আমার মেয়েটার বয়স তিন বছর। মাস দুয়েক বরং বেশিই হবে। এই বয়সি মেয়েরা খুব বাপ-সোহাগী হয়। সারাক্ষণ বাবা বাবা করে বাড়ি মাথায় করে রাখে। বাবা চোখের সামনে থাকলে তো কথাই নেই, না থাকলে কেন নেই? ছেলেরা যেমন জন্মগতভাবে মাতৃভক্ত, মেয়েরা তেমনি হয় বাপ-সোহাগী। আমার মেয়েটাও তাই। বিপ্রতীপ কোণে আমিও কি তা নই? মেয়ের জন্মের অনেক আগে, এমনকি বিয়ে করারও বহু আগে থেকে মনে মনে কল্পনা সাজাতাম, আমার প্রথম সন্তানটি যেন মেয়ে হয়। যদি একটিই সন্তান হয়, তবু সে যেন মেয়েই হয়। সেই মেয়ে যখন আহ্লাদ করে ডেকে ওঠে ‘বাবা’ বলে, মনে হয় পৃথিবীর সব কিছু ভুলে যাই। আমি সত্যিই বিপদে পড়ে যাবো, যদি কেউ আমাকে প্রশ্ন করেন– ধরো তোমাকে এক দিক থেকে ডাকছেন তোমার মা, আরেক দিক থেকে তোমার মেয়ে– কোন দিকে যাবে তুমি? এবং হয়তো শেষ পর্যন্ত লাজ-শরমের মাথা খেয়ে মেয়ের দিকটাই বেছে নেবো। আমার মা-ও হয়তো সহাস্যে মেনে নেবেন ছেলের এমন পক্ষপাতিত্ব।
আমার মেয়ের প্রায় কাছাকাছি (হয়ত কিছুটা বেশি কিংবা কিছুটা কম) বয়সি একটা মেয়ের কথা বলি। তার বাবাও আমারই মতো গানের মানুষ ছিলেন। আমি গান লিখি, মাঝেমধ্যে দু’একটা সুরও করি, তিনি সুর করতেন, গাইতেন, শেখাতেন, লিখতেনও। আমি গান লিখি পেটের দায়ে, তিনি গান করতেন চেতনার দায়বদ্ধতায়। আমি গান লেখার বিনিময়ে টাকা রোজগার করি, তিনি গান করার বিনিময়ে আদর্শের বীজ বুনতেন, চেতনার অঙ্কুরোদ্গম ঘটাতেন। আমি এর তার জন্য ফরমায়েশী গান করতে করতে মাঝে-মধ্যে মেয়েকে নিয়েও গান লিখে ফেলি দু’একটা, তিনি দেশের জন্য গান করতে করতে মেয়ের কথা ভাবারই সময় পেতেন কিনা সন্দেহ। সোজা কথায়, আমি যেমন বাঁচার জন্য গান বেছে নিয়েছি, তিনি গানের জন্যই বেঁচে থেকেছেন, যতদিন পেরেছেন।
মেয়ের জন্মের পর থেকে আমি অনুভব করতে শুরু করেছি– একটা রাতও মেয়ে পাশে না থাকলে আমার ঠিকমতো ঘুম হয় না। মেয়েরও বুঝি তাই। কোনো কোনো রাতে হয়তো ভোর পর্যন্ত কাজ করতে হবে বলে পাশের ঘরে জায়গা নিয়েছি, রাত দুটো-তিনটের দিকে দেখি চোখ ডলতে ডলতে মেয়ে এসে আমার কোলে উঠে গেল এবং বড় একটা হাই তুলে ঘুমিয়ে গেল! এখন মেয়েকে কোলে নিয়ে আমি কেমন করে কাজ করবো – সেটা আমার সমস্যা, তার নয়।
সেই মেয়েটা, সেও কি তেমনি করেই বাবার অতিব্যস্ত কাজকর্মের ফাঁকেও ঠিকই গিয়ে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়তো তাঁর কোলে? সেই মেয়েটিও কি বাবার বিপ্লবী চেতনার পাঠশালা চলাকালীন ঢুলুঢুলু চোখে বসে বসে হাই তুলতো বাবার পিঠে হেলান দিয়ে বসে? নাকি সে সেই বয়সেই শিখে নিয়েছিল– আমার বাবা আমারও আগে দেশমাতার ছেলে, আমার চেয়ে অনেক আগে দেশকে এগিয়ে রাখেন। মা, কন্যা আর দেশ– তিন দিক থেকে ডাক এলে তিনি অবলীলায় কেবল মা’কেই নয়, মেয়েকেও ফেলে রেখে এক কাপড়ে বেরিয়ে পড়বেন দেশের ডাকে!
