দরাজ গলায় মধুর সুরে কোরান শরীফ পাঠ করতেন তিনি। সবাই ভাবতো, বড় হয়ে নিশ্চয়ই অনেক বড় ক্বারী হবেন। সবার মন জয় করে নিয়েছিলেন। বাড়ির সামনে বেঞ্চিতে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গান গাইতেন। আর সে গানে মুগ্ধ হতো পরিবারের লোকজন, সহপাঠীরা থেকে শুরু করে স্কুলের শিক্ষকরাও।
শুধু যে গান করতেন তাই নয়, ছবি আঁকাতেও ভীষণ পারদর্শী ছিলেন তিনি। ১৯৫২ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত বিভিন্ন আন্দোলনে-সংগ্রামে তাঁকে দেখা গেছে প্ল্যাকার্ড, ফেস্টুন, ব্যানার আঁকতে। ছবি আঁকা ছিল তাঁর নেশা।
তবে তাঁর সবচেয়ে বড় নেশা ছিল গান। নিজে গান লিখতেন, সুর করতেন। গেয়ে শোনাতেন। প্রায় সব রকম বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পারতেন তিনি। হারমোনিয়াম, তবলা, বেহালা, পিয়ানো, বাঁশি, পার্কেশন সবকিছুতেই পারদর্শী ছিলেন। ষাটের দশকে এসে অর্কেস্টেশন সম্পর্কে বিরল জ্ঞান অর্জন করেন। সে সময়ে উপমহাদেশের অল্প যে কয়জন সংগীতজ্ঞ এ সম্পর্কে জ্ঞান রাখতেন তাদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম।
হ্যাঁ, আমি অমর গীতিকার সুরকার শহীদ আলতাফ মাহমুদের কথা বলছিলাম। হাজার হাজার বেয়নেটের চেয়ে শক্তিশালী ছিল যাঁর একটি সুর– “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি “র সেই মৃত্যুঞ্জয়ী সুরস্রষ্টা আলতাফ মাহমুদের কথাই বলছিলাম…।
১৯৩৩ সালের ২৩ ডিসেম্বর বরিশাল জেলার মুলাদি উপজেলার পাতারচর গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৮ সালে বরিশাল জিলা স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন পাস করে ভর্তি হন বিএম কলেজে। পরে চিত্রকলা শেখার জন্য ভর্তি হন কলকাতা আর্ট কলেজে। তিনি বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ সুরেন রায়ের কাছ থেকে সংগীতের প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। বাংলার মানুষের অন্তরের কথাগুলো গণসংগীতের ভাষায় তুলে আনতে শুরু করলেন তিনি। সে ভাষার সাথে যে তাঁর জন্ম জন্মান্তরের সখ্যতা…।
১৯৫০ সালে আলতাফ মাহমুদ ঢাকায় আসেন এবং ধূমকেতু শিল্পী সংঘে যোগ দেন। পরবর্তীতে তিনি এই সংস্থার সংগীত পরিচালক পদে আসীন হন। ১৯৫৩ সালে “ভিয়েনা শান্তি সম্মেলন” এ যোগ দেয়ার জন্য আমন্ত্রণ পান তিনি। কিন্তু করাচিতে পাকিস্তান সরকার তাঁর পাসপোর্ট আটকে দেয়ায় তিনি আর সেখানে যোগ দিতে পারেননি। ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত তিনি করাচিতে অবস্থান করেন এবং ওস্তাদ আব্দুল কাদের খাঁ’র কাছ থেকে উচ্চাঙ্গ সংগীত শেখেন। এছাড়া তিনি বিখ্যাত নৃত্য পরিচালক ঘনশ্যাম এবং চলচ্চিত্র পরিচালক দেবু ভট্টাচার্যের সাথেও সহকারী হিসেবে কাজ করেন।
