একজন সাহসী মানুষের মুখ – শিমূল ইউসুফ

১৯৭১ থেকে ১৯৯৩, ২২ বছর। সময় কত নিঃশব্দে চলে যায়। মনে হয় এইতো সেদিনের কথা, সেদিনের ঘটনা। সব মনে আছে, স্পষ্ট মনে আছে। এত বেশি স্পষ্ট যে, এ থেকে পালাতে চাইলেও পারি না। কেন সেই স্মৃতি ঝাপসা হয়ে আসে না? এখন তো শোনার আর কেউ নেই। কেউ জানতেও চায় না অলিখিত সেসব নৃশংস ঘটনার কথা। এ এক অসুস্থ সময়কে আরা অতিক্রম করতে চাইছি। কিন্তু পারছি কি?

তবে আমার কাছে ২২ বছর আগের ‘৩০ আগস্ট’ এখনও যৌবনদীপ্ত এক পূর্ণ যুবক। আমি তার সঙ্গে অবিরাম আমার সুখ-দুঃখের কথা বলে যেতে পারি মনে মনে। আমার মন সাম্প্রতিক ঘটনায় যখন খুব বেশি খারাপ হয়ে যায়, তখন সে এসে আমাকে সান্ত্বনা দেয়; মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। চোখের অশ্রু মুছে দিয়ে যায়। এই ২২ বছরের ‘৩০ আগস্ট’ পূর্ণ যুবক আরেক আলতাফ মাহমুদ হয়ে গেছে।

২২ বছর আগে যে আলতাফ মাহমুদকে ড্রাম ফ্যাক্টরির বারান্দার দেয়ালে হেলান দেওয়া অবস্থায় ফেলে এসেছিলাম, তিনি বেঁচে থাকলেও আর কোনো দিন সুস্থ জীবনযাপন করতে পারতেন কি না সেটাও একটা প্রশ্ন। কারণ তিনি ছিলেন পাকিস্তানীদের চোখে দেশদ্রোহী। সবচেয়ে বড় অপরাধ; তিনি ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। এই অপরাধে তাঁর ওপর অমানবিক নির্যাতন চালিয়েছিল পাকিস্তানীরা। তাঁর শরীরের সমস্ত গিঁটগুলো একটি একটি করে ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। তিনি আর কোনো দিন যেন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারেন, সেটাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। তিনি যে বড় ভালোবাসতেন দেশকে। অনমনীয় দীপ্তভঙ্গি ছিল তাঁর। সেই আলতাফ মাহমুদের নামের আগে ৭১-এর ১৬ ডিসেম্বরের পর আরো একটি শব্দ যোগ হয়ে গেল। তিনি হয়ে গেলেন ‘শহীদ আলতাফ মাহমুদ’। ‘৭১-এর ‘৩০ আগস্ট’- আমার চেতনার ভেতরে তিল তিল করে গড়ে ওঠা নবীন আলতাফ মাহমুদ- তুমি কি জানো তোমার জন্মের কথা? কেউ কি তোমাকে বলেছে কীভাবে জন্ম হলো তোমার? তবে এসো, তোমাকে শোনাই তোমারই জন্মের কথা। আর যে আলতাফ মাহমুদকে ফেলে এসেছি ড্রাম ফ্যাক্টরির বারান্দায়, তার যে কী কষ্ট, কী অপমান। কত লাঞ্ছনা, কত অত্যাচার তাকে সইতে হয়েছে। সেই অপমান, সেই অত্যাচারের কথা কতটুকুইবা আমরা জানি। আর কতটুকু পর্যন্তইবা আমি আমার প্রকাশের ভাষার চূড়ায় পৌঁছাতে পারব?

