নব-যিশু ও তার স্তোত্রকথা – ওয়াহিদুল হক

বেদ বলেছেন আত্নসংস্কৃতিকবি শিল্পানি (শিল্পের দ্বারা মানুষ আত্নপরিমার্জনা করে। এই পরিমার্জনার ফলে সে যেমন ক্রমে তার দেহের সীমা পারায়ে বিমূর্ত গভীর ও উচ্চ উপলদ্ধির জগৎকে পায়, তেমনি অতীত উপস্থিত ও অনাগত সকল মানুষের সঙ্গে অনেক অধিক করে যুক্ত হয়। সৃজনশীলতা শিল্পচর্চার মূল কথা প্রধানত রূপঘটিত সৃজন, কিন্তু যে অরূপ বীণা রূপের আড়ালে লুকিয়ে বাজে, তাও শিল্পেরই মূল ভিত। এসব সৃষ্টি আর উপলদ্ধি ব্যক্তিমানুষকে চরিত্রদান করে, মানুষের সমাজকে নিয়ে যায় বিকাশের নবদিগন্তে। শিল্প অভ্যাসের মধ্য দিয়ে অভ্যন্তের অধীনতা থেকে ধীরে মননকে মুক্তি দিয়ে নবতর অভ্যাসকে ডেকে এনে সংস্কৃতির নদীকে বহতা রাখে। জীবন প্রদায়ী করে তোলে।

শিল্প মাত্রই ব্যক্তির জন্য স্বাধীনতা গড়ে তোলে, আত্নবিকাশের মধ্য দিয়ে একটি অনপেক্ষ চরিতার্থতা ও পূর্ণতার বোধে নিয়ে যায়। প্রত্যেক মানুষ শিল্পের সংসর্গে প্রকৃতভাবে এবং সর্বাধিকভাবে তার নিজের ভেতর থেকে ‘নিজে’ হয়ে ওঠে। তার নিজের শিল্পের স্পর্শে সে তখন অন্য সবার ভেতরে এই স্বাধীনতা ও আত্নবিকাশের প্রক্রিয়াকে সঞ্চারিত করে। শিল্পের স্বাধীনতাকে বাইরে থেকে বোঝা যায় না, শিল্পের ভেতর দিয়ে না গেলে বোঝা যায় না। শিল্পময় সংস্কৃতিতে, বাইরে থেকে ইতিহাস যেমনই সাক্ষ্য দিক, অনেক অধিক প্রকৃত স্বাধীন মানুষের বাস।

শিল্প প্রথমে শ্রম, শেষাবধি শ্রম। হয়তো শ্রমের পরাকাষ্ঠা। শ্রম এড়িয়ে শিল্প নির্মাণের কৌশল আজও আবিস্কার হয়নি। হবেও না, কারণ শিল্পকে গড়তে হবে এবং তা করতে হবে শিল্পীর মাথা দিয়ে, শরীর দিয়ে। নিজের কন্ঠে হাতে শরীরে ঘটাতে হয়, নিজকে পুড়িয়ে তার তাপে। এই শ্রমের কারণে আর ওই অন্তলীন স্বাধীনতার কারণে ইতিহাস জুড়ে শিল্পীদের শ্রেণী ও সমাজ ছিল নিপীড়ন এবং অর্ধাশনের শিকার। মাইকেল এঞ্জেলোর সিস্টাইন চ্যাপেলের ছাদ ভরে ‘শেষ বিচারের দিন’ আঁকার শ্রমকে কোনো পিরামিড শ্রমিক ফারাওর ক্রীতদাসও জীবনভর পাথর বওয়া দিয়ে ছাড়াতে পারবে না। শিল্পীরা চিরকাল শ্রমিক ছিল, পরশ্রমজীবী পরভূত ছিল না। শ্রম চুরির ওপর প্রতিষ্ঠিত এযাবৎতালের সব সমাজ তাই শিল্পীকে, শিল্পীসমাজকে কোনো কালে বৃহত্তর সমাজের ঘরে তোলেনি, তাকে দরজার বাইরে রেখেছে, ঘরে প্রবেশ করতে দিলে আলাদা ও নিচু আসন দিয়েছে।

প্রকৃতপক্ষে শিল্প অত্যন্ত ঘনীভূত শ্রম এবং এ ধরনের শ্রমে ইতিহাসজোড়া সমাহারের শেষ সংযোজক। এই ঘন শ্রমের কারণে শিল্প সমাজ থেকে আগে আগে যায়। এই অভ্যগ্রতা কি ব্যাষ্টিক, কি সামাজিকভাবে, অনেক কালের পথ এককালে অতিক্রমের সূত্রে, একটি বিপ্লবী প্রক্রিয়া। প্রকৃত শিল্পী মানেই বিপ্লবী, প্রতিটি সার্থক শিল্পকর্ম মানেই একটি সংঘটিত বিপ্লব।

