষ্ট হতেন। তারপরও নতুন ছেলেমেয়ে বা অল্প গান-সুর জানাদের নিয়ে অনুষ্ঠান করতেন। তবে খুব তৃপ্তি পেতেন না, সেটা বোঝা যেত। কিন্তু একুশের অনুষ্ঠানের আহ্বানকে কখনোই ঠেলে সরিয়ে দিতেন না। একুশের জন্য পেশাগত কাজের চাপ বা সময়য়াভাবের অজুহাত তার ছিল না কখনোই। সেটা ছিল তাঁর জন্য এক অসম্ভব চিন্তা।ছাত্র ইউনিয়ন ও সাংস্কৃতিক সংসদের অনুষ্ঠানগুলোর মধ্যে ‘৬৭ সালের বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণে দুই সন্ধ্যার অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় দিনের গণসঙ্গীত আর আলতামাস আহমেদ পরিচালিত ‘বিদ্রোহী’ নৃত্যনাট্যের পেছনে প্রচুর শ্রম দিয়েছিলেন আলতাফ মাহমুদ। এই দু’জনকেই আমাদের অনুষ্ঠানের জন্য জহীর রায়হান ছেড়ে দিয়েছিলেন। তখন তার চলচ্চিত্র ‘বেহুলা’র কাজ চলছিল।তবে এ সময়কালে যে অনুষ্ঠানটির জন্য আলতাফ মাহমুদ সবচেয়ে বেশি পরিশ্রম করেছিলেন, সেটি ছিল সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক বিল্পবের ৫০ তম বার্ষিকী উপলক্ষে পল্টন ময়দানে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান-সোভিয়েত মৈত্রী সমিতির অনুষ্ঠান। সে অনুষ্ঠানের ধারবর্ণনা লিখেছিলেন শহীদুল্লাহ কায়সার। প্রচণ্ড উৎসাহ নিয়ে আলতাফ মাহমুদ নতুন গানের সুর করেছেন, রিহার্সেল করেছেন। এমনকি এ অনুষ্ঠানের জন্য তিনি নিজেও একটি গান লিখেছিলেন। ছায়ানৃত্যের পরিকল্পনা করেছেন। সমগ্র অনুষ্ঠানটির প্রাণকেন্দ্র ছিলেন তিনি। আর এর মূল সংগঠিক ছিলেন আবুল হাসনাত, সে সময়ের ছাত্র ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রধান কর্মী। তবে এ অনুষ্ঠানের পেছনেও ছিল সে সময়ের গোপন বিশেষ কমিউনিস্ট পার্টির উদ্যোগ।ষাটদশকের শেষ দিকে আলতাফ মাহমুদ ক্রান্তি, ধূমকেতু প্রভৃতি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। মনে পড়ে, সেই সময়েই বাফার হয়ে এনামুল হক রচিত ‘হাজার তারে বীণা’ গীতিনাট্যের সংগীত পরিচালনা করেছিলেন। আর, আমরাও তখন ছাত্র আন্দোলন শেষে অন্য পথের যাত্রী হয়ে গেছি। আলতাফ ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ আর থাকেনি। কেন থাকেনি, এ কষ্ট আজও বড়ো বেশি করে বাজে।
অর্থকষ্ট ছিল, তবুও
একুশে বা অন্যান্য বড় অনুষ্ঠান ছাড়া অন্য বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও তার সাহায্য আমরা পেয়েছিলাম। এমনকি ‘৬৪ সালে ঢাকা হল সংসদের অভিষেক (১ মে) অনুষ্ঠানে তিনি এসেছিলেন। পারিশ্রমিক বাবদ ৫০ টাকার সম্মানী দিয়েছিলাম। সে সময়ের অবস্থায় এ পরিমান অর্থ হয়তো তেমন কম ছিল না, কিন্তু আজকে সেদিনের কথা ভাবলে লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে আসে। পরপরই ছিল ইকবাল হল ছাত্র সংসদের অভিষেক অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠান শুরু হতে বিলম্বের কারনে শিল্পী আলতাফ মাহমুদ অসন্তুষ্ট মনে কাউকে কিছু না বলে চলে গিয়েছিলেন। আমরা ভয়ে ভয়ে ছিলাম, কিন্তু তার পরের দিন সলিমুলস্নাহ হল ছাত্র সংসদের অনুষ্ঠানে আবার ঠিক এসেছিলেন। সেদিন আর সাহস করে তেমন কোন কথা বলতে পারিনি।
এ সময়ে আলতাফ মাহমুদের বেশ অর্থভাব ছিল। সে খবর অবশ্য আমাদের তেমন জানা ছিল না। তখন তিনি থাকতেন আজকের মধুমিতা সিনেমা হলের পেছনে স্টেট ব্যাংক কলোনিতে তাঁর ভাইয়ের বাসায়। তাঁকে পেতে হলে যেতে হতো সকালে। কোনো কোনো সময়ে তার খোজে ‌বাসার ভেতরে না ঢুকে কিছুটা ভয়ে দরোজার কাছ দোতলার সিড়িতে দাড়িয়ে থাকতাম। জানতাম, ঠিক ৮টার সময় তিনি ঘর থেকে বের হয়ে আসবেন। বের হয়ে এলেন, সঙ্গে সঙ্গে চলতে চলতে কথা বলতাম। সেখান থেকে তিনি যেতেন গোপীবাগের মোড়ের দেশবন্ধু খাবার দোকানে। পরোটা-ভাজি আর দই খেয়ে চলে যেতেন কোনো কাজে স্টুডিও বা অন্যত্র। এ রকম একদিন তিনি হাঁটতে হাঁটতে বলেছিলেন তার আর্থিক সমস্যার কথা। বলেছিলেন ‘সামান্য আয়ের জন্য কোনো সিনেমায় গানের সঙ্গে আবহসঙ্গীতে বেহালা বাজাই। গানের সুর করতে, রিহার্সেলে গান শেখাতে গলায় রক্ত চলে আসে। তোমরা কি এসব বোঝো, জানো? মনে পড়ে, সেদিন তার কথা শুনে যারপরনাই কষ্ট পেয়েছিলাম। কিন্তু তখন আমাদের তো কিছু করার ছিল না। আমাদের প্রস্তাবিত অনুষ্ঠানে তিনি আসবেন কি আসবেন না, কোনো সরাসরি হ্যাঁ বা না বলতেন না। কিন্তু ঠিক সময়মতোই তিনি চলে আসতেন। আমাদের মনে আছে, তাঁকে দেখেছি, ছায়ানটের রবীন্দ্রসঙ্গীতের অনুষ্ঠানে পেছনের সারিতে বসে শুধু বেহালা বাজাচ্ছেন।