করাচি থেকে ঢাকা ফেরার পর আলতাফ মাহমুদ অনেকগুলো চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনা করেন। এগুলো হলো– তানহা (বেবী ইসলাম), বাহানা (জহির রায়হান), ক্যায়সে কাহো (জহির রায়হান), কার বউ (চাষী নজরুল ইসলাম), রহিম বাদশা ও রূপবান (সফদর আলী ভূঁইয়া), সান অব পাকিস্তান (ফজলুল হক), ময়ূরপঙ্খী (সাদেক খান), আনোয়ারা (জহির রায়হান), আলী বাবা (চাষী নজরুল ইসলাম), বড় বউ (রহিম নেওয়াজ), সপ্তডিঙা (দারাশিকো), মিশর কুমারী (চাষী নজরুল ইসলাম), বেদের মেয়ে (নূরুল হক বাচ্চু), টাকা আনা পাই (বাবুল চৌধুরী), দাতা হরিশ্চন্দ্র (বাবুল চৌধুরী), চৌধুরী বাড়ি (নাজমুল হুদা), শপথ নিলাম (জীবন চৌধুরী), কখনো আসেনি (জহির রায়হান), কুচবরণ কন্যা (নূরুল হক বাচ্চু), সুয়োরানী দুয়োরানী (রহিম নেওয়াজ), দুই ভাই (নূরুল হক বাচ্চু), নয়নতারা (কাজী জহির), সকিনা (কারিগর), আপন দুলাল (চাষী নজরুল ইসলাম), অপরাজেয় (সাফাক), বেহুলা (জহির রায়হান), সংসার (সিনে ওয়ার্ক শিল্পী গোষ্ঠী), আগুন নিয়ে খেলা (আমজাদ হোসেন ও নূরুল হক বাচ্চু), অবুঝ মন (কাজী জহির), কখগঘঙ (নারায়ণ চৌধুরী), আদর্শ ছাপাখানা (মোশতফা মেহমুদ), আঁকাবাঁকা (বাবুল চৌধুরী), প্রতিশোধ, Wealth in Point (Documentary), জীবন থেকে নেয়া (জহির রায়হান), Let there be Light (Jahir Raihan)
আলতাফ মাহমুদ যে সকল গীতিনাট্য, ছায়ানাট্য ও নৃত্যনাট্যের সংগীত পরিচালনা করেছেন :
– নূর আহমেদ রচিত ‘আগামী দিন’
– তারাশংকরের ‘দুই পুরষ’
– পূর্ব পাকিস্তান শিল্পী সংসদ প্রযোজিত ‘কিষাণের কাহিনী’
– পূর্ব পাকিস্তান শিল্পী সংসদ প্রযোজিত ‘মজদুর’
– নিজামুল হক পরিচালিত ‘শিল্পী’
– আবদুল মালেক খান পরিচালিত ‘মায়ামৃগ’
– সোভিয়েত ইউনিয়নের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে ‘আমরা স্ফুলিঙ্গ’
– ড. এনামুল হক রচিত ‘হাজার তারের বীণা’
– আমানুল হক রচিত ‘জ্বলছে আগুন ক্ষেত-খামারে’
– ড. এনামুল হক রচিত ‘রাজপথ জনপথ’
আলতাফ মাহমুদ যে সকল গণসংগীত এবং একুশের গান সুর করেছেন ও গেয়েছেন :
– মোশারফ উদ্দিন রচিত, ‘মৃত্যুকে যারা তুচ্ছ করিল ভাষা বাঁচাবার তরে…’
– আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী রচিত ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’
– ‘মোরা কি দুঃখে বাঁচিয়া রবো’
– ‘মন্ত্রী হওয়া কি মুখের কথা’
– শামসুদ্দিন রচিত ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করলিরে বাঙালি/তোরা ঢাকা শহর রক্তে ভাসাইলি’
– স্বরচিত ‘মেঘনার কূলে ছিল আমার ঘর/হঠাৎ একটা তুফান আইসা ভাইসা নিল তারে রে’
– করাচি বেতারে পরিবেশিত ‘জীবনের মধু মাস মোর দুয়ারে আজ কি কথা বলে যায়’
– শহীদুল্লাহ কায়সার রচিত ‘আমি মানুষের ভাই স্পার্টাকাস’
– স্বরচিত ‘এ ঝঞ্জা মোরা রুখবো’
– বদরুল হাসান রচিত ‘ঘুমের দেশের ঘুম ভাঙাতে’
– সংগ্রহীত রচনা ‘এই পথ কালো পথ’
– স্বরচিত ‘হে মহার্ঘধা’
– ভাষা সৈনিক গাজীউল হক রচিত ‘ভুলবো না ভুলবো না, একুশে ফেব্রুয়ারি’
– কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা
– ‘ম্যায় ভূখা হু’
– ‘জাগো কমরেড, ঈষাণ কোণে মেঘ জমেছে’
– ‘হুনছোনি ভাই দেখছোনি, দেখছোনি ভাই হুনছোনি’
– ‘স্বর্গে যাবো গো, স্বর্গে যাবো গো’
– সুখেন্দু চক্রবর্তী রচিত ‘বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা, আজ জেগেছে সেই জনতা’
এলো ১৯৫২ সাল। শিল্পী আলতাফ মাহমুদ তখন ঢাকায়। এক প্রত্যয়ী যুবক তিনি। যেমনই ব্যস্ত, তেমনি পরিচিত। তবে বাংলাদেশের এই সন্তানকে বাংলা মায়ের আহ্বান থেকে কোনো ব্যস্ততাই দূরে রাখতে পারেনা….। সুরকেই তিনি করে নিলেন হাতিয়ার।। ভাষা আন্দোলনের কথা বলতে গেলেই আবদুল মতিন, মাহবুবুল আলম, গাজিউল হকদের পাশাপাশিই চলে আসে আলতাফ মাহমুদ, আবদুল লতিফ, নিজামুল হক, শেখ লুৎফর রহমানদের নাম।
বাংলার মানুষের মুক্তি সংগ্রামে প্রত্যক্ষ অংশ নিয়েছিলেন সেদিনের সেই তরুণ আলতাফ মাহমুদ। সংগীত– নৃত্যনাট্য– নাটক এইসব সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষার দাবি আদায়ের সংগ্রামে যে নামটি নক্ষত্রের মতো চিরকাল সব চাইতে উজ্জ্বল, সব চাইতে অম্লান হয়ে থাকবে তিনি হলেন বায়ান্নর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী আলতাফ মাহমুদ।
সেই গান– যা বাংলার মাটি আর মানুষকে আজও নাড়া দিয়ে যায়, পাকিস্তানি অত্যাচারী শাসকের অন্তরাত্মা কেঁপে উঠত যে তীব্র সুরে- ভাষা আন্দোলনের সে অমর গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটির গীতিকার ও সুরকার ছিলেন আলতাফ মাহমুদ। গানটির রচয়িতা সাহিত্যিক ও সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী। এ গানটিতে প্রথম সুর করেন প্রখ্যাত গণসংগীত শিল্পী আব্দুল লতিফ। পরে আলতাফ মাহমুদ যে সুরটি দিয়েছেন সেটাই বর্তমানে জনপ্রিয় এবং অমর সুর হয়ে আছে।
আব্দুল গাফফার চৌধুরী কবিতাটি রচনা করেন ১৯৫২ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারি। রচয়িতার নিজের ভাষ্য, “শহীদ রফিকের লাশ দেখেই কবিতাটি লিখে ফেলি”। এ প্রসঙ্গে আব্দুল লতিফ বলেন যে, এ গানটি ১৯৫৩ সালে তাঁকে দিয়েছিল ড. রফিকুল ইসলামের ছোট ভাই মরহুম আতিকুল ইসলাম। এটি প্রথমে ছাপা হয় প্যামফ্লেট হিসেবে। তিনি আরো বলেন, তিনি কবিতাটিতে সুরারোপ করে গানে রূপদান করেন এবং ঢাকা কলেজে ছাত্রদের এক অনুষ্ঠানে পরিবেশন করেন।
আলতাফ মাহমুদের দেয়া সুরটি আজ এক ইতিহাস। এই সুর পর্যালোচনা করলে পাওয়া যায় আমেরিকান শিল্পী ন্যাট কিং কোলের গীত ‘আইরিন গুড নাইট আইরিন/ আই উইল সি ইউ ইন মাই ড্রিম’ গানের প্রথম পঙক্তির সুর। ন্যাট কিং কোলের এ গানটি আজও বিশ্বসংগীত আসরে খুবই জনপ্রিয়। এই প্রসঙ্গে আমেরিকার প্রখ্যাত গায়ক পল রবসনের (১৯৯৮-১৯৭৬) গানের কথা মনে পড়ে- ‘উই আর অন দি সেম বোট ব্রাদার, উই আর অন দি সেম বোট টুগেদার’। বিশ্বে যখনই কোনো নতুন সৃষ্টি হয় তার সাথে থাকে মাটি ও রক্তের সম্পর্ক, তা পৃথিবীর যে কোণেই সৃজিত হোক না কেন, খুঁজলে এমন যোগসূত্র পাওয়া যাবেই। বলতে বাধা নেই পল রবসনকে শুধু কৃষ্ণাঙ্গ শিল্পী হওয়ার কারণে পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে যাওয়ার পাসপোর্ট দেয়নি তৎকালীন আমেরিকান শাসকরা। এখানে উল্লেখ্য, আলতাফ মাহমুদ ঢাকা থেকে করাচি যাওয়ার পরও পাকিস্থানি শাসকরা তাঁকে ভিয়েনা যাওয়ার পাসপোর্ট দেয়নি।