সেই মেয়েটির বাবা সেই বায়ান্নতে এমন একটি গানে সুরারোপ করে দিয়েছিলেন, সারাজীবন তাঁর আর কিছু না করলেও চলতো। তবু তিনি একের পর এক গান করে গেছেন। গান লিখেছেন, লিখিয়েছেন, গেয়েছেন, গাইয়েছেন, শিখিয়েছেন। গানই তাঁর একমাত্র অস্ত্র হতে পারতো। অথচ কী আশ্চর্য, এমন এক দুর্দান্ত অহিংস অস্ত্রও যখন আর যথেষ্ট বলে বিবেচিত হচ্ছিল না, তখন কিন্তু তিনি সত্যিকারের অস্ত্র হাতে তুলে নিতে এতটুকুও দ্বিধা করেননি। দিনের পর দিন যাদের গান শিখিয়ে এসেছেন, সেই আগ্রহী ছাত্রদের অস্ত্রচালনা শিক্ষা দিয়েছেন, গেরিলা যুদ্ধের কৌশল শিখিয়েছেন, অস্ত্র ও রসদ জোগাড়ের জন্য দুর্ভেদ্য এক নেটওয়ার্ক তৈরি করেছেন, কুখ্যাত খুনে পাক সেনাবাহিনীর হাতের নাগালে থেকেও এতটুকু ছাড় দেননি, কৌশল করে বাঁচার নীতি গ্রহণ করেননি। সেই মেয়েটির চোখের সামনেই সব ঘটছে, সে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে, তার প্রাণপ্রিয় বাবা কী করে কন্যাসোহাগী বাবা থেকে দেশমাতার সমর্থ সন্তানে পরিণত হয়েছে। দেখছে, ভৈরবীতে কোমলগান্ধার সাধা শিল্পী কী করে কঠোর যোদ্ধায় বদলে যাচ্ছেন। মেয়েটা কি তখন থেকেই বুঝতে পেরেছিল– এই লোকটি, আজন্ম যাঁকে বাবা বলে সে জেনে এসেছে, তাঁর উপর তার আর খুব বেশি দিন অধিকার থাকবে না? সে কি তখন ঘুণাক্ষরেও জানতো, আর ক’টা দিন পর ‘বাবা’ নামক পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্বোধনটি তাকে তুলে রাখতে হবে চিরদিনের জন্য, এই অমূল্য রতনসম গালভরা ডাক আর কোনো দিন উচ্চারিত হবে না তার মুখে, এ কেবলই মনে মনে স্মরণের ক্ষরণ হয়ে থেকে যাবে আমৃত্যু!
