শাওন আর মা’কে নিয়ে নতুন বাসায় উঠে পরলাম, নিজেদের বাসা, মাসের শেষে কড়কড়ে টাকাগুলো আমার পকেট থেকে দৌড়ে বাড়িওয়ালার পকেটে আর যাবেনা, এই খুশীতেই আমি আত্মহারা। আমাদের বাসাটার ভেতরের কিছু কাঠামোগত পরিবর্তন আমি আমার মত করে নিলাম, আগে ছিল সদর দরজা দিয়ে ঢুকলেই বিরাট একটা খোলা জায়গা যেটা ডাইনিং আর ড্রয়িং হিসেবে ব্যবহার করার কথা, দেখলাম তাতে বেডরুম থেকে বেরুলেই দেয়ালে একটা হাত ধোবার বেসিন চোখে পরে। বেসিন বিদেয় হলো, দেয়াল তুলে বেডরুম পেরিয়ে আর একটা রুম হলো যেটা আমাদের টিভি রুম, বেশীরভাগ সময় এখানেই এখন কাটে আমাদের। একটা মায়ের বেডরুম, একটা আমাদের আর খালি একটায় আমার হোম স্টুডিও বানিয়ে ফেললাম পরে, যেখানে মানুষ এলে বসানো যায় আবার দরজা আটকে নিজের মত গানবাজনা নিয়ে থাকা যায়।আমার নীচের ফ্লোরগুলোতে এখনো এই মহামান্য বেসিন রাজত্ব্য করে যাচ্ছে।
নতুন বাসায় এসে আমাদের ইলেকট্রিক মিস্ত্রি নিয়ে রুমগুলোতে ফ্যান লাগাচ্ছি, শাওন আমাকে ডেকে নিয়ে গেল বেডরুমে। ফ্যানের দিকে ইশারা করে বললো এটা কিরে? বললাম ফ্যান, আবার কি? সিলিং এর এই জায়গাটায় ফ্যানই তো থাকার কথা নাকি চাঁদ থাকবে? ফ্যান থাকার কথা, লাগাবি সেটাও ঠিকও আছে শুধু এটা তৈরি কোথায় সেটা ঠিক নাই। আমি বললাম পাক ফ্যান, স্টেডিয়ামের দোকানি বলেছে এটা খুবই ভাল, বাতাসে প্রায় উড়িয়ে নিয়ে যায়। তুই আজ থেকে একা এইরুমে থাকবি আর উড়বি, আমাকে ভুলেও এইরুমে ডাকবিনা।
কথা না বাড়িয়ে মিস্ত্রিকে ডেকে বললাম, ভাই এই ফ্যানটা খুলে তোমার লাগলে নিয়ে যাও।অবাক হয়ে বলে এটাতো একেবারে নতুন স্যার, দিয়ে দেবেন? ভাই, নিলে নিয়ে যা, কথা কম। প্রায় উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে এমন পাক ফ্যান বিদেয় হলো বাসা থেকে।
মুক্তিযুদ্ধকালে আমি অত্যন্ত ভাগ্যবান যে পরিবারের কাউকে হারাতে হয়নি, তাই হারাবার বেদনা বোঝার ক্ষমতা অপ্রতুল।পাকীদের সহ্য হয়না তবে আমার অবস্থা কিছুটা “খেলার ভেতর রাজনীতি মেশাবেন না” টাইপ, পাকিস্তানী ক্রিকেট টিমের খেলা ভাল পাই, এদের কারো কারো ভক্তও আমি আর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে পড়াশোনা প্রায় শূন্যের কোঠায়। ফ্যানের বিষয়টা ভাবিয়ে তুললো আমাকে।
