২৯ শে আগস্ট, শহীদ বদিউল আলম, বীরবিক্রম এর তিরোধান দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি।
ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের সপ্তম ব্যাচের (ক্যাডেট নম্বর ১৬৪) ছাত্র ছিলেন বদিউল আলম। ঢাকার ৫৭, মনিপুরি পাড়ার বাসিন্দা আব্দুল বারী ও রওশন আরা বেগম এর বড় ছেলে ছিলেন তিনি। গল্পের বই পড়ার প্রচন্ড নেশা ছিলো তার। এমনকি পরীক্ষার দিনেও তাকে গল্পের বই পড়তে দেখেছি। এই নেশা অবশ্য পরীক্ষায় তার ভাল ফল অর্জনে কোনো বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। তিনি মাধ্যমিক পরীক্ষায় স্টার নম্বরসহ প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হন এবং উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় কলা বিভাগের মেধা তালিকায় ৪র্থ স্থান অধিকার করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রী এবং করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি মাস্টার্স ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। ১৯৭১ সালের মার্চে করাচি থেকে ঢাকায় ফিরে আসেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই বদিউল আলম ‘বদি’ নামেই পরিচিত ছিলেন। অবশ্য এ পরিচিতি পূর্ব-পাকিস্তানের তৎকালীন ক্ষমতাসীন কনভেনশন মুসলিম লীগের অনুসারী ন্যাশনাল স্টুডেন্ট ফেডারেশন (এনএসএফ)-এর সাথে তাঁর জড়িয়ে পড়ার কারণে। মুক্তিসংগ্রাম শুরুর সাথে সাথেই দেশমায়ের প্রয়োজনে রাজনৈতিক পরিচয় মুছে ফেলে তিনি ২৮ মার্চ তার নিজ এলাকা ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ে চলে যান। উদ্দেশ্য ছিলো- সেখানকার ডাকাতদের সংগঠিত করে তাদের অস্ত্র ও কৌশল ব্যবহার করে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবেন। ওই সময়ে গফরগাঁও থানা (যা তার নিজের বাড়ির এলাকা) ‘ডাকাতদের এলাকা’ বলে সাধারণ মানুষের মুখে কুখ্যাত ছিলো।
গফরগাঁওয়ে যাওয়ার সময় তাঁর সাথে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও তিনজন ছাত্র মাসুদ ওমর, শহীদুল্লাহ খান বাদল ও আসফাকুস সামাদ (১ম বাংলাদেশ ওয়্যারকোর্সের অফিসার হিসেবে কমিশন লাভ করেছিলেন এবং রংপুর জেলার জয়মনিরহাট স্থানে সম্মূখ সমরে ২২ নভেম্বর ১৯৭১ তিনি শাহাদাত বরণ করেন)। বদি ছাড়া বাকিরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই বাম রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন এবং বিপ্লবের মাধ্যমে জনগণের কল্যাণের কথা ভাবতেন।
গফরগাঁও পৌঁছার পর তারা শুনতে পান, ২য় ইস্ট-বেঙ্গল রেজিমেন্ট জয়দেবপুর সেনানিবাস থেকে বিদ্রোহ করে কিশোরগঞ্জ গিয়ে অবস্থান করছে। এ খবর শুনে তারাও কিশোরগঞ্জে চলে যান। সেখানে ২য় ইস্ট-বেঙ্গলের কাছ থেকে চারজনের জন্য চারটি পয়েন্ট ৩০৩ রাইফেল, ৪০ রাউন্ড গুলি ও ৪টি হ্যান্ড গ্রেনেড সংগ্রহ করে পহেলা এপ্রিলেই তারা ঢাকার আর কে মিশন রোডে আসফাকুস সামাদের বাসায় এসে উঠেন। পরে অস্ত্রগুলো তোষকে মুড়ে তাদের ছাত্রবন্ধু তওহিদ সামাদের (চালক) গাড়িতে করে ধানমন্ডির ৪ নম্বর রোডে আরেক বন্ধু ওয়াসেফ-এর বাসায় নিয়ে যান এবং সবার অগোচরে ওই বাসার পেছনে মাটির নিচে অস্ত্রগুলো লুকিয়ে রাখেন।