আমি শুরুতেই একটা গুরুতর অন্যায় করে ফেলেছি। কী ভয়াবহ স্পর্ধায় আমি, পিতৃত্বের স্বরূপ ব্যাখ্যার অজুহাতে হলেও, নিজেকে তুলনা করতে চেয়েছি আলতাফ মাহমুদের সাথে! এ ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। কারণ আর কেউ না জানুক, আমি তো জানি আমি একজন ভীরু মানুষ! সত্য স্বীকারের সৎসাহস ছাড়া আমার আর কোনো সাহসই নেই। গর্ভধারিণী মা নাকি আত্মজা কন্যা– এই দোটানায় মেয়েকে বেছে নেয়া যতটা আনন্দের ও গর্বের, ঠিক ততটাই কাপুরুষতায় আবারও আমি হয়ত মেয়েকেই বেছে নেবো, যদি কেউ প্রশ্ন করেন– কন্যা নাকি দেশ? কারণ চিরকালের বোকাসোকা মানুষও মোক্ষম সময়ে এসে কী করে যেন ঠিক চালাক হয়ে যায়। বুদ্ধি নয়, ধূর্ততা এসে ভর করে তার মাথায়। আলতাফ মাহমুদ বোকা ছিলেন কিনা জানি না, ধূর্ত ছিলেন না। কোনো প্রকার চালাকি করেননি তিনি।
ঢাকার রাস্তায় নামলেই যানজট, আর জটে আটকে থাকলেই অবধারিতভাবে চোখে পড়ে এক দল পথশিশু। প্রায় উলঙ্গ শরীর, জটপড়া উস্কখুস্ক চুল, খালি পা, অনাহারে-অর্ধাহারে শুকিয়ে আমসি হয়ে যাওয়া মুখ। তারপরও প্রায় প্রতিটি শিশুর মুখে কী লাবণ্য, কী মায়া! এই প্রবল অনিশ্চয়তার জীবনে, নিদারুণ অসহায়ত্বের মাঝেও সংগ্রাম করে বাঁচার কী দৃঢ় প্রত্যয় তাদের চোখেমুখে। মাঝে মাঝে দু’একটি মেয়ের সাথে হুবহু মিলে যায় আমার মেয়েটার মুখ, আর অজান্তেই আমি শিউরে উঠি– আজ এ মুহূর্তে আমি এই পৃথিবী থেকে সরে গেলে কাল কি আমার মেয়েটাও এসে দাঁড়াবে না ওই শিশুটিরই পাশে! … এই ভাবনাটুকুই আমৃত্যু আমাকে দুর্বল করে রাখবে, ভীরু কাপুরুষ বানিয়ে রাখবে, প্রয়োজনের মুহূর্তে ধূর্ত হতে শিখিয়ে দেবে। আলতাফ মাহমুদ এমনকি বিধাতাকেও সেই সুযোগ দেননি। বিদায় নেবার অবকাশেও ফিরে তাকাননি কোনো পিছুটানের প্রতি, কোনো দুর্বলতার প্রতি।
কী হতো, যদি তিনি একাত্তরে সশস্ত্র যুদ্ধে না জড়াতেন? কেউ তাঁকে মাথার দিব্যি দেয়নি যে, যাও যুদ্ধ করো। একুশের গান করেছো, বাঙালির সর্বকালের সর্বাধিক গীত সংগীতটি নির্মাণ করে দিয়েছো, বাঙালি জাতির অন্তরের একদম গভীরে জাতীয় চেতনার বীজ বুনে দিয়েছো, তাদের স্বাধিকার-স্বাধীনতার পথটা চিনিয়ে দিয়েছো, আর তোমার দরকার নেই বিবাদ-বিসম্বাদে জড়ানোর। তুমি স্ত্রী-কন্যা সবাইকে নিয়ে নিরাপদে সরে থাকো। কোলকাতায় চলে যাও, স্বাধীন বাংলা বেতারে গান করো, প্রবাসে এখানে ওখানে দেশের জন্য গান করো, তহবিল সংগ্রহ করো। তোমার কী দরকার অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করার, জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের মতো খোদ রাজধানীতে বসে গেরিলা যুদ্ধের পরিকল্পনা তৈরির? সরাসরি নেতৃত্ব দেয়ার? তুমি “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো”র আলতাফ মাহমুদ, তুমি তো বাঙালির আজীবন শ্রদ্ধার আসনে এমনিতেই বসে আছো, কেন আর সে আসন থেকে নেমে রণাঙ্গনে ছুটাছুটি? … কিন্তু তিনি এই ইমেজ ধরে রেখে গা বাঁচিয়ে চলাকে যথেষ্ট কিংবা যৌক্তিক জ্ঞান করেননি। যদি তা করতেন, কী হতো?