সময় যায়, আমি একটু একটু করে শাওন আর মায়ের কাছে একজন আলতাফ মাহমুদ সম্পর্কে জানতে চাই, মা ছোট ছোট করে জীবনের গল্প বলেন যখন যেটা মনে আসে। খাবার টেবিলে একদিন মা জানালেন “আলতাফ” যে খাবারগুলো পছন্দ করতেন সেগুলো উনি আর রাঁধেন না, অন্য কোন দাওয়াতে সামনে থাকলে ছুঁয়েও দেখেন না, গলা দিয়ে নামতে চায়না আর। যেমন কাটা মসলার গরুর মাংস, চিতল মাছের কোপ্তা ইত্যাদি ওনার জীবন থেকে হারিয়ে গ্যাছে।
শাওন তখন মায়ের পেটে, জুলাই মাস, তীব্র গরম। বাসায় ফ্রিজ না থাকায় মা পাশের বাসা থেকে এক বোতল ঠাণ্ডা পানি চেয়ে নিয়ে এসেছেন।আলতাফের চোখে পরলো, কিছু না বলে বেরিয়ে যেয়ে ভ্যানগাড়িতে করে ফ্রিজ নিয়ে ফিরলেন।জানা গেল টাকা না থাকায় কোন এক বন্ধুর কাছ থেকে ধার করে বউয়ের ঠাণ্ডা পানির ব্যবস্থা করেছেন।
বাবা কাজে গ্যাছেন, ছোট্ট শাওন গুট গুট করে পাশের বাসায় গ্যাছে।ওখানে জাম দেখেছে আর সেই বাসার মহিলা ওকে দেখে সেটা লুকিয়েছেন।শাওনের কান্না শুরু, জাম খাবেই। আলতাফ বাসায় ফিরে দেখেন মেয়ে কাঁদছে, জানলেন ঘটনা।যেয়ে মরিস মাইনর গাড়ির ডিক্কিতে একমন জাম কিনে ফিরলেন।মাকে বললেন ওকে ডিক্কিতে জামের ওপর বসিয়ে দাও, খেতে থাকুক। পাশের বাসার মহিলা অনেক লজ্জা পেয়েছিলেন এই ঘটনায়।
প্রায় প্রতিদিনই মা আর শাওনের কিছু না কিছু মনে হয়, ওরা মন খারাপ করে সাথে আমিও। বিশেষ বিশেষ দিনগুলোতে শাওন আর মা অস্থির করে, সারারাত জেগে থাকে, একটু আওয়াজ হলে শিউরে ওঠে – চোখে না দেখলে কেউ বুঝবে না।বাসায় শাওনের কাছে একটা ট্রাঙ্কে বাবার স্মৃতি গুছিয়ে রাখা, ডাইরি, ড্রাইভিং লাইসেন্স, একটা শাল, বাবার হাতে লেখা গানের স্বরলিপি আরও ছোট ছোট জিনিস। প্রতিটাতেই ওর বাবার হাতের স্পর্শ মিশে আছে।শাওন প্রায়ই ওগুলো বের করে ছুঁয়ে দেখে, আমাকে গানের স্বরলিপি দেখিয়ে বলে, বুঝিস কিছু? আমি নাদান মানুষ, মাথা নাড়ি, নারে, আমিতো গানই শিখিনি এ জিনিস বুঝবো কিভাবে। লেখাগুলোর ওপর আঙুল ছুঁয়ে ছুঁয়ে ও বাবার হাতের স্পর্শ খোঁজে, আমার চোখ ভিজে ওঠে, আমি পরিবর্তিত হতে থাকি।
পাঞ্জাবী পরলে আমি নাগরা পরি, দোকানি পাকিস্তানী নাগরা বলে আমাকে গছিয়েছে। একদিন পাঞ্জাবী পরার পর নাগরা পরে শাওনকে বললাম, দেখতো ঠিক আছে? পায়ের কাছে এসে চোখ আটকে গেলো, জানা গেল নাগরা পাকিস্তানেরই, ওটাও বিদেয় হলো বাসা থেকে।এই শেষ,আমাদের বাসায় পাকিস্তানী সুতোও ঢোকেনা, কোনদিন পাকী কিছু ঢোকার সম্ভবনাও নাই।
আমার ভেতর শেষ পরিবর্তন ঘটল আলতাফ মাহমুদের জন্য ওয়েব সাইট তৈরি করার সময়। অনেক মানুষের লেখা, প্রতিটা পড়ছি আর পাকী নৃশংসতার কথা জানছি।কিছু প্রশ্ন শাওনকে করছি, সব ওর বুকের ভেতর সযতনে আগলে রাখা। বেশিরভাগই একজন আলতাফ মাহমুদকে কাছে থেকে দেখা মানুষের অভিজ্ঞতা।জেনে ফেললাম বিশাল এক মানুষের কার্যকলাপ তাঁর কাজের পরিধি আর তাঁর পাগলামি।জানলাম ক্র্যাক প্লাটুনের দামাল ছেলেদের কথা।
