পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শ্রদ্ধাঞ্জলির গান – মোসাদ্দিক উজ্জ্বল

খুব ছোটবেলার কথা। ২১শে ফেব্রুয়ারির আগের রাতে মহল্লার বিভিন্ন ফুল প্রেমী মানুষের বাড়িতে হানা দিয়ে ফুল চুরি করে সেই ফুল দিয়ে আমরা মালা, তোড়া বানাতাম। পরের দিন আমাদের ভাষা আন্দোলনের শহীদদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাতে হবে। সারা রাত স্কুলের মাইকে বাজানো হোত ২১শের গান। সালাম সালাম হাজার সালাম সহ কত শত দেশের গান। তবে দুটো গান কিন্তু কখনো বাজানো হোতোনা ২১শের পূর্ব রাতে।

একটা আমাদের জাতীয় সঙ্গীত। আর দ্বিতীয়টা আমাদের সেই প্রভাত ফেরির গান। সারা রাত শহীদ মিনার সাজিয়ে ভোর রাতে ঘুম ঘুম চোখে বাড়িতে ফিরে সাদা পাঞ্জাবি আবার কখনো সাদা শার্ট পড়ে স্কুলে ফিরে বুকে কালো ব্যাজ ধারন করে লাইনে দাড়িয়ে থাকা। এরপর প্রধান শিক্ষক এসে জাতীয় সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে আমাদের শোভাযাত্রা শুরু। সবাই খালি পায় । সামনের সারিতে আমাদের শিক্ষক।

তাদের সামনে রিক্সায় মাইকে সেই প্রভাতফেরির ভূবন বিখ্যাত পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শ্রদ্ধাঞ্জলির গান, “ আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি” গানটি বেজে চলছে আর আমরা শত  শত ছাত্র ছাত্রী সেই সুরে সুর মিলিয়ে গাইছি হৃদয়ের সব টুকু ভালোবাসা উজাড় করে!

সুরের কথাটি চলে এলো। কোন একটি দেশাত্মবোধক গানে সুরের এমন পূর্ণতা আমি কোন গানের মাঝে আজও খুঁজে পাইনি। সেদিন কি জানতাম এই গানটিতে কে সুর দিয়েছেন? কে সেই মহাজন? তখন গীতি কবিতা, সুর, সঙ্গীত এইসব কি আর বুঝতাম? সুরের সাথে সুর মিলিয়ে অনেকে কেঁদে ফেলতাম একুশের প্রভাতফেরীতে। আহা কি সেই শ্রদ্ধা মাখা গানের সুর!

ক্লাস এইটে আমি প্রথম কোন একটি বিশ্ব বিচিত্রা নামক সাধারন জ্ঞানের বইতে দেখতে পাই একটি প্রশ্ন। আমাদের ভাষা আন্দোলনের কালজয়ী সেই গানের সুরকার কে? সাথে দেখলাম ৪ টি অপশন। আমি ধরতে পারিনি সেইদিন। নিচের লুকনো উত্তরের মাঝে খুঁজে পেলাম কাংখিত সেই উত্তর। আমাদের মহান ভাষা আন্দোলনের সেই বিখ্যাত গানের সুরকার শহীদ আলতাফ মাহমুদ। তখনও তাকে চিনতে পারিনি। পারার কথাও নয়। কীভাবে চিনবো? আমাদের রাষ্ট্র যদি চেনায় তাহলেই তো চিনবো! যেই দেশের গুনের কদর থাকেনা সেই দেশে গুণী জন্মায় আসলে কীভাবে?

আজ ২০১৩ সাল। আজও আমাদের কোন পাঠ্য বইতে শহীদ আলতাফ মাহমুদের নাম কি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে? ক্লাস টেস্ট, অ্যাডমিশন টেস্ট, বি সি এস সহ সকল প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার কমন একটি প্রশ্ন, ভাষা আন্দোলনের গানের সুরকার কে? ছেলে মেয়েরা আজও ভুল করে। আজও গাজিউর রহমানের নামের পাশে টিক মারে। আমরা এই লজ্জা রাখি কোথায়?

আমাদের চাকুরী নিয়োগ পরীক্ষা গাইডে সুরকার আলতাফ মাহমুদ এর নামটি থাকলেও ক্লাস ওয়ান থেকে টুয়েল্ভ পর্যন্ত কোন বইয়ে কেন তার নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি? আমরা যদি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা পালন করতে পারি আন্তর্জাতিক ভাবে তবে সেই ভাষা দিবসের সাথে প্রত্যক্ষ ভাবে কি শহীদ আলতাফ মাহমুদ এর নামটি আসেনা?

আজ সেই কলংকিত ৩০ শে অগাস্ট। এই মাসটি কলংকিত হয়েছে নানা কারনে। ইতিহাস সাক্ষী দেয়। আজকের এই দিনে পাক হানাদার বাহিনীর বেজন্মা কুত্তা গুলো নিজের বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায় বাঙলা সঙ্গীত আকাশের এই উজ্জ্বল নক্ষত্র কে। সেই যে নিয়ে গেলো আজও তাকে ফিরে পাওয়া যায়নি! আজকের দিনে কেউ লিখছে আজ শহীদ আলতাফ মাহমুদ এর মৃত্যুবার্ষিকী! কেউ লিখছে শাহাদাৎ বার্ষিকী! আমি কাউকে দোষ দেবনা কারন হয়তো আমাদের ইতিহাস জানানো হয়নি সঠিক ভাবে।

আজ শহীদ আলতাফ মাহমুদের অন্তর্ধান দিবস। আমি বিশ্বাস করি শহীদ আলতাফ মাহমুদ আজও বেঁচে আছেন। হয়তো দূর আকাশের দূর নক্ষত্রের মাঝে। রাতের আকাশে যেই নীল ধ্রুবতারা প্রতিদিন আমাদের মাঝে উঁকি দেয় সেই আমাদের শহীদ আলতাফ মাহমুদ!
সত্যি, আমি কি ভুলিতে পারি?

শহীদ আলতাফ মাহমুদ এর অন্তর্ধান দিবসে তার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই। তবে সেই শ্রদ্ধা এমন যে, দূরের আকাশের সন্ধ্যাতারার মতন জ্বল জ্বল করা মনের গহীন কোন থেকে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে।

Published at Protimuhurto.com

http://protimuhurto.com/index.php/freeopinion2/111-free-opinion-5/5717-2013-08-31-02-59-09.html