আমরা পরাধীন দেশের আলতাফ মাহমুদকে পেয়েছি তাঁর সংগীতে, তাঁর সমরে। আমরা হয়তো স্বাধীন দেশের আলতাফ মাহমুদকে পেতাম। ‘স্বাধীন দ্যাশের মাটি দবদবাইয়া হাঁটি’। স্বাধীন দেশের আলতাফ মাহমুদ তখন তাঁর পরাধীন কালের চেতনা ছড়িয়ে দিতে থাকতেন স্বাধীন দেশের শিশু-কিশোরদের মনে। আমরা একাত্তর নিয়েও সর্বজনীন একটা গান পেতাম, সে গানও হয়ে উঠতো “আমি কি ভুলিতে পারি”র মতো কালজয়ী, প্রশ্নাতীত, শর্তহীন, নিরঙ্কুশ এক জাতীয় মন্ত্রের মতো, ঐশী বাণীর মতো অব্যয় এক কীর্তি। হতে পারতো, অথবা না’ও হতে পারতো। হতে পারতো, ব্যক্তি’র গণ্ডি পেরিয়ে স্বাধীন দেশের সবচেয়ে বড় সংগীত প্রতিষ্ঠানটিই হয়ে উঠতেন তিনি একাই, যেমনটি ছিলেন তিনি পরাধীন বাংলাতেও। হতে পারতো, অথবা না’ও হতে পারতো। হতে পারতো, এই দেশের সংগীত শিক্ষা ও চর্চার ধারাটিকেই তিনি সযতনে অতি পরিশীলিত কাঠামোর উপর দাঁড় করিয়ে দিতেন। আজকাল যেমন বিনা চর্চার ভূঁইফোড় শিল্পী কিংবা শিল্পজীবীতে দেশ ছেয়ে গেছে, তারা কেউ তখন গান না শিখে মুখ দিয়ে ‘সা’ ধ্বণিটুকু উচ্চারণের সাহস পেত না। হতে পারতো, অথবা না’ও পারতো।
এই অনেক অনেক “হতে পারতো, অথবা না’ও পারতো”র ভিড়ে একটা ব্যাপার কিন্তু সত্যিই হতে পারতো। অবশ্যই হতে পারতো। তিন সাড়ে তিন বছর বয়স থেকে একটি মেয়ে মাথার উপর বাপের ছায়া নিয়ে বড় হতে পারতো। বুকের ভেতর বাবার ভালোবাসা নিয়ে বড় হতে পারতো। মুখে বাবা ডাকটুকু নিয়ে বড় হতে পারতো। সারাদেশের সমস্ত মানুষ যেদিন গভীর আবেগ নিয়ে মন ভরে, প্রাণ ভরে, বুক ভরে, মুখ ভরে গেয়ে ওঠে ‘আমি কি ভুলিতে পারি?’, সেদিন এই মেয়েটি ভরা ফাল্গুনে শ্রাবণের বর্ষাধারার মতো ঝরঝর করে দু’চোখ ভাসিয়ে হাহাকার করে স্মরণ করতো না – “আমি কি ভুলিতে পারি!”
শাওন মাহমুদ, আমার পরম সৌভাগ্য যে, আমি তোমাকে আমার বড়বোনের আসনে বসিয়ে তোমার আর তোমার বাবার কথা লিখতে পারছি। সেই প্রশ্রয় তুমি আমাকে দিয়েছো। নয়তো আমি তিন পয়সার ভূঁইফোঁড় গীতিকার, আমার কী সাধ্য আলতাফ মাহমুদের মতো ‘প্রতিষ্ঠান’সম ব্যক্তিত্বকে নিয়ে লিখি? আমার কী করে স্পর্ধা হয়, শাওন মাহমুদের পিতা হারানোর মতো বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের চেয়েও বিশাল শূন্যতাকে আমার নিতান্তই ক্ষূদ্র খেরোখাতায় টুকে রাখার দুঃসাহস দেখাই! শুধু একটা কথাই বলি, আমরা যেন আজীবন স্বাধীন দেশের মাটিতে দবদবিয়ে হাঁটতে হাঁটতে গাইতে পারি – “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী, আমি কি ভুলিতে পারি?” শুধু সেই কারণে আমৃত্যু বাবা ডাকার অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে হয়েছে তোমাকে – এই সত্য, এই ঋণ বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে আজ আমি তোমার কাছে স্বীকার করলাম, এটাই আমার শিল্পী জীবনের সবচেয়ে বড় সার্থকতা।