হে নবীন ‘৩০ আগস্ট’ ভোর সাড়ে ৫টা কি পৌনে ৬টার মতো হবে। মা নামাজ শেষে গুনগুন করে কোরআন শরিফ পড়ছেন। আর আমি খুবই অনুচ্চ স্বরে রেওয়াজ করছি। ঘরের সব দরোজা-জানালা বন্ধ, বাইরে যেন শব্দ না যায়। সেদিন গভীর রাতে হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙে গেলে জানালার দিকে তাকাতেই দেখলাম, একটা লোক হাফ হাতা সাদা শার্ট পরে দাঁড়িয়ে আছে। আমি বেশ ভয় পেয়েছিলাম। অত রাতে কে এমন করে দাঁড়িয়ে আছে? আর সবচেয়ে বড় কথা, পাকিস্তানী আর্মিরা দেখলে তো মেরে ফেলবে। দ্রুত সব চিন্তা মাথায় এলো। আমি বিছানায় উঠে বসব, ঠিক সেই সময় লোকটা হঠাৎ দৌড় দিলো এবং এক দৌড়ে পাশের বাড়ির দেয়াল ডিঙিয়ে চলে গেল। তার পেছনে পেছনে কতগুলে বুটের শব্দও পেয়েছিলাম। কেউ কি সত্যি এসেছিল? তাৎক্ষণিকভাবে আমার মনে হলো লোকটা বোধ হয় আমাদের কিছু বলতে বা আমাদের কাছে একটু আশ্রয়ের জন্য এসেছিল। ঘুমন্ত বাড়িটাকে সে জাগাতে পারেনি। তবে জানালার কাঁচের ওপাশে যতটুকু দেখা যায়, ঝাপসা, তবুও আমার মনে হলো এই রকমের উচ্চতা এবং শারীরিক গঠনের লোক আগেও আমি দেখেছি, আমাদের বাসায়। ভয়ে পাশে ঘুমিয়ে থাকা ভাইকে ডেকেছিলাম। কিন্তু ও তখন গভীর ঘুমে।

সকালে উঠে আমার কিছুই মনে ছিল না। শুধু কেমন যেন একটা অস্বস্তি হচ্ছিল। মাঝে মাঝেই সারা শরীর কাঁটা দিয়ে উঠছিল। জ্বর জ্বর লাগলে যেমন হয়। অন্যমনস্ক আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকাই এবং দেখি দু’টো ট্রাক বোঝাই পাকিস্তানী আর্মি চোখের পলকে আমাদের বাড়িটা ঘিরে ফেলল। মাকে বললাম, ‘মা পাকিস্তানী আর্মিরা বাড়ি ঘিরে ফেলেছে।’ মা তাড়াতাড়ি তাঁর বিশ্বাসে হাত রাখলেন কোরআন শরিফের ওপর। সকল বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার আশ্রয়। এর তিন দিন আগে আমার মেজ ভাই আর মেজ বোন চলে গেছে আগরতলা, শাহাদৎ ভাইদের সঙ্গে। আলতাফ ভাইয়ের যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু গানের টেপ সঙ্গে করে নিয়ে যেতে হবে, তাই সেপ্টেম্বরের তিন তারিখ যাবে বলে ঠিক করেছে। মা ভেবেছিলেন ওদের খবর পেয়েই বুঝি আর্মিরা বাড়ি ঘেরাও করেছে। কে জানত তারচেয়ে আরো ভয়াবহ, বীভৎস দৃশ্য আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল! মা বাড়ির সবাইকে ঘুম থেকে ডাকতে যাওয়ার আগেই পেছনের দরোজা ভেঙে ততক্ষণে আর্মিরা ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়েছে এবং চিৎকার করছে, ‘আলতাফ মাহমুদ কৌন হ্যায়? সেই চিৎকারে হঠাৎ ঘুম ভেঙে যাওয়া আলতাফ ভাইয়া কিছুই বুঝতে পারছিলেন না। তিনি তাঁর ঘরের দরোজা খুলে বেরিয়ে এলেন। একটা সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি এবং লুঙ্গি পরা অবস্থায়। সুন্দরী আমার বড় বোন, আলতাফ ভাইয়ের স্ত্রী আর মা তাকে ঘর থেকে বের হতে দিচ্ছিলেন না। যদি পাকিস্তানী আর্মিদের চোখে পড়ে যায় সেই ভয়ে। তাদের একমাত্র সন্তান শাওন যে ৬ আগস্ট সবে তিন বছর পূর্ণ করেছে, আর্মি দেখে ভয়ে তখন অবিরাম বমি করছিল। ভাইয়া আর্মিদের বলল, “আমিই আলতাফ মাহমুদ”। শোনামাত্র তিন-চারজন আর্মি ভাইয়াকে ঘিরে ফেলল, ঘাড়ের ওপর বন্দুকের বাঁট দিয়ে আঘাত করতে করতে তাকে ড্রইংরুম দিয়ে সামনের বারান্দায় নিয়ে গেল। ড্রইংরুমে তখন আমার আরো চার ভাই এবং আলভি মামা (আবুল বারক আলভি) শিল্পী, মুক্তিযোদ্ধা- যাকে মা খুব আদর করে সেই রাতে আমাদের বাড়ি রেখে দিয়েছিলেন তাঁকে আর ভাইয়াসহ মোট ছয়জনকে এক লাইনে দাঁড় করানো হয়। সহসা পাক আর্মির সঙ্গে সামাদ সাহেবকে দেখে চমকে উঠলাম, সামাদ ভাই কেন এসেছেন? আর আর্মিরা সামাদ ভাইকেই জিজ্ঞাসা করলো যে, তিনিই আলতাফ মাহমুদ কি না। সামাদ ভাই। যার ওপর ক্র্যাক প্লাটুনের মুক্তিযোদ্ধাদের অগাধ বিশ্বাস ছিল। যিনি একসঙ্গে উর্দু, পাঞ্জাবি এবং ইংরেজি ভাষায় অনর্গল কথা বলে যেতে পারতেন। তখন তিনি ঢাকা নিয়ন সাইনে কাজ করতেন। ভাইয়াদের সঙ্গে অনেক অপারেশনে তিনি অংশগ্রহণ করেছেন। যেদিন ভাইয়া তাঁর কালো রঙের অস্টিন ক্যাম্ব্রিজ গাড়ি ৮৩৮৩-র পেছনের বনেটে করে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আসেন, সেদিনও তিনি ভাইয়ার সঙ্গে ছিলেন। রাতে মাটির নিচে সেই ট্রাঙ্ক দুটো পুঁতে রাখার সময়ও তিনি ছিলেন। সেই সামাদ ভাই ভাইয়াকে শনাক্ত করতে সাহায্য করলেন আর্মিদের। তারপর আর্মি ক্যাপ্টেন ভাইয়াকে বলল এক থেকে দশ গোনার মধ্যে যে জায়গায় অস্ত্রশস্ত্র লুকিয়ে রাখা হয়েছে তা বের করে দিতে। এক থেকে সাত গোনা পর্যন্ত ভাইয়া দাঁড়িয়ে কী যেন ভাবলেন। সবাই ভাইয়ার দিকে একবার তাকালেন। সামাদ ভাইয়ার দিকেও। হয়তো ভাবলেন, মিথ্যা বললে সবাই মারা যাবে। আর অস্বীকার করেও লাভ নেই, সঙ্গে সাক্ষী আছে, সামাদ সাহেব। হয়তো তিনিই দিখিয়ে দেবেন লুকানো জায়গাটা।

