‘শাওন জেগে থাকে। ঝিনু জেগে থাকে। শিমূল জেগে থাকে। গত ৪৬ বছর ধরে এই রাতে জেগে থাকে। জীবনের শেষ বছরেও এই রাতে জেগে থাকবে। ভোরবেলায় ছটফট করে উঠবে। এই রাত কখনো ঘুমের রাত নয়।
আলতাফের চলে যাওয়া রাতের ভোরটুকু কখনো শেষ হওয়ার নয়।’
উপরের কথাগুলো শহীদ আলতাফ মাহমুদকন্যা শাওন মাহমুদ লিখেছেন তার ফেইসবুক স্ট্যাটাসে। আশা করছি আমাদের পাঠকদের আলতাফ মাহমুদের কথা মনে আছে। জ্বী, তিনি একজন সুরকার ছিলেন, একজন গীতিকার, কণ্ঠযোদ্ধা ছিলেন। তিনি সেই আলতাফ মাহমুদ যিনি আমাদের রক্তের গান, আমাদের আত্মার গান, আমাদের পরিচয়ের গান, আমাদের ভাষার গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানের সুরকার। ছোটবেলা থেকে আমার মতো অনেকেই তাকে কেবল চিনেছে এই গানের সুরকার হিসেবেই। এর বেশি জানার সুযোগ আমাদের হয়নি। কেন হয়নি সে কথা অনেকবার অনেক জায়গাতেই ব্যাখ্যা করা আছে। তাও যারা ভুলে যায় তাদের জন্য বলি, ১৯৭৫ পরবর্তী সময়টাতে একটু ঘুরে আসুন। তখন কারা ক্ষমতায় ছিল, কী তাদের দর্শন ছিল, বাংলাদেশকে তারা কতটা চেয়েছিল সেইসব প্রশ্নগুলোর উত্তরের ভেতরেই লুকিয়ে আছে এই আজকের ‘কেন’র উত্তর।
প্রতি বছর ৩০ আগস্ট আসে। আমার মতো কোটি বাংলাদেশির কাছে এই দিনটি একটি সাধারণ দিন। আজকে যখন এই লেখাটি লিখছি তখন আমরা গোটা জাতি বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে প্রথমবারের মতো অস্ট্রেলিয়ার মতো বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন টিমকে টেস্ট ম্যাচে পরাজয়ের খবরে উল্লাস প্রকাশ করছি। একই সকালে খবর এলো বাংলাদেশের আরেক কিংবদন্তি গায়ক, একজন মুক্তিযোদ্ধা, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম শিল্পী এবং বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত স্নেহভাজন আবদুল জব্বার দীর্ঘদিন রোগভোগের পর আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। জয়ের হাত ধরে আসে বিয়োগের ক্ষণ। এমনি করে একে একে চলে যাচ্ছে আমাদের আকাশের তারকারা।
আমাদের এই প্রজন্ম হয়তো মুক্তিযুদ্ধ বলতে এখনো মোটাদাগে বুঝি ৭ জন বীরশ্রেষ্ঠের কাহিনি। সংখ্যাটা মুখস্থ আছে, ৩০ লাখ মানুষ জীবন দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই ৩০ লাখ মানুষের মাঝে যারা বিশেষ ছিলেন সেইসব আত্মত্যাগী মানুষদের কয়জনকে জানি বা চিনি? কয়জন জানি আমরা শহীদ রুমী,শহীদ জুয়েল, শহীদ বদিদের কথা? অথচ এইসব তরুণেরা কতটা সাহসের সঙ্গে একের পর এক সফল গেরিলা আক্রমণ করেছিল যা আমাদের যুদ্ধকে সফলতার দিকে ত্বরান্বিত করেছিল। একজন আলতাফ মাহমুদকে আমরা ছোটবেলা থেকে চিনে এসেছি কেবল একুশের গানের সুরকার হিসেবে কিন্তু তিনি যে একজন ভাষা সৈনিক ছিলেন, মুক্তিযুদ্ধ করতে গিয়ে এই আমাদেরকে মুক্ত স্বাধীন দেশে বসবাসের অধিকার আদায় করে দিতে গিয়ে কেমন করে সেদিন নিজেদের অধিকারকে বিনা দ্বিধায় ত্যাগ করেছিলেন সে কাহিনি আজও পর্দার অন্তরালেই চাপা থাকে। একজন আলতাফ মাহমুদকে তাই চেনাতে লড়াই করে যেতে হয় তার একমাত্র সন্তান শাওন মাহমুদকে।
শহীদ আলতাফ মাহমুদ ছিলেন একজন গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ঘাটলে সেখানে কিছু তরুণের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা একটি বিশেষ বাহিনীর নাম পাওয়া যায়। ‘ক্র্যাক প্লাটুন’ বা ‘ঢাকা ক্র্যাক প্লাটুন’ নামে যা পরিচিত ছিল। সেই প্লাটুনের ‘ক্র্যাক’দের কথা জানতে হলে চিনতে হবে আজাদ, বদি, রুমি,বদিদের। জানতে হবে কেমন করে একজন আলতাফ মাহমুদ সংগীতের লোক হয়ে জড়িয়ে পড়লেন সরাসরি গ্রেনেড হাতে যুদ্ধে? অথচ সংগীতের লোক হয়ে তাঁর তো কেবল গানের সুর করে আর গলায় গান নিয়েই থাকার কথা ছিল। কী সেই চেতনা যা তাঁর মতো একজন মানুষকে লড়াইয়ে উদ্বুদ্ধ করল, অত্যাচারের প্রতিশোধ নিতে শেখালো?
