সবখানেই বাবাকে পাই – শাওন মাহমুদ

স্বাধীনতার বয়স ৪২ বছর, আর আমার ৪৫। মাত্র ৩৮ বছর বয়সে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাবার অন্তর্ধান। এখন প্রতি বছরই আমি বাবার থেকে এক বছর করে বড় হয়ে যাচ্ছি। বাবা কোথায় জানতে চাইলে ছোটবেলা থেকেই আমাকে বলা হয়েছে, বাবা বাংলাদেশের মাটির সঙ্গে মিশে আছেন। কবর কোথায় জানতে চাইলে প্রিয় মিষ্টি মামা (দীনু বিল্লাহ) সাভার স্মৃতিসৌধ দেখিয়ে বলেছিলেন, এটাই আলতাফ ভাইয়ের কবর। বাবা কত বড় মানুষ যে এতখানি জায়গাজুড়ে তাঁর অবস্হান।

বড় হওয়ার পর জানতে পারলাম, বাবার কোনো মৃত্যুদিন নেই এবং মৃতদেহ পাওয়া যায়নি বলে তাঁর কোনো চিহ্নিত কবরও নেই, মা আর আমার পরিবারের সবাই পাগলের মতো খুঁজেও বাবার কোনো চিহ্ন খুঁজে পাননি। স্মৃতিসৌধের বিশালতার সঙ্গে যোগ হলো বিশাল বাংলাদেশ। এ দেশের আনাচেকানাচে যেখানে যত শহীদের কবর আছে, তার প্রতিটাই আমার কাছে বাবার কবর।

একাত্তরের ২৯ ও ৩০ আগস্ট পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও রাজাকাররা যাঁদের ধরে নিয়ে গিয়েছিল, তাঁদের রাখা হয়েছিল নাখালপাড়ার পুরানো এমপি হোস্টেলের একটি ছোট বাথরুমে। এখন যেখানে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, তার পেছনেই ছিল এমপি হোস্টেল। সেখানে যাঁদের আটক রাখা হয়েছিল, তাঁদের মধ্যে আমি শহীদ রুমি, আজাদ, বদির সঙ্গে স্মরণ করতে চাই শহীদ হাফিজকে, যিনি ছিলেন বাবার ছায়াসঙ্গী। বাবার সঙ্গেই তাঁকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল পাকিস্তানিরা। তিনি বেহালা বাজাতেন। আমি যতটুকু শুনেছি, ১ সেপ্টেম্বর দুপুর ১২টা পর্যন্ত বাবা বেঁচে ছিলেন। আমাদের বাড়িতে যে অস্ত্র পাওয়া গেছে, তার দায়িত্ব আমার বাবা নিয়েছিলেন। ফলে, ১ সেপ্টেম্বর দুপুর ১২টায় আমার চার মামা দীনু বিল্লাহ, লীনু বিল্লাহ, খায়রুল আলম বিল্লাহ, নূহেল আলম বিল্লাহ ও আবুল বারক আলভীকে প্রচণ্ড নির্যাতনের পর ছেড়ে দিয়েছিল ওরা। আমার বাবাকেও প্রচণ্ড মেরেছিল। পা ভেঙে গিয়েছিল বাবার। বাবা তাঁর আংটিটি খনু মামার (খায়রুল আলম বিল্লাহ) হাতে দিয়ে বলেছিলেন, শাওনকে দিও। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, এরা বাবাকে বাঁচিয়ে রাখবে না। তখন বাবার শরীরে প্রচণ্ড জ্বর। বাথরুমের কলের পানি মুখে তুলে দিয়েছিলেন মামারা। কিন্তু সে পানিও ঠোঁটের কোণায় শুঁকিয়ে যাচ্ছিল। আমি সে সময়টার কথা কল্পনায় আনতে চেষ্টা করি।

একাত্তরে আমার মায়ের বয়স মাত্র ২২, আমি বড় হওয়া পর্যন্ত একটা জিনিসই কেবল দেখেছি- মায়ের অপেক্ষা করা। আমি সকল শহীদজায়াকে সালাম জানাই এ জন্য যে তাঁরা অপেক্ষা করেই জীবন কাটিয়ে গেছেন। এই আত্মত্যাগের কোনো তুলনা হয় না।

আমার মা তো রায় দেখলেন। কার্যকর হবে কি হবে না, সেটা জানি না। কিন্তু আমরা যারা শহীদের সন্তান, শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যা দিবস পালন করে এসেছি, এখন আমরা জানি, কারা দেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে, কেন আমরা ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করি। যাদের কারণে বুদ্ধিজীবীরা শহীদ হয়েছেন, তারা চিহ্নিত হয়েছে, তাদের বিচার হয়েছে, এটা বড় সান্ত্বনা আমার।

প্রতি বছর যখন একুশে ফেব্রুয়ারি সারাদেশে বাবার সুর করা আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানোগানটি ভেসে বেড়ায়, তখন মনে এক ধরনের প্রশান্তি আসে। মনে হয়, বাবা তো এখানেই, সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে আছেন। আমি তো বাংলাদেশের মেয়ে।

আজ ৪২ বছর পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হয়েছে এবং প্রত্যাশিত রায় আমরা পেতে শুরু করেছি। এখন মনে হয়, এ দেশ কিছুটা হলেও বাবাসহ একাত্তরের শহীদদের আত্মত্যাগের প্রতিদান দেওয়া শুরু করেছে। দেশের সব শহীদ পরিবারের পক্ষ থেকে এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই।