৩০ অগাস্ট, ১৯৭১ সাল। ভোর বেলায় যখন পাকসেনারা ৩৭০, আউটার সার্কুলার রোডের মুক্তিযোদ্ধাদের দূর্গ হিসেবে খ্যাত বাড়িটি ঘিরে ফেলেছিল, তখন বাসায় থাকা সকলের সাথে ঘুম ভেঙে কাঁদতে থাকা শাওনকে কোলে নিয়ে এঘর ওঘর করা ঝিনু উৎকন্ঠায় চিৎকার করে বলে উঠেছিল, আলতু এখন আমাদের কি হবে? আলতাফ মাহমুদ তাঁর দীঘল ভেঁজা ভেঁজা সাহসী গভীর চোখের চাহনীতে ঝিনুকে ধমক দিয়ে উঠেছিলেন, এতো ভয় পাও কেন? এই বাক্যটি ছিল তাঁর শেষ কথা। আমার মাকে তাঁর অসীম সাহসের ভান্ডার দিয়ে গিয়েছিলেন তিনি।
আলতাফ মাহমুদ সাহসের বরপুত্র হয়ে জন্মেছিলেন। শুধু একাত্তরকে ঘিরে তাঁকে চিনতে চাইলে পুরো মানুষটাকে চেনা যায় না। তখন তাঁর বয়স ছিল দশ অথবা বারো। তাঁর বাবা নেজাম আলী ছিলেন কট্টর মুসলিম লীগ ঘরানার। ছেলেকে প্রতিদিন কোরআন শরীফ তেলাওয়াত করে দিন শুরু করতে হবে, তাই ছিল ঘরের নিয়ম। একদিন তিনি নামাজ শেষে ঘরের উঠোনে আসতেই গজলের সুরে কেউ কোরআন তেলাওয়াত করছে শুনতে পেয়ে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠেছিলেন। ঘরের ভিতরে ঢুকে দেখেছিলেন তাঁর পুত্র তখনকার বিখ্যাত একজন গজল শিল্পীর গাওয়া গানের সুরে তেলাওয়াত করছে। লাঠি নিয়ে ছেলেকে শাসন করবার আগেই সে দৌড়ে পালিয়ে যেতে যেতে বলেছিল, “সুর তো সুরই। তা গানের হোক বা কোরআন তেলাওয়াতের হোক। আমি এভাবেই তেলাওয়াত করবো।”
পিতার মুসলিম লীগ প্রীতিতে আলতাফ মাহমুদ ত্যাক্ত বিরক্ত হয়ে নিজের ম্যাট্রিক পরীক্ষার ফরম ফিলাপ করবার সময় পিতা প্রদত্ত পদবী “আলী” বাদ দিয়ে নিজের নামের সাথে পছন্দের পদবী “মাহমুদ” সংযুক্ত করেন। এরপর ম্যাট্রিক পরীক্ষায় আশানুরূপ ফলাফল না হওয়ায় নেজাম আলীর সাথে আলতাফ মাহমুদের প্রচন্ড বাকবিতন্ডা হয়। সেই ঘটনার পর কোনো একদিন মায়ের হাতের সেলাই করা একখানা কাঁথা এবং প্রিয় বেহালা নিয়ে এক কাপড়ে কানাকড়িহীন অবস্থায় অচেনা অদেখা শহর ঢাকার উদ্দেশ্যে লঞ্চে উঠেছিলেন। পিতা নেজাম আলী বেঁচে থাকা অবস্থায় আর কখনই তিনি নিজ ঘরে পা রাখেন নাই।
সেই ‘৪৭ সাল থেকে একটা একটা করে তাঁর সাহসের ঘটনার বিনুনী গাঁথলেই শুধুমাত্র হিসেব করা যায় মাকে বলা তাঁর শেষ বাক্যটির শিকড়। বাবার সাহস নিয়ে জানতে গিয়ে অনেক ঘটনা জানা হয়েছে আমার। ঢাকায় ধূমকেতু শিল্পী সংঘের সাথে একসময় তিনি প্রবল ভাবে জড়িয়ে পড়েন। সংঘের বন্ধু নেজামুল হকের সাথে প্রায়ই তিনি বিভিন্ন জলসায় শহর, গ্রামগঞ্জে সমবেত এবং একক গান পরিবেশন করতে যেতেন। এমন একটি জলসার কথা আমার মনে গেঁথে থাকে সবসময়।
গ্রামের মেঠো পথ ধরে নেজামুল হক এবং আলতাফ মাহমুদ জলসায় গিয়ে পৌঁছানোর পর টের পেয়েছিলেন সেটা মুসলিম লীগের আসর। সাহস করে দুজন মঞ্চে হারমোনিয়াম নিয়ে গান ধরলেন –
” বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা আজ জেগেছে এই জনতা ”
গান শুরুর সাথে সাথে মুসলিম লীগের সদস্যরা এই গান বন্ধ করবার জন্য জোড়ালো দাবী তোলে। তারা হামদ নাত এবং ধর্মীয় সংগীত শুনবে বলে চেঁচামেচি শুরু করে। নেজামুল হক তাদের চিৎকারে ভয় পেয়ে গিয়ে মঞ্চ থেকে নেমে যাওয়ার জন্য আলতাফ মাহমুদকে অনুরোধ করতে থাকেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম লীগের এলাকায় খারাপ কিছু ঘটে যেতে পারে তাই। তখন মাইকের সামনে গিয়ে আলতাফ মাহমুদ ঠান্ডা মাথায় কথা বলা শুরু করেন। তিনি বলেন, ” আপনারা শান্ত হন। আমি এখনই আপনাদের পছন্দসই গান পরিবেশন করবো “। বলে তিনি গেয়ে উঠেন –
” বিশ্বে জেগেছে নওজোয়ান
কোটি প্রাণ একই প্রাণ
একই স্বপ্নে মহীয়ান – আল্লাহু আকবর
তুচ্ছ ভয় সন্ত্রাসে
রক্ত পিপাসু দানবের
একতার হিম্মত
শান্তি শপথ বলীয়ান – আল্লাহু আকবর “
গান শেষে আলতাফ মাহমুদ জনগণকে মাইকে প্রশ্ন করেন, “এবার পছন্দ হয়েছে গান” ?জনগণ উৎসাহ নিয়ে বলে উঠে, ” চলুক গান। আল্লাহ্ তায়ালার গান “। এভাবে তিনি পরের সবগুলো গণসংগীত আল্লাহ্ বা নবীজির নাম নিয়ে গেয়েছিলেন। যতটুকু জানি সে আসরে বাবা প্রায় ভোর রাত পর্যন্ত এভাবে গান করেছিলেন। মুসলিম লীগের এলাকায় সাহসে বুক ফুলিয়ে গান বাজনা করে আলতাফ মাহমুদ এবং নেজামুল হক বীর দর্পে ঢাকা ফিরেছিলেন।
‘৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে আলতাফ মাহমুদ নিজ এলাকা মুলাদী থেকে মুসলিম লীগ প্রার্থী নিজের পিতা নেজামুদ্দীন আলীর বিরুদ্ধে নির্বাচনে দাঁড়ানো যুক্তফ্রন্ট প্রার্থীকে সমর্থণ করেছিলেন। রাজপথে মুসলিম লীগ সরকারকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে পিকেটিং থেকে শুরু করে সরকারের কর্মকান্ড নিয়ে ব্যাঙ্গাত্মক ও বিদ্রুপাত্মক গান বেঁধে স্ট্রিট মিটিং গুলোতে পরিবেশন করতেন। রাজপথের সকল মানুষকে নিয়ে গানের সুরে সুরে মিছিল করতেন।
সে সময়ে তাঁর নিজের লেখা এবং সুর করা একটি মুসলিম লীগ বিরোধী জনপ্রিয় প্রতিবাদী গান –
” ওগো হুনছনি ভাই হুনছনি
স্বাধীনতার নামে আজব কান্ড দেখছনি
ও ভাই ইসকুল কলেজ বে আইনী
লেখাপড়া বে আইনী
স্বাধীনতার নামে আজব কান্ড দেখছনি। “
এমন অনেক গান তখন তিনি নিজে লিখে, সুর করে রাজপথে গলায় হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে নেচে গেয়ে নিজের কাছে মানুষের ভিড় বাড়াতেন। তখন তাঁর আরেকটি গান খুব জনপ্রিয় ছিল –
” মরি হায় রে হায়
দুঃক্ষে পরান যায়
হাজার টাকার বাগান খাইলে
পাঁচ সিকার ছাগলে!
