লাল-সবুজের পতাকায় বেঁচে থাকবেন তাঁরা – শাওন মাহমুদ

প্রকাশ : ১৪ ডিসেম্বর ২০২২ – আজকের পত্রিকা

হয়তোবা কখনো আমাদের মনে হতেই পারে যে চারপাশে যা হচ্ছে বা ঘটছে, তার সঙ্গে তাল মেলাতে পারছি না। হয়তোবা যাপিত জীবনে কারও কাজে আসছি না। হয়তোবা নিজের গুণ যা আছে, তা দিয়ে কাউকে খুশি করা যাচ্ছে না। হয়তোবা আমাদের যা করার ইচ্ছে জাগে, তার কোনোটাই সঠিক পথ খুঁজে পায় না। হয়তোবা আমরা কোনো কাজেই আসছি না—এমন সময় সবারই আসে।

নারীদের মধ্যে এমন অনুভূতির হার বেশিই অনুভূত হয়। এ ধরনের বিষণ্নতায় ক্লান্ত হই আমি, স্বস্তি পাওয়ার জন্য বই খুলে বসি। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে নারী মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ নারী, ধর্ষিত নারী, শহীদ জায়া এবং শহীদ জননীদের কথা পড়তে থাকি। তাঁদের দৃঢ়তা, সাহস ও আত্মত্যাগের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠি আবারও। তাঁদের বীরত্বগাথা আমাকে আগামীর পথে আবারও জাগ্রত করে ভালো থাকার জন্য। প্রতিটি সাফল্যের মাঝে শোকের ছোঁয়া থাকে, চলতে থাকি আবারও।

আজকের পত্রিকা অনলাইনের সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
বাংলাদেশের বিভিন্ন সাংবাদিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা, প্রত্যক্ষদর্শীদের লিখিত বিবরণে একাত্তরের নারীদের কথা উঠে এসেছে। গবেষক বা বিশ্লেষকের ভাষায়, মুক্তিযুদ্ধে লড়াই এবং মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবস্থান সম্পর্কে জানা যায়; বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ও বিভিন্ন আন্দোলনে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ, গেরিলা যুদ্ধে নারী, যুদ্ধের ময়দানে চিকিৎসা ও সেবা ক্ষেত্রে নারী, মুক্তিযুদ্ধ সংগঠক হিসেবে নারীর ভূমিকা, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মায়ের ভূমিকা, নারী গবেষক ও শব্দসৈনিক, যুদ্ধকালীন নারী নির্যাতনের বিচার-প্রক্রিয়ার কথা বারবার উঠে এসেছে।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আগের প্রেক্ষাপটের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে, এই সংগ্রাম পরিণতি অর্জন করেছে ধাপে ধাপে, যেখানে নারীর বলিষ্ঠ ভূমিকা ছিল।

১৯৭১ সালে এবং পরবর্তী সময়ে প্রায় দুই দশকজুড়ে এ দেশে নারী মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় তেমনভাবে আলোচিত হয়নি, অথচ যেখানে নারীর বলিষ্ঠ এবং দৃঢ় ভূমিকা রয়েছে।

ভাষা আন্দোলন থেকে উনসত্তরের গণ-আন্দোলন ও গণ-অভ্যুত্থানে কিশোরী শিক্ষার্থী থেকে মায়েদের উজ্জ্বল অংশগ্রহণ আছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় নারীরা পুরো দেশের মানুষের সঙ্গে যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান বলে কথা নয়, ধর্ম-বর্ণ শ্রেণির ঊর্ধ্বে উঠে নারীরা নিজের সাধ্যমতো লড়াই করেছেন। কেবল বাঙালি নয়, আদিবাসী নারীরাও এগিয়ে এসেছেন, নিজ স্বাধীনতার পথ গড়তে।

যুদ্ধের সময় যদিও বাংলাদেশ সরকারের নীতিতে নারীদের যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেওয়া, গেরিলা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করা এবং প্রশাসনিক কাজের নেতৃত্বে নারীদের দায়িত্ব দেওয়া ইত্যাদির ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো সময় ছিল না। তারপরও এ ক্ষেত্রে নারীরা বসে ছিলেন না। তাঁরা সম্মুখ সমরে অংশ নেওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছিলেন।

কলকাতায় রাজনীতিবিদ ও মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের প্রতিনিধি সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর পরিচালনায় গোবরা ক্যাম্পের ৩০০ তরুণীকে গোবরা ও ‘বিএলএফ’ ক্যাম্পে অস্ত্রের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। ঢাকা, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, বরিশাল, ফরিদপুর, খুলনা, ঈশ্বরদী, পাবনা, সিলেট, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, ময়মনসিংহসহ সব জেলায় নারীসমাজের প্রতিবাদী সভা ও মিছিল হয়েছে। এ সময় তাঁরা জেলায়, শহরে শহরে, এলাকায় এলাকায় সংগঠিত হয়ে কুচকাওয়াজ ও অস্ত্র চালনার ট্রেনিংও শুরু করেন।

সে সময়ে মায়েরা মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের অনুপ্রেরণা দিয়ে গেছেন। মায়া-মমতা ত্যাগ করে সন্তানকে লড়াইয়ের মাঠে পাঠিয়েছেন। এই ভূখণ্ডের নারীরা বাঙালির মুক্তির সংগ্রামে ত্যাগে, সাহসে কখনোই পিছিয়ে ছিলেন না। যাঁরা সরাসরি লড়াই করতে যেতে পারেননি, তাঁরা মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে রান্নার কাজ করেছেন, তাঁদের বাসস্থান পরিষ্কার করেছেন, কাপড় ধুয়ে রেখেছেন, বিভিন্ন ক্যাম্পের মধ্যে তথ্য আদান-প্রদান করেছেন, এমনকি অস্ত্রশিক্ষা নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রহরী হিসেবেও কাজ করেছেন। আবার শত্রুদের বিষয়ে, খান সেনা ও রাজাকারদের অবস্থান সম্পর্কে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে খবরও দিয়েছেন সময়-সুযোগে। বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের লুকিয়ে রাখা, অস্ত্র এগিয়ে দেওয়া, জমা রাখা অথবা যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা ও চিকিৎসা করা, তাঁদের জন্য ওষুধ, খাবার ও কাপড় সংগ্রহ করার মতো কঠিন কঠিন কোনো কাজেই নারীরা পিছিয়ে ছিলেন না। নিজে না খেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটিতে খাবার রান্না করে পাঠিয়েছেন, যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদারের হাত থেকে রক্ষা করতে নিজেদের ঘরে আশ্রয় দিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধাদের। আবার ক্যাম্পেও কাজ করেছেন। নারীদের এই সক্রিয় কর্মকাণ্ডই ছিল তাঁদের মুক্তির লড়াই, মুক্তিযুদ্ধ।

স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে শহীদ জননী এবং শহীদ জায়ারা আরেকটি লড়াই করে জীবনযুদ্ধে জয়ী হয়েছেন। তাঁদের কথা আমরা খুব একটা স্মরণ করি না। তবে তাঁরা সেই লড়াই চালিয়ে না গেলে আজকের বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছড়িয়ে দেওয়ায় বাধা আসত। শহীদ জননী এবং শহীদ জায়াদের দৃঢ়তা আর সাহসের কাছে মাথা নত করি বারবার। তাঁদের সন্তান বা জীবনসঙ্গী দেশের জন্য উৎসর্গ করে, একা জীবন পাড়ি দেওয়ার লড়াই আগামীর নারীদের জন্য উদাহরণ হয়ে থাকবে।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে নারীদের আলোকিত সময়ের, অন্যদিকে আঁধারের পথও পাড়ি দিতে হয়েছে। পাকিস্তানি সেনাদের দোসর রাজাকার ও দালালেরা নারীদের ওপর নিষ্ঠুরতম অত্যাচার চালিয়েছিল পুরো নয় মাস ধরে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রায় দুই লাখের বেশি নারী ধর্ষণের শিকার হন। পাকিস্তানি সেনারা নারীদের তাদের বাংকারে তুলে নিয়ে যেত। দিনের পর দিন ওদের বিকৃত এবং নির্মম অত্যাচারে বহু নারী অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েছিল, যদিও পরে তাঁদের বেশির ভাগই গর্ভপাত করিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যান। যুদ্ধ চলাকালে নির্যাতিত বন্দী নারীদের কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে হত্যা করা হতো সেখানেই, আবার অনেকে অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করতেন।

দুঃখজনক হলেও সত্য যে গণহত্যার প্রচুর সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া গেলেও নির্যাতিত নারীদের বিবরণ সেভাবে সংরক্ষিত হয়নি। সে সময়ে নারীদের পুনর্বাসনের দায়িত্বে থাকা সমাজকর্মী মালেকা খান বলছিলেন, ‘তখন কোনো তালিকা করা হয়নি। কারণ তাঁরা চেয়েছিলেন এই নির্যাতিত নারীদের পৃথকভাবে চিহ্নিত না করে দ্রুত তাঁরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাক।

যদিও তাঁদের নিরাপত্তার কথা ভেবে যা করা হয়েছিল, তা বর্তমান সময়ে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল যুদ্ধে নারী নির্যাতনকে জেনোসাইড অন্তর্ভুক্ত করাতে নারী নির্যাতনের জন্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সময় বদলায়, তাই বহু নির্যাতিত নারী প্রজন্মের সামনে নিজের বেদনার ইতিহাস তুলে ধরেছেন।

বীরাঙ্গনারা ধীরে ধীরে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করছেন। লজ্জায় নত নয়, মুক্তিযুদ্ধে ধর্ষিত নারীরা আমাদের রক্ত ঋণে পাওয়া স্বাধীনতার পতাকার লাল-সবুজের একাংশ হয়ে ইতিহাস আলোকিত করে বেঁচে থাকবেন।

শাওন মাহমুদ