কিন্তু সেই আরম্ভ থেকেই শিল্পের সঙ্গে ধর্মের যোগ, বুজরুকির যোগ, ব্যসনের যোগ। শিল্পী হয়েছে পুরোহিত, পুরোহিত হয়েছে শিল্পী। শিল্পের অধরা মাধুরী ঈশ্বরাদি অনুপস্থিত পরাশক্তির উপস্থিতিসূচক শান বা মাহাত্ন্য হিসেবে, কিংবা আদিতে কেবলই সিমপ্যাথেটিক ম্যাজিকের অবশ্য উপকরণ হিসেবে ক্রিয়াকার পুরোহিত শিল্পীর তাবৎ মূলধনের মূল হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। সমাজকর্মের তথা সমাজায়নের শুরুর ঘটনা শ্রম ও শিল্প শ্রমের সূত্রে বাঁচার উপকরণ গড়া, শিল্পের সূত্রে বাঁচার তাৎপর্য সার্থকতা প্রতিষ্ঠা। আবার শিল্পকে কেন্দ্র করেই কত যৌথ শ্রমের ভিত্তিতে উৎপাদন সম্পর্কের বিশিষ্ট নির্মাণ। মানুষের প্রথম ইন্ডাষ্ট্রি তার আর্টকে কেন্দ্র করেই এবং অচিরেই এই আর্ট ইন্ডাষ্ট্রি রাজশক্তির ক্ষমতা রক্ষণার্থে নিয়োজিত। সেই যে শিল্পকে শিল্পীকে কিনের নেওয়ার আরম্ভ, শিল্পীর নিজেকে বিক্রি করার আরম্ভ তা থেকে আর কোনো দিন শিল্পের মুক্তি হলো না। শিল্পীর যা কিছু মুক্তি ও স্বাধীনতা, তা তার দাসদশার ভেতরে থেকেই আপনাকে ঘোষণা করেছে চিরকালের কাছে। প্রবল প্রতাপ অধীশ্বরদের যুগের শেষে যারা পৃথিবী দখল করেছে, তারা সমগ্র উৎপাদনশীল সমাজের প্রতিভূ নয় মোটে, তাই শিল্প দ্বারা সৃষ্ট স্পর্শিত নয় মোটেও, শিল্পে অধিকার নেই একরতি। এই অক্ষম অনধিকারী শিল্পভোক্তার ও পরিপোষকের দল ফেলল ঠেলে শিল্পকে ব্যসনের উতর গর্তে। কদর্যতার পক্ষে কলুষিত হলো জীবন মৃত্যুমন্থন ধন শিল্প। অতীতের কোনো ভূমিকাই শিল্পী একেবারে ত্যাগ করেতে পারেনি, নতুন নতুন কাজে যুগে যুগে তাকে নিয়োজিত করা হয়েছে। ইতিহাসে শিল্পী ছিল কেনা গোলাম, অন্ত্যজ। বর্তমানে সে ভাড়াটে হিজড়ে। পয়সা ছড়ালেই তাকে পাওয়া যায়। হুজুমমাত্র সে যত বিকৃত কুৎসিত ভঙ্গির নৃত্য করে প্রভুর মনোরঞ্চনের জন্য। অতীতে শিল্পী বাইরের দাসত্বকে অন্তরে মোচন করত। তার শিল্প গড়ার ভেতর দিয়েই, বিপ্লব জন্ম দিতে দিতে। এখন যত ভাড়াটে  শিল্পের ভেক গড়ে অপর সকলকে দাস বানানোর জাদু শোনায়। শিল্প উধাও, তার আবরণটা নিয়ে নিজেকে সমাজকে প্রতারণা, মনুষ্যত্ব বিলোপের তিমিরে তলানো।

দুই.

আলতাফ মাহমুদকে মনের মধ্যে ধ্যান করার চেষ্টায় অত কথা মনে পড়ে। ওর যে ছবিটা অন্তরে জাগে তার সবটাই জুড়ে অত বড় ইতিহাস। শিল্পীর আবার শিল্পী হওয়ার সাধনা, শিল্পকে বিপ্লব করার সাধনা। ব্যসনের বাইজিগিরি থেকে তাকে মুক্তি দিয়ে ক্ষমতাসীন শোষকের ক্ষমতার পোষক ভূমিকা থেকে টেনে বার করে আপন মহিমায় তাকে প্রতিষ্ঠা করা – আলাতাফের জীবনে আর কিছু ছিল না। সমাজমুক্তি ও শিল্পমুক্তিকে একযোগে সর্বৈবনিবেদিত এমন প্রান এ কালে এ দেশে বিরল। আমি মহাপুরুষ দেখেছি, কারন আমি সত্যেন সেনকে দেখেছি, আমি মহনতার ধারনা করতে পারি, কারন আমি আবুল ফজলকে কাছ থেকে নিরন্তর দেখেছি, দেখেছি সুফিয়া কামালকে। দেহমনের অস্তিত্বের প্রতি বিন্দুতে অদম্য অনিরুদ্ধ মহান যোদ্ধা দেখেছি শুধু আলতাফ মাহমুদের মধ্যে। প্রথম দেখা ঢাকা কলেজের এক ইতিহাস সৃষ্টিকারী অনুষ্ঠানে । মশির হোসেনের নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তান শিল্পী সংস্থাকে দিয়ে অধুনালুপ্ত ব্রিটানিয়া হলে কলেজেরই এক অনুষ্ঠান করায় কলেজ ছাত্র ইউনিয়ন। পরিবেশিত নৃত্যনাট্য অধ্যক্ষের কাছে এতই বিপ্লবাত্নক মনে হয়েছে যে তিনি ছাত্র ইউনিয়ন প্রধানকে কলেজ থেকে বহিস্কার করেন। সেই অনুষ্ঠানে দেখা, কার সঙ্গে? কষ্টিপাথরে গড়া এক ভাস্কর্যের সঙ্গে। পাথরের মতোই নির্বাক, কিন্তু প্রতিভাবানের মতো লাজুক, অপ্রতিভ। গানগুলো সব ছিল এখন যাকে বলে গনসঙ্গিত। ছিল তার সঙ্গে নাচ, নিজামুল হকের দুরন্ত সাহসে যতটা আসে। এক ধরনের একটা সূ‌ত্রে গাথা ছিল সবটা। দেশ, নারকিয় চক্রের কবলে পড়ে দেশের দুরবস্থা, শেষে আঁধারমুক্ত শ্রমজীবী মানুষের জাগরন ও সংগ্রাম শেষে গানগুলোর সবগুলোই আলতাফের সুরারোপিত ছিল না। নাটোরের মমিনুল হকের ছিল কিছু, নিজামেরও কিছু ছিল হয়তো। আলতাফ মাত্র কিছুদিন আগে বরিশাল থেকে আনকোরা আমদানি। শিল্প সংস্থার নাটের গুরু সিতারা জুয়েলার মা, ফরিদপুরের মেয়ে কিন্তু মঠবাড়িয়ার প্রকৌশলী মোশাররফ উদ্দীনের (নেতা মহিউদ্দিনের অগ্রজ) গৃহিনী। সেই বরিশালী কানেকশন কাজ করে থাকবে, আলতাফের ঢাকা আগমন ও শিল্পী সংস্থাভুক্তির পেছনে।