১৯৬৯ সালের দিকে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট হলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন সংস্কৃতি সংসদের নামে অর্থ সংগ্রহের জন্য অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করেছিল। সে অনুষ্ঠানের গান গেয়ে চলে যাওয়ার সময় সংগঠক আবুল হাসনাতের হাতে ৫০ টাকা গুঁজে দিয়েছিলেন আলতাফ মাহমুদ। বলেছিলেন, ‘তোমাদের অনেক খরচ হলো।’ এ রকম মনের মানুষ, এরকম বড় শিল্পী আজ কোথায়? আর, এ রকম সংগ্রামী শিল্পী, সংস্কৃতিসেবীদের মেহনত ছাড়া কি কোনো দেশের মহান কর্মকান্ড সফল হতে পারে? ষাট দশেকের এসব বহুমুখী সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সঙ্গে সঙ্গে আলতাফ মাহমুদ সে সময় চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালনা নিয়েও ছিলেন ব্যস্ত।
মুক্তির সংগ্রামে শহীদ
একাত্তরে স্বাধীনতা সংগ্রাম চলাকালে, আলতাফ মাহমুদ অবরুদ্ধ ঢাকা নগরীতেই ছিলেন। গ্রামে তার মা, ঢাকায় স্ত্রী সারা ও কন্যা শাওন এবং পরিবারের অন্য সদস্যদের রেখে সীমান্ত অতিক্রম করে যাওয়ার কথা ভাবলেও সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। নানা কারনেই হয়তো সম্ভব হয়নি। তবুও ঠিক করেছিলেন, সেপ্টেম্বরে চলে যাবেন।আলতাফ মাহমুদের প্রিয় শহর ঢাকায় তিনি কী করছিলেন? জানা যায়, এপ্রিল থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত অত্যন্ত গোপনে তিনি গান লিখেছেন। আবুদল লতিফকে দিয়েও গান লিখিয়েছেন। দরজা বন্ধ করে গানে সুর দিয়েছেন। বাদ্যযন্ত্রী সংগ্রহ করেছেন। অত্যন্ত গোপনে, স্টুডিওতে সেগুলো রেকর্ড করেছেন টেপ স্পুলে। এ রকম একটি স্পুল নিয়ে একজন কুরিয়ার সীমান্ত অতিক্রম করতে গিয়ে ধরা পড়ে যান। পরেও নাকি আরো দুটো বড় স্পুল পাঠিয়েছিলেন কলকাতায়। এসব কিছু কোথায় গেল?
অবরুদ্ধ ঢাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে তার যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল। তিনি তাদের সাহায্য করতেন। এমনকি তার বাসায় অস্ত্রভর্তি ট্রাঙ্ক লুকিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু ‘জনৈক মুক্তিযোদ্ধা’ এ তথ্য ফাস করে দিলে ৩০ আগস্ট পাকবাহিনী আলতাফ মাহমুদকে ধরে নিয়ে যায়। কয়েক দিন তাঁর ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। মাথা নিচু করে পা ওপরে ঝুলিয়ে বর্বর অত্যাচার করা হয়। তিনি কোনো কথা বলেননি। কারো কোনো কথা প্রকাশ করেননি। ৩ সেপ্টেম্বর চোখ বেঁধে আলতাফ মাহমুদকে রমনা থানায় নিয়ে যায়। সেই যে গেলেন তিনি আর ফিরে আসেননি। তাঁর বৃদ্ধা মাতা, তাঁর স্ত্রী, থানা, জেলা, হাসপাতালে ঘুরেছেন অনেক। ১৬ ডিসেম্বর এবং তরপরও তারা খুজেছেন আলতাফ মাহমুদকে। আলতাফ মাহমুদ কোথাও নেই। আলতাফ মাহমুদকে কোথাও পাওয়া যায়নি। আলতাফ ভাই, আলতাফ মাহমুদ ছিলেন আমৃত্যু সংগ্রামী, লড়াইয়ের মাঠেই তাঁর মৃত্যু হলো। বর্বর পাকিস্তানী সেনাবহিনী তাঁকে হত্যা করেই শুধু তাঁর কণ্ঠ রোধ করতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু ‘বিদ্রোহী রণক্লান্ত্ম, আমি সেই দিনই হব শান্ত’-ঝড়ের পাখির অসমাপ্ত গানের কণ্ঠস্বর আজও বাজে। আজও তাঁর সুরে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী’ গান গেয়ে হাজার লক্ষ মানুষ মিছিল করে বাংলাদেশের সর্বত্র।