অমর সঙ্গীতের মহান সুরকার – সারা আরা মাহমুদ

১৯৬৩ সাল। আমি তখন দশম শ্রেণীর ছাত্র। কমলাপুরে আমাদের বাসা। আমাদের পরিবারের সবাই ছিলাম প্রগতিশীল ও সংস্কৃতিমনা। সঙ্গীত ছিল সবার অন্তর্গত। এক কথায় বলা চলে, পরিবারের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের সুন্দর সুস্থ আবহাওয়ায় আমরা সবাই ছিলাম প্রাণচঞ্চল। ঢাকার সব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেই আমাদের উপস্থিতি ছিল নৈমিত্তিক ব্যাপার।

এমনি সময়ে ১৯৬৩ সালে ঢাকার কোনো এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আলতাফ মাহমুদের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। সে সময় সঙ্গীতই তার একমাত্র নেশা ও পেশা। কন্ঠে তার উদ্দাম সুরস্রোত। তার গান শ্রোতাকে কখনো আনন্দিত, কখনো বেদনার্ত, কখনো বা উদ্দীপ্ত করত। আলতাফ মাহমুদ তখন সবার প্রিয় নাম। সে নাম এক সময় আমাকে স্পর্শ করল। আমি তাঁকে চিনলাম, জানলাম।

কেটে গেল তিনটি বছর। পরিবারের পরিচয়সূত্র তখন অনেকটা দীর্ঘ হয়েছে। ১৯৬৬ সাল। বিয়ের প্রস্তাব এল। আমাদের বয়সের পার্থক্যজনিত কারণ দর্শিয়ে আমার পরিবারের কজন এত অসম্মত হলেন। অনক টানাপোড়েনের পর কবি সুফিয়া কামালের সহযোগিতায় আমাদের বিয়ে সুন্দরভাবে সম্পন্ন হলে ১৯৬৬ সালেই।শুরু হলো সংসার সাজানো। সঙ্গীতকে তিনি যে কত ভালোবাসতেন তা তাঁর কাছে এসেই প্রথম অনুধাবন করতে পারলাম আমি। সঙ্গীতের সপ্ত স্বরই ছিল তাঁর একমাত্র বিচরনক্ষেত্র । তাঁর ধ্যান-জ্ঞানের সবটুকুই ছিল সুরের ইন্দ্রজালে আবদ্ধ।

অবসরে ঘর সাজানো খুব শখ ছিল তাঁর। কখনো কখনো আমাকে সাহায্য করতেন। দীর্ঘ অবসরে গান আর বই পড়ায় মগ্ন থাকতেন। কখনোবা পরিবারের সবার সঙ্গে গল্পে সঙ্গ দিতেন। তাঁকে কখনো রুটিন বেঁধে চলতে দেখিনি। যখন যেমন প্রয়োজন তেমন চলেছেন।

সব সময় সাদামাটা জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন আলতাফ মাহমুদ। পোশাকের মধ্যে পাজামা-পাঞ্জাবি আর চাদর ছিল সবচেয়ে প্রিয়। খাওয়া-দাওয়ায়ও তেমন বাড়াবাড়ি ছিল না। আর সব বাঙালির মত মাছ-ভাত ছিল তাঁর প্রিয় খাদ্য। মাছভাজা ও দোঁপেয়াজি খেতে ভালোবাসতেন। গ্রামকে তিনি খুব ভালোবাসতেন। গ্রামে একটা খামারবাড়ি করার স্বপ্ন ছিল তাঁর, তা আর হয়নি। দাম্পত্য জীবনে তাই প্রতিবছর একবার শ্বশুরবাড়ি বরিশালে যেতাম, আর সে সময়টা আমরা বেছে নিতাম ঈদুল আজহাকে। বেড়ানো তাঁর খুব শখ ছিল, তবে গ্রামে। মুগ্ধ চোখে ঘুরে-ফিরে দেখতেন গ্রামের চারদিক। বেড়াতেন মেঠোপথে। আমি সঙ্গী হতাম। ভালে লাগত আমারও। মাঝ-মধ্যে এমন তন্ময় হতেন, মনে হতো সুর খুঁজছেন। স্বপ্নভঙ্গ হবে ভেবে কিছু জিজ্ঞেস করতাম না। আমি বুঝে নিতাম।