বাংলাদেশের দেশমুক্তির গণজাগরণের শোষণের অবসান ঘটিয়ে সমাজবিপ্লবের প্রথম প্রেরণাসঞ্চারের কাজটি করে এই দল। উয়ারীর অগ্রণী, প্রথম বড় মাপের প্রগতিশীল ঘটনা যুবলীগ- সব এর পরের, তখন কমিউনিস্ট বলে যে কারও পেছনে মৃত্যু লেলিয়ে দেওয়া যেত। সেই কালে সরকারি আমলা মোশাররফ উদ্দীনের মেয়েরা সিতারা শিউলি নেচে গেয়ে বিপ্লবের বাণী প্রচার করেছে। ঘটনাক্রমে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রথম গান মৃত্যুকে যারা তুচ্ছ করিল ভাষা বাঁচাবার তরে, লেখা ওই মোশাররফ উদ্দীনের। আলতাফ ঢাকায় এসে একটা বিপ্লবী প্রাণবন্ত কর্মমুখর এবং ত্যাগনিষিক্ত জীবনের মধ্যে পড়ে গেলেন। আমি তার অতীত কথা ভালো জানি না- আমার কেবল মনে হয় এইখানেই এরই মধ্যে তার জীবনের সুরটি কেমন বাঁধা হয়ে গেল। আজ থেকে পঁয়ত্রিশ বছর আগের কথা।

আলতাফ তো গান খুব একটা গান খুব একটা গাইতেন না তখন। বেহালা বাজাতেন। বরিশালের বিখ্যাত বেহালাগুনী (যার কিনা বেহালাযন্ত্রের অমূল্য সংগ্রহ ছিল বলেও শুনেছি) সুরেনবাবুর ছাত্র আলতাফ। সুরেনবাবুরা খ্রিস্টান, তারা বেহালা ব্যাপারটি পেয়েছেন সাহেব মিশনারিদের কাছে। তাদের বেহালা কখনোই ভারতবাসীর যন্ত্র ছিল না। যেমন সুরেনবাবুর হাতে, তেমনি আলতাফের হাতে এ ছিল মেনুহিন, অইস্ত্রাখ ক্রাইসলারের বেহালা। কী টোন, কী টান! ঢাকা কলেজের সেই অনুষ্ঠানে বিপ্লবী কোলাহলের দেয়াল ফুঁড়ে থেকে থেকে কানে এস আছড়ে পড়ছিল সে তান। অনুষ্ঠান শেষে খোঁজ করি শিল্পীর। আফ্রিকা থেকে উঠে আসা একমাথা চুল। তার নিচের মুখটি রইল আরো নিচু হয়ে। অনেক সময়েই পাশ ফিরিয়ে। বিব্রত। অবস্থা বুঝে নিয়ে আমিও বিদায় হই।

সেই তো যাত্রা। তার সেই বরিশালীয় ভাষার প্রাচীর আর সযত্ন-লালিত গ্রাম্যতার জাঁক ডিঙিয়ে সত্যিকার মানুষটি পর্যন্ত পৌঁছানো রীতিমতো সাধনার ব্যাপার ছিল। তারপর আরো আড়াল ছিল তার। সত্যিকার সাঙ্গীতিক লোক না হলে সে নিজেকে মেলে ধরতে পারত না। আটপৌরে জৗবনের কাঠখড় কেরোসিনের ধন্দ সয়েবয়েও তিনি ভেতরে একটা আগুন শেষ পর্যন্ত জ্বালিয়ে রেখেছিলেন, এবং বাইরে দিনে দিনে যত তাকে বিভ্রান্ত দেখিয়েছে, ভেতরে যেন সেই আগুনটির আঁচে তিনি তত সত্য এবং অনমনীয় হয়ে উঠছিলেন। এই প্রক্রিয়ারই শেষ তার চুড়ান্ত আত্নোৎসর্গে। প্রথম দর্শনের সেই লজ্জা জীবনের শেষ পর্যন্ত তার প্রকৃত মানুষটিকে এবং তার নিরন্তর অভিষ্টকে আমাদের মতো আত্নীয়-বন্ধুদের কাছ থেকেও আড়াল করেছে।

তিন.

