শহীদ আব্দুল হালিম চৌধুরী জুয়েল। ডাক নাম জুয়েল। “ক্র্যাক প্লাটুন” গেরিলা দলের সাহসী মুক্তিযোদ্ধা।
শহীদ জুয়েল ক্রিকেটার হিসেবেও খ্যাত ছিলেন। ১৯৫০ সালের ১৮ জানুয়ারি মুন্সিগঞ্জ জেলার শ্রীনগর উপজেলার দক্ষিণ পাইকশা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৬৭ সালে জগন্নাথ কলেজ থেকে পড়াশোনা শেষ করে একটি কেমিক্যাল কোম্পানিতে কেমিস্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এর পাশাপাশি চলতো ক্রিকেট খেলা। তিনি ছিলেন তখনকার প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটার। মোহামেডান স্পোর্টিং ও আজাদ বয়েজ ক্লাবের হয়ে ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলেছেন। উইকেটকিপার এবং মারকুটে ব্যাটসম্যান হিসেবে তুমুল খ্যাতিমান। প্রায়ই পশ্চিম পাকিস্তানের লাহোরসহ বিভিন্ন স্থানে খেলতে যেতেন তিনি। সেই সময় থেকেই পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার বৈষম্য তার মনে দাগ কাটে। এরপর পাকিস্তান জাতীয় দলে ডাক পেলেও তিনি পাকিস্তানের হয়ে খেলতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন। মার্চের আগুন জুয়েলকেও দ্রোহী করেছিলো। ঘর ছাড়তে পারছিলেন না মায়ের তীব্র স্নেহের নিগড়ে। সেটা ছিড়লেন ৩১ মে। সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে যাওয়ার ক’দিন আগে মাকে নিজের বাধাই করা একটা ছবি দিয়ে বলেছিলেন. ‘আমি যখন থাকবো না, এই ছবিতেই আমাকে পাবে’।
খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বাধীন দুই নম্বর সেক্টরে ট্রেনিং নেন জুয়েল। ট্রেনিং শেষে ঢাকা কাঁপিয়ে ফেলা গেরিলা দল ‘ক্র্যাক প্লাটুন’-এর একজন হিসেবে যুদ্ধে অংশগ্রহন করেন। ফার্মগেট, এলিফ্যান্ট রোডের পাওয়ার স্টেশন, যাত্রাবাড়ী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশনে গেরিলা অপারেশনে যথেষ্ট সাহসিকতার পরিচয় দেন শহীদ জুয়েল । সহযোদ্ধা হাবিবুল আলম বীরপ্রতীকের স্মৃতিচারণে জুয়েল চিত্রিত হয়েছেন প্রচণ্ড বুদ্ধিদীপ্ত, সাহসী এবং ঠান্ডা মাথার একজন যোদ্ধা হিসেবে যিনি ক্রিকেট ব্যাটের মতোই সাবলীলভাবেই অস্ত্র চালাতে পারতেন। ঢাকায় বেশ ক’টি অপারেশনে অংশ নিয়েছেন জুয়েল।
জুয়েল ছিলেন বেশ হাস্যরসিক এবং প্রাণবন্ত, তিনি সবসময় তার বন্ধুদের মাতিয়ে রাখতেন। আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন অপারেশনের সময় বোমা ফেটে ডান হাতের আঙ্গুলগুলোতে মারাত্মক আঘাত পান তিনি, এতে তার মনে হতাশা জাগে, আর হয়ত তিনি ক্রিকেট খেলতে পারবেন না!
১৯৭১ সালের ২৯ আগস্ট ঢাকার বড় মগবাজার এলাকায় একটি বাড়িতে হানা দিয়ে পাকিস্তানি সেনারা তাকে আটক করে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী সেখানে হানা দিয়ে জুয়েল, আজাদ, কাজী কামাল ও আজাদের দুই ছোটভাইকে ঘুম ভাঙিয়ে ডেকে তুলে যায় এরপর তার ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। ৩১ আগস্টের পর তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। সেরাতে পাকিস্তানীদের হাতে আরও ধরা পড়েছিলেন রুমি, বদি, আলতাফ মাহমুদসহ অনেকে। ধারণা করা হয়, ঐদিনই পাকিস্তানি সেনারা তাকে হত্যা করে।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য শহীদ জুয়েলকে মরণোত্তর বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তার বীরত্বভূষণ সনদ নম্বর ১৪৮। তার বাবার নাম আবদুল ওয়াজেদ চৌধুরী এবং মা ফিরোজা বেগম। তিন ভাই ও চার বোনের মধ্যে শহীদ জুয়েল ছিলেন দ্বিতীয়।