শহীদ হাফিজ –

 

“সৈয়দ হাফিজুর রহমান”

খুব অপরিচিত একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম । তাঁকে জানে – সেই সংখ্যাটা খুব সীমিত ।

সেদিনের ত্রিশোর্ধ্ব এই সূর্য সন্তান ১৯৭১ সালের ৩০ আগস্ট দেশমাতৃকার ঋণ শুধতে নিজের জীবন উৎসর্গ করে গিয়েছিলেন এই বিশ্বাসে যে- একদিন একটি লাল-সবুজের পতাকা বাংলার আকাশে স্বগৌরবে উড়বে। যন্ত্রবাদক পরিচয়টি তখন খ্যাতি হয়ে তাঁর দুয়ারে এসে ঠাই করে নেবার পাকাপোক্ত বন্দোবস্ত করছে, রেডিও-টেলিভিশনে যাঁর নামটি তখন অনেক বেশি অর্থবহ- সেই তিনি যখন দেখলেন পাকিস্থানী হায়নাদের বর্বরতায় রক্তের বন্যা বয়ে চলেছে, যে হাতে তুলে নিয়েছিলেন বাদ্যযন্ত্র, হাতে তুলে নিলেন অস্ত্র ।

আজ ২৮ শে নভেম্বর, তাঁর ৭৮ তম জন্মবার্ষিকী, ১৯৩৮ সালে আজকের এই দিনে খুলনার মুন্সীপাড়া সেকেন্ড লেনে অবস্থিত নানাবাড়িতে শহীদ হাফিজ জন্মগ্রহণ করেন। বাবা- সৈয়দ আবদুর রহমান ও মা- মোস্তারিয়া খাতুন এর আট ছেলে ও তিন মেয়ের মাঝে শহীদ হাফিজ ছিলেন তৃতীয় সন্তান। শহীদ হাফিজের পৈত্রিক নিবাস যশোরে, পোস্ট অফিস পাড়ায় ছিলো তাঁদের বাসা এবং তাঁর বেড়ে ওঠাও সেখানেই।
ছোট বেলা থেকে সঙ্গীতের প্রতি ছিলো তাঁর প্রবল আর্কষণ, যে বাদ্যযন্ত্রই তিনি হাতে নিতেন তাই যেন তাঁর পোষ মেনে নিতো, বাঁজাতে পারতেন না এমন কোন বাদ্যযন্ত্রের নাম বলাটা বেশ কঠিন, সেতার, তবলা, হারমনিয়াম, বেহালা, গিটার, বাঁশি – সব কিছুর উপরই যেন তাঁর দখল ছিলো ঈর্ষণীয় । কলেজের গন্ডি পাড়ি দেবার পর গান-বাঁজনার প্রতি প্রবল ঝোঁক তাঁকে পড়াশোনার থেকে বিমুখ করে তুলে, প্রথমে যশোরে নানাবিধ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন, তারপর যশোরের পাঠ চুকিয়ে খুলনায় ললিতকলা নামে গানের স্কুল প্রতিষ্ঠা, সেখান থেকে ষাটের দশকের শুরুতে করাচি গমন । তিনি বিখ্যাত সংগীত পরিচালক দেবু ভট্টাচার্যের সাহচর্য পেয়েছিলেন করাচিতে, হয়ে উঠেছিলেন তাঁর প্রিয় পাত্র । বিখ্যাত সুরকার আলতাফ মাহমুদের সাথে হাফিজের প্রথম দেখা হয় করাচীতেই, সেই পরিচয়ের সুত্র ধরে ষাটের দশকের গোড়ার দিকে তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন আলতাফ মাহমুদের অনুরোধে । উর্মী প্রডাকশন – তাঁদেরই যৌথ প্রচেষ্টার ফসল, দুজনের যুগলবন্দী এতটাই ঘনিষ্ট ছিলো যে – লোকে হাফিজকে বলতো আলতাফ মাহমুদের ছায়াসঙ্গী ।

২৫শে মার্চের কালরাত্রিতে পাকিস্থানী সেনাবাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞ আর ভয়াবহতা হাফিজকে ভীষণভাবে স্পর্শ করেছিলো, আর এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে যশোরে পাকিস্থানী মিলিটারি কর্তৃক বাবাকে হত্যার খবর হাফিজের মনোজগতকে উলটপালট করে দিয়েছিলো, দেশকে হানাদার বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা করতে করেছিলো সংকল্পবদ্ধ ।

মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিলেন আলতাফ মাহমুদও, তাঁর ৩৭০ আউটার সার্কুলার রোডের বাড়িটি হয়ে উঠেছিলো ঢাকায় আসা গেরিলাদের আবাস, আহার, অর্থ, অস্ত্র তথ্যসহ নানাবিধ সাহায্য-সুবিধার কেন্দ্রবিন্দু । আলতাফ মাহমুদের এসকল কর্মকান্ডে যথারীতি ছায়াসঙ্গী হিসেবে দেখা যায় হাফিজকে । ৩৭০ নাম্বার বাড়িটি আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিলো- আর তা হলো সীমান্তের উপারে স্থাপিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জন্যে গান রচনা করা । হানাদার বাহিনী আর দোসর রাজাকার-আলবদরদের চোখ এড়িয়ে আলতাফ মাহমুদ ও হাফিজ গাড়ী নিয়ে শহর ঘুরে ঘুরে গাইয়েদের জোগার করে আনতেন । একসাথে একই দিনে ওঁদের গানের রেকর্ডিং আর রিহার্সেল হতো, কোনদিন বেঙ্গল স্টুডিওতে, কখনো’বা ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন (এফডিসি) স্টুডিওতে । এসবের কাজ সেরে বাড়ি ফিরতে ফিরতে কখনো কখনো রাত দুটো-তিনটেও বেঁজে যেতো । এই রেকর্ড করা গানগুলো সংগ্রহ করতে মেলাঘর ক্যাম্প থেকে আগরতলা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা আসতো আলতাফ মাহমুদের বাসায় । উল্লেখ্য যে, প্রথম দিকে একটি স্পুলে ১২টি গান নিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করার সময় একজন অবাঙ্গালী ক্যুরিয়ার ধরা পড়েন, এবং তাঁর মৃত্যু হয় । সেই স্পুলটি আর পাওয়া যায়নি । জুলাইয়ের শেষের দিকে আবার অনেকগুলো গান রেকর্ড করে দুটো বড় স্পুলে করে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জন্য প্রেরণ করা হয় । ঐ স্পুলটি বিলম্বে হলেও, সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময় কলকাতায় পৌছায় ।

জুন-জুলাই থেকে ঢাকার অভ্যন্তরে যখন গেরিলাদের আগমন ঘটতে শুরু হলো, সাহ্যয্যে করার পাশাপাশি শহীদ হাফিজ নিজেও অংশগ্রহণ করা শুরু করেন গেরিলা অপারেশনে । উলন পাওয়ার স্টেশন অপারেশনের সময় গাজী দস্তগীর (গফুর) এর নেতৃত্বে নির্বাচিত গেরিলা – মতিন-১, মতিন-২, জিন্না, নীলুর সাথে যুক্ত হয় হাফিজের নামটিও । সেই অপারেশনে ট্রান্সফরমার আর বিস্ফোরকের গর্জনে কেঁপে উঠে পুরো এলাকা, ধ্বংস হয় ৩০/৪০/৫০ এমভিএ ক্ষমতা সম্পন্ন ট্রান্সফরমারটি, যার ক্ষতির পরিমান ছিলো প্রায় ১৫ লাখ টাকার সমমান এবং যা ছিলো মেরামত অযোগ্য । আগস্টের এক ঝিড়ি ঝিড়ি বৃষ্টির রাতে ছয়টি মাইন বিস্ফোরণ ঘটনায় সামাদ, বাকি আর উলফতের সঙ্গী ছিলো এই যন্ত্রবাদক হাফিজ, নর্থসাউথ রোড, সায়েন্স ল্যাবরেটরী আর মোহাম্মদপুরে ছয়টি মাইন তাঁরা সফলভাবে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিলো সেই রাতে ।

৩০ আগস্ট পাকিস্থানী হানাদারদের গ্রেফতার অভিযানে রুমী, আজাদ, বকর, জুয়েল, বদি, আলতাফ মাহমুদ সহ হাফিজকেও ভোর রাতে তাঁর ২০, নিউইস্কাটন রোডের বাসা থেকে গ্রেফতার করা হয় । তারপরে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় নাখালপাড়া ড্রাম ফ্যাক্টরীর টর্চার সেলে । সেখান থেকে তিনি আর ফিরে আসেননি । রুমি, আজাদ, জুয়েল, বকর, আলতাফ মাহমুদ, বদি – হাফিজরা কেউ আর সেদিনের পর ফিরে আসেনি, কেউই সঠিক জানে না, ওঁদের সাথে পাকিস্তানী বর্বর সেনারা কতটা নিষ্ঠুর খেলা খেলেছিলো, শেষ পর্যন্ত কি ঘটেছিল ।

মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় শহীদ হাফিজের নাম ঠাই হয়নি, কেন হয়নি সে উত্তর হয়তো একদিন স্বাধীন বাংলাদেশ দেবার চেষ্টা করবে । স্বাধীন দেশের আমরা যেন এই বীর যোদ্ধাকে ভুলে যাওয়ার ধৃষ্টতা না দেখাই, যেন স্মরণে রাখি সব সময়- ক্লাব অবসকিওর এর প্রচেষ্টা এতটুকুই ।

কাভারফটো ডিজাইন: সাইফুর রহমান মিশু ভাই”