অনেক কাল তিনি ঘুরলেন শিল্পী সংস্থার সততভ্রাম্যমান দলের সঙ্গে। জানতে ইচ্ছে করে, তখন খেয়াল করিনি, তার বিড়ির পয়সাটি আসত কোথা থেকে। খাওয়া কোথাও জুটেই যায় কিন্তু বিড়ি কিনতে নগদ পয়সা লাগে। আলতাফের পয়সার যোগানটি নিয়মিত ও নির্ভরযোগ্য এবং যথেষ্ট উদার না হওয়ায় তার একটা কাজ ছিল ঢাকায় সস্তাতম খাবারের দোকান খুঁজে বার করা। সদরঘাটে রূপমহল সিনেমার উল্টোদিকের ফুটপাতে হকার্স মার্কেট খোলা সেই সেকাল থেকেই। তার ভেতরে কয়েকটি ভাতের দোকান। চমৎকার গরম ভাপ তোলা ভাত, লাল ঝোলমাংস সহযোগে রীতিমতো লালা ঝরানো। ছয় আনায় পেটপূর্তি। তা ছয় আনাই বা কোথায় মেলে। শিল্পী সংস্থার অচ্ছেদ্য বন্ধনটি শিথিল হয়ে গেলে আলতাফ প্রায় কর্মবিহীন থাকলেন অনেক দিন। ঢাকা আসার একটি সূত্র ছিল বুঝি আর্ট স্কুলে ভর্তি হওয়া। হয়তো পয়সারই কারনে সেটি তেমন জমেনি। কোনো কালে তিনি ছবিরও লোক ছিলেন, সেই তখনই সকলে ভুলে গেছে। যে ঘটনা পন্ডিতপ্রবর খালেদ চৌধুরীর বেলায়ও ঘটেছে। থাকতেন তিনি তখন যুগীনগরের যুবলীগের আস্তানায়, কারান্তগত মোহাম্মদ তোয়াহার বারবাড়িতে। মোহাম্মদ ইমাদুল্লার বিপ্লবী এবং চরিত্রপ্রখর সান্নিধ্যের ভেতরে। কোনো কারনে তিন দিন এক শয্যায় একনাগাড়ে কাটাতে হয় আমাকে তার সঙ্গে। সঙ্গে একটি কপর্দক ছিল না। পাকিস্তানি প্রথম দিনগুলোর অপর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার সময়েও আমি, এক পরিবার পোস্য নিয়ে, চুড়ান্ত নিঃস্ব ছিলাম। আবিষ্কার করলাম সধর্মীকে। তিন দিন একটানা উপোস দেওয়ার পর দুপুর নাগাদ আলতাফ কোথা থেকে দু আনার একটি মুদ্রা সংগ্রহ করলেন। প্রস্থিত দ্বিপ্রহরে আলতাফ একগাল হেসে বললেন, কতকাল চা খাই না, চল, চাঙ্গা হই। কাছেরই র‍্যাঙ্কিন স্ট্রিটের ধারের এক গলিমুখে ওয়েসাইড রেস্টুরেন্ট। দু আনায় বেশ কয়েকখানা কাগচা বিস্কুট আর দু কাপ চা মেরে তৃপ্তিতে দুজনের চোখ বুজে আসতে চায়- আস্তানায় ফিরে শুয়ে পড়ি। ঘুম পায় না, ঝিমুনিও না। ভাবতে ভাবতে বুঝি আমার কৃচ্ছ সাধনার দৌড় এপর্যন্ত। আর যেতে পারব না আমি। আলতাফের বড় চোখগুলো ঘুমন্ত পলক-পড়া অবস্থায় আরো ডাগর দেখাচ্ছে। আমি কাটলাম এবং জীবন নির্বাহের জন্য এক-বোতল আধ-বোতল করে খুচরো কেরোসিন বেচতে আরম্ভ করলাম। আলতাফ তার নিরন্নতা নিয়ে কেমন করে টিকল তা জানার সুযোগ হলো না অনেক দিন পর্যন্ত। কিন্তু আন্দোলন-সম্পৃক্ত কোন বড় অনুষ্ঠান হলে তার ঠিক দেখা পাওয়া যায়। সেই প্রথম দর্শনের তরতাজা মানুষটি। লজ্জা অনেকটা কেটেছে। তার জায়গা দখল করেছে প্রাণবন্ততা। ওই সময়টিতে তিপ্পান্ন থেকে হয়তো সাতান্ন, ঢাকায় প্রচুর বিপ্লবী ও জাতিসত্তার চেতনা-উদ্ধোধক অনুষ্ঠান হয় এবং সর্বঘটে সার্বক্ষনিক বেগার খাটিয়ে হিসেবে পাওয়া যায় এক নম্বর আলতাফ, দুই নম্বর শেখ লুতফর রহমানকে। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এই উভয় প্রতিভাধর চরিত্রবান নিবেদিত প্রাণ সংস্কৃতি-সেনানির, একনাগাড়ে, প্রায় একযোগে, বহু বছর এ দেশের উর্বর সময়ে দেশের বাইরে তথা করাচিতে কাটিয়ে আসা। এতে সঙ্গীত-বিদ্যাগতভাবে নিঃসন্দেহে লাভবান হয়েছেন এবং আমরা তাদের সূত্রে ওই অতিরিক্ত বিদ্যার সুফলও ফেয়েছি নিশ্চয়। কিন্তু তারা নিতান্ত রুটি-রুজির চাপেই বিদেশে থাকলেন এমন সময়, যখন বাংলার সমগ্র সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের অধিকাংশ তাদেরই দুজনকে কেন্দ্র করে দাঁড়াচ্ছিল। প্রথমদিককার একুশে ফেব্রুয়ারীর সান্ধ্য অনুষ্ঠান, যা ওই দিনকে জাতীয় দিবস হিসেবে গড়ে তুলতে খুব বড় ভুমিকা নেয়, তার নায়ক আলতাফ। এই অনুষ্ঠানগুলোর কাজে আলতাফের ক্ষমতাকে আবার আমাদের প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয়। নানা ধরনের ছেলেমেয়ের বিচিত্রতর কণ্ঠকে পিটিয়ে-পাটিয়ে দিন কয়েকের মহড়ায় ওই রকম মর্মস্পর্শী অনুষ্ঠানে পরিণত করা আলতাফেরই ধৈর্য, খাটার ক্ষমতা, উদ্ভাবনশীলতার ফলে সম্ভব হয়ে উঠত। আলতাফের রিহার্সল না দেখা মানে আলতাফকে না জানা।