শিল্পীর সুরে গানটির দিন-তারিখ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। এ বিতর্কের সমাধান গীতিকার আবদুল গাফফার চৌধুরী নিজেই দিয়েছেন, “আমার গানটি যদিও ১৯৫২ সালে লেখা শহীদ রফিকের লাশ দেখে। আকস্মিকভাবে করাচি থেকে আলতাফ মাহমুদ এসে আমাকে বললেন, আমি গানটাতে সুর দিতে চাই। আমি বললাম, লতিফ ভাই আপত্তি না করলে তো কোনো প্রশ্ন ওঠে না। লতিফ ভাই বললেন, ‘না আমার কোনো আপত্তি নেই’। উনি গানটির সুর দিলেন”।
১৯৫৪ সাল থেকে এই যে শুরু হলো এই গানটি ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’ গাওয়া, তারপর আর বন্ধ হয়নি। বাংলার মানুষের হৃদয়ের রন্ধ্রে রন্ধ্রে আজও এই সুর আর এই শিল্পী অমর। (সুরের প্রয়োজনে আলতাফ মাহমুদ কবিতাটির শেষ ছয়টি চরণ বাদ দেন। অবশ্য এ ব্যাপারে আবদুল গাফফার চৌধুরীর অনুমতি নিয়েছিলেন।)
অনেক ভালোবেসে গাইতেন আলতাফ মাহমুদ। হৃদয় দিয়ে গাইতেন বাংলাদেশের জন্য। শেখ লুৎফর রহমানের ভাষ্য থেকে জানা যায়, ১৯৬৭ সালের ২১, ২২ আর ২৩ ফেব্রুয়ারি পল্টন ময়দানে আয়োজিত হয় “জ্বলছে আগুন ক্ষেত খামারে” নামক গীতিনাট্য। আলতাফ মাহমুদ ছিলেন এই গীতিনাট্যের সংগীত পরিচালক, অভিনেতা। আর আলতাফ মাহমুদের সহশিল্পী হিসেবে এখানে অভিনয় করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহমদ। সেই দরদি কণ্ঠে পল্টন ভর্তি জনতার সামনে আলতাফ মাহমুদ গেয়েছিলেন “ও বাঙালি, তোরা ঢাকার শহর রক্তে ভাসাইলি…” এখনো সে গান গাওয়া হয়, চিরকাল হবে– কিন্তু আলতাফ মাহমুদের মতো করে আর কেউ কখনো গাইতে পারবে না…
১৯৭১ সাল। আলতাফ মাহমুদ তখন স্বাধীনতার জন্য গণজাগরণমূলক অনেক গান রচনা করছেন, সুর দিচ্ছেন, সংগীত পরিচালনা করছেন এবং অন্যের গানে সুরারোপ করছেন। এর মধ্যেই এসে যায় একাত্তরের উত্তাল সময়। আলতাফ মাহমুদ বেহালা, তবলা, হারমোনিয়াম নিয়ে খেলতে খেলতে কখন যেন রাইফেল নিয়ে খেলায় মেতে ওঠেন। মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশ নেন তিনি।
১৯৭১ এর মার্চে শহীদ মিনারের অনুষ্ঠানে সংগ্রামী অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের দিকে পথচলা। শহরের যেখানেই বিদ্রোহী অনুষ্ঠান সেখানেই আলতাফ মাহমুদ। শহীদ মিনারের বিভিন্ন সংগঠন, সংগীত পরিচালনা ও কন্ঠদানের মধ্য দিয়েই মুক্তিযুদ্ধের হাতছানিকে স্বাগত জানান। রাজারবাগ পুলিশ লাইনের ঠিক বিপরীত দিকে ৩৭০ নম্বর আউটার সার্কুলার রোডের বাসায় থাকতেন আলতাফ মাহমুদ। হানাদার বাহিনী তাদের মারনাস্ত্র দিয়ে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের টিনসেডগুলোতে আগুন লাগিয়ে দেয়।