ঢাকা তখন পাক হানাদার বাহিনীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। এ অবস্থায় পাকবাহিনীর জোর টহল, নিরাপত্তা চৌকি ও অতিতৎপর গোয়েন্দাদের ফাঁকি দিয়ে টিকাটুলি থেকে এরকম বড় আকারের এতোগুলো অস্ত্র ধানমন্ডিতে স্থানান্তর সত্যিই ভীষণ দুঃসাহসের কাজ ছিলো। এখন ঠান্ডা মাথায় দেখতে গেলে ভাবি, ওই সময়ে এ কাজটি অনেকটাই নির্বুদ্ধিতার প্রমাণও। তবে একমাত্র মুক্তিপাগল বাংলার দামাল ছেলে বলেই এমন দুঃসাধ্য কাজ তাদের করা সম্ভব হয়েছিল।
বদিউল আলম ও তার সহযোদ্ধাদের এমন দুঃসাহসিকতা এটি একটি সামান্য উদাহরণ মাত্র। এর পরে ঢাকায় বিভিন্ন জটিল, ভয়াবহ, কৌশলী ও দুঃসাহসিক যেসব অপারেশনে বদিউল আলম অংশ নেন তা ছিল একইসাথে বিষ্ময় ও গর্বের। এসব অপারেশনে শুধু পাক-হানাদাররা পর্যুদস্ত ও পরাস্তই হয়নি, মুক্তিপাগল জনতা, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী যোদ্ধা- সবাইকে দেশ মায়ের জন্য সাহসী পদক্ষেপ নিতে যথেষ্ট উৎসাহিত করেছে। তার সাথে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের মুখ থেকে শোনা যায়, ‘দেশের জন্য তার কিছু একটা করতে হবে’-এমন চেতনা ও তাড়না তাকে যুদ্ধে অংশ নিতে প্রেরণা যোগায়।
বদিউল আলম ঢাকা শহর ও এর আশেপাশে বেশ কয়েকটি দুর্ধষ অপারেশনে অংশ নেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলো : ৮ আগস্ট ফার্মগেটে পাক বাহিনীর চেকপোস্ট অপারেশন, ১১ আগস্ট হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের ভেতরে বিস্ফোরণ ঘটানো, ১৪ আগস্ট গ্যাস বেলুনের মাধ্যমে ঢাকা শহরের আকাশে বাংলাদেশের অনেকগুলো পতাকা উড়ানো, ১৯ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশনে অপারেশন, ২৫ আগস্ট ধানমন্ডির ১৮ ও ২০ নম্বর রোডে অপারেশন। এসব অভিযান এখনও তাদের দুর্ধর্ষতা ও দুঃসাহসিকতার উদাহরণ। এসব অপারেশন মুক্তিযোদ্ধাদের লড়াইয়ের প্রামাণিক ও সঠিক বার্তা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
এ অপারেশনগুলোতে হাবিবুল আলম বীরপ্রতিক, মোফাজ্জেল হোসেন মায়া বীরবিক্রম, গাজী গোলাম দস্তগীর বীরপ্রতিক, কাজী কামাল উদ্দিন বীরবিক্রম, কামরুল হক (স্বপন) বীরবিক্রম (ফৌজিয়ান), আলম, জিয়া, এএফএম হারিস (ফৌজিয়ান), ইশরাক আহমেদ (ফৌজিয়ান), আজাদ, জুয়েল, রুমি বীরবিক্রম, সুরকার আলতাফ মাহমুদ, মাহফুজ সাদেক (চুল্লু), সাংবাদিক শাহাদত চৌধুরী, মোক্তার, বাকী বীরপ্রতিক, তৈয়ব আলী বীরপ্রতিক প্রমূখ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। এদের মধ্যে বদির পাশাপাশি আজাদ, জুয়েল, রুমি, আলতাফ মাহমুদ আগস্টের একেবারে শেষ সময়ে পাক-বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে ব্যাপক নির্যাতনের শিকার হয়ে শাহাদত বরণ করেন।
অনন্য এক মা –
মধ্য এপ্রিলে আলী আনোয়ারসহ (হেলাল, ফকক ৮ম ব্যাচ) বদিউল আলম কিশোরগঞ্জে তার (বদি) আত্মীয়ের বাড়ি তারাইল থানার জাওয়ার গ্রামে দু’তিন সপ্তাহ অবস্থান করেন। এ সময়েও অদম্য বদিউল ও হেলাল থেমে থাকেননি। সেখানে স্থানীয় রাজাকারদের বিরুদ্ধে অপারেশনে তারা স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের নেতৃত্ব দেন এবং রাজাকারদের নিরস্ত্র করেন। এখানে উল্লেখযোগ্য অপারেশন ছিল তারাইল থানা অপারেশন ও অস্ত্র লুট করা। এতে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র শক্তি বাড়ে এবং তারা মানসিকভাবেও ভীষণ অনুপ্রাণিত হন।