এহেন পরম ক্ষনে ওকে চলে যেতে হলো পশ্চিম পাকিস্তানে। একবারেই পেটের ধান্দায়। সেখানে হলো বিচিত্র সঞ্জয়-ফিল্মি দুনিয়ার কায়দাকানুনে পোক্ত হওয়া। আলতাফ উপজীবিকা হিসেবে ছায়াছবির সঙ্গীত নির্দেশনাকে বেছে নিলেন। এবং এই সিদ্ধান্ত পাকা হয়েছে তার পেশাগত জীবনের আরম্ভেই তিমিরবরনের মতো গুনীকে গুরু হিসেবে পেয়ে। সরোদিয়া আমির খাঁ ও সঙ্গীতসম্রাট আলাউদ্দিন খাঁর শিষ্য, ভারতীয় বৃন্দবাদ্যের উজ্জ্বল অভিযাত্রী পুরুষ তিমিবরণকে তস্যশিষ্য আলতাফ সম্বন্ধে কিছু জিজ্ঞেস করার সুযোগ পাইনি। কিন্তু আলতাফকে আমি এত ভালো করেই জানি যে আমি নিশ্চিত বলতে পারি, তিমিবরন ঠিক এমত শিষ্য আর কখনো পাননি। আলতাফের কাছে তিমিরবরন প্রসঙ্গ প্রায়ই শুনতাম আর তার থেকে আমার ধারণার কনফারমেশন পেয়ে যেতাম।