২৬ তারিখ সকালে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে পাশের বাড়িতে আশ্রয় নেন। ২৭ মার্চ কয়েক ঘণ্টার জন্য কারফিউ শিথিল হলে আলতাফ মাহমুদ সবাইকে নিয়ে কমলাপুরের বৌদ্ধবিহারে আশ্রয় নেন। সেখানে ১৮ দিন থাকার পর আবার চলে আসেন আউটার সার্কুলার রোডের বাসায়। বাসায় এসে বিচলিত ও চিন্তিত হয়ে পড়েন। দেশ, জনগণ, আত্মীয়-স্বজনদের কথা ভেবে সারাক্ষণ অস্থিরতায় কাটান। দেশের এই মরণ-বাঁচন পরিস্থিতিতে কিছুই করতে পারছেন না, সে কষ্ট তাঁকে ভেতরে ভেতরে বজ্রকঠিন করে তোলে।
মুক্তিযুদ্ধের সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত হয়ে পড়েন আলতাফ মাহমুদ। ঢাকা শহরে কতগুলো অপারেশনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাও পালন করেন। ঢাকা শহরে গেরিলা আক্রমণ চলে ২নং সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফ ও মেজর হায়দারের নেতৃত্বে। তাঁদের সহযোগিতা করার জন্য কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের নিয়ে গঠিত হয় ‘ক্র্যাক প্লাটুন’। এদের কাজ ছিল ঢাকা শহরে হানাদার বাহিনীর সদস্যদের অস্থির করে তোলা। তাঁরা শহরে বেশ কয়েকটি দুঃসাহসিক আক্রমণ চালিয়ে পাকসেনাদের নাজেহাল করাসহ চেকপোস্টে হানা দেন এবং পাকিস্তানকে সমর্থনদানকারী আমেরিকান তথ্যকেন্দ্রে বোমা হামলা চালান। শহরের বিভিন্ন স্থাপনায় অর্থাৎ ডিআইটি ভবন, আজিমপুর বালিকা বিদ্যালয়, টেলিভিশন ভবন, ওয়াপদা ভবন, পেট্রোল পাম্প, সেনা চেকপোস্টে ক্র্যাক প্লাটুনের সাহসী যুবকরা হামলা চালান।
সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফের নির্দেশে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে একটি অপারেশন হয় আলতাফ মাহমুদের অংশগ্রহণে। আলতাফ মাহমুদ, হাফিজ এবং সামাদ মিলে সিদ্ধান্ত নেন বিশ্বব্যাংক প্রতিনিধিদের ঢাকায় অবস্থানকালে হোটেলে বোমা বিস্ফোরণ ঘটাবেন। ক্র্যাক প্লাটুনের অন্যতম সদস্য সামাদ ভাই নিয়ন সাইনের ব্যাবসা করতেন। ঘটনাক্রমে ঐ সময় হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল থেকে নিয়ন সাইনের একটি কন্ট্রাক্ট চলে আসে। নিয়ন বাল্বের ভেতরে বিস্ফোরক ভরে হোটেলের ভেতর পাচার করে দেয়া হয়। তবে প্রতিনিধি দল হোটেলে আসেনি, তারপরও বিদেশি সাংবাদিকদের জানানোর জন্য হোটেলে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এতে ফলও হয়। হোটেলে তখন বহু বিদেশি সাংবাদিক ছিল। তাদের মাধ্যমে এই বিস্ফোরণের খবর সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।
এদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হতে থাকে। এদিকে প্ল্যান মোতাবেক কাজ না হওয়ায় প্রচুর বিস্ফোরক বেঁচে যায়। সেগুলো নিরাপদে রাখার স্থান পাওয়া নিয়ে হয় সমস্যা। সাহসী মুক্তিযোদ্ধা আলতাফ মাহমুদ সব গোলাবারুদ তাঁর বাসার কাঁঠাল গাছের নিচে একটা হাউজে রেখে ইট, পাথর, কাঠের টুকরো দিয়ে ঢেকে রাখেন। এতো সব করতে আলতাফ মাহমুদ যেন আনন্দই পান। ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবেন না।