এর পরে তারা দুজনে ঢাকার উদ্দেশ্যে বদিউলের নানার বাড়ি পাকুন্দিয়ায় গেলে হেলালকে বদিউলের মা বলেন, ‘তোরা অসংঘবদ্ধ অবস্থায় বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্তভাবে যা করছিস এতে একদিন যেখানে সেখানে ঠিকানাবিহীনভাবে তোদের মৃতদেহ পড়ে থাকার আশঙ্কা রয়েছে। তোরা যা, যথাযথ প্রশিক্ষণ নিয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে হানাদার বাহিনীর মোকাবিলা কর। এভাবে মোকাবিলা করতে গিয়ে আমার ছেলে যদি মারাও যায়, মা হিসেবে আমি গর্ববোধ করবো।’ এর পরে হেলাল ও বদিউল গফরগাঁও হয়ে ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকায় এসে হেলাল তার পরিবারের সবাইকে নিয়ে ভারতে যাওয়ার জন্য উদ্যোগ নিচ্ছিলেন। তিনি বদিউল আলমকেও ভারতে যাওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকেন। কিন্তু বদি কোনোভাবেই ভারতে যাওয়ার জন্য রাজি হচ্ছিলেন না। কেননা, তাতে তার সে সময়কার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের রোষানলে পড়ার আশঙ্কা ছিল।
ধানমন্ডির ৭ নম্বর সড়কের পার্কে ২৭ জুলাই বদিউল ও কামরুল হক (স্বপন)-এর সাথে হেলালের দেখা হয়। তখনও বদিউল জানায়, সে কোনোভাবেই ভারতে যেতে রাজি নয়। সে ঢাকায় থেকেই যুদ্ধ করবে। এরপর হেলাল তার মা ও বোনদের নিয়ে মেঘালয়ের তুরা নামক স্থানে চলে যান। সেখানে মা ও অন্যদের রেখে হেলাল যুদ্ধের প্রশিক্ষণের জন্য যান। প্রশিক্ষণ শেষ করে যুদ্ধে যাবার সময় তিনি মায়ের কাছে গিয়ে দেখেন, এই কয়েক সপ্তাহের মধ্যে চিন্তায় তার মায়ের সব চুল সাদা হয়ে গেছে। কিন্তু ছেলেকে যুদ্ধে যেতে বাধা না দিয়ে বরং উৎসাহই দিয়েছিলেন মা। বদিউল আলমের মা’ও নিশ্চয়ই ছেলের জন্য উদ্বিগ্ন ছিলেন। কিন্তু আর কোনোদিন বদিউল আলম মায়ের কাছে ফিরতে পারেননি। ছেলে জীবিত না মৃত সে খবরটিও তাঁর জানা হয়নি। জীবনের শেষদিন অবধি ছেলে বদির জন্য দীর্ঘ অপেক্ষায় ছিলেন তিনি।
চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেলেন বদি –
মায়ের আদেশ মেনে বদিউল আলম ‘ক্র্যাকপ্লাটুনে’র সদস্য হিসেবে ঢাকা ও ঢাকার আশেপাশের এলাকায় একের পর এক দুর্ধর্ষ ও দুঃসাহসিক সফল অপারেশন পরিচালনা করছিলেন।
২৯ আগস্ট ধানমন্ডিতে ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর জালাল উদ্দিন সাহেবের বাসায় তাঁর ছেলে ফরিদ (এনএসএফ কর্মী), জাফর আহমেদ ও পারভেজ হাসানদের সাথে যথারীতি তাশ খেলছিলেন বদিউল। এখানে বুন্ধুদের সাথে প্রায়শই তিনি তাশ খেলার আড্ডায় বসতেন। তারা যখন খেলায় মত্ত, বেলা সাড়ে ১১টার দিকে পাক-বাহিনীর একটি দল হঠাৎ করেই বাড়ি ঘেরাও করে। বদিউল জানালা টপকে পালানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তা কাজে আসেনি। পাক-হায়েনারা সেখান থেকে শুধু বদিউলকেই ধরে নিয়ে যায়। এরপরে তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
কৃতজ্ঞতাঃ মোহাম্মদ সানাউল্লাহ / ফারজানা সোনিয়া