সব, সব দেখেছি। একবার ঘরের ভেতর থেকে বারান্দায় যা হচ্ছিল তা, আবার পাশের বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে  সেখানে, ওই পেছনের উঠানে কী হচ্ছিল তার সবকিছু। আমি দেখলাম যে মুহূর্তে ভাইয়া তাঁর গন্তব্যে যাত্রা করল, পাশের বাড়ির লেবু গাছের তলায়, সেই মুহূর্তে থেকে শুরু হলো ভাইয়ার ওপর অবর্ণনীয় অত্যাচার। নিজের হাতে কোদাল দিয়ে মাটি কেটে বের করেছে দু’টো বড় বড় ট্রাঙ্ক, একা। পেছনে বুটের লাথি একটু দেরি হওয়ার জন্য। কেউ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়নি। আমিও না। একবার হুমড়ি খেয়ে পড়ে গিয়েছিল, বেয়নেট দিয়ে একটা আঘাত দিল ওরা তার কপালে। তাড়াতাড়ি উঠে আবার কোদাল চালাবার জন্য। দেখলাম, কপাল থেকে একখণ্ড চামড়া ঝুলে পড়েছে। অন্য একজন আর্মি অকথ্য ভাষায় গালাগাল করছে আর গালে চড় মারছে। ঠোঁটের কষ বেয়ে তরল রক্তের ধারা বেয়ে পড়ছে। কপালের রক্ত চোখে-মুখে ঢুকে যাচ্ছে। চোখ খুলে রাখতে পারছে না। তবুও, তবুও কোদাল চালাতে হবে। একা ওই ট্রাঙ্ক দু’টো ওঠাতে হবে গর্তের ভেতর থেকে। দড়ি দিয়ে ভাইয়া টেনে তুলল ট্রাঙ্ক দু’টো। তখনও কি জানত ওই দড়ি দিয়েই বাঁধা হবে তাকে? সেই দড়ি দিয়ে ওরা হাত পিছমোড়া করে বাঁধল ভাইয়াকে। খালি পা, লুঙ্গি, গেঞ্জি কাদায় একাকার। মা ঘরের ভেতর থেকে বারান্দায় লাইন দিয়ে দাঁড়ানো ভাইদের কাছে একটা শার্ট দিতে চাইলেন, পারলেন না। ভাইরা তখনো কিছুই বুঝে উঠতে পারছিল না, কী হচ্ছে পেছনের উঠানে। কারণ সে জায়গাটা ছিল একটা বাড়ির পরে। পাশের বাড়ির বারান্দায় আমি দাঁড়ানো। আমারই সামনে দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ভাইয়াকে। রক্তাক্ত মুখ, একবার দাঁড়াল আমার সামনে। কিছু কী বলবে ভাইয়া? মনে মনে ভাবি। অনেক কষ্টে একবার হাসার চেষ্টা করল। পাকিস্তানী আর্মিরা থাপ্পড় দিয়ে সামনের দু’টো দাঁত ফেলে দিয়েছে। মনে মনে অনেক কথা বলি ভাইয়ার সঙ্গে ঐ মুহূর্তে। কী বলতে চেয়েছিল ভাইয়া? অমন গভীরভাবে কেন আমার দিকে তাকিয়েছিল! ভাইয়া বোধ হয় কিছু বলতে চেয়েছিল। ওরা বলার সময়ও দেয়নি। বারবার কষ্ট করে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিল। অহংকারী তুমি কখনো কারো কাছে মাথা নত করে দাঁড়াওনি। সেই তুমি যেন আমাকে বলতে চেয়েছিলে, “আমার সন্তানকে কে দেখিস, ঝিনু তো একটু বোকা, ওকে দেখে রাখিস। মাকে পাগলামি করতে দিস না”। তবে আমি বুঝেছিলাম এটাই আমাদের শেষ দেখা। আর কোনো দিন এই জন্মে তোমার সঙ্গে দেখা হবে না। তুমিও আমাকে তোমার চোখ দিয়ে এ কথাই বুঝি বলতে চেয়েছিলে।