এপ্রিলের শেষের দিক থেকে আলতাফ মাহমুদ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সংগীত রচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। গান রচনা, সুরারোপ করা, কন্ঠ দেয়া, রেকর্ড করে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে পাঠানো সব কাজ বিশেষ গোপনীয়তার মাধ্যমে করতে থাকেন। গানের রেকর্ড পাঠানোর উল্লেখ আগেই করেছি। জুলাই মাসে আলতাফ মাহমুদের মা ঢাকায় আসেন। ওপারে ভারতে চলে যাওয়ার জন্য তিনি ছেলেকে বেশ পীড়াপীড়ি করেন।
স্বাধীন বাংলা বেতারের জন্য গান রেকর্ডিং হয়ে যাওয়ার পর একবার স্থির করেছিলেন মা ও স্ত্রীকে বরিশালে রেখে তিনি পশ্চিমবঙ্গে চলে যাবেন। অজ্ঞাত কারণে তিনি পরে তাঁর সিদ্ধান্ত পাল্টান। কেউ প্রশ্ন করলে বলেন, “সবাই ওপারে গেলে এখানে কে থাকবে?” ‘ঢাকায় থাকা কি আপনার জন্য নিরাপদ?’ এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, “আমার ভাবনা আমি ভাববো, তোরা সবাই ভালো থাক। নিরাপদে থাকার চেষ্টা কর। আর সব কেন’র কি জবাব আছে?” এমনই সাহসী উচ্চারণ আলতাফ মাহমুদের কাছ থেকে সবাই পেয়েছে।
পরবর্তীতে আগস্টের শেষ সপ্তাহে তিনি স্থির করেন, ‘সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তিনি ঢাকা ত্যাগ করবেন; চলে যাবেন পশ্চিমবঙ্গে। কিন্তু তিনি আর যেতে পারেননি। তার আগেই বন্দি হন হানাদারদের হাতে। এ প্রসঙ্গে সারা আরা মাহমুদ বলেন, “৩০শে আগস্ট ভোরবেলা আমার বোন শিমূল রেওয়াজ করছিল। মা নামাজ পড়ছিলেন। সেই সময় বুটের আওয়াজ পেয়ে আমি জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি আর্মিরা আমাদের পুরো বাড়িটা ঘেরাও করে ফেলেছে। আমার ভাই এবং আগের রাতে শেল্টার নেয়া আবুল বারাক আলভী ছাড়াও আশপাশের বাড়ি থেকে মোট ১১ জনকে ধরে বেঁধে রাখে। আমি যখন আলতাফকে বললাম, আর্মি এসেছে, ও আমাকে বলল, ‘তুমি এত ভয় পাও কেন?’ এটাই ছিল আমার সঙ্গে ওর শেষ কথা। তারপর পরই আর্মিরা ঘরে ঢুকে জিজ্ঞেস করে, ‘আলতাফ মাহমুদ কৌন হ্যায়?’ আলতাফ জবাব দিল, আমি। তখনই ওরা আলতাফকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। সেই সময় আমি দেখলাম সামাদকে। এই লোকটিই পরবর্তীতে দেখিয়ে দেয় দুই ট্রাঙ্ক অস্ত্র কোথায় লুকানো আছে। আর্মিরা আলতাফকে দিয়ে ওই দুই ট্রাঙ্ক আর্মস্ মাটি খুঁড়ে বের করে নিল এবং আলতাফকে নিয়ে চলে গেল।
আলতাফ আমার ভাইদের কাছে ওর একটা আংটি খুলে দিয়ে বলেছিল, ‘এটা ঝিনু এবং শাওনকে দিও। ওদের জন্য তো কিছু রেখে যেতে পারলাম না। দেশের মানুষ আছে ওদের জন্য।’
আলতাফকে পেলে আমি জিজ্ঞেস করতাম, সিক্ত তুমি কাদের ভরসায় আমাদের রেখে গেলে?’ কোন দেশের মানুষের ভরসায়?”
