“আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী আমি কি ভুলিতে পারি।” মহান একুশের গান। একটি জাতিসত্তার সঞ্জীবনী শক্তি।
আর এই শক্তির ভিত্তি গড়বেন বলে একজন জন্ম নিয়েছিলেন এই বাংলায়। তিনি আলতাফ মাহমুদ। একজন ক্ষনজন্মা-প্রবাদ পুরুষ,মহান সুর সৈনিক।
আলতাফ মাহমুদের জন্ম ১৯৩৩ সালের ২৩ শে ডিসেম্বর বরিশাল জেলার মুলাদি থানার পাতারচর নামক গ্রামে এক মধ্যবিত্ত সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। পিতার নাম নাজেম আলী হাওলাদার। মাতার নাম কদবানু। পিতা নাজেম আলী হাওলাদার কর্মজীবনে প্রথমে আদালতের পেশকার এবং পরে জেলা বোর্ডের সেক্রেটারি ছিলেন। আলতাফ মাহমুদের ডাক নাম ছিল ‘ঝিলু’। সেই ছোট্ট ঝিলু ছিল ছোট বেলা থেকেই চঞ্চল, ধরা ছোঁয়ার বাহিরে। আর গানের সাথে সখ্য সেই শৈশব থেকেই।
বরিশাল জেলা স্কুলের ছাত্র থাকা অবস্থায় ছবি আঁকা ও গান গাওয়া এই দুই শিল্পসাধনায় আলতাফ মাহমুদ আপন মগ্নতার পরিচয় রাখেন বরিশালের সাংস্কৃতিক আবহে। ছবি আঁকা আর গান গাওয়ার পাশাপাশি বেহালা খুব ভালো বাজাতে পারতেন। বাঁশি বাজাতেন সুমধুর, তবলাতেও হাত ছিল বেশ। অভিনয়ও করেছেন কখনো কখনো। কিন্তু পাঠ্যপুস্তকের পড়ায় মন ছিলনা অতটা। পিতা নাজেম আলী হাওলাদার চেয়েছিলেন ছেলে আর কিছু না হোক অন্তত মেট্রিকুলেশনটা(এস.এস.সি) যেন খুব ভালোভাবে পাশ করে, লেটারসহ প্রথম বিভাগে। যথারীতি ১৯৪৮ সালে কোলকাতা বোর্ডের অধীনে ম্যাট্রিক পরীক্ষার ফলাফল যেদিন প্রকাশ হলো, দেখা গেলে পিতার আশানুরুপ ফলাফল নিয়ে ছেলে পাশ করেনি। হতাশ বাবা বিকেলের পর থেকে রাগে ঝড় তুলেছেন বাড়িতে। এই শুনে আলতাফ মাহমুদ ভয়ে আর বাড়িতে যাননি। সন্ধ্যার পর থেকে শুরু হয় ছেলের খোঁজ। দিশেহারা বাবা চারিদিকে ছেলের খোঁজ করতে লোক লাগালেন। অনেক খোঁজাখুঁজির পর অবশেষে রাত ৯ টার দিকে আলতাফ মাহমুদকে পাওয়া গেলো বরিশাল সদর বেলপার্কের কাছে। কীর্তনখোলা নদীতীরের রাস্তার পাশে এক বেঞ্চিতে বসে দরাজ গলায় গাইছেন_ সায়গলের গাওয়া একটি বিখ্যাত গজল -দুনিয়া মে হু দুনিয়াকী তলবগার নহি হু বাজার সে গুজরা হুয়া থরিদ্দার নহি হু ‘ সঙ্গে তাঁর এক বন্ধু।” যে জীবন গানের, সংগ্রামের_তাকে কি করে আটকানো যায়। সাধ্য নেই কারো। মাত্র ৩৮ বছর জীবনের ইতিহাস, পনেরো বছর বয়সে প্রথম আন্দোলন।