আমি পিতৃহারা হই ৬১ সালে। তোমার সঙ্গে আমার বড় বোনের বিয়ে হয় ৬৬ সালে। তার আগে থেকে তোমার আসা-যাওয়া ছিল আমাদের বাড়িতে। তোমার বিশাল ব্যক্তিত্বের আকর্ষণে ক্ষুদ্র এই আমি বারবার ছুটে গেছি তোমার আছে। তাই কখন, কেমন করে আলতাফ মাহমুদ নামের এই বিশাল ব্যক্তিত্ব আমার অন্তরে কখনো পিতার স্থান, কখনো শিক্ষকের স্থান, কখনো বড় ভাই বা বন্ধুর স্থান করে নিয়েছিল তা বুঝতে পারিনি। এক অদ্ভুত সম্পর্ক ছিল আমাদের। কখনো আমি তোমার কাছে থেকে পেয়েছি কন্যার আদর, কখনো বোনের আদর। আর গান শেখার বেলায় শিক্ষকের কড়া দৃষ্টি ছিল তোমার, যেন সুর থেকে বিচ্যুত না হই। আমি তোমার হাত ধরে ‘৬৯-এর গণআন্দোলনে শহীদ মিনারে গান গাইতে গেছি। তুমি আমাকে ৭০-এর ভয়াল ঘূর্নিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের ত্রাণের জন্য বিক্ষুব্ধ শিল্পীসমাজের মিছিলে নিয়ে গিয়েছিলে। তোমার গলার সঙ্গে গলা মিলিয়ে সেই মিছিলে টাকা তুলেছি জনতার কাছ থেকে আর গান গেয়েছি ‘এই ঝঞ্ঝা মোরা রুখব’, তোমারই দেওয়া সুরের গণসংগীত। এই তো সেদিন ‘৭১ এর ২১ ফেব্রুয়ারি, তোমার পায়ে পা মিলিয়ে তোমার সুর দেওয়া গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী’ কন্ঠে তুলে, ভোরের ধূসর কুয়াশার ভেতর প্রভাতফেরিতে গিয়েছিলাম। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেছি বাঙালির আত্মত্যাগের স্মৃতিবিজড়িত সেই শহীদ মিনারে। আমি দেখলাম, আমার সেই শিক্ষকের মুখ, সেই বীরের মুখ, কত দ্রুততায়, কত ক্ষিপ্রতায়, কত অবলীলায় তার আকার ওরা পাল্টে দেয়। কত সহজে পাকিস্তানী আর্মিরা তাঁর মুখ থেকে সমস্ত দেহ ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছিল। আমি সেই সুন্দর মুখ, সেই সৌম্য মুখটা কতবার চেষ্টা করেছি মনে করতে। কিন্তু সারা জীবন শত চেষ্টা করেও আমি আর কোনো দিন সেই পবিত্র মুখকে মনে করতে পারি-নি। আমার হৃদয়ে যে মুখ আঁকা হয়ে গিয়েছিল সেই মুখ রক্তাক্ত, এক বীর মুক্তিযোদ্ধার মুখ।