নিজের গানকে আলতাফ কোনো দিনই গুরুত্ব দিয়ে দেখতেন না। ‘ঢাকার শহর রক্তে ভাসাইলি’ দিয়ে বছরের পর বছর ঢাকার সমস্ত মানুষকে অশ্রুতে ভাসিয়েও আলতাফ কেন যেন নিজের গায়ন ক্ষমতা সম্বন্ধে তেমন কিছু ভাবতেন না। অথচ শুদ্ধ গায়ক হিসেব প্রতিষ্ঠা তিনি চাইলেই পেতেন- কিছুই করতে হতো না তাকে তার জন্য। অনুষ্ঠানে কোনো ফাঁক থেকে গেলে নিজের কণ্ঠ দিয়ে সেই ফাঁক পূরণ করতেন। অথচ, গণসঙ্গীত এবং তার সুর করা বিদ্রোহীর কথা বাদ দিয়েই বলি, নজরুলের ওই স্বর্গীয় গান, আমি ভাই খ্যাপা বাউল, আমি আলতাফকে যেমন গাইতে শুনেছি, তেমনটা আর কোনো গায়ককে আমার বিস্তৃত-সঙ্গীত অভিজ্ঞতার জীবনে গাইতে শুনিনি। সেই আলতাফ পাকিস্তানে গিয়ে প্লেব্যাক গাইতে আরম্ভ করলেন। তার গায়কসত্তা এবং এ বিষয়ে তার অমিত সম্ভাবনাকে যে তিনি খুবই অবহেলাভরে পাশে সরিয়ে রাখতে পেরেছেন, সেখানে আলতাফ চরিত্রের একটি বিরল বৈশিষ্ট্য প্রচ্ছন্ন রয়েছে। আলতাফের মাথায়, সঠিক করে বলতে গেলে, হৃদয়ে ও মস্ত্মিষ্কে উচ্চতর গুরুত্বের দুই বিষয় নিরন্তর কাজ করত। একটি সুরছন্দ গড়ার ঘোর যার মধ্যে, তিনি অহর্নিশ থাকতেন- নিজেকে কম্পোজার হিসেবেই দেখতেন ও জানতেন- এবাং আমরাও তাকে এক সাধনা কি জন্মগত সূত্রে সুরকার হিসেবেই জানতাম, দেখতাম, মানতাম। সুরকার অনেক দেখেছি, সারক্ষন ওর মতো সুরের ঘোরে তন্ময় থাকতে কাউকে দেখিনি। দ্বিতীয় বিষয়, সাম্যবাদী ধ্যানধারণা যা তার রক্তের মধ্যে মিশে ছিল। তার থেকে এসেছিল সমাজ বিপ্লবে বিশ্বাস ও এই বিপ্লব সংগঠনের কজে আত্মদানের খুবই সরল এবং যারপরনাই কঠিন কাজটি। গায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার মধ্যে কোথায় যেন একটি ব্যক্তিগত যশ ও প্রতিপত্তি অর্জনের ব্যাপার আছে, যা আলতাফের কাছে খুবই অরুচিকর মনে হতো। অনেক অনেক প্লেব্যাক গেয়ে, বহু বছর ঢাকার তাবৎ প্রগতিশীল সঙ্গীত অনুষ্ঠানে গান গেয়ে, বাংলাদেশের একজন শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক হয়েও আলতাফ কিছুতেই নিজেকে গায়ক হিসেবে দাঁড়াতে দিলেন না। তার ব্যক্তিগত জীবনদর্শন গঠিত ও পুষ্ট হয়েছিল আগেই, পাকিস্তান গিয়ে তার কম্পোজার সত্তাটি প্রেরনা পেল, বেগ পেল। এই রকম একটি বেড়ে ওঠা আলতাফ- দীর্ঘ প্রবাসের পর দেশে ফিরে পুরনো যত ফেলে যাওয়া কর্মকান্ডের সঙ্গে লিপ্ত হতে কয়েক দিনও সময় নিলেন না। ছায়ানটে বেহালা শিক্ষক হিসেবে যোগ দিলেন, ভালোবাসার দায়ে, বেতনের বিনিময়ে নয়। জীবনে তিনি শিক্ষকতা করেছেন কমই, কিন্তু ওই কয়েক মাসেই তিনি সঙ্গীত শিক্ষকতার একটি আদর্শ স্থাপন করেছিলেন। তিনটি বিষয়ে তিনি জোর দিতেন, ক. সাবলীল টেকনিক খ. টোনের উজ্জ্বলতা পরিপক্ব, গ. স্টাফ নোটেশন মজ্জাগত কারণ। আমার জানা সকল সঙ্গীত শিক্ষকের মধ্যে কেবল তাকেই দেখেছি প্রভুত পরিমানে ব্ল্যাকবোর্ড ব্যবহার করতে। সঙ্গীত শিক্ষার প্রাথমিক স্তরে তিনি টেকনিক্যাল ও ইনটেলেকচুয়াল উভয়বিধ অনুশীলনের পক্ষপাতী ছিলেন। এই স্তর কঠোর সাধনায় উত্তীর্ণ হলে শিল্পবোধ আপনা থেকে এস যেত, যা ভাবতেন তিনি। ছায়ানটের সঙ্গে তার নিবিড় সম্পর্কের সময়কার শ্রেষ্ঠ অবদান তার শিক্ষায়, পরিকল্পনায়, প্রয়োজনায় অনুষ্ঠিত এতাবৎকালের, সার্থকতম নজরুল-জয়ন্তীর অনুষ্ঠান। পাশাপিাশি ফিল্মের কাজের সার্বক্ষনিক ধান্দায় থেকে শিল্পিত সঙ্গীতে এমন বিরাট উৎসব প্রায় একার চেষ্টায় করা তার পক্ষেই সম্ভব ছিল।