মা আর শাওনের কাছে শুনি একজন বঙ্গবন্ধুর গল্প, কিভাবে মা’কে সাহস দিয়েছিলেন, বলেছিলেন উনি থাকতে যুদ্ধে স্বজন হারানো পরিবারগুলোর চিন্তার কোন কারন নেই।৩২ নম্বর বাসায় মা যখন খুশী যেতে পারতেন, খাবার টেবিলে বসিয়ে খাইয়ে ছাড়তেন বঙ্গবন্ধু পত্নী।এক টাকার বিনিময়ে মুজিবের ১ নং মালিবাগে মা’কে দেয়া বাড়ি, যেটা থেকে পরে উচ্ছেদ করা হয়েছিল ওদেরকে। মায়ের মাথায় কখনোই আসেনি বঙ্গবন্ধু হত্যার পর কোনদিন কেউ এসে তাকে বলবে এটা অন্যের বাড়ি আপনি দখলে আছেন।মায়ের সব ভাই বোনেরা থাকতো ওখানে, এদেরও কারো মাথায় আসেনি বাড়িটার পাকাপোক্ত কাগজ করা দরকার কারন মাথার ওপর বটবৃক্ষের মত মুজিব তো আর নেই। যা হবার তাই হলো, নকল দলিল বানিয়ে সপরিবারে এদের উচ্ছেদ করা হলো একদিন। শহীদের প্রতি বিন্দুমাত্র কৃতজ্ঞতা বোধ কাজ করলোনা আমাদের ভেতর।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে পড়াশোনা আর আলতাফ পরিবারকে খুব কাছে থেকে দেখে একটা সময় আমার ভেতর পাকিস্তানের জন্য ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট রইলো না। দেশের জন্য আমি একা কি করতে পারি এটা না ভেবে, “যে যার জায়গা থেকে যতটুকু পারি করি” এই মন্ত্রে আমি বিশ্বাসী হয়ে উঠলাম। আমার পরিধি গান, সেখান থেকেই শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ আর দেশকে ভালবাসা।আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল কলকাতার অমিত গোস্বামী, যে বাংলাদেশকে বুকের ভেতর লালন করে।ধীরে ধীরে বেরিয়ে এলো দেশ ছাড় রাজাকার, তিস্তা, ক্র্যাক প্লাটুন, স্টপ জেনোসাইড, টিটোর স্বাধীনতা।হাত বাড়ালেন অমি পিয়াল ভাই, সৃষ্টি হলো বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গান “পিতা”। একুশ বছরের ছেলে তাঞ্জিল রহমান, শাওনের কাছে ক্র্যাক প্লাটুনের গল্প শুনে আমার মতই দেশের জন্য ভালবাসা বুকে লালন করে। একদিন লিখে নিয়ে এলো গান, সৃষ্টি হলো “আজাদ” এর।বুদ্ধিজীবী হত্যার প্রতিবাদ হলো মনিরুল ইসলাম রানা’র “স্বাধীনতার বীজমন্ত্র” দিয়ে।
বয়স বাড়ছে, আমি ভাবছি সময় নাইরে, এখনো অনেক কাজ বাকী,একজন আলতাফ বা তিরিশ লক্ষ শহীদের ঋণ শোধ হবার।যুদ্ধে স্বজন হারানো একটা পরিবার আমাকে উপলব্ধি করতে শিখিয়েছে “যার যায় সে শুধু জানে হায়, যে হারায়”