শহীদ আলতাফ মাহমুদের কন্যা শাওন মাহমুদের শ্রমে গড়ে উঠেছে একটি ওয়েব সাইট। জানা যায়, তিনি আগাগোড়াই ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা। হঠাৎ করে ১৯৭১ তাঁকে যোদ্ধা বানায়নি। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি মানুষের সংগ্রামের সঙ্গে ছিলেন। লড়াই করেছেন অধিকার হারানো মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য। অবদান রেখেছিলেন গানের মাধ্যমে, ছোট ছোট দল গঠন করে মানুষের মাঝে গানে গানে চেতনা জাগাতে। মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতারের জন্য গান লিখে পাঠাতেন তিনি। ৫২’র ভাষা আন্দোলন থেকে ৭১ পর্যন্ত তিনি ছিলেন বাংলার যেকোনো অধিকার আদায়ের লড়াইয়ের সৈনিক।
১৯৭১ সালের ৩০ আগস্ট ভোর ৫.৩০ মিনিটে আলতাফ মাহমুদকে তাঁর আউটার সার্কুলার রোডের বাসা থেকে পাকিস্তানি আর্মিরা ধরে নিয়ে যায়। পরিবারের অধিকাংশ সদস্য তখন ঘুমিয়ে ছিল। সেদিন থেকে ছোট্ট শাওন হয়ে পড়ে পিতৃহারা। জীবনের সবচেয়ে দামি সম্পদ হারিয়ে পরিবারটি হয়ে পড়ে ছন্নছাড়া। এরপর তিনি আর ফিরে আসেননি। এভাবেই সেদিন হারিয়ে গিয়েছিল হাজারো লক্ষ আলতাফ মাহমুদ। তাঁরা হারিয়েছিলেন বলেই আজকের বাংলাদেশ। তাঁরা নিজেদের দিকে তাকাননি বলেই আজকের আমাদের কথা বলা, পথা চলা, নিজের অধিকার নিয়ে লড়াইয়ের শক্তি পাওয়া। জানা যায় পাকিস্তানিদের পশুত্বের সঙ্গে লড়াই করে আলতাফ মাহমুদ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। পাকিস্তানি সেনারা কী পরিমাণ অমানুষিক অত্যাচার করে মেরেছে আমাদের সেইসব মুক্তিযোদ্ধাকে সেই কাহিনি আমরা ক’জনেইবা জেনেছি? জানলেও বুঝেছি, মগজে ধারণ করেছি?
আমার মনে আছে আলতাফ মাহমুদ একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, তিনি শহীদ হয়েছিলেন, পাকিস্তানিদের অত্যাচারের শিকার হয়েছিলেন এই কথাগুলো প্রথম জানতে পারি শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ‘৭১ এর দিনগুলি’ বইটি পড়তে গিয়ে। সেখানে অনেক নাম না জানা মানুষের কাহিনি পড়েছিলাম। জেনেছিলাম, উনার বড় ছেলে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন কিন্তু কী তাঁর নাম, কারা তাঁর সাথী ছিল, কেমন করে তাঁরা শহীদ হয়েছিলেন সেসব বিস্তারিত জেনেছিলাম জননীর সেই বই থেকে। চোখের জলে বইয়ের পাতা ভিজে গিয়েছিল। প্রতিটি লাইনে লাইনে ছিল নৃশংসতার বিবরণ। কিন্তু আজকের প্রজন্মর কাছে আলতাফ মাহমুদের পরিচয় খুবই অল্প।
৩০ আগস্টে জাতীয়ভাবে হয় না কোনো স্মৃতিচারণের অনুষ্ঠান। বাবার আত্মত্যাগকে জানানোর দায় যেন কেবল একার শাওনের কাঁধেই। বড় অকৃতজ্ঞ আমরা। কত সহজেই ভুলে যাই আলতাফদের। কত সহজে মেনে নেই একজন মুক্তিযোদ্ধার চোখ উপড়ে ফেলা পাকিস্তানিদের অত্যাচারের কাহিনিকে।
তারপরও আশা দেখি। চোখের জলে আলো খুঁজি। আমাদের প্রজন্ম আলতাফ মাহমুদের মতো লাখো শহীদের রক্তকে ভুলে যাবে না। হারিয়ে যেতে দেবে না তাদের মৃত্যুর যন্ত্রণাকে। বুকে ধারণ করতে শিখবে আলতাফ মাহমুদের মতো লাখো শহীদের শানিত চেতনাকে। হাতে হাত রেখে, বুক বুক রেখে, কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে, মাথা উঁচু করে কেবল সামনেই এগিয়ে যাবে। ভুলে যাবে না ২৫ মার্চ, ২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বর, ৩০ আগস্টের মতো দিনগুলোকে। শহীদ আলতাফ মাহমুদ আছেন আমাদের প্রেরণায়, আমাদের চেতনায়, আমাদের রক্তে তিনি জেগে থাকবেন চিরকাল। লড়াই শেষ হয়ে যায়নি। লাখো শহীদের রক্তের ঋণে ঋণী আমরা।
-লেখক, কলামিস্ট