গ্রাম্য গান যেন মোটা সুতার জামদানি, তার মজা আলতাফ যেমন বুঝতেন, তেমনি বুঝতেন খেয়াল-ঠুমরির মসলিনের চিকন কাজের মর্ম। বেহালায় পাশ্চাত্য সঙ্গীতের সঙ্গে প্রথম পরিচয় ছায়াছবির আবহ সুর রচনার তাগিদে চর্চিত ঐকবাদনের সূত্রে পাকা হয়-তাই মাথায় ঘুরত কাউন্টারপয়েন্টের আকাশবিহার। আমাদের দেশের যত সুরের লোক, তার মধ্যে আলতাফের ধাবন ও ধারণক্ষমতার বেড় প্রকৃতই ছিল অসাধারন। এ ধরনের তাবৎ লোকের যা হয়- সর্বপেক্ষা প্রণম্য হন রবীন্দ্রনাথ, তা যে আলতাফের বেলা যথেষ্ট হয়নি সেই সত্যের ভেতরে লুকানো একটি ট্র্যাজেডি। মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত মূর্তিমান সঙ্গীত হলেও সঙ্গীত তার একমাত্র বিষয় তো ছিল না, শেষ বিচারে প্রধান বিষয়ও ছিল না। যে কারনে কোনো বিশেষ সঙ্গীতশিল্পী তা ধ্রপদ-ধামার খেয়াল-ঠুমরি হোক, হোক বাংলা শীলিত গান কি আবহমান গ্রাম্যগীতি, কিংবা এমনকি পাশ্চাত্য সঙ্গীতই, আলতাফের পক্ষে সময় নিয়ে যথোচিত নিষ্ঠা ও একমনস্কতায় কোনো কিছুই অনুশীলন ও সাধনাবিহীন প্রয়াসে তার চেয়ে খুব দূরে যাওয়া যায় না। কিন্তু এ তো সত্যি খুব দূর নয়। নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তার আগে সর্বজনপ্রণম্য রাধিকা প্রসাদ গোস্বামী রবীন্দ্রসুরপ্রেম পর্যায়েও এ নিয়ে যেতে পারে না। ফলে সঙ্গীতে বিশিষ্ট কাজ করেছেন আলতাফ, কিন্তু কালোত্তীর্ণ কাজ করেননি। সেই চেষ্টাও তার মধ্যে ছিল না। কারণ সর্বক্ষন সুরের ঘোরে থাকলেও তার ব্যক্তিমানুষটির আনুগত্য ছিল অন্যত্র। পাকিস্তান থেকে ফেরার পর আলতাফ সংসারী হওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু সেটা বাইরে থেকে কখনোই টের পাওয়া যায়নি। তিনি আদৌ বিয়ে করেছেন এ খবর নিতান্ত কেউ বলে না দিলে জানার উপায় ছিল না, এমনকি তার বাসায় গিয়েও না। আলতাফের চিরকালের গড়ে ওঠা এই জীবনটি অবিকৃত চালিয়ে যেতে পারার মধ্যে শ্রীমতী আলতাফের অনুরাগ সহনশীলতার কৃতিত্ব সন্দেহাতীতভাবে অনুমান করা যায়। কিন্তু সংসার তো যুগীনগরের যুবলীগের আখড়া নয়, তার একটা চাপ আছে। আলতাফ সবতাতেই আছেন, আগেরই মতো, কিন্তু আবার কিছুতে নেইও।

এর মধ্যে একটি বিচ্ছিরি ঘটনায় ওর সঙ্গে আমার যোগাযোগ গেল কমে। একশ কুড়ি ওয়াট আউটপুটের মহামূল্যবান এক পাইওনিয়ার (জাপানি) এমপ্লিফায়ার আলতাফ সংগ্রহ করেন ওদের রেকর্ড কোম্পানির জন্য। যখন দেখা গেল ওখানে এটা কোনো কাজে লাগবে না, আলতাফ বললেন, তুই ছায়ানটের জন্য এটা নিয়ে নে। দাম একটা যা হোক দিয়ে দিস। ধর বারো শ টাকা। আমি মহানন্দে ছায়ানটের কর্তাব্যক্তিদের ধরলাম, তারা আমার মতো আনন্দিত হলেন না। আলতাফকে ফিরে গিয়ে বলি, ও তো আমি নিয়েই নিয়েছি, কিন্তু টাকা পাই কোথা। আলতাফ বলেন, যা তুই আটশ দে। আবার ছুট, বসানো হলো মিটিং। সাব্যস্ত হলো সাদা হাতি পোষবার সামর্থ্য ছায়ানটের নেই। লজ্জায় আলতাফের বাড়ির পথ আমি এড়িয়ে চলতে আরম্ভ করলাম।

আলতাফ এর মধ্যে সংরক্ষন বিশারদ এনামুল হকের একধিক নৃত্যনাট্যের পুরো সুর করেছেন এবং তার রেকর্ডিং সম্পন্ন করেছেন। আমাদের যে যার জীবন এতটাই নিস্তরঙ্গ, স্বাভাবিক ও সহজ ছিল যে, সে সময়ে আমরা রাজনীতিতে, আন্দোলনে, মননশীল বন্ধুত্ব চর্চায়, সঙ্গীতানুশীলনে বেশ ডুবে থাকতে পেরেছিলাম। দেশের সকল মানুষ একযোগে এটা পেরেছিল বলে মুক্তিযুদ্ধটা কয়েক লাফে ঘরের মধ্যে চলে এল। এবং আলতাফের সমগ্র ব্যক্তিমানসের প্রকৃত আনুগত্য দীপ্যমান হয়ে উঠল।

মহৎ উপন্যাসের শেষের দিকটা কেমন যেন হয়। পড়তে গিয়ে বুকটা চেপে আসে, গলাটা ধরে আসে। উপন্যাসের ভেতরে কতই না আশ্চর্য কোইনসিডেন্স এসে থেকে থেকে পরিস্থিতিকে উদ্ধার করে, বেগ দেয়। শেষের দিকে তা আর ঘটে না। মহৎ সাহিত্য-শিল্পী জীবনে-মননে আদর্শ- অনুসরনীয় কমিউনিস্ট ওই অতিকায় মানুষ দীপেন বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনের শেষ তিন দিন অষ্টপ্রহর সাবিত্রীর মতো আগলে বসেও প্রত্যুষে দুঘন্টারজন্য ছুটি নিলাম বাহাত্তর ঘন্টার অবসাদ কাটানোর জন্য। ফিরে আর দীপেনকে পেলাম না।