মরি হায় রে হায় “
বর্তমান সময়ের সবচেয়ে প্রচলিত রাজাকার বিরোধী “ছাগু” শব্দটি তিনি মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে শুদ্ধ ভাবে ব্যবহার করেছিলেন। সাহসে বুক ভরে ওঠে এই ভেবে যে আমি এই সাহসী মানুষের কন্যা হয়ে জন্ম নিয়েছি। তাঁর সাহস খুঁজতে খুঁজতে কখনও পেয়েছি শহীদুল্লাহ কায়সারের লেখা তাঁর সুর করা নিজস্ব স্পষ্ট অবস্থানের গানে –
” আমরা পূবে পশ্চিমে
আকাশে বিদ্যুতে
উত্তর দক্ষিন হাসিতে সংগীতে
নদীরও কলতানে আমরা
সাগরের গর্জনে চলি অবিরাম
অগ্নি আখরে লিখি মোদেরই নাম
আমি মানুষেরই ভাই স্পার্টাকাস “।
সাহসের বরপুত্র থেমে থাকেননি। সেই ‘৫২ থেকে ‘৭১ রাজপথ জনপথে তাঁর সুরের ভেলা ভাসিয়ে ভেসে বেড়িয়েছেন। ষাট দশকের মাঝামাঝি থেকে চলচ্চিত্রের সংগীত আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে গেলেও রাজপথ আর গণমানুষের কথা কখনও ভুলে যাননি। ‘৫২ সালের পর থেকে গণসংগীত নিয়ে জড়িয়ে থাকা সব ধরণের কাজে শত ব্যস্ততাতেও সময় বের করে সময় দিয়েছেন, যে কোন অনুষ্ঠানে না বলেননি। নিয়মিত রিহার্সেল করবার জন্যও একদম সময় মতন হাজির হয়ে যেতেন তিনি। ‘৭১ সাল পর্যন্ত যে কোন প্রতিবাদ বা মিছিলে আলতাফ মাহমুদ স্বশরীরে থাকতেন। প্ল্যাকার্ড প্লাটুন নিজের হাতে লিখতেন। মঞ্চ সাজাতেন আর সব তরুণদের সাথে।
‘৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় কেউ জানতো না – পাহাড়সম সাহস নিয়ে মানুষটি ভেতরে ভেতরে স্বাধীনতার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। ক্রমে তাঁর ৩৭০, আউটার সার্কুলার রোডের বাড়িটি একাত্তরের দূর্গ বাড়ি হয়ে ওঠে। সেখানে ঢাকা শহরের একাধিক ছোট ছোট গেরিলা গ্রুপের যোদ্ধারা এসে জড়ো হতেন। তাঁরা ঐখানে বসে এ্যাকশনের জন্য আগে-পরে অনেককিছুই আলাপ করে নিতেন। ধীর স্থির আলতাফ মাহমুদ ছিলেন ঐ কেন্দ্রের প্রাণ। সমুদ্র সমান মৌনতা নিয়ে তিনি কাজ করে যাচ্ছিলেন।
যুদ্ধের ভয়াবহতার মধ্যেই যে মুক্তিযুদ্ধের গান লেখা হচ্ছে, গাওয়া হচ্ছে, এটা সকলকে জানানো প্রয়োজন ছিল। নিজের সমগ্র অস্তিত্ব দিয়ে মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন গলায় গান, হাতে অস্ত্র নিয়ে। তখন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে রোজ প্রায় একই গান বাজত। আলতাফ মাহমুদ এ কারণেও নতুন গানের প্রয়োজন অনুভব করতেন। দূর্গ বাড়িটার জানালা দরজা বন্ধ করে ঘরের মধ্যই গান তৈরি করতেন আবদুল লতিফ, শেখ লুতফর রহমান, আলতাফ মাহমুদ। রেকর্ড শেষে গানের পাতা ছিঁড়ে ফেলা হতো। এভাবেই চলছিল সব।
কিছু কিছু গান তিনি দুবার রেকর্ড করেন। প্রথমদিকে আলতাফ মাহমুদের ১২ খানা গানের একটি স্পুল নিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করার সময় বহনকারী ধরা পড়লে তাঁর মৃত্যু হয়। সেই স্পুলটি আর পাওয়া যায় নি। জুলাইয়ের শেষের দিকে তিনি আবার অনেকগুলো গান রেকর্ড করে দুটো বড় স্পুল স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের জন্য পাঠান। জুলাই এর প্রথম থেকে তিনি ঢাকার ক্র্যাক প্লাটুন এর সঙ্গে পুরোপুরি সংযুক্ত হন।
৩০ অগাস্ট ‘৭১ ভোর বেলায় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী তাঁর কাছে অস্ত্র আছে এই তথ্য পেয়ে তাঁর বাড়িতে হানা দেয়। আলতাফ মাহমুদ নিজের পরিচয় লুকাননি। তাঁকে দিয়েই হানাদার বাহিনী উঠোনে মাটি চাপা দেয়া ক্র্যাক প্লাটুনের অপারেশনের জন্য রাখা অস্ত্র ভর্তি দুটি ট্রাংক বের করিয়েছিল। তিনি সেই যে চলে গেলেন আর ফিরে আসলেন না। তাঁর মৃত্যুদিন নেই। কবর নেই।
আমার মাকে বলা “এতো ভয় পাও কেন?” ছিল সাহসের বরপুত্রের শেষ বাক্য। যা কিনা মা সারা জীবন বহন করে চলেছেন বেদ বাক্যের মতন। সময় গড়ালে উত্তরাধিকার সূত্রে মা আমার ভেতরে বপন করেছেন সেই সাহসের মন্ত্র। আমরা এখন আর তাই ভয় পাই না। সাহসের বরপুত্রর স্বজনদের ভয় বলে কিছু থাকতে নেই।