তখন ক্লাস সিক্সে পড়ি। জামালপুর থেকে আন্টি-আঙ্কেল বেড়াতে এসেছেন আমাদের বাসায়। আঙ্কেল নানা রকম গল্প করতেন। এক সময় বললেন, কোন এক যুবক নাকি একুশের ভোরে হারমোনিকায় “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো” বাজিয়ে রাস্তা হাঁটে!
আমারো খুব ইচ্ছে হলো। আমি তখন কিছুই বাজাতে পারিনা। বাঁশিতে একটু আধটু গানের সুর তুলতে পারি। সা-রে-গা-মা কিছুই জানিনা! ক’দিন পর একুশে ফেব্রুয়ারি!
মাথায় শুধু সেই সুরটি ঘুরছে! আমি কি ভুলিতে পারি! আমি প্রায় খাওয়া-পড়া ভুলে এই সুর ভাবি, এই গান ভাবি! কীভাবে একটি হারমোনিকা কেনা যায়? “লক্ষ্মী স্টোর” থেকে একটা কিনলাম ৬০ টাকা দিয়ে। ফুঁ দিলেই বুঝি বেজে উঠবে প্রিয় সুর!
সারাদিন হারমোনিকা ফুঁকি। বিচিত্র সুর সৃষ্টি হয়, কিন্তু একুশে ফেব্রুয়ারি বাজে না!!
একুশে ফেব্রুয়ারি আসলো, ভোরবেলায় হারমোনিকা নিয়ে বের হলাম। ফুঁ দিলাম! সুর আসে না! সকালে একটি ছবি আঁকা প্রতিযোগিতায় অংশ নিলাম। সবাইকে বললাম যে এইটা দিয়ে আমি “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেরুয়ারি” বাজাবো! সবাই শুনতে চাইলো!
বাজাতে পারিনি সেদিন! সবাই মিলে ফুঁ-টু দিয়ে চেষ্টা করলো, বাজে না! এরপর আমি অনেক চেষ্টা করেছি রাত-দিন, বাজাতে পারিনি! তারপর এক বন্ধু হারমোনিকাটি নিয়ে হারিয়ে ফেললো!
ক্লাস টেনে যখন, তখন আরেকটি কিনলাম। আবার অনেক চেষ্টা করলাম, পারলাম না!
কলেজে পড়ার সময়ে গিটার নিয়ে মাতলাম! অবশেষে একদিন ধরা দিলো প্রিয় সুর, গিটারে! এরপর অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে, পরিশ্রম করে, একা একা একদিন হারমোনিকায় বাজালাম “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো”!! তারপর আরো অনেক অনেক সুর!! অনেক অনেক গান! ব্যাপারটা এমন যেন, আমার সুরের অধিকার আমি অর্জন করলাম এই প্রিয় সুরকে সাথী করে!
আজ প্রিয় মানুষ, প্রিয় সুরস্রষ্টা, প্রিয় মুক্তিযোদ্ধা, প্রিয় অগ্রজ, চির-সবুজ “আলতাফ মাহমুদ”-এর জন্মদিন! প্রিয় মানুষটির শুধু জন্মদিনটিই আছে। অনেক বছর কেটে গেছে, ৩০ আগস্ট ১৯৭১ এর পর থেকে তাঁকে আমরা আর গাইতে শুনিনা! তাঁকে আর গাইতে দেয়া হয় না। নিকৃষ্ট-অমানুষ-কুৎসিত কিছু জানোয়াররা তাঁকে ভয় পেয়ে রুদ্ধ করে দিতে চেয়েছে তাঁর সুর। প্রিয় মানুষটি পাছে সুরে-গানে লক্ষ আলো জ্বালে, এই ভয়ে অন্ধকারের-অসুররা তাঁকে দূরে সরিয়ে দিতে চেয়েছে।
আলতাফ মাহমুদ, দূরে কোথায়! এইতো আমার হৃদয়ে, সুর হয়ে তুমি, আলো হয়ে তুমি, গান হয়ে তুমি, বাংলাদেশ হয়ে তুমি…আমার সবুজ বুকে লক্ষ সুরের মানিকজ্বলা গাঢ়-লাল সূর্য হয়ে তুমি………