দুজনের জীবনে পরিবর্তন এল ১৯৬৮ সালে। জন্ম হোল আমাদের একমাত্র কন্যাসন্তান শাওন-এর। আলতাফ মাহমুদ মেয়ের প্রথম মুখদর্শনে আনন্দে যেভাবে আপ্লুত হয়েছিলেন, ওই মুহূর্তটি আজও আমাদের সোনলি স্মৃতি হয়ে বেঁচে আছে। সন্তানের প্রতি পিতার স্নেহ যে কত মধুময়, তা তাঁর মধ্যে দেখেছি। দেখেছি, শাওনকে নিয়ে তাঁর খেলা মুহূর্তগুলো, শত কাজের চাপে তাঁর সে আনন্দ ব্যর্থ হতে দেননি। আসলে আনন্দ আর সুখ যে সব সময়ই ক্ষনস্থায়ী হয়, তা আগে জানা ছিল না। পরে বুঝছি, বেশি ভালোবাসা ভালো নয়।

১৯৭১ সাল। শুরু হলো যুদ্ধ। আমরা তখন রাজারবাগ পুলিশ লাইনের কাছে এক বাসায় থাকি। তিনিও তৎপর হলেন। যোগযোগ হলো স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে। ঢাকা তখন আমাদের কাছে অনিশ্চয়তার শহর। যেকোনো সময় অঘটন ঘটতে পারে। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে তাঁর যোগযোগ হয়েছে। কেউ কেউ বাসায় আসেন। আবার চলে যান। বেশ কিছু আর্মস তখন আমাদের বাসায় মাটির নিচে লুকানো। আমাদের চারদিকে ভয়ের দেয়াল। তবুও স্বাভাবিক থেকেছি। তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন স্বচ্ছন্দে। হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে পড়লেন গান রেকর্ডিং নিয়ে। স্পুলগুলো স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে পাঠানোর ব্যবস্থাও করা হলো। কদিন পরই সবার যাওয়ার কথা সীমান্তের ওপারে। তিনিও চেয়েছিলেন গণতন্ত্র ও শোষনহীন সমাজ। তার ভাবনায় সারক্ষন থাকত মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন। আর সে স্বপ্নের ইন্দ্রজাল থেকে খুঁজে নিতেন তেজোময় গানের সুর। কিন্তু কারোরই আর যাওয়া হয়নি।

৩০ আগস্ট ১৯৭১, ভোর প্রায় ৬টা হবে। তন্দ্রাচ্ছন্নতা তখনো কাটেনি। দরজার কড়া নাড়ার শব্দে দরজা খুলে দেওয়া হলো। কোনো কথা হলো না। আলতাফ মাহমুদ তাঁদের সঙ্গে বেরিয়ে গেলেন। ফিরে আসেননি আর কখনো। ফিরবেন না কোন দিন।

তাঁকে যে গানে সুরে চিনেছিলাম, সে গান এখনো বাজে, শুনলে এখনো শিউরে উঠি আমি। সে গান আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী। তাঁর স্ত্রী হিসেবে প্রতি মুহূর্তই তাঁকে স্মরন রাখি। আজও আমার কাছে শিল্পী আলতাফ মাহমুদ মানেই সেই অমর সঙ্গীতের মহান সুর – যার সুরকার নেই, সুর আছে, থাকবে চিরকাল।

যাদের জন্য যাওয়া, তারা আছে, আর যাদের কারনে গেছেন, তারাও আছে এবং ঘুরছে সমাজে বুক ফুলিয়ে। মাঝে-মাঝে ভাবি যাঁরা গেছেন, তাঁরা ভুল করে চলে গেছেন। আমরা শুধু রয়ে গেছি কালের সাক্ষী হিসেবে। চেয়ে আছি নতুন প্রজন্মের দিকে- এরা যদি কিছু করে।