১৪ ডিসেম্বর ২০২২ – যুগান্তর
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ শুধু ৯ মাসের যুদ্ধ ছিল না। ১৯৪৮ সালের পর ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বৈষম্য ও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে জেগে উঠছিল বাঙালি।
ইতিহাসে প্রমাণ মেলে, ভাষা আন্দোলনের পুরোটাজুড়েই বুদ্ধিজীবীদের অবস্থান ছিল স্থির ও একতাবদ্ধ। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার দাবিকে স্বাধিকার আন্দোলন থেকে রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপ দিয়েছিলেন। এর পরের ইতিহাসে ’৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬ সালের ছয় দফা, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭০ সালের নির্বাচন এবং সর্বোপরি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধসহ প্রতিটি ক্ষেত্রেই বুদ্ধিজীবী সমাজ সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিপ্লব জাগ্রত করেছেন। বুদ্ধিজীবীরা এক দিকে পূর্ব পাকিস্তানের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবিচারের ব্যাখ্যা দিয়েছেন, অপর দিকে বাঙালির সাংস্কৃতিক যুদ্ধকে ত্বরান্বিত করেছেন। এসব কারণেই মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকেই বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও সামরিক জান্তাদের কাছে সবচেয়ে বড় শত্রু হয়ে উঠেছিলেন। আমরা সবাই বাঙালি-এই একটি স্লোগানেই সৃষ্টি হয়েছিল উপন্যাস, গল্প, কবিতা, গান, নাটক, নৃত্যনাট্য, কলাম। এ অনন্য স্বকীয়তার প্রকাশ পৃথিবীর কাছে অন্যান্য ভূমি থেকে আমাদের ভূখণ্ডকে একেবারে আলাদা এক দৃষ্টান্তের রূপ দিয়েছিল। ভাষা আন্দোলন ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সাংস্কৃতিক লড়াই থেকে পাওয়া ‘স্বকীয়তা’ ছিল বাংলাদেশের মানুষের শ্রেষ্ঠ অর্জন।
মুক্তিযুদ্ধ একটি জনযুদ্ধের উপাখ্যান। তখনকার রাজনীতিকদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে বুদ্ধিজীবীদের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের লড়াইয়ের ফসল। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক অটল সিদ্ধান্ত। সাধারণ মানুষের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার লড়াইটা তৃণমূল থেকে শুরু করেছিলেন বুদ্ধিজীবীরা। তাই তারা অনেক আগে থেকেই শত্রুপক্ষের কাছে ছিলেন আলাদা ছকে আঁকা। বুদ্ধিজীবীদের লক্ষ্য করা হয়েছে তাদের নিজ নিজ কর্মক্ষেত্র থেকে যুদ্ধকালীন পর্যন্ত। দেশভাগের পর বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিকাশে যে কয়টি আন্দোলন হয়েছে, তার প্রায় সবক’টির শুরুটা ছিল বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ফসল; যা পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক আন্দোলনে পরিপূর্ণ রূপ নিয়েছিল। প্রতিটি ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনেই আলোকবর্তিকা হয়ে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন বুদ্ধিজীবীরা এবং একাত্তরে বুদ্ধিজীবী হত্যায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সর্বক্ষেত্রে সহায়তা করেছিল জামায়াতে ইসলামী ও এর ছাত্রসংগঠন ছাত্রসংঘ, শান্তি কমিটি, আল-শামস, রাজাকাররা। পরাজয় নিশ্চিত হয়ে যাওয়ায় তাদের লক্ষ্য ছিল বুদ্ধিজীবী নিধন। আগামীর বাংলাদেশকে সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও শিক্ষাগত দিক থেকে দুর্বল ও পঙ্গু করে দেওয়া।