‘নবীন আলতাফ মাহমুদ’ তেমার জন্ম হলো সেই মুহূর্তেই, যে, মুহুর্তে আমার পিতৃসম আলতাফ মাহমুদ চলে যায় আমারই চোখের সামনে দিয়ে। তাঁর প্রতিটি রক্তের ফোঁটা যে লেবুতলাকে সিক্ত করেছিল, যে মানুষটার বিন্দু বিন্দু ঘাম নিজের হাতে খোঁড়া গর্তকে ভরে দিচ্ছিল, যে দাঁত দু’টো সেই কাদামাটির ভেতরে প্রোথিত হয়ে গিয়েছিল, সেই বীজ থেকে যে অঙ্কুরের জন্ম হলো- সে তুমি। তুমিই সেই ‘নবীন আলতাফ মাহমুদ’।

ভাইয়া, তোমাকে ওরা বন্দুকের বাঁট দিয়ে গুঁতোতে গুঁতোতে একটা সাদা রঙের টয়োটা গাড়িতে ওঠাল। সেই গাড়িটা কার ছিল? কখন এসেছিল জানি না। তুমি চলে গেলে। পেছনে পড়ে রইল তোমার স্ত্রী, তোমার সন্তান, মা আর আমি। বারান্দা থেকে ভাইদের এবং আলভি মামাকেও নিয়ে গেল। সেপ্টেম্বর মাসের ১ তারিখ ভাইয়া আর মামা ছাড়া পেল। ভাইয়া, শুধু তুমি ফিরে আসোনি, শুনেছি সমস্ত দোষ নিজের কাঁধে নিয়ে তুমি ভাইদের মুক্ত করেছিলে। তুমি শেষ পর্যন্ত একটাই কথা বলেছিলে যে, এ বাড়ির কেউ এই অস্ত্র রাখার কথা জানত না। ওরা নির্দোষ, তুমি যা করেছ নিজের দায়িত্বে করেছ। এমনকি শুনেছি, একটি মুক্তিযোদ্ধার নাম বললে তোমাকে ছেড়ে দেবে, এই লোভও পাকিস্তানীরা তোমাকে দেখিয়েছিল। কিন্তু তোমার মুখ দিয়ে একটি নাম বের করতে পারেনি ওরা। ফ্যানের সঙ্গে পা বেঁধে মাথা নিজের দিকে ঝুলিয়ে ফুলস্পিডে ফ্যান ছেড়ে দিত আর্মিরা। আসা-যাওয়ার পথে তোমাদের শরীরকে অ্যাশট্রে হিসেবে ব্যবহার করত। জ্বলন্ত সিগারেট ডলে ডলে নিভাত তোমাদের শরীরে। হাঁটুর হাড় ভেঙে দিয়েছিল তোমার। ১ তারিখ পর্যন্ত পাওয়া খবরে বড় ভাইদের কাছে শুনেছি, হামা দিয়ে কোনো রকমে চলতে তুমি, যখন ডাক পড়ত জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। কত নাম শুনেছি ভাইদের কাছ, রুমি, বদি, জুয়েল, আজাদ, হাফিজ ভাই-যারা আর কেউ কোনো দিন ফিরে আসেনি। শুধু সামাদ ভাই বেঁচে গিয়েছিলেন।