এরপর বরিশাল বিএম(ব্রজমোহন) কলেজে আই এস সি তে ভর্তি হোন কিন্তু ১৯৫০ সালের গোঁড়ার দিকে তিনি পাড়ি জমালেন ঢাকার পথে। শুরু হয় জীবনের আর এক নতুন অধ্যায়। ঢাকায় এসে তিনি ঢাকা আর্ট কলেজে ভর্তি হোন। কলকাতা আর্ট কলেজেও বেশ কিছুদিন পড়েছেন বলে জানা যায়। নতুন কিছু করার প্রত্যয় নিয়ে ঢাকায় আগমন করেন আলতাফ মাহমুদ। ঢাকায় আসার পর পরেই ঢাকাকেন্দ্রিক জনপ্রিয় সাংস্কৃতিক সংগঠর “ধুমকেতু শিল্পী সংঘ” এর সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন তিনি। আলতাফ মাহমুদের আগমনে ধুমকেতু শিল্পী সংঘে নতুন প্রাণের সঞ্চার ঘটল। সেই সময় সংগঠনটির প্রগতিশীল চিন্তাধারায় শিক্ষিত সাহসী যুবকেরা সবাই মিলে গণসংস্কৃতিকে হাতিয়ার করে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে গণজীবনের দুঃখবেদনা আর তাদের ন্যায্য পাওনা আদায়ের অধিকারের দাবী জানিয়ে দেবার আকুতি নিয়ে নৃত্য -গণসংগীত -নৃত্যনাট্য -ছায়ানাট্য মঞ্চস্থ করতো।
১৯৪৮ সালের পরে আলতাফ মাহমুদ গণসঙ্গীতের প্রতি ঝুঁকে পড়েন। তারপর তো শুরু। যে গানের ভাষা মানুষের স্বাধিকার আন্দোলনের কথা,অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কথা, মানুষের কথা বলত_সেই গান আর গানের ভাষাই কন্ঠে তুলে নিলেন তিনি। গ্রামে-গঞ্জে, মাঠে ময়দানে, নগরে-বন্দরে অসংখ্য জনসভা আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গণসঙ্গীত পরিবেশন করে মানুষের চেতনাকে শাণিত করেছেন। চারনের মতো ঘুরে বেড়িয়েছেন মানুষকে জাগানোর জন্য। এরকম কিছু গণসঙ্গীত- ১)হুনছনি ভাই দেখছনি, দেখছনি ভাই হুনছনি স্বাধীনতার নামে আজব দেইখছনি ২)স্বর্গে যাব গো স্বর্গে যাব গো। ৩)মোরা উজিরে নজিরে বাঁচায়ে রাখিতে চির উপবাসী হবে। ৪)মরি হায়রে হায় দুঃখ বলি কারে পাঁচশ টাকার বাগান খাইল পাঁচ সিকার ছাগলে। ৫)ম্যায় ভুখা হু অনাথ হামারা লাড়কা.. আরো কত কত গান।
বিষ্ময়ের অবধি থাকে না। ষাটের দশকের শেষাশেষি কোন এক কাব্যগীতি আলেখ্যের আয়জনে অনুষ্ঠিত অনুষ্ঠানে আলতাফ মাহমুদ গেয়েছিলেন-নজরুলের বিদ্রোহী- “উঠিয়াছি চিরবিস্ময় আমি বিশ্ব বিধাত্রির।” কখনো গেয়েছেন-আমি ভাই ক্ষ্যাপা বাউল।
বড় দরদ দিয়ে তিনি গাইতেন-
১)আমি মানুষের ভাই স্পার্টাকাস..
২)ঘুমের দেশের ঘুম ভাঙাতে ঘুমিয়ে গেলো যারা..
৩)ঢাকার শহর রক্তে ভাসাইলি..
৪)ধন্য আমি জন্মেছি মা গো তোমার ধূলিতে..
৫)বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা, আজ জেগেছে সেই জনতা..
৬)নওজোয়ান নওজোয়ান/বিশ্বে জেগেছে নওজোয়ান..
৭)নাকের বদলে নরুন পেলাম/তাক ডুমা ডুম ডুম..
৮)এসো মুক্ত করো এসো মুক্ত করো/অন্ধকারের এই গান..
৯)পথে এবার নামো সাথি/পথেই হবে পথ চেনা..
১০)ও আলার পথযাত্রী এ যে রাত্রি/একানে থেমো না..
১১)কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি /কালো যারে বলে গাঁয়ের লোক..
আরো কত কত গান।