১৯৪৮ সাল মাত্র ১৫ বছর বয়সের কিশোর ঝিলু ভিতরে বিপ্লবের দ্রোহ পুষে গণসংগীতের সাথে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন, এমনকি জীবনের উত্তাল ঊর্ধ্বমুখী সময়েও তিনি গণসংগীতের সাথেই ছিলেন। কিশোর ঝিলু যৌবনে পুরোদস্তর সেলিব্রেটি, মানুষের সুখ-দুঃখ জীবনের সংগ্রামে তাঁর সুর তখন অনুভূতির হাতিয়ার, রূপালি পর্দায় নায়কের কামনায় আর নায়িকার বিরহে ঝিলুর সুর, মাঠে কৃষকের ঘামে, ঢাকায় পুলিশের গুলিতে নিহত বন্ধুহারা বন্ধুর গলায়ও ঝিলুর সুর, গোটা একটা জাতিকে একই সময়ে শ্রেণিভেদে কথা সুর আর সংগীতে বেঁধে রেখেছিলেন ‘ঝিলু’ সময়ের আলতাফ মাহমুদ।
৫২ এর ভাষা আন্দোলন এবং ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতি ও স্বার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিলেও, মাঝখানের সময়টা ১৯৫২-১৯৭১ আমাদের স্বাধীনতার যে বীজমন্ত্র বোনা হয় তা আলতাফ মাহমুদ ও সমসাময়িক সাংস্কৃতিক অঙ্গনের যে বিপ্লবীদের দৃঢ়চিত্তে মুক্তি কামনার ফসল, যে কামনা তারা বুকে বেঁধে সুরে গানে নাটকে তুলে ধরেছেন পরে তা সংক্রামিত হয়ে বুক থেকে বুকে ছড়িয়ে গিয়ে স্বাধীনতায় রূপ নিয়েছে।
আমাদের ভাষা কিংবা স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রেরণায় কণ্ঠযোদ্ধা আলতাফকে খুঁজে পাওয়া যায়। ১৯৫০ সালে এ বাংলার তরুণদের ভাষা আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ করতে আলাতাফের সুর প্রেরণা জুগিয়েছে, একটি জাতির সবচাইতে স্বতন্ত্র পরিচয় তার ভাষা আর আমাদের ভাষার আন্দোলনের পেছনের অন্যতম সংগঠক আলতাফ মাহমুদ, এমনকি ভাষা সংগ্রামের প্রথম প্রভাতফেরীর প্রথম গান “মৃত্যু কে যারা তুচ্ছ করেছে ভাষা বাঁচাবার তরে” তাঁরই সুর করা।
১৯৫৪ থেকে ১৯৭১ পরাধীন এ জাতির নিজের বলতে শুধু আলতাফ মাহমুদের সুর করা “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি” গানটিই ছিল, জহির রায়হান “জীবন থেকে নেয়া”তে যার বাস্তবতা তুলে ধরেছেন। ১৯৫৪ থেকে ১৯৭১ যাত্রায় এই সুরেই স্বাধীনতার বীজ বোনা হয়েছিল এবং ঠিক স্বাধীনতার প্রক্কালে “জীবন থেকে নেয়া মুক্তি” পেলে “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি” ও “আমার সোনার বাংলা গান” দু’টি সমসাময়িক তরুণদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের সংকল্প তীব্র থেকে তীব্রতর করে। উল্লেখ্য, বাংলা সিনেমার ইতিহাসের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ সিনেমা “জীবন থেকে নেয়া”য় আলতাফ মাহমুদের গানটি সুর করা গানটি ব্যবহার করা হয়।
উত্তাল ৭১, আলতাফ গোপনে রেকর্ডিং শুরু করলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জন্য। লুকিয়ে গান তোলা ও রেকর্ডিং করার মাঝেই ওই সময়ের সবচাইতে আলোচিত তরুণরা মিলে স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য ‘ক্র্যাক প্লাটুন’ গঠন করেন এবং এই গ্রুপটি পরে পাকিস্থানিদের সবচাইতে বেশি আতঙ্কের কারণ হয়ে ওঠে।
ক্র্যাক প্লাটুন গঠন, গেরিলা যোদ্ধাদের আশ্রয় দেওয়া ও তাঁদের অস্ত্র নিজের জিম্মায় রাখার খবর পেয়ে যায় পাকবাহিনী, শহীদ আলতাফ মাহমুদকে ১৯৭১ সালের ৩০ আগস্ট ধরে নিয়ে যায়, তারপর থেকেই নিরুদ্দেশ বাংলার আকাশের রক্তিম সূর্যের অন্যতম ফেরিওয়ালা। ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ এবং এর মধ্যবর্তী সময়কাল পর্যন্ত আলতাফ মাহমুদ সবচাইতে উল্লেখযোগ্য নাম এবং তিনিও এ জাতীয়তাবাদের অন্যতম স্থাপক। এ জাতি ও এ স্বাধীনতার অন্যতম স্বপ্নদ্রষ্টা আলতাফ মাহমুদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
নোট : আলতাফ মাহমুদকে নিয়ে কাজ করতে পেরে নিজেকে ভাগ্যবান মনে হয়েছিল। পরে লিখতে গিয়ে দেখলাম আমি এতটা যোগ্যতা রাখি না, ভয়ে ভয়ে উপরের এই লেখাটুকু অনেক দিনে দাঁড়িয়েছে। অভ্র দিয়ে লেখার কারণে ও বিদ্যার অভাবে লেখায় ভুল হতে পারে, ক্ষমাসুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন সবাই।