আমার জীবনের সবচেয়ে গৌরবোজ্জল, ত্যাগে ভাস্কর, নটি মাস যুদ্ধের মধ্যে কাটিয়ে স্বাধীন দেশে প্রবেশ করে দেখি, আমার কনিষ্ঠ ভ্রাতা নিহত। ‘কষ্ট পেলাম, তার সংসারটিকে তুলে নিলাম নিজের কাঁধে। কর্তব্য করে যাই, এ এমন কিছু ঘটনা নয়। সারা বাংলা জুড়ে কত ভাই, কত বোন গেল। কিন্তু আলতাফও নেই। এই তিরোধানকে তেমন করে নিতে পারি না। আলতাফের যাওয়া মানে আমাদের কত মানুষের যে জীবন থেকে বিরাট এবং মহার্ঘ একটা অংশ চলে যাওয়া!

আর কীভাবেই যে গেল। তার সমগ্র ব্যক্তিটি ছিল কোথায়? হেথা নয়, হোথা নয়, অন্য কোনোখানে। গানে নয়, দলে নয়, প্রবল ভাবে বাঁচায় নয়। এসবকে উজাড় করে দিয়েও মানুষটা চিরকাল ষোলআনা রয়ে গেল বিপ্লবের সন্তান।

আলতাফের মানসে নিবিষ্টতম সত্যটি তার সঙ্গে পরিচয়ের প্রথম দিনে যেমন দেখেছিলাম, তার এই বীরের মৃত্যুতে সেই সত্যটি আবার আমার কাছে ধরা দিল। কেন যে আমরা আগেই বুঝিনি, যথোচিত মূল্য দিইনি। বুঝতে পারার মতো যথেষ্ট কিছু তিনি করেছিলেন। আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি প্রথম শুনি, শিখি তো আমরা কজন। কেন ধরতে পারিনি আমাদের মধ্যে মানুষের মুক্তিনির্মাতা এক নব- যিশু, যিশুরই মতো চূড়ান্ত হিউমিলিটি আত্মবিলোপী বিনম্রতা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। গানটির আরম্ভ পশ্চিম দেশীয় স্তোত্রের করনে। কিন্তু ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ এবং ললিত নিসর্গ অংশগুলোতে ভারতবর্ষীয় রাগ-রাগিনী একাধারে প্রচন্ড নির্ঘোষ ও কিশলয় কোমলতা দিয়ে বিপ্লবের মর্মবানীকে মেলে ধরে কী আশ্চর্য অমোঘতায়! বাঙালি যত দিন থাকবে এই ধরাপৃষ্ঠে, থাকবে আমার সোনার বাংলা, থাকবে বাংলার মাটি, বাংলার জল এর থাকবে আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো। ওই গান তৈরির সময় আমরা সাধারণ মরণশীলরা বুঝিনি যে একটি জাতিসত্তার সঞ্জীবনী তৈরি হলো, এইটি গড়বেন বলে একজন জন্ম নিয়েছিলেন, তিনি তা গড়ে জীবনের কাজ শেষ করলেন। আমরা তখন আলতাফের মধ্যে আমাদেরই মতো কাউকে দেখছিলাম, পাচ্ছিলাম।

আলতাফ গেলেন যথাযোগ্যভাবে। ওই সঞ্জীবনীর উদগাতার যেভাবে যাওয়া উচিত, বিপ্লবের সন্তানের যেভাবে যাওয়া উচিত, মসিহের যেভাবে যাওয়া উচিত। গণহত্যারূপী পিশাচের বক্ষের ভেতরে বসে তার সঙ্গে যুঝছিলেন তিনি। একসময়, হয়তো কোনো বিশ্বাসঘাতকের আত্মবিক্রয়ের সূত্রে তাকে তারা ধরল, দাঁত তুলে নিল। আলতাফ এক অসম যুদ্ধের শ্রেষ্ঠ বীর, যুদ্ধরত অবস্থায় শহীদ হলেন। আমাদের লাখো শহীদের মধ্যে আলতাফের মতো স্বেচ্ছামৃত্যু, উন্নতশির শাহাদত, খুব কম লোকের বলেই মাত্র কদিনে মুক্তিযুদ্ধ ‘গোলমালের দিনে’ পরিণত হয়। সোভিয়েতের ঘরে ঘরে আলতাফপ্রতিম শাহাদতের ফলে, মহান দেশপ্রেমের যুদ্ধ চার দশক পরও তার প্রতিটি মানুষের রক্তে জীবন্ত বাজে।

আলতাফ- এ আমাদের দেশের এক চিরবাঞ্ছিত অথচ নিতান্ত দুর্ঘট এক সম্মিলনকে পাই। শিল্প ও রাজনীতির সম্মিলন। আলতাফকে স্মরন করে তার উত্তরসূরিদের কাছে এ প্রত্যাশা রাখতে চাই, যেন তাদের কর্মযোগের সাফল্যের সংস্কৃতি ও রাজনীতির কৃত্রিম ভেদরেখা মুছে যায়-সংস্কৃতি হয়ে ওঠে রাজনীতি, রাজীতি সংস্কৃতি।