বাংলাদেশের আদর্শ-গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার স্তম্ভে তৈরি। স্বাধীন বাংলাদেশ এ আদর্শগুলোকে খুব হালকাভাবে নেওয়া শুরু করে। এ বিষয়গুলোকে লালন, ধারণ ও সংরক্ষণে তাই চলে এসেছিল অলসতা। জীবিত মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন, বুদ্ধিজীবীরা আপসে অভ্যস্ত হতে থাকেন এবং রাজনীতিতে লোভ প্রবেশ করতে থাকে। এসব কারণে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে এসেছিল স্থবিরতা, স্বাধীনতাবিরোধীদের ক্ষমতা দখল এবং ইতিহাস বিকৃতির প্রবণতা। আজ বিজয়ের ৫১ বছর পূর্তিতে এসে যার ফলাফলে আমরা পাচ্ছি ধর্মান্ধতা, আপস, ক্ষমতার আধিপত্য বিস্তার, অপসংস্কৃতি, শিক্ষায় বিকৃত ইতিহাস। একাত্তরে বুদ্ধিজীবী হত্যার ফলাফল সর্বক্ষেত্রে বিরাজমান। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে রাষ্ট্র এখন ধর্মীয়প্রতিষ্ঠান ও এতিমখানা খাতে যে পরিমাণ বার্ষিক বাজেট ব্যয় করে, তার একশ ভাগের তিন ভাগও ইতিহাস সংরক্ষণ, গবেষণা বা সাংস্কৃতিক খাতে ব্যয় করা হয় না। আপসকামী বুদ্ধিজীবীরা শিক্ষা, সংস্কৃতি, কৃষ্টি বা ঐতিহ্য নিয়ে তৃণমূলে কাজ করার বদলে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় টকশো করতে ব্যস্ত থাকেন।
দুঃখজনক হলেও সত্যি, ’৭৫-পরবর্তী বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে সৎ সাহসের প্রচণ্ড অভাব ছিল। সে সময়ে স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে, বঙ্গবন্ধুকে মুছে ফেলার চক্রান্ত করা হয়েছে, আমাদের প্রাণের স্লোগান ‘জয় বাংলা’র ওপর নিষিদ্ধ শব্দটি জারি করা হয়েছে, শহিদ বুদ্ধিজীবী পরিবারগুলোকে বঙ্গবন্ধুর উপহার দেওয়া বাড়িগুলো থেকে পুলিশ দিয়ে উচ্ছেদ করা হয়েছে। কিন্তু সেই প্রজন্মের বুদ্ধিজীবীরা ক্ষমতাসীনদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করার মতো সাহসের অভাবে চুপ করে ছিলেন। দেশকে মেধাশূন্য করার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চেষ্টায় স্বাধীনতাবিরোধীরা অনেক ক্ষেত্রে সফল হয়েছিল। শহিদ বুদ্ধিজীবীদের শূন্যতা প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রকটভাবে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। সে সময়কার বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে সেই শূন্যতা পূরণের তাগিদ আসেনি তাই। ধীরে ধীরে রাজনীতিতে প্রবেশ করেছেন ব্যবসায়ীরা। স্বাভাবিকভাবেই গবেষণা বা ইতিহাস সংরক্ষণ, সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রয়োজনবোধ করেন না তারা। গণমাধ্যমের প্রসার ঘটেছে অনেক, তবে ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো হয়ে গেছে দিনভিত্তিক। অথচ আধুনিক সময়ে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলো সবচেয়ে ভালো আর্কাইভ করার ক্ষমতা রাখে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি রোধে আর্কাইভ করার প্রচেষ্টায় তেমন কোনো বড় উদ্যোগ দেখা যায়নি এ মাধ্যমে। কারণ, বেশির ভাগ গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান ব্যবসায়ী গ্রুপ বা ব্যক্তি মালিকানাধীন।
মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে সবচেয়ে জরুরি কাজ-একাত্তরের শহিদ মুক্তিযোদ্ধা, শহিদ বুদ্ধিজীবী, বীরাঙ্গনা এবং রাজাকারের তালিকা প্রণয়ন-এখনো অসম্পূর্ণ। বর্তমান সময়ে গেজেটে লজ্জাজনকভাবে খুঁজে পাওয়া যায় এমন প্রায় ২০০০ মুক্তিযোদ্ধার নাম, যাদের বয়স বর্তমানে ৫০ বছর! শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস গুরুগম্ভীরভাবে অনুষ্ঠিত হলেও তাদের অনেকেরই পূর্ণাঙ্গ তালিকা বা স্বীকৃতি নেই এবং পাঠ্যপুস্তকে তাদের পূর্ণাঙ্গ জীবনী রাখা হয়নি। সরকারিভাবে বুদ্ধিজীবীদের একটি তালিকা এলেও তাদের গেজেট নিবন্ধন করতে জন্ম, মৃত্যু বা ট্রেনিং সার্টিফিকেট লাগে। আমার মতো শহিদ সন্তানরা অত্যন্ত সংশয়ে পড়ে যায়, কারণ, বাবার মৃত্যুর দিন বা কবর কোথায়, তা আমাদের জানা নেই। তারপরও কিছুটা স্বস্তি যে, বর্তমান সরকার শহিদ বুদ্ধিজীবীদের একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর শহিদ বুদ্ধিজীবীদের একটি প্রাথমিক তালিকা চূড়ান্ত করেছে। এতে ১২২২ জন শহিদ বুদ্ধিজীবীর নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এবং মুক্তিযুদ্ধে শহিদ বুদ্ধিজীবীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরির অংশ হিসাবে শহিদ বুদ্ধিজীবীর সংজ্ঞা চূড়ান্ত করেছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। নতুন সংজ্ঞা অনুযায়ী, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ৩১ জানুয়ারি ১৯৭২ পর্যন্ত সময়কালে যেসব বাঙালি সাহিত্যিক, দার্শনিক, বিজ্ঞানী, চিত্রশিল্পী, শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক, আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, স্থপতি, ভাস্কর, সরকারি-বেসরকারি কর্মচারী, রাজনীতিক, সমাজসেবী, সংস্কৃতিসেবী, চলচ্চিত্র, নাটক ও সংগীতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন এবং এর ফলে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী কিংবা তাদের সহযোগীদের হাতে শহিদ কিংবা ওই সময়ে চিরতরে নিখোঁজ হয়েছেন, তারা শহিদ বুদ্ধিজীবী হিসাবে বিবেচিত হবেন।
মুক্তিযুদ্ধে শহিদ বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ইতিহাসে ঘটে যাওয়া অন্যান্য ভয়াবহ জেনোসাইডের সঙ্গে মিলে যায়। ১৬ ডিসেম্বর ’৭১-এর বিজয় দিবসে একদিকে আনন্দ মিছিল, অন্যদিকে রায়ের বাজারের বধ্যভূমিতে নিজ দেশের সেরা সন্তানদের ছিন্নভিন্ন দেহগুলো পরিবেশকে শোকাচ্ছন্ন করে তোলে। ব্রিটিশ সাংবাদিক নিকোলাস টোমালিন বাঙালিদের বধ্যভূমি পরিদর্শন করে গণমাধ্যমে শিরোনাম দিয়েছিলেন-‘বাংলার বুদ্ধিজীবীরা এক খাদে মরে পড়ে আছেন। বিজয়ের ৫১ বছর পূর্তিলগ্নে আবারও মনে করিয়ে দিতে চাই, মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের ওপর ঘটে যাওয়া জেনোসাইডের জন্য পাকিস্তান এখনো ক্ষমা চায়নি। আশায় থাকব, আগামী প্রজন্ম সোচ্চার ও সফল হবে আমাদের এ রেখে যাওয়া দাবিগুলো নিয়ে।
শেষে একটি অভিমানের কথা জানাতে চাই-ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের আবাসন প্রকল্পের ছবিগুলো যখন দেখেছিলাম, বিমোহিত হয়েছিলাম। মনে প্রশ্ন জেগেছিল-আচ্ছা, এই যে স্বাধীনতার এত বছর পার করে ফেলল বাংলাদেশ, কারও কি একবারও মনে হয়নি যে বীরাঙ্গনা, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আর শহিদ পরিবারগুলোর জন্য এমন আবাসন প্রকল্প গড়ে তোলা যেত? কতই না কষ্টে জীবনযাপন করেছেন তারা। খেয়ে-না খেয়ে, সমাজচ্যুত হয়ে, ভিক্ষা করে, ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হয়েও বেঁচে থেকেছেন। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের চেয়েও ক্ষুদ্র চাহিদার জীবন পার করেছেন। তাহলে কেন তাদের এত কষ্টের জীবনযাপন করতে দিয়েছে বাংলাদেশ?
শাওন মাহমুদ : শহিদ আলতাফ মাহমুদের কন্যা