ভাইদের কাছে শুনেছি, তোমাদের প্রথমে ড্রাম ফ্যাক্টরিতে নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে তখন আরো অনেককে ধরে আনা হয়েছে। ২৯ আগস্ট সন্ধ্যা থেকে যারা ধরা পড়েছিল, রুমি, জুয়েল, বদি, আজাদ, হাফিজ ভাই- আরো অনেকে। একসঙ্গে ধরা পড়েছিলে তোমরা ৩২ জন। দিনের বেলায় জিজ্ঞাসাবাদসহ অত্যাচার চলত ড্রাম ফ্যাক্টরিতে। একটা ৬ বাই ৪ ফুট বাথরুমে তোমাদের রেখেছিল। সেখান থেকে একজন একজন করে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদসহ অত্যাচার চালাত। যন্ত্রণায় ক্লিষ্ট তৃষ্ণার্ত তোমরা পানি চাইলে তার বদলে পেতে বুটের লাথি। রাতে তোমাদের নিয়ে আসা হতো রমনা থানায়। আমরা জানতাম না। কারণ এর মধ্যে যাদের কাছ খোঁজ নিয়েছি, তারা সবাই ভুল খবর দিয়েছে। কেউ কেউ বলেছে, তোমাদের নিয়ে যাওয়ার পরপরই গুলি করে মেরে ফেলেছে।

১ তারিখ দুপুরে ড্রাম ফ্যাক্টরির বারান্দার দেয়ালে হেলান দিয়ে তুমি বসেছিলে। অত্যাচারে তোমার শরীর বীভৎস হয়ে গিয়েছিল। তার একটু আগেই তোমাদের ছয়জনকে এক লাইনে দাঁড় করেছিল গুলি করে মেরে ফেলবে বলে। কিন্তু একজন পাকিস্তানী আর্মি বলেছে, এসব কাফেরদের মারার জন্য গুলি খরচ করা যাবে না। ওদের হাতে-পায়ে ইট বেঁধে পানিতে ফেলে দিতে হবে। আর যদি বাঁচতে চাস তবে মুক্তিদের নাম বল। না, বলোনি তোমরা। হঠাৎ কী মনে করে ভেতরে ক্যাপ্টেনের ঘরে ভাইদের ডেকে নিয়ে যায়। ভাইয়া তুমি তোমার শেষ জিজ্ঞাসাবাদেও ওই একই কথা বলেছিলে এবং ভাইদেরও শিখিয়ে দিয়েছিলে ওই একই কথা বলতে। নইলে কেউ এখান থেকে ফিরে যেতে পারবে না, এ কথাও বলেছিলে। বেলা আড়াইটার দিকে ভাইদের ছেড়ে দেওয়া হয়।

দৃশ্যটা আমার চোখে, আমার কল্পনায় আমি এরকমই দেখি। আমার ভাইয়েরা চলে যায় জীবনের টানে, বাঁচার টানে। আর পেছনে ড্রাম ফ্যাক্টরির বারান্দায় হেলান দিয়ে বসে থাকে যে, তার জীবন সেখানেই থেমে গেছে। জীবন এবং মৃত্যুর মুখোমুখি তুমি। কী সাহস, কী ধৈর্য, কী সহনশীলতা তোমার। তুমি তোমার জীবন দিয়ে আমার ভাইদের বাঁচিয়ে দিয়ে গেছ। ঘর থেকে পালানো তুমি আমাদের কাছে এসে ঘরের স্বাদ, গৃহে মায়ের ভালোবাসা, ভাইবোনদের স্নেহমমতা পেয়েছিলে। সেই সংসারের বন্ধনে তুমি জড়াতে চাইলেও জীবন তোমাকে নিয়ে গেছে অনন্তের সন্ধানে। তুমি সেই ঋণ তোমার জীবন দিয়ে শোধ করে গেলে। তুমি আমার মায়ের ছেলেদের ফিরিয়ে দিলে মার কোলে। শুধু তুমি ফিরে এলে না। তোমার কাছ থেকে শেষ কথা শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল সেজ ভাইয়ার। তুমি তার হাতে তোমার বিয়ের পান-চিনির আংটিটা দিয়ে বলেছিলে, মার কাছে দিতে। বলেছিলে, “শাওন আর ঝিনুকে দেখে রেখো। ওরা বড় একা হয়ে গেল”। এই ছিল তোমার শেষ কথা।