আলতাফ মাহমুদ এই রমনা থানায় মৃত্যুর মুঠোয় বসে সেই অসম্ভব অত্যাচারের মধ্যেও খনুকে (আলতাফ মাহমুদের আরেক শ্যালক) আক্ষেপ করে বলেছিল, ‘দেশের কোনো কাজই তো করতে পারলাম না।’ পরে এখানকারই একজন বন্দি তাঁর ওপর নির্যাতনের নানা ভয়ংকর খবর জানিয়ে বলেছিল, ৩ সেপ্টেম্বর চোখ বেঁধে আলতাফ মাহমুদকে কোথাও নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর কী হয় আজ পর্যন্ত কেউ জানে না।
সারা মাহমুদ বলেন, “অক্টোবর মাসে বন্দিদের সঙ্গে দেখা করতে চাইলে পারমিশন দিত। আমি যেতাম সেন্ট্রাল জেলে, কয়েকবার গিয়েছি। বাইরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রেখে শেষে জানাতো এখানে এ নামে কেউ নেই। আমার মা ক্যান্টনমেন্ট হাসপাতালে গিয়েছেন। সেখানেও তাঁকে খাতা দেখে বলা হয়েছে, এ নামে কেউ নেই। ফখরুফ আলম বিল্লাহ্ ও দীনু বিল্লাহ্ বলেছেন, “১৬ ডিসেম্বর রাতে ও পরের কয়েকদিন তন্নতন্ন করে খুঁজেছি। জেল আর হাসপাতালের রেজিস্টারে নামটি পর্যন্ত নেই। না, আর তাকে ফিরে পেলাম না।”
চলে গেলেন আলতাফ মাহমুদ। শহীদ আলতাফ মাহমুদ। তাঁর মা গিয়েও নানা জেলের দরজায় খোঁজ করেন। কিন্তু সন্তান আর ফিরে আসেনি মায়ের কাছে। পরে এই মা মস্তিস্কের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন এবং এভাবেই তাঁর মৃত্যু হয়। দিনু বিল্লাহ্ তার ‘একাত্তরের দুর্গ বাড়িটি’ নিবন্ধে লিখেছেন, ‘৮৬ সালের ২৪ অক্টোবর আমার মা মারা যান। বনানী গোরস্তানে দাফন শেষে মোনাজাত করে সবাই যখন বাড়ি ফিরছিলাম তখন হঠাৎ ১৮ বছরের শাওন এই প্রথম চিৎকার করে ওর বাবার কথা বলল। শাওন চিৎকার করে আমার বড় ভাইকে বলল, “তোমার মা’র একটা কবর আছে, জায়গা আছে-আমার বাবার কবর কোথায়?”
এই প্রশ্নের উত্তর কি দিতে পারব আমরা কেউ? যদি না পারি তাহলে অন্তত নিজেদের বিবেকের দংশনে হলেও যেন পাকিস্তানকে ঘৃণা করি, মুক্তিযুদ্ধকে ভালোবাসতে শিখি। অনেক রক্তের দামে পাওয়া এই বাংলাদেশ, কারো দানে পাওয়া না….
_____________________
১৯ জানুয়ারি, ২০১৫
সভ্যতা ডট কম-এ প্রকাশিত