প্রাণোচ্ছল এক পুরুষ – আলতামাস আহমেদ

আলতাফ ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় হঠাৎ করেই। আমি তখন বেচারাম দেউড়ীতে থাকতাম। সম্ভবত ১৯৫১ সালে সেখানে গণনাট্য সংঘের উদ্যোগে আয়োজিত একটি উম্মুক্ত গণসঙ্গীতের অনুষ্ঠানে আলতাফ মাহমুদের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়।

তারপর আমিও সেই সংঘের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ি। সক্রিয়ভাবেই সে সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সভায় আমাদের গান গাওয়ার ডাক আসত। সভা শুরুর আগে আমরা গণসঙ্গীত করতাম। সেই সুবাদে অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে যাওয়ার সুযোগ হয়। বিশেষ করে মওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবর রহমান, মোহাম্মদ তোয়াহা প্রমুখ নেতার। তোয়াহা ভাই তখন ১৪ নম্বর যুগীনগর লেনে থাকতেন এবং তার বাসায়ই ছিল যুবলীগের অফিস। এভাবে আলতাফ ভাই, আমি আমরা একদিন যুবলীগের সদস্য হয়ে যাই। পরবর্তী সময়ে আমরা কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গেও যুক্ত হই। সে সময় শহীদুল্লাহ কায়সার ছিলেন পার্টির সাধারণ সম্পাদক।

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী গানটির সুর আলতাফ ভাই যুবলীগ অফিসে বসেই করেছিলেন। তখন তিনি নিজামুল হকের সঙ্গে থাকতেন। যদ্দুর মনে পড়ে,লেখার পর আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী নিজেই ওই কবিতাটি আলতাফ ভাইকে দিয়েছিলেন সুর করার জন্য। যুবলীগের অফিসের পাশেই ‘বুড়ির হোটেল’ নামে একটি রেস্টুরেন্ট ছিল। এক বুড়ি সেটা পরিচালনা করত, পকেটে পয়সা না থাকলে আমরা তার হোটেলে বাকিও পেতাম। সেই বিশেষ দিনটিতে আলতাফ ভাই আমাকে একটি সিকি দিয়ে কিছু নিমকি কিনে আনতে বলেন। খাওয়ার পর তিনি গানটির সুর করতে বসে যান। কয়েকবার সুর করে বদলাবার পর তিনি শেখ লুতফর রহমানের কাছে যান তার মতামত জানতে। তিনি খুবই সামান্য পরিবর্তনের পরামর্শ দেন। আলতাফ ভাই সেইমতো কিছুটা গ্রহন করেন। তারপর আলতাফ ভাই আবদুল লতিফের কাছে যান সুরটি সম্পর্কে তার মতামত জানতে। তখন লতিফ ভাই ওরা আমার মুখে ভাষা গানটির সুর করা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন।

তখনকার দিনের সকল আন্দোলন ও সংগ্রামের সঙ্গে আলতাফ ভাই একাত্ত হয়ে ছিলেন। পোস্টারিং করা থেকে শুরু করে গান করা সব কাজেই আমরা তার সঙ্গে ছিলাম। আমাদের গানের নেতৃত্ব দিতেন আলতাফ ভাই। অসাধারণ এক শিল্পী ছিলেন তিনি। একাধারে বেহালা, বাঁশি, বাজাতে পারতেন খুব ভালো। তবলাতেও তার হাত ছিল । দরাজ কন্ঠের গণসঙ্গীতের মাধ্যমে তিনি শ্রোতাদের রক্ত গরম করে দিতে পারতেন। আর দ্রুত সুর করার ব্যাপারে তার কোনো তুলনা ছিল না। সে সময় গণনাট্য সংঘের গানের ক্ষেত্রে আমরা তাকেই অনুসরণ করতাম।

১৯৫৬ সালের কাগমারি সম্মেলনেও আমরা একসঙ্গে কাজ করেছি। আমরা সেখানে পরপর তিন রাত গণসঙ্গীত শোনার জন্য প্রচন্ড শীতের ভেতরও মানুষ সারা রাত বসে ছিল।

এর পরপরই আলতাফ ভাই করাচি চলে যান। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের সময় আমার নামে হুলিয়া জারি হয় তখন আলতাফ ভাই আমাকে করাচিতে নিয়ে যান। সে সময় নিজাম ভাইও (নিজামুল হক) করাচিতে থাকতেন। বস্তুত এদের সঙ্গে কাজের সুবাদেই আমি শিল্প-সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়ি।