১৬ ডিসেম্বর এলো। স্বাধীন হলাম আমরা। তারপর থেকে ভাইয়ারা যে যেখানে পারল বেরিয়ে পড়লো তোমার খোঁজে। সব হাসপাতাল, জেলের হাসপাতাল, ক্যান্টনমেন্টের যেসব জায়গায় মাটির নিচে বন্দিদের রাখা হতো সেখানে। ড্রাম ফ্যাক্টরির সব ঘর, বাথরুম-সব জায়গায় তন্ন তন্ন করে খোঁজা হলো তোমাকে। না কোথাও পাইনি। পাবো কেমন করে, তোমাকে পুড়িয়ে মেরে ফেলেছিল। গায়ে পেট্রোল ঢেলে দিয়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। যেন গুলি খরচ করতে না হয়।
তুমি ছিলে তোমার মায়ের একমাত্র সন্তান, তোমাকে জন্ম দিয়ে তিনি অর্ধ উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলেন । তিনি কি ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা ছিলেন? তিনি কি বুঝেছিলেন যে, তার এই সন্তানকে কখনোই তিনি বুকে আগলে রাখতে পারবেন না। সে জন্যই তিনি তাঁর স্নেহ-মমতা থেকে তোমাকে বঞ্চিত করেছিলেন। যেন ঘরের টান, মায়ের টান তাঁর ছেলের চলার পথে বাধা না হয়ে দাঁড়ায়।

ভাইয়া তুমি খুব সুন্দর সুর করে কোরআন শরিফ পড়তে পারতে। তোমার বাবা তাই তোমাকে মাদ্রাসায় দিয়েছিলেন। তিনিও সম্ভবত বুঝতে পারেননি কোরআন শরিফের সুরের টানেও মানুষ ঘরছাড়া হতে পারে। সুরের টানে তুমি ঘরছাড়া হয়েছ। তোমার সুর দিয়ে তুমি জয় করে নিয়েছ এ দেশের লক্ষ-কোটি মানুষকে। সেই সুর দিয়ে তুমি এ দেশের মানুষকে স্বাধীনতার লক্ষ্য, মুক্তির লক্ষ্য, মানবকল্যাণের লক্ষ্যকে একত্র করতে পেরেছিলে। ‘৫২- মাতৃভাষার জন্য জীবন দিয়েছিল যারা, তাদের জন্য তোমার সুরের গান গেয়ে এ দেশের মানুষ স্বাধীনতা এনেছিল। ঘৃণা করতে শিখিয়েছিলে সেই সব স্বাধীনতাবিরোধীদের। কী অবলীলায় তুমি সুর করে যেতে একের পর এক গণসংগীত। কত গান, কত স্মৃতি সব ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গিয়েছে। আর কি কোনো দিন একত্র করতে পারব?

তুমি চলে গেছ সুর থেকে সুরে। তুমি চলে গেছ ঘর থেকে ঘরে, লোক থেকে লোকান্তরে। তুমি চলে গেছ অনন্তের মাঝে। আমরা কেউ তোমাকে ধরে রাখতে পারিনি। যে তুমি সুরের টানে গৃহত্যাগ করেছিলে, সেই তুমি যখন দেশের টানে, মাটির টানে চলে যাও-তখন কি আর তুমি ফিরে আসতে পারো? তুমি ফিরে এলে হয়তো স্বাধীনতাই আসত না! তুমি বাঙ্গালির ঘুম ভাঙিয়েছিলে তোমার সুর দিয়ে আর তুমি নিজেই চলে গেলে ঘুমের দেশে। এ দেশের ঘুম ভাঙিয়ে তুমি নিজেই ঘুমিয়ে গেলে।

‘৭১-এর ‘৩০ আগস্ট’ হে নবীন আলতাফ মাহমুদ, তোমাকে বলি-বাঙালি আবার ঘুমিয়ে গেছে। আজ এত বছর পর তুমি যখন যুবক হলে, তখন এই ঘুমিয়ে পড়া বাঙালিকে জাগিয়ে তোলার জন্য তোমাকে স্মরণ করছি। চলো তুমি আর আমি মিলে আমাদের পিতার ঋণ শোধ করি।