আলতাফ ভাইয়ের সঙ্গে আমার জীবনের একটি স্মরণীয় কাজ করার অভিজ্ঞতা হচ্ছে কাজি নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী কবিতাকে নৃত্যনাট্যে রূপান্তর, সময়টা সম্ভবত ১৯৬৭ সাল ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক পরিষদের এক অনুষ্ঠানে আমরা বিদ্রোহী নৃত্যনাট্য করি। এদেরই আরেক অনুষ্ঠানে আমরা এবার ফিরাও মোরে নামে একটা অনুষ্ঠানও করেছিলাম। নৃত্য পরিচালনা করার ক্ষেত্রে আলতাফ ভাই সব সময় আমাকে সময় দিতেন। তার মতামত জানাতেন। একইভাবে কোনো গানের সুর করার পর যাকে সামনে পেতেন তাকেই সেই সুরটি সম্পর্কে তার মতামত জানতে চাইতেন। আলতাফ ভাইয়ের সঙ্গে বহু সিনেমায় কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। সেসব ছবিতে নৃত্য পরিচালনার ভার আমার ওপর থাকত।

ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের সময় আলতাফ ভাই সিনেমা নিয়ে যথেস্ট ব্যস্ত থাকা সত্ত্বেও অর্জিত রায়, জাহেদুর রহীমকে দিয়ে অনেক গণসঙ্গীত করিয়েছেন। বহু গণসঙ্গীতে সুর দিয়েছেন।

একাত্তরের পঁচিশ মার্চে পাকিস্তানিদের আক্রমনের সময় আমরা উভয়ে ঢাকায় ছিলাম। আলতাফ ভাইয়ের স্ত্রী তখন সন্তানসম্ভবা। আমি ভারতে পাড়ি জমানোর জন্য প্রস্তুতি নিয়েছি। তিনি তখন রাজারবাগে থাকতেন। ওকে দেশ ছাড়ার কথা বলতেই তিনি বললেন, কাজগুলো কে করবে? তখন আলতাফ ভাই মুক্তিযোদ্ধাদের অর্থসহ নানাভাবে সহযোগিতা করতেন। যতদূর মনে পড়ে, আলতাফ ভাই ১৪ আগস্ট টেলিভিশনের একটা অনুষ্ঠান করে দেওয়ার জন্য খবর দেন। সে সময় অনুষ্ঠান না করে কোনো উপায় ছিল না। রাজি না হলে আমাদের সবারই জেলে যেতে হতো। ওই অনুষ্ঠানের সঙ্গীত পরিচালনায় ছিলেন ওস্তাদ খাদেম হোসেন। আমার ওপার যাওয়ার পরিকল্পনার কথা শুনে আলতাফ ভাই বললেন, ধরা যখন পড়ে গেছ, অনুষ্ঠান করেই যাও। ওই অনুষ্ঠানের দু এক দিন পর আমরা খাদেম হোসেন সাহেবের বাসায় অনেক রাত পর্যন্ত একসঙ্গে আড্ডা দিয়েছিলাম। টেলিভিশনের ওই অনুষ্ঠানটির রেকডিং আমরা ইচ্ছাকৃতভাবেই অসম্পূর্ণ রেখেছিলাম যে কারণে তা প্রচার করা সম্ভব হয়নি। খাদেম ভাই তখন মতিঝিল কলোনীতে থাকতেন ওই বাসাতেই আলতাফ ভাইয়ের সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয় তার পরপরই আমি ভারতে চলে যাই। পরবর্তী সময়ে ঢাকায় ফিরে জানতে পারি যে, ওই দেখার দু দিন পরই তিনি ধরা পড়েন। এর পরের সেই মর্মান্তিক ঘটনা তো সবারই জানা।

আমি যে আলতাফ মাহমুদকে জানতাম, তার সম্পর্কে বলে শেষ করা কঠিন। তার মতো প্রাণোচ্ছল মানুষ খুব কমই দেখা যায়। তিনি যা উপার্জন করতেন, তার সবটাই আমাদের পেছনে ব্যয় করতেন। আলতাফ ভাই মানুষকে দিয়ে শান্তি পেতেন। আমাদের গণসঙ্গীতের পেছনে তার অবদান সর্বাধিক। সমগ্র জাতি তার কাছে ঋণী।